বন্ধুর পিরীতি ষোলো আনা পর্ব-০১

0
113

#বন্ধুর_পিরীতি_ষোলো_আনা
কলমে: মম সাহা

১.
‘যেই বেডিমানুষ বাচ্চা দিতে পারে না তারে আর বেডি কওয়া যায় না। তারে তো বেডা কওয়া উচিত। বাচ্চা দিতে না পারলে তুই আবার কিয়ের বেডি হইলি, মা গী?’
শাশুড়ির এমন ঘৃণা ভরা বিদ্রুপেও মাথা তুলে তাকাল না বাড়ির ছোটো বউ- টুইটুবানি। সে নিজ মনেই উঠোন ঝাঁট দিতে থাকল।
শাশুড়ি জামেলা আক্তার বউয়ের নিশ্চুপতায় যেন আরেকটু ক্ষিপ্ত হলেন। ঘর লেপা বন্ধ করে উপুড় হয়ে বসেই বউয়ের দিকে তাকিয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করে বললেন,
‘বান্দির ঝি আমার পোলারে বশ করছে। অর বাপে না কবিরাজি করে, আমার পোলারে মনেহয় তাবিজ কবজ করছে। নাইলে পাঁচ বছরেও যে মা গী বাচ্চা দিতে পারে না তার আঁচলের তলে কেউ থাহে? থাহে না।’

রান্নাঘর থেকে বাড়ির বড়ো বউ টিটকারি করে বলল, ‘আমার দেওরারে মনে হয় ম্যালা সোহাগ দেয় ছোটো জা। তাই সোহাগের লোভ ছাড়তে পারে না আমার দেওরা। কী গো বইন, কী এমন সোহাগ দিয়া বশ করছো জামাইরে আমাগোরেও শিখাও। তোমার ভাসুরেরতো বাইরের দিকে ছুঁকছুঁক স্বভাব। তারেও নাহয় বশ করতাম।’
বড়ো বউ সালমার টিটকারি যেন আগুনে ঘি ঢালার মতন কাজ করল জামেলার শরীরে। তিনি ঘর লেপা বন্ধ দিয়ে হা-হুতাশ শুরু করলেন। কোন বাড়ির বউ বিয়ের একমাসের মাথায় পোয়াতি হইছে, কোন বাড়ির বউয়ের বাপ ম্যালা বড়োলোক তা নিয়ে কত আহাজারি শুরু করলেন। টুইটুবানি মুখ দিয়ে টু শব্দটুকু করল না। কেবল মনে মনে অভিমানে বুক ভেঙে গেল। নিজেরে মনে হলো কত অবহেলার বস্তু।

দুপুরে মাঠের কাজ শেষ করে ভাত খেতে এসেছে সোলাইমান। শক্ত, সুঠাম পুরুষ দেহটা ঘামে ভিজে একাকার। মাথার উপর এক ঝাঁক কোঁকড়া চুল। শ্যামলা গায়ের বর্ণ।
ঘরে এসেই ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে টুইটুবানিকে জড়িয়ে ধরল সে। মেয়েটা তখন আলনার জামাকাপড় গুছিয়ে রাখছিলো ভাঁজে ভাঁজে। তাকে আচমকা জড়িয়ে ধরলেও ভয় পেল না। কারণ সে জানে এ সময় তার স্বামীর বাড়ি ফেরার কথা। আর বিয়ের এত বছর যাবত বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরা যেন সোলাইমানের প্রধান কাজ। অন্যদিন টুইটুবানি হাসে, রহস্য করে, ঠাট্টা করে কিন্তু আজ তার কিছুই করল না। বরং মুখ ভার করে রাখল।

সোলাইমান স্ত্রী’র স্কন্ধে গাঢ় চুমু খেয়ে ফিসফিস করে শুধাল, ‘কী হইছে আমার ময়নাটার? হের কি আইজ মন ভালা নাই?’

টুইটুবানি স্বামীর প্রশ্নে রা করল না। এমন ভাব করল যেন সে শুনতেই পায়নি সোলাইমান কী বলেছে। স্ত্রীর এমন নিরবতা সোলাইমানের কাছে বড়ো যন্ত্রণার ঠেকল। থুতনি ধরে জোর করে মেয়েটাকে ফেরালে নিজের দিকে। কানের পিঠে অগোছালো চুল গুলো গুঁজে দিতে দিতে বলল, ‘মান করছে নাকি, ময়নাটা? আম্মা কি আবার বকছে?’
স্বামীর আহ্লাদে এবার অনুভূতিহীন টুইটুবানির সমস্ত অনুভূতি একত্রিত হয়ে কান্নায় রূপ নিল। ফুপিয়ে উঠল চাপা গলায়। কান্না জড়িত স্বরে বলল, ‘আমার পোলাপাইন হয় না তাতে কি আমার দুশ? আম্মায় খালি আমারে খোঁটা দেয়। আল্লাহ্ যদি না দেয় আমি কী করমু কন?’

টুইটুবানির কান্না সোলাইমানের পছন্দ না। তার বুকে কামড় দিয়ে উঠে মেয়েটার চোখের জল দেখলে। তবুও ক্যান যে আম্মা মেয়েটারে এমন কষ্ট দেয়! সোলাইমান টুইটুবানির মাথায় যত্ন সহকারে হাত বুলিয়ে দেয়। বাচ্চাদের মতো সান্তনা দিতে দিতে বলে,
‘ধুরো আম্মার কথা ধইরো না তো। আম্মা বয়স্ক মানুষ। বয়স হইতাছে। কারে, কহন, কি কয় তার কি হুঁশ আছে?’
টুইটুবানির অভিমান গাঢ় হয়। তার স্বামী যে কোনো কালেই নিজের মায়ের কথার প্রতিবাদ করেনি এটাতো সে জানেই। তবুও রোজ রোজ আশায় থাকে, এই বুঝি তার স্বামী তার হয়ে কথা বললো! এই বুঝি তার স্বামী কার হয়ে প্রতিবাদ করলো! কিন্তু দিনশেষে তাকে আশাহতই হতে হয়।
স্বামীর প্রতি নিবিড় অভিযোগ জানায় সে, ‘আপনে তো একটু আম্মারে নিষেধ করতে পারেন। আমারে যেন এগুলা না কয়। বড়ো ভাবিরে তো কুনুদিন এমনে কইতে পারেন না আম্মা। বড়ো ভাইজান রাগ দেহাইবো হেয় ভয়ে আম্মা ভাবিরে মাথাত কইরা রাহে। আর অন্যদিকে আপনে কিছু কন না দেইখ্যা আমারে এতকিছু সইয্য করতে হয়।’

টুইটুবানির অভিযোগ মনযোগ দিয়েই শুনল সোলাইমান। সবশেষে বোকা বোকা হাসল। মেয়েটার কপালে গাঢ় চুম্বন এঁকে বলল, ‘তুমি তো জানো, আম্মার উপর আমি কথা কইতে পারি না। তাছাড়া আম্মা হইল বেহেশত। হেই আম্মারে আমি কেমুন কইরা দুঃখ দেই কও?’
‘হ। আম্মা তো বেহশত। আর আমি পরের বাড়ি মাইয়া, আমি তো কেউ না। আমি দুঃক্ক পাইলেও কী আর কষ্ট পাইলেও কী।’

সোলাইমান এবার এই অভিমানীনিকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। তার সুঠাম, সুস্বাস্থ্যের কাছে বিশ বর্ষীয়া টুইটুবানির লতার মতন অঙ্গটা বড়োই নাজুক। বত্রিশের সোলাইমান এই বিশের কন্যার মায়ায় মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘোর লেগে যায়। খুব নিকটে, দাম্পত্য জীবনের সবটুকু মায়া গাঢ় করে বলে,
‘কে কইলো তুমি কেউ না? আম্মা আমার মরার পরের বেহশত আর তুমি তো আমার বাইচ্চা থাকার কারণ। তুমি তো আমার কলিজা। আমার শান্তি। তুমি দুঃক্ক পাইলে আমার অন্তর জ্বলে। কে কইলো তুমি আমার কেউ না? আমি যে আমারে বলতে কেবল তোমারেই বুঝি। তুমি কী হেইডা জানো না?’
স্বামীর সোহাগে লজ্জায় মরি মরি অবস্থা হয় টুইটুবানির। স্বামীর বুকের পাশে লেপ্টে থাকে সেই সোহাগ লাজে। যখন শাশুড়ির তিক্ত কথায় তার জীবনটা অসহ্য মনেহয় তখন এই মানুষটাই আবার তাকে শক্তি দেয় বেঁচে থাকার। এই মানুষটা না থাকলে তার যে কী হতো!

দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদ টিনের উপর পড়াতে গরম আরও বেশি লাগছে। দৈনন্দিন নিয়মে একসাথে খেতে বসেছে সোলাইমান তার বড়ো ভাই নোমান ও বাবা মোতালেব। সালমা হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছে সকলকে। জামেলা ভাত বেড়ে দিচ্ছেন সকলের পাতে। তরকারি দিতে গিয়ে দেখলেন চামচটা আনেননি রান্নাঘর থেকে। খাবার ঘর থেকে রান্নাঘর কিছুটা দূরে বিধায় তিনি ছোটো বউকে ডাকলেন গলা তুলে, ‘সোলেমাইন্যার বউ, ও সোলেমাইন্যার বউ, পাকের ঘর থেইক্যা চামুচটা আনো তো। তোমার শ্বশুর আব্বা বইয়া আছেন।’
এমন গলা তুলে ডাকার পরেও টুইটুবানির দেখা না পেয়ে মহিলা বিরক্ত হলেন। কিছুটা রুক্ষ স্বরে বললেন,
‘সোলেমাইন্যার বউ, কই তুমি? হুনো না কী কই? মানুষের কী ভাইগ্য! তাগো বউরা শ্বশুর শাশুড়িরে পালঙ্কে তুইল্যা খাওয়ায় আর আমি…. বান্দিগিরি কইরা মরি। কই গো? মরছো নাকি?’

সোলাইমান কিছুটা ইতস্তত করে মা’কে বলে, ‘আম্মা ও হয়তো গোছলে গেছে। তুমি গিয়া নিয়াও।’

‘গোছলে গেছে! সকালে না একবার গোছল করল! এহন…’ কথা আর সম্পূর্ণ করেন না ভদ্রমহিলা। ছেলের নত মুখের দিকে তাকিয়েই বাকিটুকু বুঝে নেন আলগোছে। রাগে দাঁত কিড়মিড় করেন। বিড়বিড় করে কী যেন বলতে বলতে রান্নাঘরে গিয়ে নিজেই চামচ নিয়ে আসেন।
সোলাইমানদের খাওয়ার মাঝামাঝি সময়ে উপস্থিত হয় টুইটুবানি। মাথায় আধ হাত ঘোমটা টেনে প্রায় ছুটেই আসে কিছুটা। ভয়ে বুক কাঁপে। কাজে একটু হেরফের হলেই তার শাশুড়ি গুষ্ঠি উদ্ধার করেন তার। আর আজ তো কতটা দেরি হয়ে গেল। এত বার বার মানুষটাকে বলল যেন এখন কাছাকাছি না আসে কিন্তু মানুষটা শুনলে তো! কথা তো আর মানুষটাকে শুনতে হয় না। শুনতে হয় তাকে। যেভাবে হেলাফেলা করে কথা বলেন শাশুড়ি! আজও নিশ্চয় ছাড় পাবে না।
ছুটে এসেই হম্বিতম্বি করল। পানির মগ, গ্লাস এগিয়ে পিছিয়ে দিল। শ্বশুর খেয়ে উঠতেই গামছা এনে দিল। পান সাজিয়ে দিল। ভদ্রলোক ঘর ছাড়তেই হুঙ্কার ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠলেন জামেলা,
‘তোমার কি শরম লজ্জা নাই, বউ? দিন দুপুরে এমনে ভিজা চুল লইয়া শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাসুরের সামনে ঘুরঘুর করতে লজ্জা লাগে না? আক্কেল-জ্ঞান কী খাইছো?’

এমন নিম্নমানের কথায় মাথা নামিয়ে ফেলল টুইটুবানি। চোখে জল চলে আসল লজ্জায়। ভাসুরের সামনে এমন একটা লজ্জা দেওয়া কী আম্মার খুব দরকার ছিল?
শাশুড়ির কথায় মজা পেল সালমা। ফিক করে হেসে দিয়ে পরিস্থিতিকে আরও বিব্রতকর করে তুলল। আবার ঠেস দিয়ে বলল,
‘বইনগো, তোমরা জামাই-বউ এমন করো লাগে নতুন বিয়া হইছে। মাইনষের নতুন বিয়া হইলেও তো এত টান থাহে না। মাগ্গো মা! কী প্রেম!’

এই সালমার কাজই যেন উস্কানি দেওয়া। আর সেই উস্কানিতে শাশুড়ি আম্মা আরও একধাপ কঠিন হয়ে যান। এখনও তাই হলো। বড়ো বউয়ের ঠেস মারা কথায় উনি ছ্যাঁত করে উঠলেন,
‘এত প্রেম দিয়া কী হইবো? অহনো পোলাপাইনের মুখই দেহাইতে পারে নাই। আমরা হইলে স্বামীর লগে সোহাগ করতাম তো দূরের কথা, গলায় দড়ি দিয়া মরতাম।’

এত এত অপমানে মূর্ছা গেল টুইটুবানি তবুও টু শব্দও করল না। মাথা নিচু করে যে রাখল তা আর উঠালো না। সোলাইমানের বড়ো খারাপ লাগল। টুইটুবানির এমন অপমান তার কাছে বিদঘুটে লাগে তবুও মুখ ফুটে ধমকে বলতে পারে না তাদের চুপ করতে। কেবল বরাবরের মতন আজও বলল,
‘আহা আম্মা, থামো।’

ছেলের কথায় থামার বদলে মা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেন। ন্যাকা স্বরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘পুতরে, পুত, আমি কী তোর খারাপ চাই? তোর ঘরে পোলাপাইন হয় না, শেষ বয়সে তোরে কে দেখবরে পুত!’

‘আল্লাহ্ দেখব, আম্মা।’
কথা বলেই হাত ধুয়ে উঠে যায় সোলাইমান। যেতে যেতে টুইটুবানির দিকে আড় চোখে তাকায়। মেয়েটা তার দিকে ভুল করেও তাকাচ্ছে না। আবারও বোধহয় অভিমান করেছে। কিন্তু সে-ও বা কী করবে? বাপ-মারে কষ্ট দিলে কী আদৌ সুখ পাওয়া যাইবো? মাইয়াটা বুঝে না। আর বুঝবোও কী? আম্মা যা ব্যবহার করে!

টুইটুবানি হয়তো কথার বিপরীতে কথা বলে না কিন্তু তার অভিমান দৃঢ় হয়। ভেতরটা অভিমানে আঙার হয়ে যায় কিন্তু ঠোঁট দু’টো থাকে নীরব। তার যে কথা বলার সম্বল নেই। একে তো বাবার বাড়ি গরীব তার উপর যৌতুক দিয়েছে তিলমাত্র। আবার বিয়ের পাঁচ বছরেও সন্তান দিতে পারেনি। স্বামীওবা তার হয়ে কী বলবে? এ অব্দি স্বামীকে বাবা ডাকটাও শুনাতে পারেনি। তারে দিয়ে তো কিছুই হলো না। এসব অপমান তো তার প্রাপ্যই। এসব নানান কথা ভেবে মনে মনে হাপিত্যেশ করে সে। মুখে তুলে না একটা দানাও। অন্যদিকে তাকে দুঃখ দেওয়া জামেলা আর সালমা মনের সুখে গপগপ করে গিলতে থাকে খাবার। একবার ভুল করেও তাকে খেতে ডাকে না। এখানে যে একটা মেয়ে অভিমানে বুক ভরিয়েছে সেদিকে যেন কারোই হুঁশই নেই। বাড়ির পোষা কুকুরের চেয়েও মূল্যহীন গরীব বাবার মেয়েটা।

খাবার-দাবার শেষ করে যে যার ঘরে ঘুমাতে চলে যায়। টুইটুবানি গিয়ে বসে পুকুরের ঘাটটায়। ঘরে যেতে ইচ্ছেই করছে না। সোলাইমানের কাছে গেলে তার এই শক্ত রাগ পানি হয়ে যায়। সে চায় না রাগ পানি করতে। আজ যেভাবে লজ্জায় সে মাটিতে মিশে গিয়েছে তার কিছুটা শাস্তি তো স্বামীরও প্রাপ্য। মানুষটা কী জানে না তার আম্মা কেমন? মুখে একটুও লাজ নেই মহিলার। হুটহাট গলা ছেড়ে এমন লাগামহীন কথা বলে অপমান করেন যে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে তার। তবুও সোলাইমান কেন সংযত থাকতে পারল না? কেন কাছে ডাকল? স্বামী-স্ত্রীর কাছে আসা নিয়েও এ বাড়িতে ঝগড়াঝাঁটি হয় সেটা কী নতুন? তা-ও লোকটার শিক্ষা হয় না। আজ একটা শিক্ষা হোক। ঘুমাক ঘরে একলা। সে যাবে না।
মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে পুকুরে ঢিল ছুঁড়তে লাগল। গাছগাছালির ফাঁকফোকড়ে রোদ এসে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেল তার কালো বর্ণের শরীরটাকে। গরম লাগছে, ঘামছে অনবরত। তবুও সে উঠল না। নড়লও না এক চিমটি। উদাস নয়নে কেবল সামনের দিকে তাকিয়ে রইল।

‘গরম লাগতাছে না তোমার? কী যে করো না! এই ভরদুপুরে কেউ এইহানে আইস্যা বসে?’

আচমকা স্বামীর কণ্ঠে ভয় পেল টুইটুবানি। থুতু দিল বুকে। মৃদু মৃদু বাতাস অনুভব করল শরীরে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখল সোলাইমান হাতপাখা নিয়ে এসেছে। সেটা দিয়েই বাতাস করছে তাকে। উদোম শরীরটা ভিজে গিয়েছে ঘামে। অথচ তার স্ত্রীর ঘাম নিয়ে যত চিন্তা!
টুইটুবানি আবারও মুখ ঘুরিয়ে নিল। কথা বলল না একটাও।

সোলাইমান স্ত্রী’র গা ঘেঁষে বসল। ডান হাত দিয়ে মেয়েটার বাহু জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ময়না আমার, রাগ কইরো না।’

টুইটুবানি কিছু বলল না কেবল মোচড়ামুচড়ি করল স্বামীর বাহু থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য। সোলাইমান আলিঙ্গন আরও শক্ত করে হাসতে হাসতে বলল,
‘আমি না চাইলে তুমি ছুটতে পারবা? একে তো এই চিকনা শইলড্যা তার উপর দুপুরবেলা খাইলা না, শক্তিতে পারবা আমার লগে?’

চমকে উঠল টুইটুবানি। সে দুপুরবেলা খায়নি এটা কীভাবে জানল মানুষটা? সবিস্ময়ে তাকাল স্বামীর পানে। চোখ জুড়ে প্রশ্ন। ঠোঁট এবার নড়ল কিঞ্চিৎ। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
‘আমি খাই নাই কে কইলো?’

‘কেউ কওয়া লাগব? আমি জানি না আমার বউডা কেমন? অভিমান হইলে তো হেয় সব রাগ ভাতের উপর দেহায়। খাওনের লগে কেউ মান করে?’

মুখ ভেংচালো টুইটুবানি। রাশভারী কণ্ঠে বলল, ‘আমার আর এ দুনিয়ায় আছে কে যার লগে মান করুম? তাই ভাতের লগেই করি। আমিও বোবা, আমার মানও বোবা। তাই এই দুনিয়ার কেউ বুঝব না, কদর দিব না হেই ‘মানের।’

সোলাইমান স্ত্রী’র মাথায় হাত বুলালো। যেমন করে ছোট্টো শিশুর মাথায় মানুষ হাত বুলিয়ে দেয় ঠিক তেমন করে। বুঝদার কণ্ঠে বলল,
‘তোমার কেউ নাই দুনিয়ায়? তাইলে আমি কে? এই যে রাইতের বেলা কারেন্ট গেলেগা হারা রাইত ভইরা বাতাস করি এডা কিছু না? আম্মারে লুকাইয়া শাড়িডি ধুইয়া দেই, বিছানাডা পাতি, মশারি টাঙাই, বাজার থেইক্যা লুকাইয়া আচার আনি এডি কার লাইগ্যা করি? তোমার লাইগ্যাই তো! আম্মার মুখের উপর কথা কইলেই আমি তোমারে ভালোবাসি এছাড়া বাসি না এমন ভাবো ক্যান? তোমারে আমি যেমন কইরা ভালোবাসি এমন কইরা আর কেউ কোনোদিন কাউরে ভালোবাসছিল? বাসে নাই। তা-ও কইবা আমি তোমার কেউ না?’

রাগ করতে গিয়ে স্বামীকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে ভেবেই মনে মরে জিব কাটলো টুইটুবানি। তবে উপর উপর রইল গম্ভীর। মুখ ভার করে বলল,
‘অহন কি আমি একটু রাগ কইরা চাইরডা কথাও কইতে পারুম না?’

‘পারবা না ক্যান? পারবা। আমারে বকো, পারলে মারো আমি কিছু কমু না। কিন্তু কোনোদিন কইও না আমি তোমার কেউ না। তোমার থেইক্যা তুমি আমারে বাদ দিয়া দিলে আমি যে বাঁচমু না। আমার সকাল-সন্ধ্যা হয় তোমার নামে আর হেই তুমি যদি আমারেই বাদ দিয়া দেও আমার কেমন লাগে জানো?’
কথা বলতে বলতে সোলাইমানের কণ্ঠটাও কাঁপল খানিক। সেই কম্পন টুইটুবানির হৃদয় অব্দি পৌঁছাল। জড়িয়ে ধরল সে স্বামীর গলা। খিলখিল করে হেসে দিল সদ্য নবজাতকের মতন। ফিসফিস করে বলল,
‘আপনে এত বলদা! আমি কী আপেনেরে বাদ দিতে পারমু কোনোদিনও? আপনে হয়ত বাদ দিয়া দিবেন কিন্তু আমি পারমু না। আপনারে যে আমি আমার অন্তরে রাখছি। কেমনে বাদ দিমু কন? হের লাইগ্যা কান্দন লাগে?’

সোলাইমানও জড়িয়ে ধরল স্ত্রীকে। চোখের জল লুকাল আলগোছে যদিও টুইটুবানি ধরতে পারল তা। এক হাতে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলেও আরেক হাত ব্যস্ত রইল হাত পাখাটা নাড়তে। মেয়েটার যে গরম সয় না! সেই কথা কী সে জানে না?

দুপুরের রোদ হাসে। তারি তলে পটু হাতে ভাত মেখে স্ত্রীর মুখে তুলে দেয় সোলাইমান। চোখ রাখে দরজার বাহিরে। আম্মা না আবার এসে পড়েন সে ভয়েও কান খাঁড়া করে রাখে।
তা দেখে আনমনে হাসে টুইটুবানি। আবার ভয়ও হয় বুকে। সেদিন আম্মা দ্বিতীয় বিয়ের কথা উঠিয়ে ছিলেন কিন্তু লোকটা তেমন পাত্তা দেয়নি। কিন্তু কতদিন এমন থাকবে? একদিন তো মানুষটারও বাপ ডাক শুনতে মন চাইবো। তখন টুইটুবানির জায়গা হবে কোথায়? এত যত্নের টুইটুবানিকে কোথায় রেখে দ্বিতীয় ঘর করবে মানুষটা?

কত অলুক্ষণে কথা ভাবতে ভাবতেই নাকেমুখে খাবার উঠে যায় তার। সোলাইমান উদ্বিগ্ন হাতে পানি এগিয়ে দেয়, ফু দেয় মাথাতে। বারে বারে পিঠে হাত বুলিয়ে বলতে থাকে, ‘কিচ্ছু হইবো না, শান্ত হও। আমি আছি না।’

কাশতে কাশতে বেহাল দশা হয় টুইটুবানির। কালো মুখটা লাল হয়ে যায়। এক দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে ভাবে, ‘ঠিক কতদিনের জন্য আছে মানুষটা? এই একজীবন নাকি এই মায়াটুকু যতদিন?’

চলবে….