বর্ণহীন রংধনু পর্ব-০২

0
192

#বর্ণহীন_রংধনু (পর্ব ২)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

ঘরে স্ত্রী থাকা স্বত্বেও অন্য নারীর বুকে সুখ খুঁজতে ব্যস্ত ফাহাদ। এর মাঝেই রুমের দরজায় ঠকঠক শব্দ করে উঠল। একসাথে দরজার দিকে তাকিয়ে থেমে যায় ফাহাদ-শান্তা দুজনই।
ফাহাদ ক্ষনিকটা কৌতুহলী দৃষ্টিতে শান্তার দিকে চেয়ে বলে,
“বলেছিলে, তোমার বাসায় আসার মতো তেমন কেউ নেই। তাহলে এই অসময়ে কে এলো?”
শান্তা কিছু না বুঝার মতো ভাব করে বলে,
“আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। আচ্ছা সরো, দেখে আসি কে।”
ফাহাদ না সরেই বলে,
“তুমি থাকো। আমিই দেখছি।”

বলেই বিছানা থেকে নেমে দরজার সামনে এগিয়ে আসে ফাহাদ। দরজা খুলে বাইরে থাকাতেই যেন বিদ্যুতের মতো চমকে উঠে সে। চৈতি এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে।
ফাহাদের পরনে শুধুই একটি শর্টপ্যান্ট ব্যতিত আর কিছুই নেই। মনের ভেতর তৈরি হওয়া সন্দেহ সত্য প্রমানিত হতেই বুকের ভেতরটা যেন কোনো ধ্বংসাত্মক আঘাতের ন্যায় কেঁপে উঠল। বিয়ের এত বছরেও মানুষটার এমন দ্বিমুখী অভিনয় একবারের জন্যও বুঝতে পারেনি চৈতি। ভাবতেই বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথার সাথে নিজের প্রতি তীব্র রাগ হচ্ছে তার।

ফাহাদ শুধু অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। যেন বাকশক্তি হারিয়েছে আজ। তাকে উপেক্ষা করে ভেতরে প্রবেশ করে চৈতি। দেখে শান্তা নামের মেয়েটা একটা চাদরে নিজেকে ঢেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

কিছুক্ষণ নিরবতায় পার হলে ফাহাদ ক্ষনিকটা নিচু স্বরে বলে,
“তুমি এখানে কিভাবে চৈতি?”
কোনো উত্তর দিল না চৈতি। পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলে,
“আমার সাথে এমনটা কিভাবে করলে ফাহাদ?”
“শান্ত হও চৈতি। আসো আমরা একটু বসে কথা বলি।”
চৈতি তার দিকে শাম্ত দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
“এত কিছুর পর আমি তোমার সাথে শান্ত হয়ে বসে কথা বলবো, এটা তুমি কি করে ভাবলে?”

কি করবে কিছুই মাথায় আসছে না ফাহাদের। কারণ চৈতিকে সে ভালো করেই চেনে। চৈতি তাকে ক্ষমা করা দুরে থাক, আর কখনো মেনেই নিবে না। কিছুক্ষণ অস্থিরতায় পার হওয়ার পর আচমকাই দেওয়ালের সাথে মিশিয়ে চৈতির গলা চেপে ধরে ফাহাদ। উম্মাদের ন্যায় পরপর কয়েকটা শ্বাস নিয়ে বলে,
“নিজের মান-সম্মান বাচাতে এমনটা করতে হবে আমায়। পরিশেষে বলবো, পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও চৈতি।”

গলা চেপে ধরায় যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে চৈতির। ফাহাদকে ছাড়াতে চেয়েও ব্যর্থ হয়ে আচমরাই ব্যাগ থেকে একটা বোতল বের করে ফাহাদের মুখে স্প্রে করে দেয় সে। দুয়েক সেকেন্ডের মাঝেই জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পরে ফাহাদ। এমন কিছু ঘটতে পারে এটা আগেই আন্দাজ করেছিল চৈতি। তাই আগে থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করেছিল সে।
,
,
জ্ঞান ফিরতেই দুটো চেয়ারে নিজেদেরকে বাধা অবস্থায় দেখতে পায় ফাহাদ ও শান্তা। তারা যেমন ছিল তেমন উলঙ্গ অবস্থায়ই তাদের শক্ত করে বেধে রেখেছে চৈতি।
নিজেদের ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো দুজন। অতঃপর হাল ছেড়ে চৈতির দিকে তাকায় ফাহাদ। পরপর কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে বলে,
“এসব কিভাবে করলে তুমি? জানলেই বা কিভাবে?”

————————–
(দুজনের ঘনিষ্ট ছবি দেখার পর থেকেই সন্দেহ হয়েছিল চৈতির। ক্ষনিকটা শিউর হয়, সেদিন ফাহাদের অফিসে যাওয়ার পর।
ফাহাদের রুম দেখিয়ে দিতে যাওয়া লোকটার পেছনে হাটার পথেই শান্তাকে দেখতে পায়। চৈতি লোকটাকে থামিয়ে শান্তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সে বলে,
“ফাহাদ স্যারের সাথে সম্পর্ক ভালো আছে শান্তা ম্যাডামের। কাজ ও কাজের বাইরে দুজনই খুব ফ্রেন্ডলি চলাফেরা করে। মাঝে মাঝে অফিস ছুটির পর দুজনকে একসাথেই গাড়িতে উঠতে দেখি। অথচ অন্য দিন গুলোতে দুজনের পথ দু’দিকে থাকে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, তাদের দেখে খুব ভালো বন্ধুই মনে হয়।”

একটা তপ্ত শ্বাস নিল চৈতি। কিছু না বলে সামনের দিকে পা বাড়াতেই লোকটা তাকে থামিয়ে বলে,
“আফা শুনুন, আমি আপনাকে এসব বলেছি তা ফাহাদ স্যারকে বলবেন না। পরে বড়ো স্যার এর কানে গেলে আমার চাকরি থাকবে না।”
চৈতি তাকে অভয় দিয়ে বলে,
“আচ্ছা ঠিক আছে। এখন আমাকে পথ দেখিয়ে দিন।”
লোকটা চোখের ইশারায় দেখিয়ে দিল,
“ওই যে, ঐ রুম টা।”

সব শেষে অফিস থেকে ফেরার পথে সেই লোকটাকে ডেকে নেয় চৈতি। অফার করে ফাহাদের সব তথ্য চৈতিকে পৌঁছে দিতে হবে। বিনিময়ে প্রতি তথ্যে দুই হাজার টাকা করে পাবে সে। আর অফার গ্রহন না করলে কিছুক্ষণ আগে তার বলা সব কথা ফাহাদকে বলে দিবে চৈতি।
ক্ষনিকটা বিভ্রান্তিতে পড়ে যায় লোকটা। পরিশেষে দু’দিক ভেবে সিদ্ধান্ত নেয় চৈতির অফার গ্রহন করার। তার পর থেকেই বাড়ায় ফাহাদ ও শান্তার উপর নজরদারি। আর তথ্য পৌছে দেয় চৈতির কাছে।)
————————–

লোকটার মাধ্যমে চৈতি সব তথ্য পেলেও লোকটার নাম প্রকাশ করেনি ফাহাদের কাছে। ফাহাদের করা প্রশ্নে ক্ষনিকটা শান্ত গলায় জবাব দেয়,
“কোনো মিথ্যা চিরস্থায়ী হয় না। একদিন না একদিন সত্য বেড়িয়ে আসবে, এটাই স্বাভাবিক।”

বলেই দুজনের দিকে এক নজর তাকায় চৈতি। নিজেকে শান্ত রাখার অভিনয় করে চললেও বুকের ভেতর যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে তার। একটা শ্বাস নিয়ে ফাহাদের উল্টো দিকে ফিরে লুকিয়ে চোখের জল মুছে পূনরায় স্বাভাবিক ভাবে ফিরে তাকায় চৈতি। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন করে,
“কবে থেকে আমার সাথে এমন প্রতারনা করে এসেছো?”

ফাহাদ নিশ্চুপ থাকলে চৈতি পূনরায় বলে,
“চুপ করে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। সত্যটাই বলে ফেলো। কষ্ট পাবো না আমি। জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্টটা তো পেয়েই গেলাম ইতিমধ্যে।”

কয়েক সেকেন্ড নিরবতায় কাটলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই।

(শান্তার সাথে ফাহাদের অবৈধ সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল চৈতির প্রেগন্যন্সির সময় থেকেই। ফাহাদ না চাইতেও চৈতির থেকে দুরে রাখতে হতো নিজেকে। তাদের এই সাময়িক দুরুত্বটা যেন মেনে নিতে পারেনি ফাহাদ। এদিকে অফিস কলিগ হওয়ায় শান্তার সাথে ভালোই সম্পর্ক ছিল তার। শান্তা নিজেও বিবাহিত ছিল। বছর খানেক আগে ডিভোর্স হয়েছিল তার। একাকিত্ব তাকেও গ্রাস করে নিয়েছিল একটু একটু করে। সব মিলিয়ে দু’জনের এই ফ্রেন্ডলি সম্পর্কটা এক সময় অবৈধ ফিজিক্যাল সম্পর্কে রুপ নেয়।)

বেশ কিছুক্ষণ নিরব রইল ফাহাদ। অতঃপর ফাহাদ মাথা নিচু করে জবাব দেয়
“তোমার প্রেগন্যন্সির সময় থেকে।”
কথাটা যেন তিরের মতো করে বিঁধল চৈতির বুকে। চোখ বুঁজে নেয় চৈতি। ঐ সময় গুলো যেন চোখের সামনে ভেষে উঠছে তার। যখন ফাহাদ অফিস থেকে ফিরেই নানান ভাবে চৈতির যত্ন নিতো। নিজ হাতে খাইয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে মাঝ রাতে উঠে চৈতির হাতের তালু ও পায়ের তালু মালিশ করে দেওয়া কিছুই বাদ রাখেনি সে। নিজের চাহিদাকে এক মুহুর্তের জন্যও প্রকাশ করেনি ফাহাদ। এসব দেখে নিজেকে খুব ভাগ্যবতি মনে হয়েছিল চৈতির। কত সুন্দর ছিল সেই সময় গুলো। অথচ কে জানতো, অন্য নারির কাছে নিজের চাহিদা পুরণ করে ঘরে এসে একজন দায়িত্ববান স্বামীর অভিনয় করতো সে।

ওসব ভাবতেই আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না চৈতি। হু হু করে কে়ঁদে উঠে ফাহাদের দিকে চেয়ে। হৃদয়টা যেন জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে তার।
নিরবে কেঁদে চলছে চৈতি। নিশ্চুপ হয়ে নিচের দিকে চেয়ে আছে ফাহাদ। এই রাতের সুনশান নিরবতার মাঝে যেন চৈতির নিরব কাঁন্নাই যেন শোনা যাচ্ছে চারপাশ জুড়ে।

এর মাঝেই ফোনটা বেজে উঠে চৈতির। পূনরায় নিজেকে শাম্ত করার চেষ্টা করে চোখের পানি মুছে নেয় চৈতি। ফোন হাতে নিয়ে দেখে তিথি আপুর কল। রিসিভ করতেই বলে উঠে,
“কিরে, আর কতক্ষণ লাগবে তোর? ফাহিম কিছুক্ষণ পর পর কাঁদছে। চেষ্টা করেও সামলাতে পারছি না আমি।”

স্পিকার অন করতেই ওপাশ থেকে তাদের একমাত্র ছেলে ফাহিমের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো কানে। কয়েক সেকেন্ড কান্নার আওয়াজ শুনেই ফলন কেটে দিল চৈতি।
ফাহাদের দিকে চেয়ে বলে,
“শুনতে পাচ্ছো? আমাদেরই সন্তান। সেও অপেক্ষায় আছে, কখন তার বাবা-মা গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিবে। আদরে আদরে ভরিয়ে দিবে তাকে। সে কাঁদছে, কারণ সেও জানে তার কান্না থামানোর জন্য তার দুজন বাবা-মা আছে। আমার ভালোবাসার মূল্য তুমি নাই বা দিলে। এই নবজাতকে ছেলেটির জন্যও কি একটু করুনা হয়নি তোমার?”

নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে রইল ফাহাদ। এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই তার কাছে। একটা তপ্ত শ্বাস ছাড়ে চৈতি। ব্যাগ থেকে ধাড়ালো ছুরিটা বের করে চেপে ধরে ফাহাদের গলায়। কাঁন্না ভেজা চেহারা মুহুর্তেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে যেন।

ফাহাদ চোখ তুলে তাকায় চৈতির দিকে। করুন গলায় বলে,
“মেরে ফেলবে আমায়, তাই না?”
কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ থাকে চৈতি। অতঃপর ফাহাদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
“আজ তোমার জায়গায় আমি, আর আমার জায়গায় যদি তুমি হলে কি করতে? একবার নিজেকে প্রশ্ন করে উত্তর দাও দেখি। হয়তো, তোমার উত্তরই আজ তোমার ভাগ্য নির্ধারণ করবে।”

To be continue………………..

~ ভূল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।