বসন্ত কন্যা পর্ব-৩৩

0
386

#বসন্ত_কন্যা
#পর্ব_৩৩
#লেখিকা : সাদিয়া

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

আজ প্রায় দুই মাস আবসার বাহিরে গেছে মিশনে। আফ্রিকার একটি ছোট্ট দেশ এটি। বাড়ি, পরিবার ছেড়ে এতটা দূরে থাকা মেঘ কতটা কষ্টকর তা একমাত্র যারা থাকে তারাই জানে। এই বিষয়ে প্রবাসী ব্যক্তিবর্গ সবসময়ই আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র। আবসার এই দুই মাসেই হাঁপিয়ে উঠেছে সেখানে প্রবাসী ব্যক্তিরা বছরের পর বছর কিভাবে তার পরিবার স্ত্রী সন্তানদের ছেড়ে এত দূরে কাটিয়ে দেয় জানা নেই আবসারের। হাজার ব্যস্ততার মাঝেও একটু সময় পেলেই কল লাগায় বাড়িতে বাবা, মা , ভাই , বোন, নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীর সাথে এইটুকু কথায় যেন মন ভরে না তার। তবুও এতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে আর যে উপায় নেই।

আফ্রিকার একটা ছোট্ট দেশ এটি। সভ্যতার নীড়ে এখনও প্রবেশ করতে পারেনি দেশটির জনসাধারণ। দেশটির অধিকাংশ মানুষই বেঁচে থাকে মাটি খেয়ে। মাটির তৈরি ঘরে কোনো রকমের যাযাবরদের মতো বাস করে এরা । তার মধ্যে মাঝে মাঝেই পাশের দেশ চালায় অতর্কিত হামলা। নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য নেই কোনো ভালো অস্ত্র। মূলত এদের রক্ষা করা এবং সভ্যতার নীড়ে নিয়ে আসার জন্যই আবসারদের এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। আর বাংলাদেশের আর্মিরা তাদের কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে পালন করতে জানে।

আজ তিনদিন কথা হয়না নিশার সাথে। বিভিন্ন ব্যস্ততায় সময় করে উঠতে পারেনি। অবশ্য এখানে আসার পর এমনও হয়েছে যে একটানা সাতদিনও কথা হয়নি। তাছাড়া দেশটির সব স্থানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। তবে এমন একটা দেশে যে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় সেটাই তো বড় ভাগ্য। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ডাটা অন করতেই পর পর তিনটি ছবি এলো নিশার আইডি থেকে। ছবি তিনটি দেখেই চমকে উঠলো আবসার। প্রেগন্যান্সি রিপোর্টের ছবি যাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নিশা প্রেগন্যান্ট। থম মেরে বসে আছে আবসার। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না, চোখ দুটো ছলছল করছে। দেরি না করে কল লাগলো নিশাকে। কলটা ধরতেই আবেগী কন্ঠে বলল – আমি কি সত্যি দেখছি বসন্ত কন্যা, আমি সত্যিই বাবা হতে চলেছি?

নিশা বুঝতে পারছে আবসারের অবস্থা। একটু মজা নেওয়ার জন্য বলল – কে বলেছে আপনি বাবা হতে চলেছেন, আপনি তো মামা হতে চলেছেন।

– দুষ্টমী বাদ দেও বউ, সত্যি করে বলো না , আমি কি সত্যিই বাবা হতে চলেছি?

– মোটেই দুষ্টমী করছি না আমি ক্যাপ্টেন সাহেব। তুমি আমার বান্ধবীর ভাই সেই হিসেবে আমারও ভাই তাহলে হলে তো তুমি আমার বাচ্চার মামা । তুমি ফিরলে আমি আমার বাচ্চাকে তোমাকে মামা ডাকতে শিখিয়ে দেব।

ঠোঁট কামড়ে ধরলো আবসার, অস্রুসিক্ত নয়নে বলল – আমাকে তোমরা মাফ করে দিও।

নিশা অবাক হয়ে বলল – কি সব বলছো? মাফ চাইছো কেন? আমি তো দুষ্টমী করেছি তুমি কি সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছো?

– মাফ করে দিও আমাকে। আমি আজ এমন একটা সময় তোমার পাশে থাকতে পারলাম না। আমি এমনই হতভাগ্য একজন স্বামী যে স্ত্রীর এই সময় তার পাশে থাকতে পারছি না, এমনি হতভাগ্য পিতা যে নিজের সন্তানের জন্মের সময়ও তার পাশে থাকতে পারবে না, তাকে সবার প্রথম কোলে নিতে পারবে না।

ছলছল করে উঠলো নিশার চোখ। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে।
– এভাবে বলছো কেন? তুমি সেখানে মহৎ কাজে গেছো। সেখানে হাজার মায়ের সন্তান আজ তোমার শিক্ষার শিক্ষায় আলোকিত ক্যাপ্টেন সাহেব। সেখানকার হাজার মানুষ আজ তোমাকে নিজেদের ভরসার স্থল হিসেবে পেয়েছে। আমার তোমাকে নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই, উল্টো তোমাকে নিয়ে গর্ববোধ হয় আমার। দেখবে আমাদের সন্তানও তোমাকে নিয়ে গর্ববোধ করবে।

মৃদু হাসলো আবসার। ঠোঁটে হাসির রেশ নিয়েই বলল – একদম কেয়ারলেশের মতো চলবে না, তোমার তো আবার যেখানে সেখানে আছাড় খাওয়ার অভ্যাস আছে। ঠিকভাবে খাওয়া দাওয়া করবে, একদম খাওয়া দাওয়ায় অনীহা করবে না। আমি কিন্তু মাকে জিজ্ঞেস করবো।

– ইসসসস বেবি আসতে না আসতেই বাবার এত কেয়ার। আমি বুঝি এখন পর হয়ে গেছি।

– এই কেয়ার গুলো বেবি এবং বেবির মা দুজনের জন্যই। কাছে নেই তো আমি চাইলেও নিজের হাতে বেবি আর বেবির মায়ের যত্ম নিতে পারবো না।

আর কথা বাড়ালো না নিশা। এত বড় একটা খুশির খবরের মধ্যে সে কিছুতেই চায় না আবসারের মনটা খারাপ হয়ে যাক। লোকটা এমনি কত দূরে , চাইলেই হয়তো নিজের খুশিটা কারো সাথে ভাগ করে নিতে পারছে না। এমনি পরিবারকে ছেড়ে এত দূরে রয়েছে। এখন আবার তার সন্তান আসছে আর সে কাছে নেই।

– বউ……

– হুম

– মোবাইলটা একটু তোমার পেটের কাছে নেবে আমি আমার সন্তানকে একটু অনুভব করতে চাই‌।

নিশা মোবাইলটা নিজের পেটের কাছে ধরলো। আবসার পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে নিজের সন্তানকে অনুভব করছে। হয়তো এত দূর থেকে অনুভব করা সম্ভব না। কেউ শুনলে এটাকে পাগলামি ছাড়া আর কিছুই মনে করবে না। তবে এই মুহূর্তে আবসারের যেন এতেই তৃপ্তি। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে নিশাকে শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে নিতে কিন্তু সেটাও সম্ভব না। তাই এভাবেই নিজের অশান্ত মনটাকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে।

_____________________________

গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপদাহ চারদিকে। তীব্র রোদে খাঁ খাঁ করছে পুরো শহর। নিশার আট মাস চলছে। পেটটা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। হাঁটতে চলতেই কষ্ট হয় খুব। হাত পা গুলোও ফোলা ফোলা। নিচতলায় শিফট করা হয়েছে তাকে। এই অবস্থায় বারবার শিড়ি বেয়ে উপরে ওঠা নিচে নামাটা ভালো হবে না । প্রেগন্যান্সির পর থেকেই তাকে নজরে নজরে রাখছে আবিদা বেগম। বাড়ির সবাই খুব খেয়াল রাখছে। আর আবসার, সে সময় পেলেই কল করে সব খবরাখবর নিচ্ছে।

সারাদিন আর শুয়ে বসে থাকতে ভালো লাগে না নিশার। ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটির উদ্দেশ্য একটু বেড়িয়েছিল কিন্তু তার জন্য যে এমন একটা বিপদ ওত পেতে বসে আছে বুঝতে পারেনি। কাজের মেয়েটা ঘর মোছার সময় পানি ফেলে রেখেছে খেয়াল করেনি। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ পানির উপরে পা পিছলে উপুড় হয়ে পড়ে গেল নিশা। পেটে আঘাত লেগেছে তার, তীব্র যন্ত্রনায় চিৎকার করে উঠল সে। র’ক্ত ছুটে গেছে। চিৎকার শুনে আবিদা বেগম দৌড়ে এসে আঁতকে উঠলো। গরু কা’টা’র মতো র’ক্ত গড়িয়ে নামছে, আর অসহ্য ব্যথায় ছটফট করছে মেয়েটা। চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। জ্ঞান হারালেন আবিদা বেগম। এমনি হার্ট দুর্বল তার , নিশার এমন অবস্থা সহ্য করতে পারেনি। ছুটে এলো মিষ্টি, এই বিপদে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে সে। একদিকে মায়ের মতো শ্বাশুড়ি অন্য দিকে বোনের মতো জা। দুজনের অবস্থা দেখেই অস্থির হয়ে উঠছে। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। বিপদের সময় বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছে, মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়েছে। কোনো মতে নিজেকে সামলে আয়ানকে কল করলো। আয়ান আর আনসার সাহেব তখন অফিসে ছিলেন, বাড়িতে শুধুমাত্র এরা তিনজনই ছিল।

___________________________

( ৬ মাস পর )

সময় ও স্রোত কারো জন্য বসে থাকে না। সময় পরিবর্তনশীল। তার সাথে সাথে পরিবর্তনশীল চারপাশ, পরিবর্তনশীল মানুষ। সময়ের সাথে সাথে সবকিছু বদলে গেছে। আয়না দুই মাসের প্রেগন্যান্ট, কাজল এখনও আগের মতোই আছে। রাকিব প্রেম করছে, মেয়েদের পিছু ঘুরতে ঘুরতে একজনকে পটিয়ে প্রেমিকা বানিয়ে ফেলল। নিলয় এখন কম খায়, ডায়েট করছে। তার নাকি আর মোটা জীবন ভালো না, কোনো মেয়ে পাত্তা দেয় না। ফারিয়া মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। আগের থেকে ফয়সালের সাথে সম্পর্কটা ভালো হয়েছে। ফয়সাল এখন তাকে চোখে হারায়। অবশ্য এসবই ফারিয়ার কঠিন অধ্যাবসয়ের ফল। সে হাল না ছেড়ে ফয়সালের পিছনে পড়ে ছিল। একটা সময় ফয়সালও গলেছে, ভুলতে পেরেছে নিশাকে। আর নিশার জায়গা নিয়ে নিয়েছে ফারিয়া। রিশাটাও বেশ বড় হয়েছে। মিষ্টিও প্রেগন্যান্ট। সব মিলিয়ে সবাই ভালো আছে। রেবেকা বানু বিছানায় পড়ে গেছেন। এখন আর হাঁটতে চলতে পারে না। বিছানাই তার সঙ্গী।

আজ দেশে ফিরছে আবসার। মনের মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভূতি। কতদিন পর আজ সে বাড়িতে ফিরবে নিজের পরিবারের কাছে, নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে। আর তার সন্তান? নিশ্চই সেও এখন বড় হয়ে গেছে, হাসতে পারে। আচ্ছা সে কি বসতে পারে? শুনেছে তার নাকি একটা সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। ছবি দিয়েছিল আয়ান। ছবিতে মেয়েটা চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে ছিল। তবে নিশার সাথে যোগাযোগটা কেমন যেন বন্ধ হয়ে গেছে। কথা হয় না বললেই হয়। দুই তিনদিন পর পর আবসার কল করে তাও ফোন রিসিভ করায় আবিদা বেগমকে দিয়ে আবার কখনও মিষ্টিকে দিয়ে। আর তখনই কল করে তখনই সে হয় মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত, না হয় গোসল করে , না হয় ওয়াশ রুমে। গত ছয় মাসে নিশার সাথে কথা হয়েছে হাতে গোনা ৫ থেকে ৬ বার। এটা কেমন কথা বেবি হয়েছে বলে কি হাজবেন্ডকে ভুলে যাবে? এখন বেবিই সব। অভিমানের পাহাড় জমেছে আবসারের মনে। এবার বাড়িতে গিয়ে আচ্ছা করে বকে দিবে মেয়েটাকে। দূরে গিয়েছে কিনা মেয়েটা ওর রাগ, আর ধমককে একদম পাত্তা দিচ্ছে না। সাহস বেড়ে গেছে খুব।

সেই কখন থেকে বাড়ির বেল বাজাচ্ছে কিন্তু দরজা খুলছে না কেউ ‌। আবসার এখন রীতিমতো বিরক্ত। আর কতক্ষন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। এমনি বাইরে যা গরম। অবশ্য ও যে আসবে বাড়িতে জানায়নি। ভেবেছিল সবাইকে সারপ্রাইজ দিবে। আচ্ছা নিশা যখন দেখবে আবসার ওর সামনে দাঁড়ানো তখন কি করবে সে? সে কি খুব খুশি হবে? আনন্দে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার বুকে? ভাবতেই ঠোঁট টিপে হাসলো আবসার । এখনও দরজাটা কেউ খুলে দেয়নি। আবার কলিং বেল বাজানোর জন্য হাত তুলতেই দরজা খুলে দিল মিষ্টি।

দরজার সামনে আবসারকে দেখে ভরকে গেল মিষ্টি। দেখেই মনে হচ্ছে খুব ভয় পেয়ে গেছে মেয়েটা। ভ্রু কুঁচকে এলো আবসারের , নিজের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলো না ভয় পাওয়ার মতো তো কিছু নেই। একটা শুকনো ঢোক গিলে সরে দাঁড়ালো মিষ্টি। আবসার ভিতরে ঢুকে গেল। রান্নাঘর থেকে আবিদা বেগম আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো।

– কে এসেছে ছোট বউমা?

সামনে আবসারকে দেখেই চমকে উঠলো। এতদিন পর ছেলেকে এভাবে সামনে দেখে চোখ দুটো ভরে এলো। নিজের সাথে জড়িয়ে নিল ছেলেকে।

– কেমন আছিস বাবা? একদম রোগা হয়ে গিয়েছিস। খাওয়া-দাওয়া করিসনি ঠিক মতো?

– আয়ান আর বাবা কোথায় মা?

– ওরা অফিসে ‌।

সবাই সামনে থাকলেও আবসার খুঁজে যাচ্ছে অন্য একজনকে। তার চোখ দুটো যে তাকে দেখার তৃষ্ণায় কাতর হয়ে আছে। চারদিকে চোখ বুলিয়েও কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির দেখা না পেয়ে আবসার জিজ্ঞেস করল – নিশা কোথায় মা?

এতক্ষন এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন আবিদা বেগম। নিশার কথা শুনে আমতা আমতা করছে আবিদা বেগম। চোখে মুখে ভয় স্পষ্ট। মিষ্টি দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। সবার পরিস্থিতি একবার পর্যবেক্ষণ করে রুমের দিকে পা বাড়ালো আবসার। এখানে যেহেতু নেই তাহলে নিশা মেয়েকে নিয়ে তার রুমেই থাকবে।

চলবে….