বসন্তপবনে প্রেমছন্দ পর্ব-৩১+৩২

0
2

#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
৩১.
ঝড়ের বেগে কথাটা কানে পৌঁছে গেছে নিভার। তার থেকেও বেশি বেগে নিভা এসে দাঁড়িয়েছে দোরগোড়ায়। টিকলি অসহ্য চোখে টায়রার দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা আসার আধ ঘন্টার মাঝেই নিভা এপার্টমেন্টে এসে হাজির। টিকলি ভ্রূ কুটি করে জিজ্ঞেস করলো,

‘কি দেখতে এসেছিস তোরা?’

‘এই তোদের রোমান্টিক মূহুর্ত। কীভাবে তোরা মিল হলি তাই দেখতে এলাম।’

টিকলি ফুঁসে উঠলো, ‘কি বললি?’

নিভা তৎপরতার সহিত বলে, ‘বললাম তোর পা। তোর পা দেখতে এসেছি।’

‘ আমার পায়ে তেমন কিছু হয়নি। যা।’

টায়রা আর পেটের কথা চেপে রাখতে পারে না। বেহায়া মুখে বলে ফেলে, ‘তাহলে ভরা রাস্তায় ভাইয়ার কোলে চরে এলি কেনো?’

টিকলি বেকায়দায় পরলো। লজ্জায়, অস্বস্থিতে জড়োসড়ো হয়ে বসলো। নিজের স্বামীর কোলে উঠে সে মহাপাপ করে ফেলেছে। কোলে উঠার সময় থেকে পদে পদে পাওয়া লজ্জায় নুইয়ে পরছে। এদিকে আদরের দেখা নেই। ওই ঘরে গিয়ে দোর দিয়ে বসে আছে যেনো সে বিরাট কোনো অন্যায় করে ফেলেছে। ভরা রাস্তায় ছোট ভাই এবং ভাইয়ের বউয়ের সামনে কোলে নিয়ে ইহজন্মের মস্ত বড় পাপটা করে ফেলেছে।

একটু পর দৈবারিক মনোয়ারা খানের দেখাও পাওয়া গেলো। টিকলি আধশোয়া থেকে উঠে বসে পরনের কাপড় টেনেটুনে ঠিক করলো। অতঃপর বিস্ময়ের সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে টায়রার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলে ফেলল,

‘মা আপনি?’

মনোয়ারা খান যেনো টিকলির চেয়েও বিস্ময়ের অতল সাগরে ডুবে গেলো। তার পেছনে আর্দ্র আর দরজার ওপাশে আদর দাঁড়ানো। আদর হালকা কেশে সরে গেলো। টিকলি বুঝতে পেরে চোখ বড় বড় করে মাথা নিচু করে নিজেকে তিরস্কার করে গেলো। এইসময়-ই এতো সোহাগ নিয়ে মা বলে ডাকতে হলো? যদিও আগে ডেকেছে তবে আজকের ডাকে ছিলো প্রফুল্লতা, স্ব-ইচ্ছা। মনোয়ারা খান খুশিতে গদগদ হয়ে পরলেন। টিকলির থুতনি ধরে চুমু খেলেন। আহা! কী মধুর শোনালো! টিকলিকে ভালোমতো আদর-যত্ন করে, খাবার-দাবার খাইয়ে মনোয়ারা খান সবাইকে নিয়ে চলে এলেন।

ফ্ল্যাটে পরে রইলো শুধু একা আদর আর টিকলি। ওরা সবাই গেলো রাত আটটার দিকে। অথচ ওপাশের ঘরের জলজ্যান্ত আদর টিকলির কাছে এলো না ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে। লজ্জায় নাকি জড়তায় নাকি অপ্রসন্নতা টিকলি জানে না। তবে তারও নিজেকে ধাতস্থ করতে… নিজের সংকোচ কাটাতে একটু সময়ের দরকার ছিলো। তাৎক্ষণিক আদরের মোকাবেলা করার মতো প্রস্তুতি ছিলো না বৈ কি! এই দুই তিন ঘন্টা সেও দরজা আটকে নিজেকে স্থির করলো। অব্যাখ্যাত নিমিত্তে বুকে ধামাধাম শব্দ হচ্ছে। টিকলি বার কয়েক জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে দরজা খুললো।

কিন্তু একি? ওমা! ফ্ল্যাটে তো কেউ নেই। টিকলি আনাচে কানাচে খুঁজে। কোথাও নেই। ক্লান্ত চিত্তে বিষন্ন মুখে গাল ফুলিয়ে টিকলি ড্রইংরুমের সোফায় বসে ওভাবেই শুয়ে হাত বিছিয়ে দেয়। আদর না বলে চলে গেলো কেনো? লজ্জা পাচ্ছে? টিকলিকে সবার সামনে সরি বলেছে এই লজ্জা? টিকলি দুষ্টুভাবে হেসে মুখ আড়াল করে। হাত-পা নাঁচিয়ে নিজের লাজ প্রকাশ করে বাচ্চাদের মতোন।

মিনিট দশেক বাদে দরজায় শব্দ হলো। দরজা খুলে কেউ প্রবেশ করলো। এসে ঠিক টিকলির মাথার কাছে বসলো। টিকলি মাথা তুলে তাকায়। তাকিয়ে আবার সোফায় মুখ গুঁজে দেয়। এরপর আবার তাকায়। উঠে বসে। ঠোঁট উলটে বলে,

‘কোথায় গিয়েছিলেন?’

‘আপনার শশুড়বাড়িতে।’

টিকলি আবার লজ্জা পায়। লজ্জায় হাত দিয়ে মুখ ঢাকে। আদর বড় করে হাসে শব্দ বিহীন। টিকলির গাল চেপে বলে,

‘আপনি যে এতো কিউট আগে তো জানতাম না।’

বলে হাতে থাকা আইসক্রিম টিকলির হাতে তুলে দেয়। টিকলি আইসক্রিম দেখে খুশি হয়ে যায়। এই গরমে এটার এ মূহুর্তে ভীষণ দরকার ছিলো। আদর অনেকগুলো এনেছে। পলিথিন ভর্তি করে। সেগুলো ফ্রিজ বোঝাই করে রাখলো। টিকলি বলে,

‘আমি একা খাবো?’

‘হু। আমি আইসক্রিম খাই না জানেন না?’

টিকলি মিষ্টি করে হাসে, ‘জানি তো। আমার থেকে এক কামড় খান। নিন।’

আদর নাকচ করে না। বিনাবাক্যে এক কামড় খেয়ে টিকলির পাশে বসে শান্তশিষ্ট ভাবে। টিকলি খেয়ে যাচ্ছিলো নিমগ্ন হয়ে। আদর পকেট হাতড়ে কিছু জিনিস বের করলো। এরপর ওর গলায় একটা স্বর্ণের চেইন পরিয়ে দিলো। কানে ছোট্ট স্বর্ণের দুল। নাকে মাঝারি আকারের একটা স্বর্ণের নাকফুল পরালো। দুই হাতে দুটো চিকন চুড়ি পরিয়ে দিলো। তারপর…. পরিয়ে দিলো সেই টিকলিটা। টিকলি খাওয়া ছেড়ে স্তম্ভিত হয়ে আদরের কান্ডকারখানা দেখলো। কপালে হাত দিলো। বিস্মিয়ের সাগরে ডুবে গিয়েও আদরকে কোনো প্রশ্ন করলো না। বুঝে গেলো এসব আনতেই আদর ‘খান বাড়িতে’ গিয়েছিলো। মিনিট দুয়েক বাদে আদরকে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো,

‘শাড়ি পরবো?’

আদর তৎক্ষণাৎ টিকলিকে কোলে তুলে নেয়। টিকলি আদরের গলা জড়িয়ে ধরতেই আদর বলে নির্মল, হীমশীতল, গা শিরশিরে কণ্ঠে,

‘আমি পরাবো।’

টিকলি হাসে। আরেকটু শক্ত করে আদরের গলা জড়িয়ে ধরে। আদর টিকলির কপালে টিকলির উপরে চুমু খায়। চোখ বন্ধ করে একাগ্র মনে মগ্ন হয়ে টিকলি তা উপভোগ করে। ঘরের দিকে কদম ফেলে আদর বলে,

‘এবার না আদর খানের বউ বউ লাগছে!’

‘কেনো? এতোদিন কি আমি ডাঃ আরাফ হোসেনের বউ ছিলাম?’

টিকলির কণ্ঠে শয়তানি। আদর চোখ পাকিয়ে মেজাজ গরম করে বলে,

‘বাজে কথা বলবেন না। একদম ফেলে দিবো।’

‘দিন না! তারপর নিজেই আবার কান্নাকাটি করে বলবেন সরি টিকলি। সবকিছুর জন্য সরি। আপনাকে ফেলে দেওয়ার জন্য সরি। আপনার কোমর ভাঙ্গার জন্য সরি।’

বলে টিকলি ঘর কাপিয়ে হাসে। আদর চোখ ছোট ছোট করে টিকলিকে ছেড়ে দেওয়ার ভান করে ওমনি আদরের গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ মুখ কুচকে টিকলি তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠে। আদর টিকলির ভুবন ভুলানো শব্দমিশ্রিত হাসি দিয়ে নাকের সাথে নাক ঘষে। টিকলি মিষ্টি করে হেসে বলে,

‘ওই মেরুন রঙের শাড়িটা পরতে চাই।’

আদরের ভ্রু খানা বেঁকে গেলো। ত্যাড়া গলায় বলল, ‘বিয়েতে যখন পরেননি এখন আর পরতে হবে না।’

‘তখন তো জেদ করে পরিনি।’

আদর টিকলির দিকে তাঁকায় মাদকতার পাগলপনা চোখে। সেই চাউনির দিকে চেয়ে ধরিত্রীর বুকে যাবতীয় সমস্ত মগ্নতা ভুলে যায় টিকলি। কেবল মনে থাকে ওই দুটো চোখের আদুরে বিষাসক্তি। দুটি হৃদয়ের সমীপে আসা… চোখে চোখ রাখা… ভালোবাসি বলা। এরপর অন্তক্ষরার বিন্যাস স্থিত রাখার ন্যায় অন্তরিন্দ্রিয়’র লাব-ডাব বাজনা গিয়ে গড়ালো অন্তরিক্ষ অবধি। সেই জলের ধারা গিয়ে গড়ালো বহু দূর অবধি। এরপর কেউ কোনো শব্দ করলো না…. ঠোঁটে ঠোঁট মিললো…. অঙ্গের ভাঁজে ভাঁজে চিহ্ন টেনে দিলো….স্পর্শে স্পর্শ টের পেলো… গায়ের বস্ত্রগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরলো এদিক সেদিক। গরমের উত্তাপ উবে গিয়ে উত্তাল হাওয়া হুরহুর করে প্রবেশ করে অভ্যর্থনা জানালো। পবনের স্নিগ্ধতা টের পেয়ে কেঁপে উঠে আদরকে খামচে ধরলো টিকলি।

,
তখন কালো নিশীথ রাত্রের আড়াইটা বাজে। টিকলি গাল ফুলিয়ে দু’হাটু মুড়ে বিছানার এক কোণায় বসে আছে। চুল থেকে টপটপ করে ঝরছে পানি। আদর যত্ন নিয়ে তা মুছে দিতে দিতে প্রশ্ন করলো,

‘কোনো সমস্যা হচ্ছে? মন খারাপ কেনো?’

টিকলি জবাব দেয় না। আদর আবার বলে ভ্রু নাঁচিয়ে, ‘লজ্জা পাচ্ছেন?’

জবাব আসে না।

‘শরীর খারাপ লাগছে? ঘুমিয়ে যান। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।’

টিকলি জবাব দেয় না। আদর কাধে, পিঠে নিজের ক্ষত দেখিয়ে বলে,

‘দেখুন! কি করেছেন! জ্বলে যাচ্ছে।’

টিকলি চোখ মেলে তাকালো। তৎক্ষণাৎ আদরের উন্মুক্ত পিঠের আচড়ে স্পর্শ করে বলল,

‘জ্বলছে? ইশশ… মলম লাগিয়ে দিবো?’

‘লাগবে না। কি হয়েছে আপনার সেটুকু বললেই চলবে।’

টিকলি আবার নিজের ফর্মে ফিরে যায়। গালে আধ মণ চাল ভিজিয়ে থমথমে গলায় বলে,

‘আপনাকে বললাম শাড়িটা পরবো। আপনি তো আমাকে পরার সুযোগই দিলেন না। এভাবে চেয়েছিলাম আমি?’

‘সমস্যা নেই আবার বাসর হবে। সুন্দর করে ঘর, বিছানা এবং আপনাকে সহ সাজিয়ে।’

আদর চোখ টিপে। টিকলি ভ্রু কুৃঁচকে অন্যদিকে তাকায়। আদর ওর মুখোমুখি বসে। মাথাটা উঠিয়ে নাকে চুমু খায়। বলে,

‘ঠিকাছে, চলুন। এখন পরুন।’

‘পরে কি লাভ?’

‘আমি দেখবো মন ভরে। তারপর আপনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যাবো।’

টিকলি হেসে ফেলে, ‘আসলেই? সত্যি পরবো? কিন্তু আমি তো শাড়ি ঠিকমতো পরতে জানি না।’

‘আমি আছি তো। হেল্প করবো।’

‘আপনি শাড়ি পরাতে পারেন?’

‘পারি না কিন্তু একরকম ভাবে পরলেই হলো আমিই তো দেখবো অন্যকেউ তো আর দেখছে না। আমার বউ আমার কাছে সবভাবে বিশ্বসুন্দরী।’

টিকলি মোহনীয় ভাবে হাসলো। আদর ওভাবেই ওর ঠোঁটে চুমু বসালো। মুগ্ধ স্বরে বলল,

‘শরীর থেকে গয়না-গাটি একদম খুলবেন না। বিশেষত নাকফুল আর চুড়ি।’

‘কেনো?’

‘এসব পরলে নাকি মেয়েদের বউ বউ লাগে। তখন আর কেউ চোখ তুলে তাকাবে না। এমনেই যে অবস্থা! যেভাবে পেলাম আপনাকে!’

টিকলি ঘর কাঁপিয়ে হেসে আদরকে জড়িয়ে ধরে। আদর টিকলিকে কোলে নিয়ে সেভাবেই উঠে দাঁড়ায়। টিকলি আলমারি থেকে শাড়ি বের করে। অতঃপর বাকি রাতটুকু দুজন শাড়ি পরা নিয়ে যুদ্ধ করে নিজেদের মূহুর্তগুলো ক্যামেরা বন্দী করে ভোর বেলায় ঘুমোতে যায়। সেই জৈষ্ঠ্যের ঊষালগ্নের রং ছিলো শান্ত, কোমল অথচ রক্ত লাল বর্ণের। পূর্ণতার প্রথম প্রভাতের সূচনালগ্নে, ওদের জানালো আন্তরিকভাবে স্বাগতম নতুন জীবনে।

চলবে❤️

#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
৩২.
কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম আভায় মিলেমিশে তপ্ত রোদ্দুরে লালাভ হয়ে ওরা শহর চষে বেড়ালো। টিকলি আদরের হাত’টা জড়িয়ে ধরলো। পরনে আদরের পছন্দ করা শাড়িটা। আদর ঠোঁটের একপাশ টেনে হাসলো। টিকলি আদুরে গলায় শুধালো,

‘আজ আমাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম ডেইট।’

আদর মাথা ঝাঁকায়, ‘হু। আমরা কি কি করবো?’

‘হাটবো, খাবো, ঘুরবো, অন্যকিছুও করতে পারি।’

আদর ভ্রু নাঁচায়। দুষ্টুমি কণ্ঠে বলে, ‘অন্যকিছু কি?’

টিকলি লজ্জায় মিইয়ে যায়, ‘অন্য অনেক কিছু। এই যেমন বৃষ্টিতে ভেজা।’

আদর আকাশ পরখ করে বলে, ‘বৃষ্টি আসবে বলে মনে হয় না।’

‘আসতে পারে। বাতাস ছেড়েছে। রোদের তাপ কমে আসছে।’

ওরা উদবাস্তুর মতো এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ালো। টিকলি আদরের চুল ঠিক করে দিতে দিতে ফিক করে হেসে দিয়ে বললো,

‘ওরা এসব দেখলে তো অজ্ঞান হয়ে যাবে, বাদর সাহেব। বলবে, কীরে তোদের এতো প্রেম? ডেটে গিয়েছিলি অথচ একবার জানালি না? আমাদের কি কাপল বলে মনে হয় না? শুধু তোরাই শীর্ষ কপোত-কপোতী?’

‘ঠিক বলেছেন, মিস টিকটিকি। ওহ সরি মিসেস।’

টিকলি নাক ফুলানোর ভঙ্গি করে গাল ফুলিয়ে বলে, ‘আমাকে টিকটিকি ডাকবেন না।

‘আপনি আমাকে বাদর ডাকলেন কেনো?’

‘সে তো আদর করে আদরকে বাদর ডেকেছি।’

আদর টিকলির গাল টেনে দিয়ে বলল, ‘আমিও তো আদরের আদর দিয়ে টিকলিকে টিকটিকি ডাকলাম।’

‘উফফ… এতো জোরে গাল টানে কেউ? ব্যথা পেলাম না?’

‘আসুন। চুমু দেই।’

‘লাগবে না। মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালান।’

‘আপনাকে পাশে রেখে তো অন্যকিছুতে মনোযোগ আসে না।’

‘কয়দিনের ছুটি যেনো নিয়েছেন আপনি?’

‘আজকের দিন’টাই।’

‘তাহলেই বুঝুন আপনার মনোযোগ কোন দিকে। মানুষ নতুন বিয়ে করলে এক মাসের ছুটি নেয়।’

‘এক মাস? কে নিলো?’ আদর অবাক হওয়ার ভান করে। টিকলি দাঁত খিচে তাকায়।

‘এক মাস না হোক। অন্তত সাতদিনের তো নেয়।’

‘আমি কি আর নতুন বিয়ে করেছি?’

টিকলি ভ্রু কুচকালো, ‘নতুন না মানে? কয়মাস হলো বিয়ে করেছেন? দুই মাসও হয়নি এখনো এর মাঝেই পুরাতন হয়ে গেছি? দুই বছর গেলে তো বলবেন পুরোনো হয়ে জং ধরে গেছে। বাতিলের খাতায় পরে যাবো।’

আদর জিহ্বায় কামড় দিয়ে ডানে-বামে মাথা নেড়ে অভিনয় করে বলে,

‘ছি ছি! তওবা! আস্তাগফিরুল্লাহ! দুই বছর কেনো দুইশ বছর পরেও আপনি আমার কাছে নতুন বউ থাকবেন। আজ থেকে বিশ বছর পরে গিয়েও যদি আপনি এই লাল শাড়িটা পরেন আমার কাছে তখনো মনে হবে আমি নতুন বিয়ে করেছি। তারপর বউয়ের মান ভাঙাতে একটা সরি বলে বাসর করে ফেলবো।’

বলে আদর হু হা করে হেসে উঠলো। টিকলি আদরের বাহুতে হালকা হাতে চাপর মারলো। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে সলজ্জে মুচকি মুচকি হাসলো। আকাশ ডেকে উঠলো মেঘ ভাঙিয়ে হুড়মুড় করে বর্ষণের ধারা নেমে এলো। টিকলি, আদর গাড়ি ছেড়ে নামলো। ফাঁকা রাস্তায় দু’হাত মেলে ভিজলো। আদর টিকলির বিভিন্ন স্টাইলে ছবি তুলে দিলো। একজন রিক্সাওয়ালা মামার হাতে ফোন দিয়ে ওদের নিজেদের একসাথে কিছু মূহুর্ত মুঠোফোনে বন্দি করে নিলো।

সেই বৃষ্টির মুক্তোর দানার ন্যায় শুভ্র ধারা টিকলির মুখ চুইয়ে পরতেই টিকলিকে দেখালো আশ্চর্য লাস্যময়ী… চিত্তাকর্ষক সুন্দরী। আদর দেখে গেলো পলকবিহীন ওই কপোল বেয়ে… ললাট ছুইয়ে.. অধর স্পর্শ করে… থুতনি চুইয়ে পরা নীরের ধারাপাতের দিকে। টিকলির গাল স্পর্শ করে মনোমুগ্ধকর, স্থিতপ্রজ্ঞ, ধীর স্বরে শুধালো,

‘আপনার মনে আছে আমি কীভাবে প্রথমবার আমার ভালোবাসার কনফেশন জানিয়েছিলাম?’

টিকলি হাসলো। জুতো জুড়ো খুলে রাখলো পাশে। আদরের পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রাখলো। গলায় দু’হাত বেধে বলল,

‘In the end of rain, The love is beginning.’

‘আমি আবার বলতে চাই… বলে আদর এদিক সেদিকে তাকায়। নির্জন রাস্তায় ঝুম বৃষ্টির বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে উচ্চস্বরের গানে দিন অন্ধকার করে আকাশের গমগম আওয়াজে ডেকে উঠা। আদর সযত্নে টিকলির মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে দিলো। টিকলিকে মুগ্ধতার সাগরে ভাসিয়ে স্নিগ্ধ, শান্ত, এই বৃষ্টির ধারার ন্যায় বিশুদ্ধ স্বরে ফিসফিস করে বলল,

‘In the air of spring, The love is beginning.’

টিকলি মুচকি হেসে সতর্কদৃষ্টি আশেপাশে তাকিয়ে আদরের পায়ের উপর থেকে পা নামায়। উজ্জ্বল হাসি দিয়ে বলে,

‘ভালো বলেছেন তো! আমাদের বিয়েটাও কিন্তু বসন্তের শেষদিনে হয়েছিলো।’

‘হু। মনে আছে। এবার চলুন তাড়াতাড়ি। জ্বর আসবে।’

গাড়িতে উঠে বসতে বসতে টিকলি বলল, ‘কোথায় যাবো?’

‘কোথায় যেতে চান?’

‘মায়ের কাছে চলুন।’

‘আপনার বাড়িতে যাবেন এখন?’

‘না,আপনার বাড়িতে। ওই মায়ের কাছে যাবো।’

,
দোরগোড়ায় ভিজে নেতিয়ে যাওয়া আদর-টিকলিকে দেখে মনোয়ারা খান হায়হায় করে উঠলেন,

‘একি! তোরা এভাবে ভিজে কোথা থেকে আসলি? আয় মা। আয়।’

মনোয়ারা খান টিকলিকে ভেতরে নিয়ে বসিয়ে একটা তোয়ালে নিয়ে এসে মাথা মুছে দিতে লাগলেন। উচ্চস্বরে টায়রাকে বললেন,

‘টায়রা, তোর এক সেট জামা-কাপড় নিয়ে আয় তো।’

টায়রা মিনিট খানেকের মাথায় নিজের জামা এনে টিকলির হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে জহুরি নজরে তাকালো,

‘দেখে তো মনে হচ্ছে ইচ্ছে করে ভিজেছিস। এই, সত্যি করে বল। ঘুরতে বের হয়েছিলি তোরা না?’

টিকলি টায়রা দিকে তাকিয়ে জোকার মার্কা একটা হাসি দেয়। টায়রা মাথায় হাত দিয়ে বলে,

‘নিমোকহারাম রে! এই ছিলো তোর পেটে? কাল মিল মহব্বত হয়ে আজই জামাই নিয়ে ঘুরতে বের হয়ে পরেছিস! একটা বার বললিও না। কেনো রে? বললে কি তোর শাড়ির আচঁল টেনে ধরে তোর সাথে নিয়ে যেতে বলতাম? নাকি তোর বরের পকেটে ঢুকে যেতাম? দাড়া, নিভাকে বলছি।’

টায়রা টিকলিকে কোনো কথার উত্তর দিতে না দিয়ে নিভাকে ফোন দিতে গেলো। মনোয়ারা খান যত্ন করে টিকলির মাথা মুছে দিতে দিতে বললেন,

‘এসেছিস খুব ভালো করেছিস। কি খাবি বল?’

মনোয়ারা খানের তুই ডাক শুনে টিকলি মৃদু হেসে মনোয়ারা খানকে ঝাপটে ধরে বলল,

‘তুমি কি খাওয়াবে সেটা বলো!’

‘আরে কি করছিস! ভিজে গেলাম যে আমি!’

‘একটু ভিজলে কিছু হবে না। চলো ছাদে গিয়ে আমরা আরেকবার বৃষ্টি বিলাস করে আসি।’

‘জ্বর আসবে।’

‘ইশশ… তোমাদের মা ছেলের এক কথা।’

মনোয়ারা খান টিকলির দিকে একদৃষ্টিতে কতক্ষণ চেয়ে থেকে ওর থুতনি ধরে চুমু খেয়ে বললেন,

‘তুই আমার খুব শখের বউমা।’

টিকলি মনোয়ারা খান কে আবারো ঝাপটে ধরে বলল,

‘তুমিও আমার খুব শখের শাশুড়ি সাথে তোমার ছেলেটাও।’

শেষ কথা টিকলি ফিসফিসিয়ে জানায়।

_________________
আষাঢ় মাস পরেছে। নিভার সাড়ে চার মাস চলছে। এর মাঝে একদিন টায়রা পোটলা পাটলি গুছিয়ে টিকলির এপার্টমেন্টে এসে হাজির হয়েছে। টায়রা-আর্দ্রর মাঝে কেস এবার সিরিয়াস। তুমুল ঝগড়া লেগেছে দু’পক্ষের। আর্দ্রর এক্সের সাথে কথোপকথন ধরা পরেছে। টায়রা থমথমে মুখে ভেতরে ডুকলো। হাতে একটা মাঝারি সাইজের ট্রলি। টিকলি একটা ক্লান্ত শ্বাস ফেলে। আর্দ্র তাকে ফোন করে সব বলেছে। টায়রা মনমরা হয়ে বসে থাকার কিছুক্ষণ পর রাহুল এসে নিভাকে দিয়ে গেলো। মেয়েটার এতো জেদ বেড়েছে! রাহুল সামলাতেই পারছে না। রাহুলের কোনো ‘না’ পরোয়া করছে না এই মেয়ে।

রাতের দিকে আদর বাড়ি ফিরলো। ফ্রেশ হয়ে জামা-কাপড় বদলে টিকলির কাছে যাবে। গত দুইদিন টিকলির সাথে তার দেখা হয়নি। হসপিটালেই রাত কাটিয়েছে। এখন রুমে ঢুকে দেখে আর্দ্র চিৎপটাং হয়ে, ছ্যাকাখোর প্রেমিকের ন্যায় বিষন্ন মুখে আদরের বিছানায় শুয়ে গেমস খেলছে। আদর ভ্রু কুচকালো,

‘কি ব্যাপার?’

‘এবার অনেক বড় ব্যাপার ভাইয়া। টায়রা বাড়ি ছেড়ে, আমার মতো মাসুমকে মেরেধরে চলে গেছে।’

আদরের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। বিস্ময়ে বলল, ‘কোথায়? কেনো?’

‘আরে আর বলো না আমার লাস্ট গার্লফ্রেন্ড’টা আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছে। শালী মেসেজ পাঠায়ছে তো পাঠাইছেই তাও আবার চুমু দেওয়াদ ইমুজি দিয়ে লিখেছে ‘আই মিস ইউ মাই বেইব’। বলো কেমন’টা লাগে? ভাগ্যের কি খেলা ফোনটা তখন টায়রার হাতে ছিলো।’

‘তারপর চলে গেলো?’

আর্দ্র দুঃখে জর্জরিত হয়ে গেলো,

‘হ্যাঁ, ভাইয়া। আমার এক্সপ্লেনেশন তো শুনলই না বরং নিজের মতো করে ঝেড়ে আমাকে ফেলে চলে গেলো। ওকে বুঝাতেই পারলাম না আমি ইনোসেন্ট। ওকে পাওয়ার পর কারোর সাথে কোনোরকম যোগাযোগ কিংবা সম্পর্ক নেই আমার। ওর এক কথা আমার ফ্রেন্ডলিস্টে মেয়েটা কি করে? আমি যে আনফ্রেন্ড করতে ভুলে গিয়েছিলাম এ কথা বিশ্বাসই করলো না। আমি এখন রাতে ঘুমাবো কি করে ভাইয়া?’

আর্দ্র বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে মায়াকান্না কাঁদলো ছোট মানুষের ন্যায়। এদিকে আদর পরেছে আরেক মুসিবতে! কপালে ভাঁজ ফেলে চিন্তা করছে সে এখন টিকলির কাছে যাবে কীভাবে? গেলেই তো ওরা পেছনে লাগবে। এদিকে বউয়ের মুখটা দুদিন ধরে না দেখে আদর শরীরে শক্তি পাচ্ছে না। ইশশ… মহা ঝামেলা তো!

বহু ভাবনা-চিন্তা শেষে আদর ঠিক করলো সে যাবে। অন্যের বউয়ের কাছে যাচ্ছে নাকি? নিজের বউয়ের কাছে যেতে আর ভয় কীসের! কিন্তু যাওয়ার পর আদর যা ভেবেছিলো তাই। টায়রা, নিভা মুচকি মুচকি হাসছে ওকে দেখে। টায়রা তো বলেই ফেলল,

‘ভাইয়া আমি এসেছি বলে মাইন্ড খেয়ে বসবেন না আবার। আমার কিচ্ছু করার নেই।’

নিভাও টায়রাকে অনুসরণ করে থমথমে মুখে বলে,

‘আমারও কিচ্ছু করার নেই। আমার বান্ধবীর কপালে এতো বড় বিপদ! সতীন জুটে যাচ্ছে ওর।’

বলতেই টায়রা কটমট করে নিভার দিকে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘হে আল্লাহর বান্দা! শুধু পেটে বাচ্চা নিয়ে ঘুরছিস বলে পদে পদে বেঁচে যাচ্ছিস।’

এরমাঝে কলিংবেল বেজে উঠলো। টায়রা দরজা খুলেই দেখলো আর্দ্র দাঁড়িয়ে। চোখ পাকিয়ে আর্দ্রর দিকে চেয়ে সরে এলো। আর্দ্র ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো, ‘ভাইয়া, তুমি আমাকে ফেলে চলে এলে কেনো?’

টায়রা ততক্ষণে পাশের ঘরে চলে গিয়েছে। আর্দ্র আড়চোখে তা দেখে ওই ঘরে ছুটে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। আদর হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এবার আর কেউ তাকে বিদ্রুপ করবে না। আদর বিরবির করলো,

‘নির্লজ্জ! বড় ভাইয়ের সামনে কীভাবে দরজা লাগিয়ে দিলো দেখো!’

আবার কলিংবেল বাজে। টিকলি ওর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে খুলতে যেতে যেতে বলে, ‘আমি সিউর এবার রাহুল ভাই।’

কথা সত্য! রাহুলই। বউ জানিয়ে দিয়েছে আজ সে থেকে যাবে।রাহুল বউ ছাড়া রাত পার করবে কীভাবে? তাই চলে এসেছে। রাহুল এসে নিভাকে ধরে ওর হাল-চাল জিজ্ঞেস করতে করতে আরেক রুমে গেলো। টিকলি আদরের দিকে ভ্রু টান টান করে বললো,

‘দেখে শিখুন। সব বউ পাগল। বউকে ছাড়া এক রাত থাকতে পারে না। আর আপনি বউয়ের সাথে এক রাত ঠিকমতো থাকতে পারেন না।’

বলে টিকলি হনহন করে নিজের রুমে ঢুকলো। আদর ওর পেছন পেছন যেতে যেতে মিনমিনে কণ্ঠে বলে,

‘বউয়ের সাথে থাকতেই তো এলাম। বউ তো পাত্তা দিচ্ছে না। আমার বউ আমার মন বুঝে না।’

‘লাইনে লাইনে বউ বউ করলেও এতে আমি গলছি না।’

চলবে❤️