বন্ধুর পিরীতি ষোলো আনা পর্ব-০৩

0
70

#বন্ধুর_পিরীতি_ষোলো_আনা
কলমে: মম সাহা

৩.
সকাল হতেই গোসল সেরে রান্নাঘরে গেল টুইটুবানি। নীল রঙের একটি সুতির কাপড় পরনে। আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে বিধায় তার মনে কিছুটা ভয়ও লাগছিল। শাশুড়ি মায়ের কথার যে তেজ! আজ না আবার কী কী শুনতে হয়!
টুইটুবানির ভয় সত্যি হলো যখন সে রান্নাঘরে ঢুকল। শাশুড়ির রুটি বানানো শেষ। আলু ভাজা শেষ। চা বসিয়েছে চুলাতে। সালমা পেয়াজ কাটছে ডিম ভাজার জন্য। টুইটুবানিকে চোখে পড়তেই সালমা হাসল। শাশুড়িকে তাতিয়ে দেওয়ার জন্য কিছুটা ঠেস মেরেই বলল,
‘কী গো বইন, আমার দেওরা ছাড়লো তোমারে? এতক্ষণে তোমাগো রাইত পোহাইলো?’

জামেলা আক্তার এতক্ষণ ছোটো বউকে খেয়াল করেননি। কিন্তু বড়ো বউয়ের কথায় খেয়াল করলেন এবার। ছোটো বউয়ের ভেজা চুল দেখলেই যেন ভদ্রমহিলার শরীরে আগুন লেগে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটলো না। টুইটুবানির ভেজা চুল দেখে তিনি প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন,
‘ও মাগো মা, আওন লাগতো না তোমার এইখানে। মাগো, রাজার মাইয়া তুমি, সারাদিন খাইবা আর ঘুমাইবা। তোমার কোনো কাম করতে হইব না। বান্দীগিরি করার লাইগ্যা তো আমরা আছিই।’

টুইটুবানি শাশুড়ি সাথে তর্ক করল না মোটেও। মাথাটা নামিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘রাইতে একটু দেরিতে ঘুমাইছিলাম তো তাই উঠতে পারি নাই, আম্মা।’

‘আমার পোলার আক্কেল জ্ঞান ছাড়া কাম দেখলে আমি অবাক হইয়া যাই। যেই বউ পোলাপাইনই দিতে পারব না হেই বউয়ের লগে তার এত সোহাগ কইতে আহে কে জানে? আমি হইলে ফিইরাও চাইতাম না।’

টুইটুবানি মাথাটা নামিয়ে রাখল যে আর উঠাল না। কোনো জবাব দেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করল না।

~

আজ টুইটুবানিদের বাড়িতে মেহমান এসেছে। মাত্র দু’জন মেহমান। অথচ রান্না করতে হয়েছে কত রাকমের পদ! ইলিশ মাছ ভাজা, চিংড়ির দোপিয়াজা, ডিম ভুনা, দেশী মুরগীর ঝোল, করলা ভাজি আর ডাল। সব রান্নার দায়িত্ব ছিল টুইটুবানির ঘাড়ে। নিয়মই এমন। যেই মেয়ের বাপ কম টাকা যৌতুক দিবে সেই মেয়েকেই শ্বশুর বাড়িতে গাধার খাটনি খেটে বাকি টাকার পাওনা পরোক্ষ ভাবে শোধ করতে হবে। তার উপর যদি হয় বাচ্চা দিতে অক্ষম তাহলে তো হলোই।

উঠোনে মোড়া পেতে গল্প পেতেছেন জামেলা। সাথে আজকের মেহমান মানে তার বোন রেহানা এবং বোনের মেয়ে বকুল সাথে সালমাও আছে। সালমার ছেলে-মেয়ে নানার বাড়িতে গিয়েছে বিধায় সালমার বিশেষ কোনো কাজ নেই এখন। গল্প করা সাথে টুকটাক এগিয়ে পিছিয়ে দেওয়া ছাড়া। কোনো এক বিষয়বস্তু নিয়ে কথা হচ্ছে। রান্নাঘর থেকে স্পষ্ট শোনা যায় সে কথা। টুইটুবানির রান্নাও শেষের দিকে তাই তার মনোযোগ আড্ডার ভেতরই। কথায় কথায় রেহানা বেগম বললেন,
‘আফা, আমাগো সোলেমাইন্যার ঘরে দেহি কোনো পুত-ঝি নাই। বউয়ের কি সমস্যা আছে কুনু?’

জামেলা আক্তার কিছুটা শুনিয়ে শুনিয়েই বললেন,
‘সমস্যা আছে দেইখ্যাই তো পাঁচ বছরেও কোনো পোলাপাইন হওয়াইতে পারে নাই।’

‘তোর পুতের বউ তো তাইলে বেডিই না।’ কথাটা বলেই রেহানা বেগম ফিক করে হেসে দিলেন। মনে হলো যেন দুনিয়ার সবচেয়ে মজাদার কথাটা উনি বলে ফেলেছেন। রেহানার সাথে তাল মিলিয়ে হাসল সালমা। জামেলা ঠোঁট টিপে হেসে বললেন,
‘আর কইছ না। আমার দুঃক্কের কপাল। পোলা বিয়া করাইলাম এমন মাইয়ার লগেই যার রূপ নাই, ছিরি নাই, গুণ নাই। আবার আমার পোলাডারে বাপ ডাকও হুনাইতে পারে নাই। কত আশা আছিলো বকুলডার লগে পুত বিয়া দিতাম!’
কথাটা বলেই ভদ্রমহিলা এমন ভাবে আফসোসের শ্বাস ফেললেন যেন এ দুনিয়ায় এর চেয়ে বেশি আফসোসের মতন ঘটনা অবশিষ্ট নেই।

রান্নাঘরে থাকা টুইটুবানির মুখ শুকিয়ে গেল। ঘৃণায় ভরে গেল অন্তর। এ দুনিয়ায় তার শাশুড়ির প্রতি যতটুকু ঘৃণা জন্মেছে ততটুকু বোধহয় আর কারো প্রতি জন্মাবে না। রান্না শেষ হতেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো সে। তাকে দেখে বকুল হাসিমুখে এগিয়ে এলো। নিঃসংকোচে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ভালা আছো, ভাবি?’

‘হ। ভালাই আছি।’

টুইটুবানির উত্তরে ঠেস মেরে জামেলা বললেন, ‘তোর ভাবি ভালাই থাকে বকুল। দেহছ না পায়ে রুনুঝুনু নূপুর পরে, কানে স্বর্ণের দুল পরে। আমার পোলা তো তারে সুখ দিয়া জড়াইয়া রাখছে।’

‘আহা, এমনে ক্যান কইতাছো খালা? ভাবি ভালা মানুষ, তারে ভালোবাসব ভাইজান হেইডায় তো স্বাভাবিক।’

মুখ ভেংচালেন জামেলা, ‘আর ভালা মানুষ! আমরা তো থাহি, আমরা জানি কদ্দুর ভালা।’

‘আপনাগো চাইয়া আমি এক আনা হইলেও বেশি ভালা এট্টুক তো আপনে মানবেন, আম্মা। তাই না?’ বোবা টুইটুবানির মুখের ধারাল বুলিতে তাজ্জব বনে গেলেন জামেলা। বাতাস বইছে তখন চারপাশে। গাছপালা উন্মাদ নড়ছে সে বাতাসে। জামেলা খ্যাপে গেলেন। মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
‘একদম মুখ লাড়বা না। টাইন্যা ছিঁইড়া দিমু মুখটা।’
‘হেইডাই তো বাকি রাখছেন আর।’ কথাটা বলেই হনহনিয়ে ঘরে চলে গেল টুইটুবানি। রেহানা বেগম অসন্তুষ্ট গলায় বোনকে বললেন,
‘মা লো মা, আফা! তোর পুতের বউয়েরনি এই মেজাজ?’

জামেলা আক্তার সাপের মতন ফুঁস ফুঁস করে বললেন, ‘অর মেজাজের আইজ চল্লিশা করুম। মা গীর খাইয়া দাইয়া গতর বাইরা গেছে না? অর গতর কমামু। খা ন কির ঝি আমার মুখের উপর কথা কইবো! কত বড়ো সাহস!’

ঘরের ভেতর গিয়েই চোখের জল টুকু ছেড়ে দেয় টুইটুবানি। ফুঁপিয়ে উঠে সে। বিছানায় সোলাইমান উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল। বাহিরের টুকটাক কথা তার কানেও গিয়েছে যৎসামান্য। কিন্তু নিদ্রা ঘোরে তেমন ঠাহর করতে পারেনি কী হয়েছে। কিন্তু হুট করেই কান্নার শব্দ পেতেই সে ধরফরিয়ে উঠে বসল। টুইটুবানির গলার স্বর তার চেনা। কান্নার শব্দ তার মুখস্থ। আম্মা মেয়েটারে এত কাঁদাইছে যে মুখস্থ না করে উপায় নেই।
খাট থেকে নেমে হন্তদন্ত পায়ে স্ত্রী’র সামনে এসে দাঁড়াল। বাহুতে হাত রেখে ব্যস্ত কণ্ঠে শুধালো,
‘কী হইছে? কাঁদো ক্যান? আম্মা কী আবার বকছে?’

টুইটুবানি স্বামীর হাতটা ঝারা দিয়ে ফেলে দিল। রুষ্ট কণ্ঠে বলল, ‘আমারে ধরবেন না। সরেন এইখান থেইক্যা। এই জীবনে আপনে কী করতে পারছেন আমার লাইগ্যা? আম্মা বকছে কি-না এদ্দুর কথা কওয়া ছাড়া আর কিচ্ছু করতে পারছেন? পারেন নাই। কিচ্ছু যহন করতেই পারবেন না তাইলে জিগাইয়া লাভ কী হ্যাঁ? আমার জ্বালা বাড়ান?’

টুইটুবানির এমন হিং স্র অভিযোগ এর আগে কখনোই দেখেনি সোলাইমান। স্বভাবতই ভীষণ অবাক হয়ে গেল। চমকিত গলায় বলল, ‘পরাণ…!’

‘আপনের সোহাগের ডাক আর আমারে ডাকবেন না। আমার জীবনডা একবারে ধ্বংস কইরা দিছে আপনের আম্মায়। উঠতে ,বইতে, খাইতে, হুইতে সবসময় খালি আমার দুশ দুশ আর দুশ। ক্যান আমারে নিয়ে তার এত সমস্যা একটাবার জিগাইছেন? একটাবার মুখ ফুইট্যা তার কথার প্রতিবাদ কইরা কইছেন যে মা হইতে না পারাডা আমার অন্যায় না। হেইডা আমার হাতে নাই। তাইলে কিয়ের সোহাগ আপনে দেহাইতে আহেন হ্যাঁ?’

সবকিছুরই একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তেমনই সীমাবদ্ধতা ছিল টুইটুবানির ধৈর্যের। কিন্তু মেয়েটার ধৈর্যকে ভরা সমাজে এত ঘাত-প্রতিঘাত সইতে হয়েছে যে আজ সেই বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। মেয়েটা হয়ে উঠেছে উন্মাদ।
এমন উন্মাদ টুইটুবানি সোলাইমানের কাছে অপরিচিত। তবুও সে শান্ত করার চেষ্টা করল মেয়েটাকে,
‘আস্তে কথা কও, বাইরে হগলেই হুনবো। এমন কথা কইতাছো ক্যান? আম্মা তো তোমার বড়ো। গুরুজন তাই না?’

‘আরে রাহেন আপনের গুরুজন। আপনের আম্মা গুরুজন আর আমার বাপ কী আছিল? হের গায়ে তো হাতও তুলতে ভুলে নাই আপনের পরিবারের মানুষ। বেহশত, বেহশত কইরা আপনে আমার জীবনটা নরক বানায় দিছেন। কহনো কিচ্ছু কই নাই, ভাবছি শাউড়ি যেমন হোক জামাই তো মনের মতন কিন্তু আর কত? আপনের আম্মা যেই কথা কয় বোবারও মুখে বুলি ফুটবো হেই কথা হুনলে অথচ আপনের মুখে বুলি ফুডে নাই। এত বেহেশত নিয়া যদি চিন্তাই আছিল তাইলে আপনে আমারে ক্যান বিয়া করছিলেন? বেহশেতের পছন্দের মানুষরে করতে তাইলে তো আর আমার জীবনডা শেষ হইতো না।’

‘আমি তোমারে ভালোবাসছিলাম বইলাই তো বিয়া করছিলাম, ময়না।’

সোলাইমানের কথা আরও বাড়ার আগে বাহির থেকে জামেলার গালি-গালাজ ভেসে এলো। ঘরের সব কথাই যে উনি শুনেছেন তা স্পষ্ট হলো উনার গালি-গালাজে। টুইটুবানি দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘আপনার বেহশতের মুখ দিয়া দেখেন কেমন কথা বাইর হইতাছে। তা-ও আপনে কিছু কইবেন না? এত অপমানই যদি আমার প্রাইপ্য তাইলে কন অহনই গলায় ফাঁ সি দেই। ঝুইল্যা যাই ফ্যানের লগে। আপনেরে শান্তি দিয়া যাই।’
টুইটুবানির কথায় যে একটা হুমকির আভাস ছিল তা সোলাইমানের বুঝতে অসুবিধা হলো না। সে তাই ধমকে উঠল তার শখের ময়নাকে, ‘কী কইতাছো এডি? পা গ ল হইছো? চুপ কইরা বহো। আমি আম্মারে থামায় আইতাছি।’

কথা শেষ করেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল সোলাইমান। জামেলার কণ্ঠস্বর তখন প্রায় আকাশ ছুঁইছুঁই।
ছেলেকে ঘর ছেড়ে বের হতে দেখেই তার হাপিত্যেশ যেন সীমানা ছাড়ালো,
‘পুতরে পুত, কোন আজরাইল বিয়া কইরা আনছতরে পুত? ঘরে গিয়া আমার নামে তোর কাছে কান ভারি করে। এদিকে এতডি মাইনষের সামনে কতডি কথা হুনাই গেল। আমি কী এই অপমান প্রাইপ্য?’

সোলাইমান ঝগড়া থামানোর জন্য মায়ের কাছে যেতে নিলেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে টুইটুবানি। কাঁপছে রাগে থরথর করে। চোখ-মুখ লাল হয়ে গিয়েছে ভীষণ। সে আঙুল উঁচিয়ে শাশুড়িকে বলল,
‘আপনে একটা জালিম, অসইব্য, বেদ্দপ মহিলা। আপনের মতন শাশুড়ি থাকলে কোনো মাইয়াই ঘর করতে পারব না।’

আচমকা পুত্রবধূর মুখের এমন শব্দ আশা করেননি জামেলা। সচারাচর তো মেয়েটা চুপই থাকত। অথচ আজ সামান্য ব্যাপারে এতটা চটে গেল কেন?
টুইটুবানির লাগামহীন ভাষায় ধমকে উঠল সোলাইমান,
‘টুইটুবানি, খবরদার। আম্মারে তুমি কী কইতাছো? মুখ সমালাও।’
গগন কাঁপিয়ে দেওয়া সোলাইমানের ধমকে কেঁপে উঠল সকলে। টুইটুবানি আরও উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠল। তার বাবার সাথে এই পরিবার যে ব্যবহার করেছে সেটা সে কোনমতেই ভুলতে পারছে না। তাই তার রাগ পাল্লায় পাল্লায় বাড়ছে। সে সোলাইমানের ধমকের বিপরীতে একরোখামি করে বলল,
‘থাকমু না চুপ। আপনের তো বেহেশত পাওনের লোভ কিন্তু আমার জীবনডা যে নরকে পুইড়া যাইতাছে তা দেহেন না।’

জামেলা আক্তার যেন মোক্ষম সময় পেয়ে গেলেন। ছেলে ও ছেলের বউয়ের মাঝে এমন ঝড় আগে কখনো উঠেনি। তাই আজকের এই মোক্ষম সময়টা উনি ছাড়তে চাইলেন না। বরং মরাকান্না জুড়ে দিলেন। নাটকীয় ভঙ্গিতে রান্নাঘরে ছুটে গিয়ে বটিদা-টা নিয়ে নিজের গলায় ধরলেন। আর আকস্মিক কাজের মানে খুঁজে পেল না কেউ। জামেলা আক্তার কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘সোলাইমাইন্যা, তুই যদি এহনই, এই উডানে দাঁড়াইয়া এই মাইয়ারে তিনবার তালাকা না দেছ তাইলে আমি আমার গলাডা হালায় দিমু।’

বিনা মেঘে যেন বজ্রপাত হলো। হতভম্ব হয়ে গেল সকলে। টুইটুবানি অবাক চোখে তাকিয়ে তারপর উচ্চস্বরে হেসে উঠল। স্বামীর দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
‘নেন, এবার বেহেশতরে বাঁচাইয়া আমারে বিদায় দেন। আপনের আম্মা ম্যালা বছর ধইরাই এই দিনডার অপেক্ষা করছে। আপনার বেহশতের মনের আশা পূরণ হইছে আইজ। হেয় বালা কইরাই জানে, এ দুনিয়ায় হেরে আপনের চাইয়া বেশি ভালো কেউ বাসতে পারে নাই। নেন, মায়ের পোলা মায়ের কাছেই যান। এই জীবনে সবচেয়ে বড়ো দুঃখ কী জানেন? আপনারে আমি বুঝাইতেই পারলাম না যে মায়েরাও অন্যায় করতে জানে। মায়েরাও ভুল হয়।’

চলবে……