#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
১৪.
রৌদ্রে গা ভিজিয়ে আদর নির্বিকার মুখে পা ফেলছিলো বিরতিহীন। হাতে ধরে রাখা টিকলির হাত। তালু গরম করা রৌদ্রের তেজী শুভ্র রৌপ্য ঝিলিকে টিকলি অপর হাত কপালে রাখলো ছাউনির ন্যায়। পেছন ফিরে তাকিয়ে একবার দেখলো। ওরা কম করে হলেও বিশ ত্রিশ সিড়ি দূরে। টিকলি থেমে দাঁড়ালো। টান লেগে দাঁড়িয়ে পরলো আদরও। প্রশ্ন করতে হলো না। টিকলির দিকে তাকাতেই টিকলি দুর্বল স্বরে বলল,
‘একটু দাড়াই? ওরাও আসুক।’
‘খারাপ লাগছে আপনার?’
‘না।’
‘পা ব্যাথা করছে?’
‘অল্প।’
‘কেনো?’
‘জানি না। হয়তো কাল সারাদিন দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করেছি এরজন্য।’
‘বসবেন কোথাও?’
‘না।’
‘আমার কাধে উঠবেন?’
এই কথা শুনে টিকলি বজ্রাহতের ন্যায় অভিভূত চোখে এমনতরে তাকালো যেনো এই জাফলং এর সিড়িগুলো ভেঙে ভেঙে পরলো ওর মাথার উপর। কয়েক মূহুর্ত পর বিস্মিত গলাটুকু ঠেলে শুধু বের করতে পারলো,
‘পাগল হয়ে গেছেন?’
‘আপনার তো পা ব্যাথা করছে।’
টিকলি নির্বল চোখে তাকালো ওই সুন্দর পুরুষের দিকে। যে পুরুষ সামান্য পা ব্যথা করছে বলে এই জনসম্মুখে তার নারীকে কাধে তুলতে চায়! সে পুরুষ তার নারীকে ছেড়ে দিন কাটায় কেমন করে? কেনো একবার খোঁজ করে না? অভিযোগ করে না? রাগ ঝাড়ে না? নিরাভরণ অম্বুর নেত্রে চেয়ে থাকার কালেই পেছন থেকে উচ্ছ্বাস শোনা গেলো। ওরা কাছাকাছি চলে এসেছে। আদর আবার টিকলির হাত ধরলো। নির্মল, স্বতঃসিদ্ধ গলায় বলল,
‘আস্তে আস্তে চলুন। আর কিছু সিড়ি বাকি!’
কী সুন্দর স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর! যেনো কিছুই হয়নি.. যেনো ওদের মাঝে দৈনন্দিনের খুব ভালো বোঝাপড়া। সাধারণ, বিশুদ্ধ আচরণ। তবে টিকলির কেনো এই সময়’টায় এসে মনে হচ্ছে আদর এমন আচরণ করে তাকে ভৎসর্না জানাচ্ছে। তিরস্কার করছে। হেয় প্রতিপন্ন করছে। টিকলিকে সামনে পেয়ে আদরের রাগ ঝাড়া, অপমান করা, তাকে দেখতে না চাওয়া এসবই কি সাধারণ আচরণ ছিলো না?
‘চলুন।’
টিকলি নিচু স্বরে বলে, ‘ওরা আসুক। ডাক্তার আরাফ কি ভাববেন আমরা এভাবে চলে গেলে?’
আদরের ভ্রুদ্বয় টান টান হলো। মনের মাঝে পোষা প্রশ্ন’টা করেই ফেললো শক্ত কণ্ঠে,
‘ডাঃ আরাফের সাথে আপনার ওতো কি?’
টিকলির সেকেন্ড কতক লাগলো প্রশ্ন’টা বুঝতে। ওরা কাছাকাছি এসে পরেছে। তার মানে আরাফ এসে পরেছে। আদর টিকলিকে হেঁচকা টান মেরে পা ফেলতে ফেলতে বলল,
‘বেশি কষ্ট হলে বলুন বাকি পথ কোলে নিয়ে নামছি।’
টিকলি উত্তর দিলো না। স্বচ্ছ চোখে সামনের মানব’কে একদৃষ্টিতে দেখে যাওয়ার কালে তার মনে হলো আদতে সে ভুল। তার পুরুষ তারই রয়েছে। তাকে ভীষণ ভালোবাসে বলে….. ভীষণ যত্ন করে বলে অবজ্ঞা করতে পারছে না। হেয় করা নয় বরং আদরের হৃদপিণ্ড টিকলি। টিকলি মৃদু আওয়াজে হাসলো। কেউ শুনলো না। কানে লাগলো শুধু টিকলির। প্রফুল্লচিত্তে টিকলি আদরকে জানালো,
‘তার সাথে আমার কিছু নেই। শুধু একটু ভাব জমেছে।’
‘যার তার সাথে এতো ভাব জমবে কেনো?’ আদরের ওমনি উত্তর। আজ আর কোনো ছাড়াছাড়ি নেই। আদর মনের মধ্যে এসব আর পুষে রাখতে পারছে না। পায়ে পায়ে হেটে টিকলি দুষ্টু ভাবে ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করে,
‘ভাব জমবে না?’
‘না।’
‘ঠিকাছে। জমবে না।’
আদর মাথা দুলিয়ে পেছন দিকে চুল ঠেলে দিয়ে সিড়ির ধাপ পেরোতে পেরোতে বন্ধ ঠোঁটে প্রসন্ন হাসলো। গায়ে তার সাদা গেঞ্জি, নেভি-ব্লু প্যান্ট। চোখে কালো রঙের সানগ্লাস। হাতে কালো রঙের ঘড়ি। পায়ে ব্লু-হোয়াইট মিশেলে ক্যাজুয়াল স্নিকার্স। টিকলি মুগ্ধ চোখে চেয়ে শুধু নিজেকে শুনিয়ে বলল,
‘আপনি বসন্তের আকাশের মতো সুন্দর।’
,
অদূরে ডাউকি ব্রিজ। সামনে পিয়াইন নদী। রংবেরঙের বাহারি আকৃতির পাথরের স্তূপ এদিকে। নদীর স্বচ্ছ পানির নিচেও দেখা যাচ্ছে রকমারি জীবন্ত পাথরের বাহার। রাহুল নিভার ছবি তুলে দিতে দিতে বলল,
‘এমন একসময় এলাম যে ঝর্ণায় পানি নেই। মূল সৌন্দর্য’টা উপভোগ করতে পারলেন না।’
নিভা রাহুলের দিকে এগিয়ে এসে ছবিগুলো দেখতে দেখতে বলে, ‘তাতে কি? আপনার সাথে কাটানো প্রতিটা মূহুর্ত আমার জন্য উপভোগ্য।’
রাহুল হাতে ফোন ধরে রেখে নিভার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায়। প্রশান্তি নিয়ে হাসে। নিভা খেঁকিয়ে উঠে,
‘এই নিরব, আমাদের ছবি তুলে দে, শালা। আয়।’
নিরব’কে গালি দিয়ে নিভা জিব কামড় দিয়ে চোরাচোখে রাহুলের দিকে তাকায়। রাহুল হাসির ঝংকার তুলে নিভাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘আপনি আমার না হলে আমাকে এতো ভালোবাসতো কে বলুন তো?’
‘এর জন্যই তো আপনার হয়েছি।’ নিভা সুন্দর করে হাসে। রাহুল ওর থুতনি ধরে বলে,
‘আপনি এতো কিউট কেনো?’
‘কারণ আমি রাহুলের বউ।’
রাহুল আবার হাসে শব্দ করে। দূর থেকে তা মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে টিকলি মুক্ত বাতাসে হাপ ছাড়া শ্বাস ফেলে। দূরে আরাফ আর্দ্র-টায়রার ছবি তুলে দিচ্ছে। টায়রা একটা বড় পাথরের উপর বসে আছে। পেছনে আর্দ্র আরেকটা মাঝারি আকারের পাথর নিয়ে টায়রার দিকে মারকুটে ভঙ্গিতে পোজ দিয়েছে। ওই পোজে ছবি তুলা শেষ হলে টায়রা ছবিগুলো দেখতে চাইলো। পেছন দেখে আর্দ্র ইশারায় বারবার না করলো। আরাফ শয়তানি হাসি দিয়ে টায়রাকে ছবিগুলো দেখাতেই টায়রা এমন ভাবে আর্দ্রর দিকে তাকালো যেনো ভস্ম করে দিবে।
‘আপনার সাথে আর কোনো ছবিই তুলবো না আমি।’
বলেই টায়রা মুখ ফুলিয়ে হনহন করে চলে এলো। আর্দ্র ওর পেছন পেছন অসহায় মুখে ছুটলো। ওই মূহুর্তের ছবি তুলে রাখলো আরাফ। টায়রা পেছন দিকে নুখ ঘুরিয়ে ছুড়ে মারলো বুলি,
‘আপনি একটা আনরোমান্টিক।’
‘না, বউ। আমি অনেক রোমান্টিক। খালি একবার সুযোগ দিয়ে দেখুন।’
‘চুপ থাকুন। সবসময় এক আলাপ। একদম আমার পেছন পেছন আসবেন না। পাথর ছুড়ে মারবো।’
‘আমি কেচ ধরবো।’
‘অসহ্য আমি!’
‘অতিষ্ঠ আমি!’
ওদের কান্ড দেখে টিকলি হাসলো। বিরবির করে বলল,
‘কী কিউট একটা জুটি! এক মিনিট লাগে না ঝগড়া লাগতে আবার এক মিনিট পারে না আলাদা থাকতে।’
টিকলির হাসির মাঝে নিরব ওর ক্যামেরা তাক করে বলল, ‘হাস দোস্ত, অনেক সুন্দর ছবি আসছে।’
টিকলির সোজাসুজি পেছনে আদর প্যান্ট ভাঁজ করে পানিতে দাঁড়িয়ে আছে। নিরব টিকলির অনেকগুলো ছবি তুললো অযথা। টিকলি ছবি তুলতে বিরক্ত হয়। নিরবকে বারকয়েক ধমকালো। নিভা রাহুল একসাথে পানিতেই ছিলো। নিভা কোমরে হাত রেখে বলে,
‘এতোক্ষণ ধরে চিল্লিয়ে আমার দুটো ছবি তুলে দিলি আর টিকলি ছবি তুলতে চায় না অথচ ওর ছবি তোলার জন্য মরিয়া তুই? ইতর ছেলে।’
নিরব ভেংচি দেখায়। আদর নিরবের দিকে তাকিয়ে ওর কার্যকলাপ দেখে। কাটা গায়ে নুনের ছিটা দিতে আসে টায়রা। আদরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলে,
‘নিরব কি ভালো ছেলে! টিকলির সাথে খুব মানাবে।’
আদর টায়রার দিকে চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে উঠে আসে শুকনো ডাঙায়। বিরবির করে বলে,
‘পুরান পাগলের ভাত নেই নতুন পাগলের আমদানি। এক আরাফের জ্বালায় বাঁচি না!’
তন্মধ্যে আবার দৃশ্যপটে দেখা গেলো আরাফ টিকলিকে ডাকতে ডাকতে ছুটে আসছে। আরাফ, নিরব দু’জন দুইদিক থেকে টিকলিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। আদর তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে,
‘পৃথিবীতে এতো মেয়ে থাকতে উনার দিকেই নজর কেনো সবার?’
বড় বড় পায়ে এগিয়ে গিয়ে ওদের মাঝখান থেকে অপ্রত্যাশিত ভাবে টিকলিকে ছিনিয়ে নিয়ে আদর এগোতে লাগলো। টিকলি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে প্রশ্নবোধক চোখে চেয়ে আছে। সম্বিৎ ফিরে আদর অস্বস্থি নিয়ে বলে,
‘নৌকায় উঠবেন?’
‘ওদের ছাড়া?’
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা।’
‘দ্রুত চলুন। দেখতে পেলেই সবগুলো দৌড়ে আসবে।’
ওরা দ্রুত হাটলো। বস্তুত মৃদু পায়ে দৌড়ালো জাফলং এর পাথরের উপর দিয়ে। বাতাসের ঝাপটায় তাদের চুল উড়লো…. টিকলির গলার স্কাপ উড়লো… উড়লো তাদের মনের বহুদিনের বন্দী কোকিল। কুহু কুহু রবে ছেয়ে গেলো রৌদ্রজ্বল মরুতরঙ্গ।
চলবে❤️
#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
১৫.
নৌকা চলছে গন্তব্যহীন। নৌকার দু’পাশে দুই নর-নারী বসে জীবনের হিসেব কষছিলো। গোটা নৌকা আদর ভাড়া করেছে। টিকলি নদীর পানি আচঁলা ভরে নিয়ে চোখে মুখে ছিটিয়ে হাত ডুবিয়ে দূর দূরান্তের অন্তহীন শৈলের শূন্য চূড়ায় চেয়ে রইল।
আদর নিরব চোখে টিকলির দিকে পিঠ ঘুরিয়ে বসেছিলো। ও বুঝে উঠতে পারছে না নিজের কীর্তি গুলো। যে ক্ষুব্ধতা মনের মাঝে খুটি গেড়ে বসেছিল তা এই মেয়েকে দেখার সাথে সাথে তাসের ঘরের ন্যায় ভেঙে পরে গেলো। আদর পারছে না ছয় মাস আগের ঘটনা গুলো ভুলতে আবার পারছে না টিকলির কাছে থেকেও দূরে সরে থাকতে। আদরের সেই দোটানার মাঝামাঝি সময়টায় পেছন থেকে ভেসে এলো মিষ্টি কণ্ঠস্বর,
‘আপনি কি আমায় কোনো প্রশ্ন করতে চান?’
প্রশ্ন? আদর জানে এ কোন প্রশ্ন। সে প্রশ্ন করে নিজের দম্ভের কাছে হেরে যেতে চায় না…. চায় না এই মেয়েটা নিরীহ প্রমাণিত হোক। আদর চায় সবটুকু দোষ টিকলির ঘাড়ে থাকুক। নয়তো এতোদিনের একটা দূরত্ব… এতোটা সময় অপচয় আদর’কে খুব করে ভোগাবে। আদর কিছুতেই এই সময়গুলো নষ্টের বোঝা নিজের কাধে নিতে চায় না। সে টিকলিকে মন-প্রাণ দিয়ে ঘেন্না করতে চায় কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে নিজের সাথে ছলনা করে আদতে সে ভালোবাসা দিয়ে ঘেন্না করছে।
আদর ধীর ভারিক্কী কণ্ঠে বলে,
‘আমি আপনাকে কক্ষনো ক্ষমা করবো না।’
টিকলি তাকায়। একদম স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে বলে, ‘আচ্ছা। করবেন না।’
‘সবকিছুর দোষ আপনার।’
‘মেনে নিলাম।’
‘আপনি নির্দয়, প্রতারক, ধূর্ত।’
‘তাও মেনে নিলাম।’
‘বোকার স্বর্গে বাস করে যার ধূর্তামো আমি চোখ বন্ধ করে ভালোবেসেছি।’
‘ভুল করেছেন আপনি। আর ভালোবাসবেন না।’
‘আপনি আমাকে একটাবার খোঁজ করেননি। একটা ফোনকল দেননি।’
‘আপনিও তো দেননি।’
‘কেনো দেবো?’
‘কেনো দিবেন না? আপনি না চোখ বন্ধ করে ভালোবেসে গেছেন? হঠাৎ করে চোখ খুলে গেলো আপনার?’
‘আপনার মধ্যে একটুও অনুতাপ নেই।’
‘এটা ভুল। অনুতাপ ছিলো বলেই আপনার সাথে যোগাযোগ করার সাহস করিনি।’
‘করলে হয়তো ছয়টা মাস নষ্ট হতো না।’
‘নিজেকে ডিফেন্ড করার কোনো ইচ্ছে ছিলো না, ডাক্তার।’
‘খবরদার! ওভাবে ডাকবেন না।’
‘আচ্ছা, ডাকলাম না।’
‘আপনি এতো কঠিন কবে হলেন?’
‘যেদিন আপনি আমাকে ভুল বুঝলেন।’
‘নিজেকে ডিফেন্ড করার ইচ্ছে কেনো নেই আপনার?’
‘কারণ আপনার সাইকোলজির সাথে আমার’টা মিলছে না। হয়তো আমি উদ্ভট।’
‘আপনি কেনো আপনার বাবা-মার কাছে ফিরে যাননি?’
‘ইচ্ছে করেনি।’
‘আপনার বাবার সাথে কথা বলেন না কেনো?’
‘সবই জানেন দেখছি।’
‘ইচ্ছে না নাহলেও জানতে হয়। আপনার বোন সারাক্ষণ আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে আপনার ব্যাপারে খোশগল্প করে।’
‘ঠিকাছে, আমি ওকে বারণ করে দেবো।’
‘বারণ করতে কখন বললাম?’
‘ওই মেয়েটা কে?’
‘কোন মেয়েটা?’
‘ওই যে… ইভেন্টে আপনার পেছনে ঘুরঘুর করলো যেই মেয়েটা।’
‘রিফা…?’
‘হয়তো।’
‘নার্স প্লাস আমার পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট।’
‘অবিবাহিত না?’
‘হ্যাঁ। কার থেকে শুনেছেন?’
‘কারোর থেকে না। মুখ দেখলেই বলে দিতে পারি। এও বলে দিতে পারি, She has a crush on Dr. Ador Khan.’
‘বাজে কথা বলবেন না।’
‘সত্যি। তার চোখে মুখে লেখা। আপনার মনে আছে একদিন আপনি ফোন ধরছিলেন না বলে এই নার্স নার্স করে আমি কত তুলকালাম কান্ড করেছি?’
‘মনে আছে। আপনার ফোন ধরছিলাম না বলে আপনি ভেবেছেন আমি কোনো নার্সের সাথে খোশমেজাজে আছি। খুব চিৎকার চেঁচামেচি করেছেন আমার উপর। কান্নাকাটি করেছেন। আমি ব্যস্ত ছিলাম সাথে প্রচুর ক্লান্ত ছিলাম বলে ফোন কেটে দিয়েছিলাম। ব্যস্ততা শেষে না ঘুমিয়ে কালো পাঞ্জাবি পরে ভোরে আপনার বাসার নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আপনি কালো শাড়ি পরে আসলেন। গাড়ির ভেতরে আপনার বুক ভাঙা কান্না দেখে আমি প্রথমবারের মতো আপনাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। চোখ মুছিয়ে কতশত বলে আপনাকে বুঝালাম!’
আদর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘সেসব অতীত। জীবনের সেরা ছয় মাসের রঙিন অতীত।’
‘বিয়ে করছেন না কেনো?’
‘করবো। আপনাকে আমার বিয়ের ইভেন্টের দায়িত্ব দিবো। আপনি আবার আমি যেই ইভেন্টে থাকি তা খুব ভালোভাবে হ্যান্ডেল করতে পারেন।’
টিকলি চোখ পাকিয়ে নাক ফুলিয়ে তাকালো। রুষ্ট মুখে বলল,
‘মনে হয় আমি ইচ্ছে করে থাকি? আমাকে জোর করে দেওয়া হয়। আপনার বিয়ের ইভেন্ট সাজাতে আমার বয়ে গেছে।’
‘বিয়ে না সাজান অন্তত বাসর’টা সাজিয়ে দিয়েন।’
দীর্ঘ যাত্রা শেষে দুপুর গড়িয়ে দিনান্তে ধাক্কা তুলে তুলে ছোট্ট তরী’টা তখন ডাঙার কাছাকাছি এসে গেছে। টিকলি থমথমে মুখে নাও এর কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালো। যখনি নামবে আদর ওর হাতখানা চেপে ধরলো। গোধূলিবেলার প্রথম প্রহরের কড়া সোনালু আলোয় টিকলির ক্লান্ত, তৈলাক্ত, বিশৃঙ্খল মুখের দিকে চেয়ে আচম্বিতে সেই নির্লজ্জ পুরুষ ঘোর লাগা কণ্ঠে বলে উঠলো,
‘আরাফের থেকে দূরে থাকবেন।’
‘থাকবো না।’
‘নিরবের থেকেও দূরে থাকবেন।’
‘এটাও থাকবো না।’
‘রাহুলের থেকে দূরে থাকবেন।’
টিকলি অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,
‘সে আগের কথা। ওর এখন বউ আছে।’
‘পৃথিবীর সমস্ত ছেলের থেকে দূরে থাকবেন।’
‘থাকবো না…থাকবো না। সব ছেলেকে আমার চারপাশে ঘিরে রেখে মাঝখানে পুতুলের মতো বসে থাকবো। হয়েছে?’
‘না হয়নি। আপনাকে সবার থেকে দূরে থাকতে হবে।’
‘কেনো?’
‘আমি বলেছি তাই।
টিকলি চোখ মেলে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো। তাকাতেই চোখাচোখি হলো। চারচোখ একত্রিত হলো। সময় থমকে দাড়ালো। দেহের নার্ভগুলোর স্পন্দন থেমে গেলো। শুধু কিছু খুচরো উগ্র হাওয়ারা দোল দিলো।
,
বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে আসা নিভা যখন টিকলিকে বিয়ে করতে না পারা বিধ্বস্ত সদ্য ব্যর্থ রাহুলকে আকুল আবেদনে নিজের করে চাইলো রাহুল তখন আকণ্ঠ হয়ে বলেছিলো,
‘আপনি আমাকে বিয়ে করবেন? আমার সাথে থাকবেন? পারবেন?’
নিভা আবিষ্টমনে একনাগাড়ে উদ্ধৃত মোলায়েম স্বরে বলে দিলো,
‘লোকে বলে, তুমি যাকে ভালোবাসো তাকে জীবনসঙ্গিনী করার আগে যে তোমাকে ভালোবাসে তার দিকে নজর দেও।’
‘কথাটা আমার ক্ষেত্রে সত্যি হতে পারে কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে..’
রাহুলকে আটকিয়ে নিভা বলল, ‘হয়ে যাবে। আমি আপনার কাছে থাকতে চাই।’
নিভা বলেছিলো আচম্বিতে রাহুলের বুকের বাম পাশের উপর হাত রেখে। রাহুল নিভার হাতের দিকে একবার তাকিয়ে পলক ফেলে বলল,
‘ভালো করে ভাবুন, নিভা। আমি আপনাকে আদর করতে পারবো তবে ভালোবাসতে পারবো না। মন দিতে পারবো হয়তো হৃদয় দিতে পারবো না। এই বুক দিতে পারবো কিন্তু ধুকপুক শোনার অনুমতি দিতে পারবো না।’
দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে শত কষ্টকে উপেক্ষা করে তবুও নিভা বলেছিল,
আমি তাতেই রাজি? যাবেন আমার সাথে? পথ পাড়ি দিতে? অজানার পথে? যেখানে আর কখনো আপনাকে কষ্ট ছুবে না হয়তো দুঃখ ছুবে। কান্না ছুবে কিন্তু মন খারাপ ছুবে না।’
নিভা হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। রাহুল আস্তে করে সেই হাত ধরে। নিভা দেখছিলো রাহুলের চোখের কোণায় টিকলির জন্য পানি। বুকটা ছিন্নভিন্ন হলো। রাহুল নিভার ওই আলতো ফর্সা রাঙা মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকলো ক্ষণকাল। তাকাতেই চোখের সামনে টিকলির মুখ ধরা দিলো। রাহুল চকিতেই চোখ সরিয়ে নিলো। সে কি কখনো পারবে টিকলিকে ভুলতে? নিভাকে আপন করতে? না পারুক চেষ্টা করতে ক্ষতি কি? ক্ষতি তো নেই! তবে খুঁজে নেওয়া যাক চিরকালের দুঃখের পর একটু সুখের আশ্রয়! ছোঁয়া! আশা!
,
রাহুল টিকলিকে ভুলতে পেরেছে। নিভার কথা সত্যি করে ওর প্রতি ভালোবাসাটা হয়ে গিয়েছে। আর তার সমস্ত কথা মিথ্যাতে পরিণত হয়েছে। সে নিভাকে আদর করেছে…ভালোবেসেছে.. মন দিয়েছে… হৃদয় দিয়েছে… বুক দিয়েছে… ধুকপুক শোনার অনুমতিও দিয়েছে। সব দিয়েছে। নিজেকে নিভার নামে সপে দিয়েছে। বিনিময়ে কিনে নিয়েছে আজন্মের জন্য অন্তহীন প্রেম।
শ্রীমঙ্গলের ‘গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট এন্ড গল্ফ’ রিসোর্টের ছাদে দাঁড়িয়ে পাহাড় দেখতে দেখতে আগের কথাগুলো ভাবছিলো রাহুল। হঠাৎ পেছন থেকে দুটো মোলায়েম হাত এসে আড়াআড়িভাবে থামলো রাহুলের বুকের মাঝে। ঘাড় বাঁকাতেই মিষ্টি মেয়েটি ছোট্ট বাচ্চার ন্যায় সরল, নির্মল হাসি দিলো। রাহুল হেসে নিভার নাকে চুমু খায়। হাত ধরে সামনে নিয়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে চুলের ভাঁজে মুখ ডোবায়।
চলবে❤️
#বসন্তপবনে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
১৬.
রুম নং ৩০৯। সফেদ রঙের ডাবল বেড সামনে। চোখ ধাঁধানো রিসোর্টে এসে টিকলির চোখ জোড়া ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে, বাকিঁয়ে, ছুয়ে ছুয়ে দেখছে সব। রুমে উপস্থিত আরেক প্রাণী ঠোঁটে হাত রেখে চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। চিন্তা-ভাবনা শেষ হলে ভ্রু উঁচিয়ে টিকলিকে প্রশ্ন করলো,
‘আপনি এতো বড় ইভেন্ট সাজাতে পারেন অথচ একটা খাট সাজাতে পারবেন না?’
টিকলি আড়চোখে তাকিয়ে উত্তর করলো,
‘আমি খাট সাজানোর ইভেন্ট প্ল্যান করিনি এখন অবধি।’
আদর চোখ তুলে তাকিয়ে আবারো চিন্তিত ভঙ্গিতে মুখে হাত দেয়। টিকলি বিরক্ত কণ্ঠে বলে,
‘হোটেল ম্যানেজমেন্ট কে বললেই তো ওরা দুটো রুম একরকম ভাবে সাজিয়ে দেয়।’
আদর চোখ তুলে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, ‘তাহলে একজন ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর কে সাথে নিয়ে কেনো ঘুরছি যদি অন্যকে দিয়েই সাজাতে হয়?’
টিকলি চোখ উল্টালো। আদর বলে,
‘আমি চাইছি ওদের জন্য এটা মেমোরেবল হোক। আপনি নিজের হাতে সাজান। ওদের বিয়েটা পালিয়ে হয়েছে। ওরা তো বাসর রাতের ফিল পায়নি।’
টিকলি মৃদু কাশে। মহা বিপদে পরেছে তো সে! আরে বাপ বাসররাতের ফিল পাওয়ার কি আছে? একটা খাট সাজানো বা না সাজানোতে কি এমন যায় আসে? আর যদি সাজাতেই হয় নিজের বাড়িতে সাজাতে পারিসনি? টিকলির সাথে কীসের এতো আড়ি তোদের? ওকে দু’দন্ড একটু রেস্ট দিবি না? ঘুরতে এসেও কাজ ধরিয়ে দিবি? টিকলির নাকের পাটাতন ফুলে উঠলো। বলল,
‘আচ্ছা, ওরা তো হানিমুনে এসেছে। আপনি ঢাকায় গিয়ে ওদের জন্য বাসর সাজিয়ে দিয়েন। আমাকে জ্বালাবেন না।’
আদর সে কথার পাত্তা না দিয়ে বলে, ‘কি কি লাগবে বলুন। আমি আনার ব্যবস্থা করছি। এরপর রুম’টা সুন্দর করে সাজান।’
টিকলি হাল ছেড়ে দিলো, ‘ঠিকাছে, নিরবকে পাঠিয়ে দেন।’
আদর ভ্রু উঁচায়, ‘কেনো?’
‘কেনো মানে? আমি একা করতে পারবো? লোক লাগবে না?’
আদর ডান গালে জিব ঠেকালো। দু মিনিট ভেবে বলল,
‘ঠিকাছে আপনার বোনকে গিয়ে বুঝান। তার জন্যই এতো নাটক করা হচ্ছে। এখানে আপনি আছেন ওকে বুঝাবেন। আই হোপ, ও মানবে।’
উফফ… বাসর! বাসর! নিরব পর্যন্ত গত কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জেনে গিয়েছে যে ওদের এখনো বাসর হয়নি। টিকলি বিরবির করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে এলো,
‘এই মহাবিশ্বের সবাই জানে যে ওরা বাসর করেনি। বেহায়া দুটো!’
‘সব ঠিক থাকলে আমাদেরও বিয়ে হতো। ওদেরও বাসর হতো।
আদরের অপ্রত্যাশিত কথায় টিকলি থেমে বিদ্যুৎ বেগে তাকালো। অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইলো কতক্ষণ। শরীরে ঝিম ধরে গেলো। অলোক কোনো রাজ্যের ইন্দ্রজালে আটকা পরে ওদের চোখে চোখে ভেলকি খেলে গেলো। বিভ্রম নিয়ে টিকলি ক্ষীণ সৌম্য কণ্ঠে বলল,
‘আপনার সেই কথাগুলো আমি কখনো ভুলতে পারবো না।’
আদর পকেটে হাত রেখে মন্ত্রবলে এগিয়ে এলো। চোখে চোখ রেখে টিকলির ন্যায় বলল,
‘আপনার চরটাও আমি কখনো ভুলতে পারবো না।’
________________________
‘কি করছিস?’
‘চোখে দেখিস না?’
টায়রা বসেছিলো সুইমিংপুলের পানিতে পা ভিজিয়ে। টিকলি মুখ টানা মেরে ওকে ধাক্কা মেরে সেখানে বসলো।
‘ওদের বিয়ের কতদিন হলো?’
‘উমম…. মনে নেই। তুই হিসেব কর।’
টিকলি বিপন্ন চোখে তাকায়। পানিতে পা ডুবিয়ে বলে, ‘তুই বড় হবি না?’
টায়রা চোখ পিটপিট করে তাকায়, ‘এক বছরের বড় হয়ে ভাব নেস? আমি বড় হই নাই?’
টিকলি এই নির্মল মুক্ত বাতাসে বুক ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়ে। বলে,
‘বড়-ই যখন হয়েছিস তখন এতো বাচ্চামো কেনো?’
‘ঝেড়ে কাশ।’
‘টায়রা, জীবন কখনো কারোর জন্য থেমে থাকে না। হয়তো গতি হারায়। সাময়িকের জন্য থমকে দাঁড়ায় কিন্তু চিরকালের জন্য থেমে যায় না। আমি যদি সারাজীবন অবিবাহিত থাকি তুই আর্দ্র ভাইয়ার কাছে যাবি না?’
‘ভেবে দেখিনি।’
‘এতো চমৎকার একজন জীবনসঙ্গী পেয়েছিস যার কাছে তোর প্রায়োরিটি সবথেকে আগে। তোর এইসব বালখিল্যতা আচরণ সে হাসিমুখে মেনে নিয়েছে ঠিক। কিন্তু কতদিন? এভাবে কি চলে? অধিকারই যদি না দিবি তবে বিয়ে কেনো করলি যখন দেখলি আমি বিয়ে করলাম না?’
টায়রা জোরপূর্বক হেসে বলে, ‘এতো কঠিন কঠিন কথা কেনো বলছিস?’
‘এরজন্যই বলছি যাতে তুই আমার জন্য আর না ভাবিস। আমার চিন্তা করে নিজের জীবনের সুন্দর সময় গুলো নষ্ট করিস না। তুই চিন্তা করে দেখ ভাইয়ার কত ধৈর্য্য! You have to cheerful to have such a wonderful partner.’
‘Yes, I am.’
‘আমার খালা হওয়ার বয়স হয়েছে।’
টায়রা মুখ ফুলিয়ে বলে, ‘আমারও হয়েছে।’
টিকলি সে কথার উত্তর দিলো না, ‘আজ তোদের জন্য বাসর সাজানো হবে।’
‘কে সাজাবে?’
‘আমি।’
টায়রা ঠোঁট গোল করে বলে, ‘ওওও… এর জন্য এতো লেকচার? আচ্ছা ঠিকাছে তোর কথা সব মানলাম But what about you?’
টিকলি প্রশ্নবোধক চোখে তাকায়। টায়রা আমতা আমতা করে বলে,
‘ভাইয়ার সাথে কিছু যদি না হয় তবে অন্য কাউকে দেখ। পার্টনার খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। জীবনে কেউ একা চলতে পারে না।’
টিকলি ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে, ‘কাকে দেখবো?’
‘কত মানুষ! তোর কাজে কতজন আছে। ভার্সিটিতে আছে। রাস্তাঘাটে কত আছে। এই যে আমাদের নিরব আছে তারপর আরাফ ভাইয়া আছে।’
টিকলি চোখ গরম করে তাকালো টায়রার দিকে। তখনি ফোন’টা বাজখাঁই গলায় বেজে উঠলো। টায়রার দিকে তাকিয়ে ফোন রিসিভ করতে করতে টিকলি বলল, ‘বাজে কথা বলিস না। পাহাড়ের সাথে বেঁধে রেখে চলে যাবো।’
টিকলি ফোন কানে ধরে, ‘হ্যাঁ, মা। কেমন আছো?’
‘ভালো। তুই?’
বলে শায়লা আক্তার থামলেন। মেয়েদের সাথে তার মাঝেমধ্যেই কথা হয়। খোঁজখবর নেওয়া হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোন আলাপ হয় কিন্তু তবুও কোথাও একটা ফাঁকফোঁকর রয়ে গেছে। বড় মেয়ের সাথে তার কথা হয় ঠিক কিন্তু গুরুতর নিরব অভিমানে বাবা-মেয়ের মাঝে কথা হয় না। ছোট মেয়েটার সাথে সবার কথা হয় ঠিক, সবকিছু মেনেও নেওয়া হয়েছে তবুও সে বাপের বাড়িতে পা রাখেনি বোনকে ছাড়া।
‘কিছু বলবে, মা?’
শায়লা আক্তার এলোমেলো গলায় বললেন, ‘হুম? ও হ্যাঁ। শুনলাম তোরা নাকি সিলেটে গিয়েছিস?’
টিকলি টায়রার দিকে এক পলক তাকায়। ছোট করে উত্তর দেয়,
‘হ্যাঁ।’
‘কাজে গিয়েছিলি?’
‘হুম।’
‘টায়রা কোথায়?’
‘পাশেই বসে আছে।’
‘ওকে একটু বোঝা। এখনো তো বাচ্চাই রয়ে গেছে। সংসারের কিচ্ছু বুঝে না। ওর শ্বাশুড়ি তো ফোন দিলেই ওদের নানান কাণ্ড নিয়ে হাসে। এখন এসব ভালো লাগছে ঠিক কিন্তু সবসময় ভালো লাগবে না। একটু ম্যাচিউর হতে বল ওকে।’
টিকলি মৃদু হাসে। বলে, ‘তুমি এমনভাবে বলছো মা যেনো আমার সংসার করার কতো অভিজ্ঞতা আছে?’
শায়লা আক্তার এই পর্যায়ে চুপ হয়ে গেলেন। ধীর কণ্ঠে বললেন,
‘আছেই তো। একা সংসার পেতেছিস। কাউকে লাগছে না। কি সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে থাকছিস!’
‘কাদঁছো কেনো মা?’
‘কোথায় কাঁদছি?’
‘তোমার কান্না আমার ভালো লাগে না। ইম্পোর্টেন্ড কিছু বলবে নাকি রেখে দিবো?’
‘একবার আয় না মা!’
‘সম্ভব না।’
‘তোর বাবা তোকে দেখতে চাইছে। কতগুলো মাস হয়ে গেলো দেখে না!’
টিকলির বুকটা খামচে ধরলো কি যেনো! বড় করে শ্বাস নিয়ে বলল,
‘আমি ব্যস্ত, মা। যাওয়ার সময় নেই।’
‘আচ্ছা, আসতে না চাইলে অন্য কোথাও দেখা কর। কোনো রেস্টুরেন্টে?’
‘বাবাকে আমার এপার্টমেন্টে নিয়ে এসো, মা। একদিন তোমাদের আমার নুন,ঝাল, তেল ছাড়া রান্না খাওয়াই।’
শায়লা আক্তার চোখ মুছে হাসলেন, ‘ঠিকাছে, মা। আমি তোর বাবাকে এক্ষুনি বলছি। রাখি।’
‘মা…।’
‘হ্যাঁ বল।’
‘কিছু কি হয়েছে? বাবা কি অসুস্থ?’
‘না।’
টিকলি হাফ ছেড়ে ফোন কেটে দিলো। ওদের সাথে তখন জয়েন হয়েছে নিভা। টায়রা ওকে কাধ দিয়ে ধাক্কা মেরে বলল,
‘তোদের জন্য নাকি এই সিঙ্গেল রানী বাসর সাজাচ্ছে।’
নিভা আঙ্গুল ডানে-বামে করতে করতে বলে,
‘না না না… এ তো কাম্য নয়। একজন অবিবাহিত নারী বিবাহিতদের বাসর কেনো সাজাবে?’
টিকলি ওদের দুজনকে দুটো লাত্থি মেরে চলে গেলো।
____________________
শ্রীমঙ্গলের চা বাগানের উঁচু নিচু সৌন্দর্য আরেকদিন ঘুরে বুঝে নিতেই সময় গড়িয়ে এলো বিদায় বেলার। অদূরে ভোরের সূর্য উঁকিঝুঁকি দিয়েই লালাভ রশ্মি পৃথিবীতে ছড়িয়ে চট করে উঠে পরলো। টিকলিকে প্রথম নামিয়ে দেওয়া হলো ওর এপার্টমেন্ট বিল্ডিং এর সামনে। পেছনে সবাই ঘুমে বিভোর। আদর শক্ত, ক্লান্ত, ভারিক্কি চোয়ালে সোজা সামনে তাকিয়ে আছে। টিকলি কোমর বাকিয়ে গাড়ির উইন্ডো গলিয়ে আদরকে বলল,
‘সেইদিনের চরের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আপনার কাছে আমার আর কোনো ঋণ রইলো না।’
চলবে❤️