বন্ধুর পিরীতি ষোলো আনা পর্ব-০২

0
70

#বন্ধুর_পিরীতি_ষোলো_আনা
কলমে: মম সাহা

২.

টুইটুবানির বাবা- করিম হাসান এসেছেন আজ মেয়ের বাড়িতে। একই গ্রামেই মেয়ের শ্বশুর বাড়ি হওয়া স্বত্বেও ভদ্রলোক কালেভদ্রে একবার আসেন মেয়েকে দেখতে। তাও মনে বড়ো সংশয় নিয়ে। বেয়াইন সাহেবার মুখ ভালো না। কথা বলতে বড়ো ছোটো মানেন না। যখন যা ইচ্ছে শুনিয়ে দেন মানুষকে। সেই শুনিয়ে দেওয়ায় বিপরীতপক্ষ কতটুকু কষ্ট পেলেন তা ভাবার প্রয়োজনটুকুও বোধ করেন না।
টুইটুবানি সবে গোসল সেরে এসে উঠোনের রশিতে শাড়ি মেলছিল। বাবা যে আসবেন সে ঘুনাক্ষরেও জানত না। হুট করে বাবাকে দেখে ভুত দেখার মতন চমকে গেল। কীসের কাপড় শুকাতে দেওয়া, কীসের কী! একছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল বাবাকে। জামেলা তখন ছিলেন রান্নাঘরে। ছেলের বউয়ের এমন দৌড় দেখে তিনিও রান্নাঘর থেকে উঁকি দিলেন।

‘আব্বু! তোমার এতদিনে আহনের সময় হইলো? মাইয়া যে একটা পরের ঘরে দিছো তা কী ভুইল্যা যাও? তোমারে দেহনের লাইগ্যা মনডা কেমন করে বুঝো না তুমি?’

করিম হাসান মেয়ের বাচ্চামো কথাতে হাসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন স্নেহময় ভাবে। উনার জীবনে নিজের বলতে সম্বলটুকু আছেই কেবল এই একমাত্র মেয়েটি। স্ত্রী কবর দেশেতে ঘুমিয়েছে বহুবছর হলো। সন্তান কেবল টুইটুবানি। এছাড়া আর কেউ নেই। মায়ের পেটের ভাই ছিল দু’জন, তারাও মারা গিয়েছে। ভাইয়ের ছেলেরা জায়গাজমি নিয়ে ঝামেলা করে সম্পর্ক ছেদ করেছে। দিন দুনিয়ায় করিম হাসানের মতন একা বোধহয় আর কেউ নেই। শূন্য গাছে থাকা কাকটাও না।

‘আম্মা, একলা থাহি আমি। এইডা ঐডা করতে করতেই তো বেলা চইল্যা যায়। আর আইতে সময় পাই না। জানোই তো তুমি।’
‘একটা মাত্র মাইয়ার লাইগ্যা তোমার সময় হয় না, আব্বু? নাকি মাইয়ারে পর কইরা দিছো বইল্যা আর মায়া লাগে না?’

মেয়ের অভিমানী কথায় হাসেন পিতা। হাসতে হাসতে বলেন,
‘বাপের কলিজার ধন হয় মাইয়া সন্তান। নিজের মাইয়া সন্তানের ভেতরে বাপেরা নিজেগো মারে খুইজা লয়। হেই মাইয়া রূপ মারে কেউ পর কইরা দিতে পারে? সন্তানগোরে শ্বশুর বাড়ি পাডাইলেই যদি পর হইয়া যাইতো তাইলে কোনো বাপ-মা তার মাইয়ারে বিয়া দিতো না। আমি নিজেই তো দিতাম না।’

‘কোনো বাপ-মার কথা জানি না কিন্তু আপনি আপনার মাইয়ারে বিয়া না দিলেই মনেহয় ভালা হইতে ভাইসা’ব।’

বাবা-মেয়ের কথার মাঝেই তৃতীয় যে কণ্ঠটি মাত্রই ভেসে এলো সেটি হলো টুইটুবানির শাশুড়ির। কারণ উনি ছাড়া এমন অদ্ভুত, অপ্রয়োজনীয় কথা আর কেউ বলতে পারবে না।
করিম হাসান ভ্রু কুঞ্চিত করলেন মেয়ের শাশুড়ির অর্থহীন কথায়। শুধালেন, ‘ক্যান আপা? আমার মাইয়্যা কী এমন করছে যে তারে বিয়া না দিলেই ভালা হইতো?’

রান্নাঘর থেকে এবার আধহাত ঘোমটা টেনে বেরিয়ে এলেন জামেলা। ঘোমটার নিচের মুখটা র ক্ত চোষা পেত্নীর মতন গম্ভীর এবং ভয়ঙ্কর হয়ে আছে। রান্নাঘর থেকে বেরিয়েই নিজের রসকষহীন কণ্ঠে বললেন,
‘আপনার মাইয়্যা এহনো আমার পোলারে বাপ ডাক হুনাইতে পারে নাই। বিয়ার পাঁচটা বছর কী মুখের কথা? তার উপর বিয়ার সময় আপনে আমার পোলারে যা দিছেন তা দেওয়া আর না দেওয়া এক হমান আছিলো। খালি পোলাডা সৎ দেইখ্যা বিয়াডা ভাঙতে পারি নাই। অহনের বাজারে কেউ এত কম জিনিসে বিয়া দেয়? খালি আমরা ভালা মানুষ দেইখ্যা বাইচ্চা গেছেন। অন্য কেউ হইলে হারা গেরামে ঢুল পিডাইয়া আপনাগো ইজ্জত খাইতো।’

‘মাইয়া বিয়া দিছি, আপা বেচি তো নাই। বাজারের হিসাব বিয়ার মাঝে কেমনে আহে? এক বাপের একটা মাইয়া, তারে দিয়া দেওন মানেই তো ঐ বাপের সব দিয়া দেওন। এত বড়ো, মূল্যবান জিনিস দিছি তা-ও আপনার এত রাগ?’
করিম হাসান স্পষ্টবাদী মানুষ। মেয়ের শাশুড়ির কথা তার যুক্তিতে বনে না তাই মাঝে মাঝেই কড়া জবাব দিয়ে ফেলেন। যদিও তিনি জানেন, তার এই কড়া জবাব মেয়ের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায় তবুও সে ছাড়তে পারে না অযৌক্তিক কথার প্রতিবাদ করা।

বেয়াইয়ের কথায় ফুঁসে উঠলেন জামেলা,
‘অমন ধন আমার লাগব না ভাইসা’ব। বংশের বাতিই যে দিতে পারব না হেয় আবার কিয়ের ধন? অর জীবনই তো বৃথা।’

‘বংশের বাতি দেওয়ার ক্ষমতা অর হাতে না উপরওয়ালার হাতে, আপা? ঐ আল্লাহর ইশারা ছাড়া কেউ কি কিচ্ছু করতে পারে? মানুষের কি সাইধ্য আছে ভাইগ্য বদলানোর? না, হেই সাইধ্য নাই। যদি থাকতো তাইলে আমিই সবার আগে আমার মাইয়ার ভাইগ্য বদলাইতাম। আর যাই হোক, আপনের মতন শাশুড়ি যেই ভাইগ্যে আছে সেই ভাইগ্য যেমনেই হোক বদলাইতাম। কিন্তু…. যা হোক, উপরওয়ালা যা করেন ভালোর লাইগ্যাই করেন।’

এবার জামেলার রাগ আর বাঁধ মানল না। হৈচৈ শুরু করলেন বাড়ি কাঁপিয়ে। উনার হৈচৈ-এ ঘুমন্ত নোমান, মোতালেব ছুটে এলেন। গোসলে গিয়েছিল সোলাইমান। আম্মার চিৎকারে সে বোধহয় ভালো করে গোসলটাও শেষ করতে পারেনি। ভেজা লুঙ্গি নিয়েই দৌড়ে এসেছে উঠোনে।
টুইটুবানি বাবার হাত ধরে টানছে। ঘরে যাওয়ার বিনীত অনুরোধ করছে। কিন্তু জামেলা অত্যন্ত বদমেজাজি হয়ে গেলেন। ছেলেদের দেখেই শুরু করলেন মরাকান্না,
‘দেখ রে আব্বারা, দেখ। আমার ছুডু বউয়ের বাপ বাড়ি বইয়্যা আইয়া আমারে কথা হুনাইতাছে। আমি নাকি এতই খারাপ যে তার মাইয়ারে এই সংসারে তার রাখতেই ইচ্ছা করে না। আমি নাকি দ জ্জা ল। হায় রে আল্লাহ্। গজব পড়ুক এই লোকের উপর।’

শাশুড়ির উলটপালট কথায় সবসময় বোবা থাকা টুইটুবানি অব্দি রাগ সংবরণ করতে পারল না। মেয়েটার শরীর কাঁপছে। বাবার অপমান বোধহয় সহ্য হয়নি শরীরে। সে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
‘আম্মা, মুখে লাগাম দেন। আমার আব্বারে নিয়া একটাও খারাপ কথা কইবেন না। আমার আব্বা এই অপমানের মতন কিচ্ছু করে নাই। খবরদার, আম্মা।’

বাবাকে ধরেই কাঁপতে কাঁপতে কথা গুলো বলল টুইটুবানি। তার জীবনের কখনোই বোধহয় সে এতটা রাগেনি। কালো মুখটা থমথমে হয়ে গিয়েছে। সোলাইমান স্ত্রী’র দিকে তাকিয়ে রইল বিস্মিত চোখে। মেয়েটার এমন ভয়ঙ্কর রাগ সে কখনোই দেখেনি। রাগে রীতিমতো কাঁপছে।
নোমান নে শা খোর ছেলে। তার উপর তার চালচলন অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ঝগড়া ঝামেলায় বা-হাত ঢোকানো তার স্বভাব। তার উপর নিজের মা’কে পরের বাড়ির মেয়ের বাপ ছোটোবড়ো কথা বলেছে সেটা ও যেন মানতেই পারল না। ছুটে গিয়েই নিজের চেয়ে বয়সে দ্বিগুণ বড়ো মানুষটার সাদা সুন্দর পাঞ্জাবির কলার টেনে ধরল। তারপর দানবীয় শক্তিতে ধাক্কা মেরে ফেলল দূরে।

ঘটনাটা এতই শীগ্রই ঘটল যে কেউ বুঝে উঠতে পারল না। বৃদ্ধ করিম হাসান মাটিতে পড়েই কঁকিয়ে উঠলেন। গরীব বাবা বলে মেয়ের বাড়িতে সম্মান তার এই মাটি অব্দিই হলো। টুইটুবানি ছুটে গেল বাবার কাছে। হাউমাউ করে কাঁদতে আরম্ভ করল। সোলাইমান এবার ছুটে এলো শ্বশুরের কাছে। তার ভাইয়ের আচরণ অপ্রত্যাশিত ছিল একেবারে। সে শ্বশুরকে ধরতে ধরতে ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘কী করলেন, ভাইজান? হেয় আপনের বড়ো, সম্মানের। হের গায়ে হাত তুলতে কলিজায় বাঁধল না? আপনার একবার বিবেকে বাঁধল না?’

‘তুই তো একটা মাইগ্যা। তোর মারে তোর শ্বশুর এমন কথাডি কওয়ার পর তুই কেমনে চুপ থাকছ? নিজের মার প্রতি কোনো দরদ নাই, দরদ তোর সব বউয়ের বাপের প্রতি তাই না?’

‘ভাইজান মুখ সামলাইয়া কথা কন।’

‘এই কী করবি তুই? খান*র পোলা। কী করবি?’ বলতে বলতে ভাইয়ের দিকে তেড়ে গেল নোমান। বৃদ্ধ মোতালেব এতক্ষণ সবটাই নীরবে দেখছিলেন। কিন্তু বড়ো ছেলের এমন বাড়াবাড়ি তাকে আর নীরব থাকতে দিল না। সে দুই ভাইয়ের মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়ালেন। বড়ো ছেলের বুকে ধাক্কা দিয়ে রাগান্বিত স্বরে বললেন,
‘মায়ের প্রতি আপনের বড়ো দরদ তাই না? হের লাইগ্যাই বুঝি ভাইরে খান কির পোলা কইতে মুখে বাঁধে নাই? দুই হপ্তা আগেও তো টেকার লাইগ্যা আম্মারে চেলাকাঠ দিয়া বাইরাইলেন। আর আইজ এমন টানই আইছে যে বাড়ির আত্মীয়ের গায়ে হাত তুলতে আপনের বিবেকে বাঁধল না! আর একটা পা যদি তুই আগাছরে বান্দির পো, তাইলে তোর পা দুইটা আর হুদাই চিল্লানোর কারণে তোর বুড়া মা মা*গীর গলাডা আর থাকব না। একবারে কাইট্টা লামু। জা নো য়া রের বংশ।’

বাবার ধমকে থেমে গেল নোমান। সালমা স্বামীকে টেনে নিয়ে গেল দূরে। আঁচলে মুখ চেপে মরাকান্না করা জামেলাও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।

মেয়ের সাহায্যে মাটি থেকে উঠলেন করিম হাসান। আশেপাশের প্রতিবেশীদের উঁকিঝুঁকিতে তার লজ্জায় মাথা নত হয়ে গেল। সাদা পাঞ্জাবিটা মাটিতে এমন মাখামাখি হলো যেমন করে বাবার ঝকঝকে হৃদয়ে আঘাত এলো।
টুইটুবানি তো কেঁদে একসার। বাবার শরীর ঝারতে ঝারতে বাচ্চাদের মতন ফুঁপাতে লাগল,
‘ব্যথা পাইছো, আব্বা। কই লাগছে ব্যথা? আব্বাগো, আমারে মাফ কইরো। তোমারে এত খবর দিয়া আনছিলাম আমি। যদি একটাবার ধারণা করতে পারতাম এমন হইবো তাইলে তোমারে কহনো আইতে কইতাম না।’
ক্রন্দনরত মেয়ের মাথায় হাত বুলালেন করিম হাসান। বৃদ্ধের চোখ জলে টলমল। বললেন,
‘ক্ষমা তো আমি চামু, আম্মা। তুমি আমারে মাফ কইরো, আম্মা। তোমারে এমন দোযখে আমি ফেলছি যেই দোযখের জ্বলনে তুমি পুইড়া শেষ হইয়া যাইতাছো। আমি এক বেলা-ই যে তাপ সইতে পারলাম না তুমি হেই তাপ পাঁচটা বছর ধইরা সইতাছো। আমারে মাফ কইরো, আম্মা। তোমারে এমন আগুনে ফালাই দিছি বইলা। কেমন অসহায় বাপ আমি! এই আগুন থেইক্যা তোমার বাঁচাইতে পারলাম না। উডাইতে পারলাম না।’

বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে দিলেন মানুষটা। সে-কি কান্না! পুরুষদের কান্না পৃথিবী ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়ার মতন করুন। একটা বাবার এই আফসোসের ক্ষত কোনো মাটি দিয়েই ঢাকা যায় না। বাবা যখন দেখে তার দেশে সে যেই কন্যাকে রাজকন্যা করে রেখেছিল সে-ই কন্যাই শ্বশুর বাড়ি নামক কসাইখানায় প্রতিদিন নিজেকে কোরবানি দিচ্ছে তখন সেই বাবা আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। তেমনই ঘটল করিম হাসানের সাথে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সে যাওয়ার পথ ধরল। মোতালেব সরকার নিজের বড়ো ছেলের হয়ে ক্ষমা চাইলেন কিন্তু হৃদয় ভাঙা বাবার সেই দিকে যে কোনো হুঁশ নেই। সোলাইমান থামাতে চাইলেও থামলেন না তিনি। বরং মেয়ে জামাইয়ের হাত ধরে বড়ো আকুতি করে বললেন,
‘মা আছিল না আমার টুইটুবানির। আমি অরে মা’র অভাব বুঝতে দেই নাই। কিন্তু তবুও মাইয়াটার মায়ের লাইগ্যা পরাণ কানতো। এর লাইগ্যাই এত অল্প বয়সে বিয়া দিছিলাম। ভাবছিলাম শ্বশুর বাড়িতে গেলে মা পাইবো। অর অভাব ঘুচবো। কিন্তু মা দিতে গিয়া যে আমি আমার মাইয়ার জীবনে দোযখ দিয়া দিমু হেইডা জানতাম না। সবসময় খালি মাইয়াডা কইতো তোমরা নাকি হেরে ম্যালা ভালোবাসো। আমার অভাগিনীর কপালে ম্যালা ভালোবাসা যে এমন হেইডা আমি বুঝি নাই বাপ। শাউরি যে কহনো মা হইতে পারে না হেইডা যে আমি জানতাম না। আব্বা গো, তোমার দুইডা হাতে ধইরা কইলাম, কোনোদিন যদি তোমার মনেহয় আমার টুইটুবানির লগে তুমি আর থাকবা না তাইলে আমার মাইয়াডারে কোনো রকমের কষ্ট না দিয়া আমার বাইত দিয়া আইও। আমি রাহুম অরে। আমার ঘর অর লাইগ্যা খোলা চিরজীবন। আমার রুহটা তোমার কাছে আমানত দিয়া গেলাম। আমার মাইয়ারে তুমি যত্ন কইরো, আব্বা। আমার কলিজার ধন যে সে। তার কষ্ট আমি সইতে পারি না, আব্বা। আমার বুকটা জ্বইল্যা যাইতাছে।’

এই করুন আকুতি নিয়েই ভদ্রলোক মেয়েকে বললেন, ‘আম্মা, তুমি ভালোমতন থাইকো কেমন? খাইও ভালো মতন। কষ্ট পাইও না, আম্মা। আমি কোনো ব্যথা পাই নাই। তোমারে যেই দুঃখ দিছি গো, আম্মা, হেই দুঃখের কাছে এই ব্যথা কিছুই না। যাই, আম্মা। কোনোদিন যদি তোমার দোযখ ছাড়তে মন চায় তুমি আমার কাছে আইয়ো, আম্মা। আমি স্বর্গ দিমু তোমারে। কোনো দ্বিধা কইরো না। যাই, আম্মা। যাই।’

চোখের জল মুছতে মুছতে সকলের চোখের বাহিরে চলে গেলেন মানুষটা। বাবা গরীব হলে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে কতটা আদর-আপ্যায়ন লিখা থাকে তারই যেন প্রমাণ পেল সকলে। টুইটুবানি হৃদয় নিংড়ানো চিৎকার করতে করতে চলে গেল নিজের ঘরে। এতদিন, এত অপমান সে মাথা পেতে নিয়েছে। কিন্তু আজ….
সে তো কোনোদিন বাবারে জানতে দিতে চায়নি তার এই জীবনের গল্প কিন্তু বাবা জেনে গেলেন। বাবারা যে কখনো তার রাজকন্যার দূর্দশা সইতে পারেন না।

ঘরের জানালা দিয়ে সুদূরের মাঠ দেখা যাচ্ছে। সারি সারি তালগাছ বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই মাঠে। টুইটুবানি তাকিয়ে আছে সেদিকেই। একধ্যানে। চোখ-মুখ ফুলে একাকার। সারাদিন এত পরিমাণ কেঁদেছে যে এখন আর কান্নাও আসছে না।
‘ময়না, খাইয়া লও না খাওনডা। সারাডাদিন কিচ্ছু খাও নাই। এমন কইরো না।’

সোলাইমানের অনুরোধেও তার দিকে একবার ফিরে তাকাল না টুইটুবানি। তার উদাস দৃষ্টি পথের বাঁকে। সোলাইমান স্ত্রী’র সামনে হাঁটু মুড়ে বসলো। আকুতিভরা কণ্ঠে বলল,
‘ময়না, কথা কইবা না আমার লগে? আর কতক্ষণ মুখ ফিরাইয়া থাকবা?’

রাগে, ক্ষোভে ফুঁসে উঠে টুইটুবানি। স্বামীর প্রেমে আজ তার রাগ জল হয় না। যতই হোক, প্রসঙ্গ যখন বাবার দুঃখ, কন্যা তখন তো হিং স্র হবেই।
‘শখ কইরা আপনেরে বিয়া করছি, দুই চাইরডা দিন ভাত না খাইয়া তো থাকতে হইবোই। এত সুন্দর ভাইগ্য আমার!’

সোলাইমান বড়ো দুঃখ পেল মনে। টুইটুবানিকে সে কখনো একটা জোরে ধমকও দেয়নি অথচ মেয়েটা তাকে কেমন কঠিন কথাই না বলে দিল! তারে পেয়ে মেয়েটা এত অখুশি?
‘আমারে পাইয়া তুমি অনেক অসুখী, তাই না?’

সোলাইমানের কণ্ঠস্বর করুণই শোনালো কিছুটা। না চাইতেও টুইটুবানির দৃষ্টি মাঠ পেরিয়ে স্বামীর কাছে ছুটে চলে এলো। তবে স্বামীর কষ্টের কাছে তার বাবার দুঃখটা হীন হলো না। তাই বিক্ষিপ্ত হৃদয়ে বলল,
‘আপনারে পাইয়া আমি অখুশি হইতে যামু ক্যান? আপনে অখুশি হেইডা কন। আপনে, আপনের মা, সবাই অখুশি। তাই তো আমার বাপের গায়েও হাত দিতে বাঁধে নাই।’

সোলাইমান এবার স্ত্রী’র পাশে বসল। মেয়েটার পিঠে স্নেহ ভরা হাত বুলিয়ে দিল। করুন স্বরে বলল,
‘ভাইজান কেমন তুমি তো জানোই, ময়না।’

‘হ, সবকিছু জানার দায়ভার তো আমি একলা লইছি।’

‘এমনে কথা কইও না, ময়না। আমার কষ্ট হয়। সারাডাদিন তুমি কিচ্ছু খাও নাই। মুখটা তোমার কেমন শুকনা লাগে। আহো না, রাইত হইলো তো ম্যালা। কিচ্ছু খাইয়া লও। কাইল তোমারে আব্বার কাছে লইয়া যামু কথা দিলাম।’

আব্বার কাছে যাওয়ার কথা শুনে টুইটুবানির রাগের আঁচ কিঞ্চিৎ কমলো। তবে মুখ-চোখ রইল শক্ত। কর্কশ স্বরে বলল, ‘আমি খাইলেও কী? না খাইলেও কী? আমার খাওনের জইন্য তো কিছু থাইম্যা থাহে নাই। হেই তো সবাই কী সুন্দর রংতামাশা কইরা খাইলেন।’

‘কলিজা, এমনে কয় না খাওন নিয়া। আর সবাই খাইছে কিন্তু আমি তো খাই নাই। তুমি না খাইলে আমার গলা দিয়া খাওন নামবো কও? তুমি কী আমারে চিনো না?’

‘ক্যান খান নাই? আপনার বেহশত তো খাইছে। হেয় খাইলে তো আপনার খাওয়া হয়।’

‘আম্মারে নিয়া এমনে কইও না, পরাণ। আম্মা কত কষ্ট কইরা পালছে আমাগোরে। তারে হেলাছদ্দা করতে নাই।’

সোলাইমানের সহজসরল কথায় তাচ্ছিল্য হাসল টুইটুবানি। বিষণ্ণ স্বরে বলল,
‘হ, আপনার আম্মাই আপনাগোরে কষ্ট কইরা পালছে। আর আমার আম্মা-আব্বা তো কোনো কষ্টই করে নাই। কারণ আমরা মাইয়া। আমরা বাতাসে বড়ো হইয়া গেছি। আর বড়ো হইয়া আপনাগো গলায় ঝুইল্যা পড়ছি।’

টুইটুবানির তাচ্ছিল্যে মুখ কালো হয়ে গেল সোলাইমানের, ‘ময়না, আম্মারে ছুডু কইরা কথা কইও না।’

‘হ, আর আমার আব্বারে ছুডু কইরা কথা কওয়া যায় আর গায়েও হাত তোলা যায়। তাই না?’

স্ত্রীকে আর কিছু বলল না সোলাইমান। হন হন করে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। টুইটুবানির কী ভীষণ কান্না পেল! আজ স্বামীও তার উপর রাগ করছে। কাল হয়তো মায়ের তালে তালে নাচবে। নানান আশংকায় তার বুক টলে। বিয়ে ভাঙবে সেটা তার কাছে বড়ো ব্যাপার নয়। যেই সংসারে এত অপমান তার নামে লেখা সেই সংসার ছাড়তে তার আপত্তি নাই। কিন্তু যেই স্বামী এত ভালোবাসা দিছে, মাথায় করে রাখছে সেই স্বামীকে ছাড়া ও থাকবে কীভাবে? এই মায়া কী কাটানো যায় আদৌ?
টুইটুবানির ভাবনার মাঝেই এক থালা ভাত নিয়ে উপস্থিত হয় সোলাইমান। রাত তখন অনেকটা। থালার ভাতের পাশে ডিম ভাজা দেখে অবাক হয় টুইটুবানি। সবিস্ময়ে বলল, ‘এত রাইতে আপনেরে ডিম ভাইজ্যা দিল কে?’

সোলাইমান হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো। যত্ন করে ভাত মাখিয়ে মেয়েটার মুখের সামনে ধরল। মায়া মায়া স্বরে বলল,
‘আমিই ভাইজ্যা আনলাম। তোমার তো ম্যালা পছন্দ। খাও, ধরো। আর রাগ রাইখো না।’

সোলাইমান ডিম ভেজেছে কথাটা যেন বিশ্বাস হলো না টুইটুবানির। তাজ্জব স্বরে বলল, ‘আপনে না ডিম ভাজতে পারেন না? হাত পুড়াই ফেলেন?’

স্ত্রী’র এমন চিন্তায় আনন্দ লাগে সোলাইমানের। সে হাসে। স্ত্রীকে বলে না যে, আজও তার হাত পুড়েছে। মেয়েটার সারাদিন পর মুখে যেই চাপা সুখটা দেখেছে তা আর মাটি করতে ইচ্ছে হয় না তার। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
‘খাও তো। রাইত হইছে। ঘুমাইতে হইবো না? আমার কিন্তু সোহাগ ছাড়া ঘুম হয় না। তাড়াতাড়ি খাইয়া সোহাগ দেও।’

দাম্পত্য জীবনের ঘনিষ্ঠতার কথা মনে পড়তেই লজ্জায় লাল হলো টুইটুবানি। লজ্জা ঢাকতে দ্রুত ভাত মুখে দিল। সারাদিন পর ভাত মুখে দিতেই খিদেটা জেঁকে ধরল তাকে।
সোলাইমান ভাত মুখে দিতে দিতে ছোটো স্বরে বলল,
‘আম্মারে ছোটোবড়ো কথা কইও না আমার খারাপ লাগে। তুমি তো জানো আম্মারে আমি কত কদর করি।’

টুইটুবানির চিবুতে থাকা ব্যস্ত মুখটা থেমে গেল। তাকিয়ে রইল নিজের স্বামীর পানে। লোকটা নিজের মা’কে অতিরিক্ত ভালোবাসে বলেই তার ভয় হয়। এত মা ভক্ত মানুষ, যদি মা ভালো করে একদিন চেপে ধরে দ্বিতীয় বিয়েটা করতে বলে তাহলে তো নিশ্চয় রাজি হয়ে যাবে। এত প্রেম বিসর্জন দিয়ে তখন নতুন বউ ঘরে তুলবে। একটা বারও এই এত ভালোবাসা-বাসির কথা মনে পড়বে না। তার ঠিকানা হবে অবহেলায়! সঙ্কায় বুক কাঁপে টুইটুবানির। স্বামীকে বলতে গিয়েও আর বলে না যে, তার শাশুড়ি ঘরের বাহিরে কান পেতে দাঁড়িয়ে কথা শুনছে তাদের। প্রায় সবসময় উনি একাজটি করেন। কিন্তু সোলাইমানকে বলে আদৌ লাভ আছে? মায়ের দোষ দেখতে পাবে সে কখনো? পৃথিবীতে সবচেয়ে দুর্ভাগ্য সেই নারীর, যে-ই নারীর স্বামী অতিরিক্ত মা প্রেমী হয়। কারণ অতিরিক্ত প্রেম মানুষকে অন্ধ করে দেয়।

ভাবতে ভাবতেই খাবার শেষ হয় মেয়েটার। সোলাইমান থালা রেখে এসে ঘরের দরজা আটকে দেয়। শার্টের পকেট থেকে আলগোছে কিছু একটা বের করে টুইটুবানির পায়ে পরিয়ে দেয়। চমকে যায় মেয়েটা। পায়ের দিকে তাকাতেই রূপোর নুপুর জোড়া চকচক করে উঠে। সোলাইমান উঠে এসে স্ত্রীর কপালে চুমু খায়। ঘনিষ্ঠ হয় কত স্পর্শকাতর ভাবে। ফিসফিস করে বলে,
‘পরাণ, তোমার না নুপুর পছন্দ? ম্যালা দিন আগে বানাইতে দিছিলাম। আইজ আইছে। পছন্দ হইছে তোমার?’

টুইটুবানির পছন্দ হয়েছে ভীষণ। তবুও বলে, ‘কী দরকার আছিলো এডির?’
‘আমার ময়নার যা ভালো লাগবো তা আমার ময়নার পায়ের কাছেই আইন্যা দেওয়া আমার কর্তব্য। এদিকে দরকার অদরকার আহে কই থেইক্যা? আমার ময়নার ভালো থাকা সব দরকারের উর্ধ্বে।’

টুইটুবানির চোখ দিয়ে আলগোছে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। এত প্রেম কতদিন রবে?

চলবে….