বসন্ত কন্যা পর্ব-২৯+৩০

0
395

#বসন্ত_কন্যা
#পর্ব_২৯
#লেখিকা : সাদিয়া

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

আয়না চুপচাপ ঘোমটা দিয়ে বিছানায় বসে আছে। ইয়াসিন ধীর পায়ে আয়নার পাশে বসলো।‌ আয়না ইয়াসিনকে সালাম করলো। ইয়াসিন আয়নার হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে পুরে নিল। শান্ত কন্ঠে বলল – এখনও ভয় পাও আমাকে?

আয়না দুই দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে না বোঝালো। ইয়াসিন আয়নার গাল দুটো ধরে আলতোভাবে কপালে একটা ভালোবাসার পরশ এঁকে দিল। কেঁপে উঠলো আয়না। লজ্জায় ইয়াসিনের বুকে মুখ লুকালো।

_________________________

বাসর ঘরে নীরব দর্শকের মতো বসে আছে কাজল আর শাহরিয়ার ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে তার নাকি আজ ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। কাজল শুধু দাঁতে দাঁত চেপে শাহরিয়ারের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছে। শাহরিয়ার ফ্রেশ হয়ে কাজলকে শুতে বলে নিজেও চুপচাপ শুয়ে পড়ল। ৫ মিনিট অতিবাহিত হয়ে গেছে কাজল ভ্রু কুঁচকে শাহরিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। শাহরিয়ার চোখ বন্ধ করে আছে, ব্যাটা কি ঘুমিয়ে পড়লো? হয়তো। নাহ আর সহ্য করা যাচ্ছে না। কাজল উঠে শাহরিয়ারের পে*টে*র উপরে বসে ওর গলা চেপে ধরলো।

– কি করছো? বাসর রাতে স্বামীকে মেরে বিধবা হওয়ার প্ল্যান আছে নাকি?

কাজল দাঁতে দাঁত চেপে বলল – এমন নিরামীষ স্বামী রাখার চেয়ে তাই ভালো।

– আমি আবার কি করলাম?

– বাসর রাতে বউকে আদর না করে আপনি ঘুমাচ্ছেন কেন?

শাহরিয়ার কাজলের এক হাত ধরে টান দিয়ে নিজের বুকের উপর ফেলে দিলো। দুষ্ট হাসি হেসে বলল – বউয়ের আমার আদর লাগবে বললেই হতো।

কাজল লজ্জায় শাহরিয়ার বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলল।

_____________________________

ধরনীর বুকে সকাল নেমেছে কিছুক্ষণ হলো। আকাশের কোনে সূর্য উঁকি দিয়েছে, আর তাকে স্বাগতম জানাচ্ছে পাখির কিচিরমিচির কলধ্বনি। কারো গভীর উত্তপ্ত নিঃশ্বাস নিজের গলায় অনুভব করে পিটপিট করে চোখ খুলল নিশা। চোখ খুলে সামনের মানুষটার মুখ দর্শনে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল তার। আবসার উ*দ*ম গায়ে নিশাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। কালকে রাতের কথা মনে পড়তে লজ্জাও লাগছে বেশ। আলতো হাতে ছুয়ে দিল আবসারের বক্ষ। যেখানে অজস্র খামচির আর কামড়ের দাগ, নিজের নখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল নিশা। মাথাটা একটু এগিয়ে আবসারের বুকে আলতোভাবে একটা চু*মু খেয়ে উঠে বসলো।‌ গোসলটা সেড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মাথা মুছছিল। হঠাৎ আয়নার দিকে চোখ পড়তেই চিৎকার করে উঠল নিশা।

নিশার চিৎকার শুনে ধরফরিয়ে উঠে বসলো আবসার। পাশে তাকিয়ে দেখে বিছানায় নিশা নেই। দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। নিশা মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদছে। আবসার দ্রুত গিয়ে নিশার কাছে বসলো। অস্থির হয়ে ওর দুই বাহুতে হাত রেখে বলল – কি হয়েছে বউ? কাঁদছো কেন?

নিশা কেঁদেই যাচ্ছে কোনো উত্তর দিচ্ছে না। আবসার আরও অস্থির হয়ে উঠছে।

ব্যাগ্র কন্ঠে জিজ্ঞেস করল – কি হয়েছে বলবে তো? বেশি কষ্ট হচ্ছে তোমার? কাল রাতের জন্য খারাপ লাগছে তোমার? স্যরি বউ, কিছু তো বলো।

আবসার নিশার মুখ থেকে হাত টেনে সরানোর চেষ্টা করছে, নিশা আরও শক্ত করে নিজের হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। নাক টেনে টেনে বলল – আমার মুখ দেখাবো না তাহলে আপনি আর আমায় ভালোবাসবেন না।

আবসার চমকালো, মুখ দেখার সাথে ভালোবাসার কি সম্পর্ক। আর এই মেয়েই বা এমন কেন করছে? নাহ এর কি হয়েছে আগে সেটা জানতে হবে। আবসার জোর করে নিশার মুখ থেকে হাত সরিয়ে দিল, নিশা আরও জোরে কেঁদে উঠলো। নিশার সম্পূর্ণ মুখ ছোট ছোট লাল ছোপ ছোপ দাগে ভরে গেছে। এলার্জি জনিত সমস্যা মনে হয়। আবসার দীর্ঘশ্বাস ফেলল, এর জন্য এই মেয়ে এত কান্নাকাটি করছে?

শান্ত কন্ঠে আবসার জিজ্ঞেস করলো – এগুলো কি করে হলো?

নাক টেনে টেনে নিশা বলল – কাল ভারী মেকআপ করেছিলাম তাই। আমি অতিরিক্ত ভারী মেকাআপ করতে পারি না ত্বকে সমস্যা হয়।

চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আবসারের। তরতর করে মাথায় রাগ উঠে গেল। এই মেয়ের নিজের দিকে কি কোনো খেয়াল নেই? সে কি জানতো না এভাবে মেকআপ করলে তার সমস্যা হবে তারপরও সে কেন সংয়ের মতো সেজেছিল। ধমকে উঠলো আবসার।
– কে বলেছে তোমাকে ভারী মেকআপ করতে? আমি আগেই বলেছি যেগুলোতে তোমার সমস্যা হয় সেগুলো করবে না। তারপর কেন করেছো ভারী মেকআপ?

ডুকরে কেঁদে উঠলো নিশা। নাক টেনে বলল – আপনি এখান আর আমার ভালোবাসবেন না তাই না?

নরম হলো আবসার, বুকে জড়িয়ে নিল নিশাকে। শান্ত কন্ঠে বলল – ভালোবাসা কি মুখ দেখে হয় বসন্ত কন্যা? যদি তাই হতো তবে তো ফয়সালকে ছেড়ে তোমার আমাকে ভালোবাসার কথা ছিল না। ফয়সাল আমার থেকে অনেক বেশি সুদর্শন। তুমি তাকে উপেক্ষা করে আমাকে ভালোবাসেছো। ভালোবাসা হয় মন থেকে কারো সৌন্দর্য দেখে নয়। সৌন্দর্য দেখে যেটা হয় সেটা হয় মোহ যা দুদিন পরে কেটে যায়। আমি তোমাকে ভালোবাসি তোমার চেহারাকে নয়, আর সারাজীবন ভালোবাসবো তাতে তোমার পুরো মুখটা যদি পুড়ে যায় তবুও। আমার ভালোবাসা এতটাও ঠুনকো নয় বসন্ত কন্যা , বিশ্বাস রাখতে পারো।

কান্না থেমে গেছে নিশার, অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আবসারের দিকে। আবসার এবার আদুরে কন্ঠে বলে উঠলো- আমার বউকে এই অবস্থায় কতটা রূপসী লাগছে জানো তুমি? শ্যামলা মুখ খানায় ছোট লাল লাল ছোপ ছোপ দাগগুলো অন্যরকম সৌন্দর্য বহন করছে আমার বউয়ের মুখে। আমার তো ইচ্ছে করছে বউটাকে এখনই খেয়ে ফেলি। কিন্তু খেয়ে ফেললে আবার বউ কই পাবো আমি। দশটা না পাঁচটা না আমার একটা মাত্র মুরগীর বাচ্চার মতো কিউট বউ।

নিশা ফ্যাল ফ্যাল করে আবসারের দিকে তাকিয়ে আছে। এজন্যই হয়তো বলে ভালোবাসা অন্ধ হয়। ভালোবাসলে তার প্রিয় মানুষটার সব কিছুতেই সৌন্দর্য খুঁজে পায়। এই যেমন আবসার পাচ্ছে নিশার গালের লাল দাগগুলো দেখে। যে তোমায় ভালোবাসবে সে তোমায় পৃথিবীর সব নিয়ম ভেঙেই ভালোবাসবে। তোমার গালে তীব্র ব্রনের দাগ যেগুলো অন্য কারো কাছে ঘৃনার কারন হলেও, সেগুলোর মধ্যেই তোমার ভালোবাসার মানুষটা সৌন্দর্য খুঁজে নিবে। আর যে তোমায় ভালোবাসবে না সে তুমি যদি বিশ্ব সুন্দরীও হও তবুও ভালোবাসবে না।

সকাল থেকে রুমের বাইরে বের হয়নি নিশা। আবিদা বেগম, রেবেকা বানু, মিষ্টি, আয়ান , আনসার সাহেব সবাই রুমে এসে ওকে দেখে গেছে। বিয়ে বাড়িতে অনেক মানুষ। এই মুখে নিচে সবার সামনে যেতে অসস্থি লাগছে নিশার তাই আবসারও আর জোর করেনি। ডাক্তার এসেও দেখে গেছে ,ঔষধ দিয়ে গেছে। আবসারও সারাক্ষন নিশার পাশেই বসে আছে। একের পর একজন আসছে নিশাকে দেখতে, বউয়ের কাছে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না সে। বউয়ের পাশে যে বসে থাকতে পারছে এই তো ঢের। সর্বশেষ আনসার সাহেব রুম থেকে বেরুতেই আবসার উঠে দ্রুত রুমের দরজাটা এটে দিল।

নিশা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো – একি দরজা আটকালেন কেন?

আবসার ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিলো – সকাল থেকে বউ আমায় পাত্তা দিচ্ছে না, বউয়ের পাত্তা তো পেতে হবে নাকি?

নিশা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো – মানে?

আবসার নিশার পাশে বসলো , একটু সময় নিশার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর ঠোঁটে দুটো নিজের ঠোঁটের ভাঁজে নিয়ে নিল। আকর্ষিক আক্রমণে হকচকিয়ে গেল নিশা, খামচে ধরলো আবসারের বাহু।

মিনিট পাঁচেক পর ছেড়ে দিয়ে বলল – তুমি বড্ড নিষ্ঠুর বউ , সকাল থেকে যে তোমার বরটা উপস করে বসে আছে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই তোমার।

নিশা গোল গোল চোখে আবসারের দিকে তাকিয়ে আছে। আবসার যেন কাল থেকে নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে। এমন গম্ভীর পু্রুষ যে এতটা রোমান্টিক হবে ভাবনার বাহিরে ছিল নিশার। আবসারের বুকে মাথা এলিয়ে দিল নিশা। আবসারও পরম যত্মে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল নিশাকে‌, চুলের মধ্যে একটা চু*মু খেয়ে বলল – ভালোবাসি বউ।

নিশা দুই হাত বাড়িয়ে আবসারকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল – আমিও ভালোবাসি ক্যাপ্টেন সাহেব।

___________________________

কেটে গেল চারটা দিন। আজ নিশাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ শ্বশুর বাড়ি এসেছে আবসার। আগেই আসতো কিন্তু নিশার অসুস্থতার জন্য আসতে পারেনি। এসে থেকেই নিশা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নিজের বাড়ির মানুষের সাথে, আবসারের দিকে কোনো খেয়াল নেই তার। আশেপাশের বাসার ছেলে মেয়েরা নিশার বরকে দেখতে আসছে। সবার মধ্যে অসস্থি হলেও কিছু বলতে পারছে না আবসার। নিশার মা আবসারের মুখ দেখেই বুঝতে পারছে মেয়ে জামাইর ভীষণ অসস্থি লাগছে। সে হাক ছেড়ে নিশাকে ডাকলো বললো আবসারকে নিয়ে রুমে যাওয়ার জন্য।

নিশা দাঁত দিয়ে জিহ্বা কাটলো। এখানে এসে তো আবসারের কথা একদম ভুলেই গিয়েছিল। মানুষটা নিশ্চই ওকে খুঁজেছে, হয়তো রেগেও আছে‌। আবার ধমক টমক দিবে না তো, দিলে দিক তাহলে ও তার উপর দুই তিনটা ধমক দিয়ে দিবে। এখন সে ক্যাপ্টেন সাহেবের বউ ‌।

নিশা আবসারকে নিয়ে ওর রুমে বসিয়ে দিল। আবসার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রুমটা পর্যবেক্ষণ করে দেখছে। খুব সাদামাটা রুমটা। একটা খাট, একটা আলমারি, একটা পরার টেবিলে আর একটা ড্রেসিং টেবিল দিয়ে সাজানো রুমটা। নিশা কোথা থেকে একটা হাত পাখা এনে আবসারকে বাতাস করা শুরু করলো। আবসার ভ্রু কুঁচকে নিশার দিকে তাকাতেই নিশা বলল – কারেন্ট নেই। বাইরে গরম পড়েছে খুব।

আবসার মুচকি হাসি দিয়ে নিশার হাত থেকে পাখাটা নিয়ে নিল আর বলল – এর থেকে বেশি গরমে থাকার অভ্যাস আছে আমার। তোমার গরম লাগলে বলো আমি ঠান্ডা করে দিচ্ছি।

নিশা লজ্জায় মিইয়ে গেল। এই লোকটা সারাক্ষণ শুধু লজ্জা দেয়। নিশা মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে ফিরলো। লোকটা কেমন অসভ্য মার্কা হাসি হেসে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

চলবে….

#বসন্ত_কন্যা
#পর্ব_৩০
#লেখিকা : Smiling

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

সময় বহমান, সে কারো জন্য বসে থাকে না আপন গতিতে চলে। এ কয়টা দিন স্বপ্নের মতো কেটেছিল আবসার আর নিশার কিন্তু বিদায়ের ঘন্টা যে বেজে গেছে। আবসারের ছুটি শেষ। আজ রাতের ট্রেনেই ফিরবে সে। নিশা মন খারাপ করে বসে আছে। আবসারের মনটাও যে খুব ভালো তা কিন্তু নয় বউকে ছেড়ে যেতে হবে আবার কবে ছুটি পাবে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। কিন্তু তার উপরের গম্ভীরতা দেখে ভিতরের মন খারাপটা বোঝার জো নেই।

রাত ৮ টা বেজে গেছে। নিশা সেই যে ওয়াশ রুমে ঢুকেছে বের হওয়ার আর নাম নেই। বিদায়ের সময় প্রিয়তমার মুখটা না দেখে, তার কাছ থেকে বিদায় না নিয়ে যেতেও ইচ্ছে করছে না আবসারের । বারবার ভ্রু কুঁচকে হাত ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে আবার ওয়াশ রুমের দরজার দিকে তাকাচ্ছে নাহ ওয়াশ রুমের দরজা খোলার নাম নিচ্ছে না। ট্রেনের সময় হয়ে যাচ্ছে, তবে কি যাওয়ার সময় একটা বার প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখটা দেখতে পারবে না সে, পারবে না নিজের বক্ষপিঞ্জরে একটা বার জড়িয়ে নিতে, পারবে না পরম ভালোবাসায় তার ললাটে একটা গভীর চুম্বন করতে? মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো, হাতের ব্যাগটা নিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য উদ্ধত হলেই ওয়াশ রুমের দরজাটা খট করে খোলার আওয়াজ হলো। হাসি ফুটে উঠল আবসারের ঠোঁটে, অধৈর্য হয়ে ওয়াশ রুমের দরজার দিকে তাকাতেই থ হয়ে গেল আবসর। শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরায় শীতল রক্তস্রোত বয়ে চলেছে, কেঁপে উঠছে কন্ঠনালী। গলা শুকিয়ে আসছে। বারবার মনে হচ্ছে “এই মেয়ে নির্ঘাত আমার চাকরিটা খেয়ে ছাড়বে ।”

ওয়াশ রুমের দরজায় সেই লাল রঙা রেবেকা বানুর না’ই’টিটা পড়ে দাঁড়িয়ে আছে নিশা, ঠোঁটে লাল টকটকে লিপস্টিক, চুলগুলো খোলা। জানালা থেকে আসা বাইরের মৃদু বাতাস দোলা দিয়ে যাচ্ছে নিশার চুলগুলোকে। গলায় , মুখে ফোঁটা ফোঁটা শিশির বিন্দুর বিন্দুর মতো পানির ফোঁটা আরও মোহনীয় করে তুলছে নিশাকে। নিশার শ’রী’রে’র অধিকাংশ ভাজই দৃশ্যমান এই পাতলা না’ই’টি’তে । ঢোক গিলল আবসার। কল লাগালো কাউকে।

– আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।

– ওয়ালাইকুমুস সালাম। হ্যা আবসার কি বলবে বলো।

জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজালো আবসার, বলল – আসলে স্যার ছুটিতে এসেছিলাম , বিয়ে করেছি এখন ছুটি তো শেষ।

– হ্যা তা কবে ফিরছো? আর তোমার কন্ঠ এমন কাঁপছে কেন?

– ম্যালেরিয়া।

– মানে?

– আমার ম্যালেরিয়া হয়েছে স্যার। আর কিছুদিন ছুটি লাগতো।

– কি ? ম্যালেরিয়া বাধালে কিভাবে তুমি?

– নারায়নগইঞ্জা মশার কামড়ে।

– নারায়ণগঞ্জের মশা আবার তোমাকে পেলে কিভাবে?

– আসলে আমার শ্বশুর বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। বিয়ের পর বউকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলাম। আর নারায়ণগঞ্জ কি যে মশার উপদ্রব কি বলবো স্যার। এত মশার ভীরে কখন যে ম্যালেরিয়া বাহীত মশা কুটুস করে আমাকে কামড় দিয়ে চলে গেল টেরই পেলাম না। আর এখন আমি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত।

– আচ্ছা সমস্যা নেই তুমি আরও কিছুদিন ছুটি নেও, সুস্থ্য হয়ে ফিরে এসো।

– আচ্ছা স্যার, ধন্যবাদ। এখন তাহলে রাখছি। আসসালামুয়ালাইকুম

নিশা এতক্ষন অবাক হয়ে আবসারকে দেখছিল। আবসারকে আজ নতুন ভাবে আবিষ্কার করে সে। আবসার যে এভাবে গুছিয়ে বানোয়াট কাহিনী বানাতে পারে জানা ছিল না নিশার। নিশা ঘুরে ঘুরে আবসারকে দেখছে। আবসার এক টানে নিশাকে নিজের কোলে বসিয়ে দিল, ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে বলল – এ কি রূপ দেখাইলা বউ, আমি যে পাগল হয়ে যাচ্ছি।

– আপনি এখনও এখানে কেন ক্যাপ্টেন সাহেব , আপনার ট্রেন যে মিস হয়ে যাবে।

– মশকরা করছো আমার সাথে?

– বালাই সাট আপনার সাথে মশকরা করার মতো সাহস আছে নাকি আমার, গরদান যাবে যে।

– বাহ ভালোই কথা বলতে শিখেছো, সাথে আমাকে পাগল করার দুষ্ট দুষ্ট বুদ্ধিও তৈরি করে শিখেছো।

নিশা লজ্জায় এলোমেলো দৃষ্টি ফেলছে। সত্যিই আজ বড় সাহসের কাজ করে ফেলেছে ও। তবে এই বুদ্ধি কিন্তু ওর মাথা থেকে বের হয়নি। এই বুদ্ধিদাতা হলেন মহান রেবেকা বানুর। ঐ বুড়ির মাথায় যে কিভাবে এত দুষ্ট দুষ্ট বুদ্ধি আসে কে জানে। প্রথম প্রথম কাজটা করতে একটু লজ্জা লাগলেও শেষে লাজ লজ্জা ভুলে আবসারকে আটকানোর এই পথই বেছে নিল নিশা।

বিছানায় শুইয়ে নিশার গলায় মুখ গুজলো , পরম আবেশে আবসারের চুলগুলো দুই হাতে খামচে ধরেছে নিশা। ভালোবাসার সাগরে ডুবে যাচ্ছে নিশা আর আবসার।

____________________________

দিন যায় , রাত যায়। কেটে গেল আরও একটি সপ্তাহ, এবার যে আবসারকে ফিরতে হবে। আগের বার মিথ্যা বলে ছুটি বাড়িয়েছিল। এবার যে আর তাও পারা যাবে না। কেঁদে কেটে নাক মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে নিশা। এই মায়াভরা মুখটার দিকে তাকালেই আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না আবসারের। কিন্তু করার কিছু নেই, যেতে যে হবেই। আবসারের সাথে স্টেশন পর্যন্ত এসেছে সে। আবসার অনেক বার বারন করেলেও শোনেনি নিশা। অবশ্য আয়ানও এসেছে ওদের সাথে। ট্রেন ছেড়ে যখন চলে যাচ্ছিল নিশার চোখ টলমল, আবসারের মনে হচ্ছিল ওর কলিজাটা ছিঁড়ে এখানেই রেখে যাচ্ছে। ট্রেনটা একটু দূরে যেতেই ফুঁপিয়ে উঠলো নিশা। নিজেকে কোনো মতে সামলে আয়ানের সাথে বাসায় ফিরলো।

বাসায় ফিরে কতক্ষন রেবেকা বানুর রুমে, কতক্ষন আবিদা বেগমের সাথে ঘুরছে নিশা, নিজের রুমে এখনও ঢোকেনি। ঐ রুমটা যে বড্ড খালি খালি লাগে ওর কাছে। রুমটার চারদিকে আবসারের স্মৃতি জড়িয়ে আছে, কান্না পায় খুব। আবার কবে দেখা হবে প্রিয় মানুষটার সাথে? আবার কবে তাকে জড়িয়ে নিতে পারবে নিজের সাথে? হাতের ফোনটা বেজে চলেছে নিশার সে দিকে কোনো খেয়াল নেই তার। সে আনমনেই আবসারের কথা ভাবছে। কিছুক্ষণ বাদে রেবেকা বানুর কথায় হুঁশ ফিরলো নিশার।

– কি রে ছেমড়ি হুঁশ কোন দিগে তোর মোবাইল বাজে।

হকচকিয়ে উঠলো নিশা। মোবাইলের স্ক্রীনে তাকিয়েই দেখে আবসার কল করেছে। তড়িঘড়ি করে কলটা রিসিভ করতে গিয়ে দিল কলটা কেটে। চমকে উঠলো সে , যাহ বাবা কলটা রিসিভ করতে গিয়ে কেটেই দিলো। আবসার নিশ্চই খুব রাগ করবে । নিশার ভাবনার মধ্যেই মোবাইলটা আবার বেজে উঠল। এবার নিজেকে বেশ শান্ত রেখেই কলটা রিসিভ করলো। কল রিসিভ করার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে অস্থির কন্ঠে আবসার বলে উঠলো – রাগ করেছো বউ? কথা বলবে না আমার সাথে?

– আমি রাগ করিনি, কেন রাগ করবো?

– তাহলে কেন কেটে দিলে?

নিশা আমতা আমতা করে বলল – তড়িঘরি করে কল রিসিভ করতে গিয়ে কেটে গেছে।

সস্থির নিঃশ্বাস ফেললো আবসার। শান্ত কন্ঠে বলল – মন খারাপ বসন্ত কন্যা?

– উঁহু

– মিথ্যে কেন বলছো? আমি স্পষ্ট দেখছি তোমার মন খারাপ।

– যখন দেখেছেনই জিজ্ঞেস করছেন কেন?

– এভাবে কথা বলছো কেন বউ?

ডুকরে কেঁদে উঠলো নিশা। নাক টেনে টেনে বলল – কথা বলবেন না আপনি। বড্ড নিষ্ঠুর আপনি ক্যাপ্টেন সাহেব। আমাকে একা রেখে চলে গেছেন।

– একা কোথায়? মা, বাবা , দাদী , আয়ান, মিষ্টি সবাই তো আছে।

– কিন্তু আপনি তো নেই আমার কাছে ক্যাপ্টেন সাহেব। আপনি যে আমার কাছ থেকে বহুদূরে চলে গেছেন। চাইলেই আপনাকে আর আমি দেখতে পারবো না। পারবো না এই অশান্ত মনটাকে শান্ত করতে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল আবসার, এ ছাড়া যে আর কোনো উপায় নেই তার। তার মনটাও যে বড্ড কাঁদছে। বুকের ভিতরটা হু হু করছে। তারও যে তার বসন্ত কন্যাকে ফেলে আসতে মোটেই ইচ্ছে করছিল না। বড্ড অসহায় লাগছিল নিজেকে।

– এভাবে কেঁদো না বউ। আমি যে শান্তি পাচ্ছি না, তোমার ঐ কান্নার শব্দ আমার বুকে তীব্র দহনের সৃষ্টি করছে। কষ্ট হচ্ছে আমার।

থেমে গেল নিশা। যাই হোক এই মানুষটাকে কষ্ট দিতে পারবে না সে। তার কষ্ট হচ্ছে শুনেই বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছে নিশার। তড়িঘড়ি করে চোখ মুছে বলল – এই দেখুন আমি আর কাঁদছি না। আপনি একটুও কষ্ট পাবেন না। আপনার কষ্ট যে আমার সইবে না ক্যাপ্টেন সাহেব।

হাজার কষ্টের মধ্যেও প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠল আবসারের মুখে।

চলবে….