বসন্ত বিকেল পর্ব-০১

0
30

#বসন্ত_বিকেল
#নবনী_নীলা
#পর্ব_১

” বিয়েতে রাজি না হয়ে আমি কোথায় যাবো শুনি? আমি যদি এখন বলি যে আমি এই বিয়ে করবো না। আমার ফ্যামিলি ধরেই নিবে আমার প্রেম আছে। আর এমন ভয়ানক অপবাদ আমি নিজের মাথায় নিতে পারবো না। সমস্যা আপনার তাই সমাধান আপনি নিজেই খুঁজে বের করুন।”

” ওকে অল রাইট। তাহলে এইসবের কনসিকুয়েন্স তোমাকেই ফেইস করতে হবে। আমার যা বলার ছিলো আমি বলেছি।” বলেই শুদ্ধ গর গর করে সিঁড়ি বেয়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো।

মাহা হা করে তাকিয়ে রইল। লোকটা কি তাকে হুমকি ধামকি দিয়ে গেলো নাকি! বিয়ে করবে না নিজের ফামিলকে বললেই তো হয়। আমাকে হুমকি দিয়ে গেলো কেনো? এতদিন মেয়েদেরকে জোর করে বিয়ে দিতে শুনেছি।ছেলেকে জোড় করে বিয়ে দিচ্ছে এটা প্রথম শুনলাম।

বিয়েটা ভেঙে দেওয়ার উপায় থাকলেও মাহা নিরুপায়। কারণ এই প্রস্তাব এনেছে তার আপন দুলাভাই। যদি এইখানেও সে ঝামেলা করে তাহলে তার পিন্ডি চটকাবে সবাই। বিয়ে নিয়ে আলাদা কোনো চিন্তা নেই মাহার। যা হবে দেখা যাবে।
সে শাড়ির কুচি ধরে আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নামলো। বাসায় ঢুকেই দেখে সবার মুখে কি মিষ্টি এক হাসি।

বিয়ে যার তাদের মুখে হাসির বিন্দুমাত্র দেখা যাচ্ছে না। একেই বলে কারোর পৌষ মাস তো কারোর সর্বনাশ। মাহাকে দেখেই এক মহিলা এসে আদর করে কথা বলতে বলতে ভিতরে নিয়ে গেলো।

আজকে মাহা আর শুদ্ধর এনগেজমেন্ট হয়ে গেলো। বহু চেষ্টা করে পাত্র বা পাত্রী কেউই এনগেজমেন্ট আটকাতে পারলো না। পাত্র পক্ষ আর পাত্রী পক্ষ সবাই ভীষন খুশি। তারা যত দ্রুত সম্ভব তারা বিয়ে সেরে ফেলতে চায় এইদিকে পাত্র পাত্রী বিয়ে ভাঙতে চায়।

মাহা নিজের ইয়ার ফাইনালের কথা বলে বিয়ে পিছিয়ে নিতে নানা আকুতি মিনতী করেই যাচ্ছে। ওইদিকে শুদ্ধ নিজের বিজনেসের ব্যস্ততা দেখিয়ে কারোর কথাই কানে নিচ্ছে না। আবার এদিকে মেয়ে পক্ষ থেকেও ছেলে পক্ষের তাড়া বেশি। তাই ছেলের মা নিজেই মেয়ের বাবাকে ফোন দিলেন।

” দেখুন খন্দকার সাহেব। বিয়ের ব্যাপারে দেরি করাটা আমাদের পছন্দ না।”

” জ্বি। আপনারা তারিখ ঠিক করুন। এইদিকে বিয়ের আয়োজনের একটা ব্যাপার আছে। আবার মাহজাবিনের পরীক্ষা সামনে, সব মিলিয়ে একটা তারিখ ঠিক করতে হবে।”

” কিছু যদি না মনে করেন, আমি একটি প্রস্তাব দেই?”

” জ্বি, জ্বি অবশ্যই বলুন।”

” আমি বলি কি নিজ নিজ কাছের মানুষদের নিয়ে আকদ সেরে ফেলি। তারপর মাহজাবিনের পরীক্ষা শেষ হলে আমরা মনের মতো করে অনুষ্ঠান করে ওকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসবো। আপনার এই ব্যাপারে কি মত? ”

” জ্বি পবিত্র কাজ তো ফেলে রাখা ঠিক হবে না। তাহলে আপনারা একটা তারিখ ঠিক করে আমাকে জানান।”

শুদ্ধর মা এবার আর কোনো রিস্ক নিতে চায় না। একবার এমন গাফলিতেই তার ছেলের আজ এই অবস্থায়। দ্বিতীয়বার তিনি আর এই ভুল করবেন না। বিয়েটা যত তারাতারি তাকে সেরে ফেলতে হবে। শুদ্ধ যদি আবার মত বদলে ফেলে।

আফরোজা বেগম নিজের মেয়ের সাথে আকদ নিয়ে আলোচনায় বসে পড়লেন। কবে তারিখ ঠিক করবে, কি কি কিনতে হবে তার লিস্ট, কে কে যাবে? আরো কত কি! অথচ এইদিকে বরের কোনো মাথা ব্যথা নেই। সে নিজেকে ব্যবসায় ব্যাস্ত রাখছে। শুদ্ধ নিজের ম্যানেজারের সাথে কথা বলছিলো এই সময়ে তার মা ঘরে ঢুকলেন।

আফরোজা বেগম যেনো ছেলের চেয়ে আরো বেশি ব্যতিব্যস্ত। রুমে ঢুকেই বললো,” শুদ্ধ মাহাজাবিনকে কল দে তো। ওর সাথে কথা আছে আমার।”

শুদ্ধ তার মাকে এতো ব্যতিব্যস্ত দেখে ফোন রেখে বলল,” কি হয়েছে তোমার! কি করছো?”

আফরোজা বেগম ছেলের কথা অগ্রাহ্য করে বলল,” কল দিতে বলেছি কল দেও।”

শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে বললো,” মাহজাবিন? কে মাহজাবিন!”

আফরোজা বেগম অগ্নি চোখে তাকিয়ে বললেন,” তোমার হবু বউ। তাকে কল দেও।”

শুদ্ধ এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,” আমার কাছে ওর নাম্বার নেই।”বলেই চলে যাচ্ছিল তখন আফরোজা বেগম কটমট করে তাকিয়ে বললেন,” রিধি তোমাকে হোটসঅ্যাপ করেছে নাম্বার।”

শুদ্ধ চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করে বললো,” মা, তুমি যে আমার অমতে বিয়েটা দিচ্ছো। তোমার কি মনে হয় এটা ঠিক হচ্ছে?”

আফরোজা বেগম কাপড় ভাজ করা থামিয়ে বললেন,”তোমার কথা তো আমি কোনোদিন ফেলেনি। তোমার পছন্দকেও মেনে নিয়েছিলাম। তার ফল কি পেলাম? কোথায় সে এখন! সারাজীবন কি তার বিরহে কাটিয়ে দিবে তুমি? জীবনে তো সব কিছু নিজের ইচ্ছায় করলে একবার না হয় এই মায়ের কথা শুনে দেখো।”

তার মায়ের এতো চিন্তা এতো উদ্বিগ্নতার কারণ হয়তো সে নিজেই। শুদ্ধ নিশ্চুপে নিজের মায়ের চেহারার দিকে তাকালো তারপর বললো,” হুম সেটাই করছি।”

আফরোজা বেগম কঠিন গলায় বললেন,” না তুমি করছো না। আমার কথা শুনলে এইভাবে আমার সিদ্ধান্তকে অবহেলা করতে না।।”

শুদ্ধ এগিয়ে গিয়ে নিজের মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” মা আমি একটু ঝামেলায় ছিলাম। তুমি বলো কি করতে হবে, সব করবো।”

আফরোজা বেগম একটু অভিমান দেখিয়ে শুদ্ধকে সরিয়ে দিয়ে বলল,” মাহাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করো কালকে সে কখন ফ্রি থাকবে। তাকে নিয়ে একটু বাইরে যাবো আমি।”

” আমি কল দিচ্ছি তুমি জিজ্ঞেস করে নেও।” বলে নিজের মায়ের দিকে তাকালো।আফরোজা বেগম নিজের অভিনয় আরেকটু শক্ত করতেই শুদ্ধ বললো,” থাক আমিই জিজ্ঞেস করছি।”

আফরোজা বেগম রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে একটু মুচকি হাসলেন।

শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। কি বলবে সেটাই ভাবছে। পরক্ষনেই সে চিন্তা করলো এতো ভাবার কি আছে! শাহরিয়ার শুদ্ধ কত বড় বড় প্রজেক্ট ডিল করে আর এই মেয়ে কি এমন যে তাকে নিয়ে ভাবতে হবে।

মাহা নিজের খাটে শান্তিতে শুয়ে এই জটিল অবস্থা নিয়ে ভাবছে। লোকটা বিয়ে করতে চায় না। এই কথা কি তার পরিবার জানে? কোনো ভাবে যদি এই কথা বাবা মায়ের কানে দেওয়া যায়। এই দুশ্চিন্তার মাঝে আননোন নাম্বার থেকে কল আসতেই তার ফোন বেজে উঠলো। মাহা বিরক্তি নিয়ে তাকালো তারপর কল কেটে দিয়ে আবার গভীর ভাবনায় চোখ বুজলো।অপরিচিত নাম্বারে সে কথা বলে না। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন বেজে উঠলো মাহা আবার কল কেটে দিলো।

শুদ্ধ দাঁতে দাঁত চিপে তৃতীয় বার কল করলো। সাহস কত! আমার ফোন কেটে দিচ্ছে। এবার কল ধরতেই শুদ্ধ কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে মাহা বললো,” কে আপনি! রাত বিরাতে মেয়েদের ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করেন তাই না? বার বার কল কেটে দিচ্ছি তাও কল করে যাচ্ছেন। একদম ইভটিজিংর মামলা দিয়ে…” বাকিটা বলে শেষ না করতেই ওপাশ থেকে একটা ধমক খেলো মাহা।

” আর ইউ আউট অফ ইউর মাইন্ড। কি যাতা বলছো?”

মাহা অবাক হয়ে বললো,” আমাকে ফোন দিয়ে আবার আমাকেই ধমক দিচ্ছে। সাহস তো কম না।

শুদ্ধ দাঁতে দাঁত চিপে,” স্টুপিড” বলেই ফোনটা কেটে দিলো। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে সে। হাও ডেয়ার সী?

মুহুর্তেই শুদ্ধর ফোন বেজে উঠলো। শুদ্ধ কল কেটে দিলো কিন্তু মাহা নাছোড়বান্দা তাকে মুখের উপর স্টুপিড বলে কেউ কল কেটে দিবে আর সে ছাড় দিবে এটা সম্ভব নয়। শুদ্ধ কল ধরতেই ওপাশ থেকে,” আপনি স্টুপিড।” এই বাক্যটি সজোরে প্রতিধ্বনি হয়ে কল কেটে গেলো। শুদ্ধ চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ সামলাচ্ছে। এই মেয়েকে সারাজীবন সহ্য করবে কিভাবে ভেবেই তার কপালে ভাঁজ পড়ছে।

মাহা সাথে সাথে নাম্বারটা ব্লক লিস্টে রেখে দিলো। মেজাজটাই খারাপ করে দিলো। মাহার বোন সাহা ( শাহানাজ)রুমে ঢুকে মাহার চোখে মুখে রাগ দেখে বললো,” কিরে চেহারা এমন করে রাখছিস কেনো?”

” কিছু না বাদ দেও।” বলেই আবার চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো মাহা।

” বাদ দেই কিভাবে তোর স্বশুর বাড়ির সবাই দেখি বিয়ে দিয়ে একদম প্রস্তুত। বাবা বললে তো কাল এসেই বিয়ে করিয়ে দেয়।”

মাহা নিজের বোনের দিকে তাকিয়ে বললো,” কেনো এতো তড়িঘড়ি করছে সব বুঝেছতে পারছি আমি।”

” এই কি বুঝেছিস তুই?”

মাহা এক হাতে ভর করে উঠে বললো,” লোকটার কোনো সমস্যা আছে মনে হয়। লোকটাকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে কি আর এমনি এমনি?”

সাহা ভ্রু কুঁচকে বললো,” তুই কিভাবে জানিস জোড় করে বিয়ে দিচ্ছে?”

” আরেহ লোকটা নিজে আমাকে বলেছে। আমি যেনো বিয়েতে না করে দেই।”

” আচ্ছা তাই বুঝি? এই কথা আর কে কে শুনেছে?”

” আমি শুনেছি। আমাকে বলেছে নিজের মুখে।”

” আচ্ছা তাহলে পরেরবার আমি নিজেই জিজ্ঞেস করবো।”

মাহা মুখ বাঁকিয়ে বললো,” তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছো না, তাই তো? তোমার বরকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। প্রস্তাব তো সে নিজেই এনেছে।”

সাহা এতক্ষণ এইসব কথা না ধরলেও এইবার তার মুখ কালো হয়ে এলো। কিন্তু সত্যি যদি এমনটা হয়। মাহার এক গাল টেনে বললো,” বেশি কথা শিখেছিস।” বলেই সে উঠে গেলো।

সাহা আবার কোনো কথা শুনলে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা করে। সে হয়েছে তার মায়ের মতন। কিছু শুনলেই দুশ্চিন্তা তাকে ঘিরে ধরে। সাহা নিজের রুমে গেলো।
শাওন খাটে হেলান দিয়ে বই পড়ছিলো। সাহার চিন্তিত মুখ দেখে নিজের পাশে বসতে বললেন।

সাহা তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বলল,” সত্যি করে বলো তো তোমার এইযে বন্ধু শুদ্ধ, তার কোনো সমস্যা নেই তো?”

শাওন বুঝতে পেরেছিলো শুদ্ধ হাল ছাড়বে না। গন্ডগোল তো বাঁধবেই। তবে এনগেজমেন্ট হয়ে যাবার পর বাধাবে এটা আশা করেনি সে। শাওন সব জেনেও বললো,” কি বলছো তুমি? সমস্যা থাকবে কেনো?”

” সে নাকি মাহাকে বলেছে, সে এ বিয়ে করতে চায় না।”

” ওহ এই ব্যাপার!”বলেই শাওন হাসলো।

সাহা রেগে বললো,” এই ব্যাপার মানে? তোমার কাছে এটা ছোট ব্যাপার মনে হচ্ছে। হাসছো কেনো তুমি!”

” বিয়েতে তো তোমার বোনও রাজি না। তাই বলে কি ধরে নিতে হবে মেয়ের সমস্যা আছে।”

” তোমার বন্ধুর আবার প্রেমটেম আছে নাকি!”

শাওন নিজের বই খুলতে খুলতে বলল,” এখন প্রেম নেই, তবে আগে ছিলো। দেখো মানুষের অতীত নিয়ে কখন কাউকে বিচার করতে হয় না।”

” কারোরই মত নেই এমন বিয়ে দিয়ে কোনো বিপদ হবে না তো।”

” দুজনের বিয়েতে মত নেই বলেই বিয়েটা দিতে হবে। একজনের মত থাকলে বরং সমস্যা বারতো। তাছাড়া শুদ্ধর মা নিজে মাহাকে পছন্দ করেছে। মা কখনো ছেলের খারাপ চায় না।”

শাওনের কথা মিথ্যে নয় তবে সাহার মনটা কেমন জানি করছে।

( চলবে )