বসন্ত কন্যা পর্ব-৩৪ এবং শেষ পর্ব

0
519

#বসন্ত_কন্যা
#পর্ব_৩৪ ( শেষ পর্ব )
#লেখিকা : সাদিয়া

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

রুমে গিয়ে আবসার দেখে নিশা একটা পুতুল নিয়ে শুয়ে আছে। কত দিন পর সে তার বসন্ত কন্যাকে দেখলো, চোখ দুটো যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে। কন্ঠনালী কাঁপছে। কিন্তু মেয়েটা কেমন শুকিয়ে গেছে, চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে, মুখটা কেমন চুপসে গেছে। অসুস্থ নাকি মেয়েটা? কিন্তু কেউ তো তাকে বলেনি। এই দুই দিন আগেও তো ওর মায়ের সাথে কথা হলো আবসারের। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল – বসন্ত কন্যা।

চোখ খুললো নিশা, চমকে উঠলো সে। চোখ দুটো বন্ধ করে আবার খুলল। না সে ভুল দেখছে না। আবসার তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কতদিন পর এই মানুষটা তার সামনে। কতদিন পর তার প্রিয় মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছে সে। কতশত অপেক্ষা, প্রায় দেড়টা বড় বছর। ১ বছর পরই আবসারের ফিরে আসার কথা থাকলেও বিভিন্ন ঝামেলায় ফেরা হয়েছে প্রায় দেড় বছর পর। ঝাঁপিয়ে পড়লো আবসারের বুকে, ডুকরে কেঁদে উঠলো। আবসারও নিজের সাথে জড়িয়ে নিল তার বসন্ত কন্যাকে কতদিন পর তার বসন্ত কন্যাকে একটু ছুঁয়ে দিতে পেরেছে। ইচ্ছে তো করছে একদম বুকের ভিতরে ঢুকিয়ে নিতে। মেয়েটা কেঁদেই যাচ্ছে। নিশার মাথায় হাত বুলিয়ে আবসার বলল – কাঁদছো কেন তুমি? কি হয়েছে এই দেখো আমি চলে এসেছি।

নিশা দুই হাত দিয়ে চোখ মুছে বলল – হ্যা তাই তো তুমি চলে এসেছো, একেবারে চলে এসেছো আমার কাছে।

বিছানা থেকে পুতুলটা কোলে তুলে নিল নিশা। আবসারের সামনে নিয়ে গিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল – দেখো আমাদের মেয়ে। কোলে নেও ওকে।

আবসার কোলে নিল না পুতুলটাকে। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো – কি সব আছে বাজে কথা বলছো তুমি? এই পুতুলটা আমাদের মেয়ে হতে যাবে কেন? আর আমাদের মেয়েই বা কোথায়?

তেড়ে এলো নিশা। কর্কশ কন্ঠে বলল – কি বললি আমার মেয়েকে তুই পুতুল বললি? তোর সাহস কি করে হলো আমার মেয়েকে পুতুল বলার?

নিশার কথাগুলো খুব অস্বাভাবিক লাগছে। সে তুই তোকারি করছে তাও আবসারের সাথে। যে মেয়েকে আপনি থেকে তুমিতে আনতে কাঠঘড় পোড়াতে হয়েছে সে আজ তুই তোকারি করছে। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আবসার। নিশা যেন রনচন্ডী রূপ ধারন করেছে। রুমের সবকিছু একের পর এক ভাঙচুর করা শুরু করেছে। আবসার শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। দৌড়ে এলো আবিদা বেগম আর মিষ্টি। মিষ্টি নিশাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে কোনো কাজ হচ্ছে না। আবিদা বেগম আবসারকে টেনে বাইরে নিয়ে এলো। আয়ান আর আনসার সাহেবকে খবর দেওয়া হয়েছে তারা এখনও আসেনি। নিশার পাগলামো বেড়েই চলেছে। মিষ্টি দ্রুত ডাক্তারকে কল করেছিল। ডাক্তার এসে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে গেছে নিশাকে আর ওকে উত্তেজিত করতে বারন করে গেছে তাহলে হিতে বিপরীত হবে।

এতক্ষন সবটা নীরব দর্শকের মতো দেখছিল আবসার। সবটা দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। মুখ দিয়ে কথা বলতে ভুলে গিয়েছিল সে । এতক্ষন পর মুখ খুলল আবসার। বলল – কি হয়েছে আমার নিশার?

আবিদা বেগম আমতা আমতা করছে। আবসার আবার বলল – এখনও চুপ থাকবে মা? এতক্ষন সবটা দেখে আমার বুঝতে বাকি নেই নিশার স্বাভাবিক নয়। কি হয়েছে ওর? আর কিভাবে হলো।

আবিদা বেগম বা মিষ্টি কেউ কোনো কথা বলছে না। চিৎকার করে উঠলো আবসার, বলল – অ্যানসার মি ড্যাম ইট।

কেঁপে উঠলো আবিদা বেগম আর মিষ্টি। ভয়ে কথা বলছে না তারা। সবটা শুনে কিভাবে রিয়েক্ট করবে আবসার জানা নেই। এমন সময় বাড়ির মধ্যে ঢুকলেন আয়ান আর আনসার সাহেব। ঢুকতে ঢুকতে তারা আবসারের সব কথাই শুনেছে। আনসার সাহেব বললেন – তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আমি দিচ্ছি মাই সান।

সবটা বলা শুরু করলেন আবসার সাহেব।

– সেদিন পা পিছলে পড়ার পর নিশাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয় । টানা ৪ ঘন্টা অপারেশন শেষে ডাক্তার এসে বলল – স্যরি অনেক চেষ্টার পরও আমরা বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারিনি। পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়েছিল বাচ্চাটা তাই বাঁচানো সম্ভব হয়নি।

বাচ্চাটা খুব ফুটফুটে হয়েছিল। কিন্তু পৃথিবীতে আসার আগেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হয়েছিল তাকে। বাড়ির সবার উপরেই শোকের ছায়া নেমে এসেছিল সেদিন । টানা ৪৮ ঘন্টা পর নিশার জ্ঞান ফিরেছিল। ততক্ষন পর্যন্ত তার সন্তানের লাশ রাখা সম্ভব হয়নি সবাই মিলে কবরে রেখে এসেছিল ফুটফুটে মেয়েটিকে। জ্ঞান ফেরার পর নিশা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেছিল তার বাচ্চার জন্য। এক নার্সের মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল তার মৃত বাচ্চা হয়েছে। উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল নিশা। কোনো ভাবেই তাকে শান্ত করা যাচ্ছিল না। শেষে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো ঘুম ভেঙে একদম নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল নিশা। কারো সাথে কোনো কথা বলছিল না। মুখ ফুটে শুধু এই টুকুই বলেছিল – আমি বাড়ি যাব।

বাড়িতে নিয়ে আসার পর নিশা নিজেকে ঘর বন্ধি করে নিল। সবাই অনেক চেষ্টা করেও তাকে রুমের বাইরে আনতে পারেনি। তবে সে যখন নিজের ইচ্ছাকৃতভাবে রুম থেকে বেরিয়ে এলো তখন তার হাতে একটা পুতুল ছিল। তার মতে এ পুতুলটাই তার মেয়ে। ঐ পুতুলটাকে পুতুল বলায় সেদিনও উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল সে। ডাক্তারকে ডাকা হলে সে বলল নিশা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে যেন কোনোভাবে উত্তেজিত করা না হয় ।সারাদিন রুমের মধ্যে থাকে নিশা আর ঐ পুতুলটার সাথে কথা বলে। আবিদা বেগম বা মিষ্টি তার রুমে খাবার নিয়ে গেলে শুধু মাত্র দুই একবার তাদের দিকে চোখ তুলে তাকাতো। রুমের বাইরে কখনও আসেনা সে।

সবটা শুনে হুংকার দিয়ে উঠলো আবসার।
– এত কিছু হয়ে গেল আর তোমরা আমাকে কেউ কিছু জানানোর প্রয়োজনবোধে করলে না।

আনসার সাহেব আমতা আমতা করে বলল – এসব শুনলে তুই খুব চিন্তা করতি। তুই খুব দূরে ছিলি ওখান থেকে তোর আসাও সম্ভব ছিল না। তারপর এইসব শুনে যদি তোরও ওখানে বসে কোনো বিপদ হতো তাই জানাইনি।

– তাই কি? আমার স্ত্রী, আমার সন্তান এত কিছু হয়ে গেল তাদের বিষয় জানার কি আমার কোনো অধিকার নেই?

রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে তার। এত কিছু হয়ে গেল সে কিছু জানতেই পারলো না। তার সন্তান পৃথিবীতে আসার আগেই তাকে রেখে বিদায় নিল, আর স্ত্রী আজ পাগল প্রায় আর সে ক্ষুনাক্ষরেও কিছু টের পেল না। কতকিছু গেছে মেয়েটার উপর দিয়ে, একা একা কতটা সহ্য করেছে নিশা ভাবতেই চোখ ভরে এলো আবসারের। নিশার রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।

খাটের উপর পুতুলটাকে কোলে নিয়ে বসে আছে নিশা। আবসারকে দেখেই আবার উত্তেজিত হয়ে উঠল। আবসার দ্রুত গিয়ে নিশাকে জড়িয়ে নিল নিজের সাথে। এবার আর নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। অবাধ্য চোখের পানিগুলো যে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। আবসারের স্পর্শে নিশা শান্ত হয়ে গেছে। চুপ মেরে মুখ গুজে রয়েছে আবসারের বুকে।

আবসার নিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল – এমন করছো কেন বউ? তুমি কি আর আমাকে আগের মতো ভালোবাসো না?

নিশা ঠোঁট ফুলিয়ে উত্তর দিল – বাসি তো। কিন্তু তুমি আমার মেয়েকে পুতুল বললে কেন? জানো তো সবাই আমার মেয়েটাকে পুতুল বলে।

– আমাদের মেয়েটা পুতুলের মতো সুন্দর দেখতে কিনা তাই সবাই পুতুল বলে।

নিশা ঠোঁট প্রসস্ত করে একটা হাসি দিয়ে বলল – সত্যি বলছো তুমি?

আবসার নিশার কপালে একটা চু’মু দিয়ে বলল – একদম সত্যি বলছি।

____________________________

( ৫ বছর পর )

পেড়িয়ে গেছে অনেকটা সময়। বদলেছে সবকিছু। রেবেকা বানু আর নেই। তিনি গত হয়েছেন আজ প্রায় তিন বছর। মিষ্টি আর কাজলের ফুটফুটে দুটো ছেলে হয়েছে আর আয়নার একটা মেয়ে হয়েছে। রাকিব তার সেই প্রেমিকাকে বিয়ে করে নিয়েছে আর নিলয় বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছে। বেচারা আর জীবন প্রেম করতে পারলো না। ফয়সাল আর ফারিয়াও বিয়ে করে নিয়েছ। আর নিশা আর আবসার, তাদের ফুটফুটে একটা কন্যা সন্তান হয়েছে। মেয়ের বয়স তিন বছর। আবসারের চেষ্টা আর আল্লাহর রহমতে নিশা এখন পুরোপুরি সুস্থ।

আজও আবার সেই পহেলা বসন্ত। পুরো ঢাকা মেতে উঠেছে বসন্তের উৎসবে। রাস্তার পাশ হাতে হাত রেখে হাঁটছে তিনজন। আবসার, নিশা আর তাদের মাঝখানে দুহাতে বাবা মায়ের হাত ধরে হাঁটছে তাদের ছোট্ট মেয়ে আনিয়া । নিশা সেই প্রথম দিনের মতো আজও হলুদ শাড়ি জড়িয়েছে নিজের শরীরে, চুলগুলো খোলা। আবসার হলুদ একটা পাঞ্জাবি জড়িয়েছে আর ছোট্ট আনিয়াকেও হলুদ একটা শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছে নিশা।

হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ আবসার নিশার দিকে তাকিয়ে বলল-

“শীতের শুষ্কতাকে বিদায় দিয়ে যেমন
বসন্ত এসে নিজের রঙে রাঙিয়ে দেয় প্রাকৃতিকে।
তেমনি তুমিও আমার শুষ্ক , নির্জীব হৃদয়কে রাঙিয়েছো
তোমার রঙে
তুমি এসেছিলে কোনো এক বসন্তে,
আমার হৃদয়ে বসন্তের দোলা দিতে।
বসন্ত কন্যা
– ( কলমে : Smiling )

( সমাপ্ত )