বসন্ত বিকেল পর্ব-০৩

0
20

#বসন্ত_বিকেল
#পর্ব_৩
#নবনী_নীলা

শুদ্ধ নিজের রুমে আসতেই দেখলো মাহা তার রুমের এটা ওটা ধরছে, দেখছে। তার জিনিস পত্র অন্য কেউ ধরুক সেটা সে পছন্দ করে না।শুদ্ধ রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো,” তুমি আমার রুমে কি করছো?”

হঠাৎ শুদ্ধর আওয়াজে মাহা চমকে তাকালো। মুহুর্তেই তার হার্ট বিট বেড়ে গেলো। মাহা একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,” আমি নিজের ইচ্ছায় আসিনি। আপনার বোন আমাকে এই রুমে বসতে বলে চলে গেছে।”

শুদ্ধ এগিয়ে এসে মাহার হাত থেকে টান দিয়ে তার বইটা নিয়ে বললো,” রুমে বসতে বলেছে, এটা ওটা ধরতে বলেনি নিশ্চয়ই?”

মাহার এই কথায় রাগ হলো। আশ্চর্য সে একটা বই তো ধরেছে এমন তো নয় কোনো কিছু নষ্ট করেছে। লোকটা মুখ খুললে কখনো কোনো ভালো কথা বলতে পারে না। পুরো চেঙ্গিস খান।

” আপনার না নিজের অ্যাটিটিউড ঠিক করা উচিৎ।”, তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বলল মাহা।

” কখনোই না। ইউ বেটার ওয়াচ ইওরসেলফ।”, বলেই শুদ্ধ বইটা আগের জায়গায় রেখে দিলো।

” আপনি আমার সাথে কথায় কথায় এমন ঝগড়া করেন কেনো?” দাঁতে দাঁত চিপে বললো মাহা।

” ওটা তুমি করো। আমি না।”তাচ্ছিল্যের সাথে বললো শুদ্ধ।

” মোটেও না। আপনি আমার সাথে ঝগড়া করেন।”, বলেই আরো রাগে ফুঁসতে থাকলো মাহা।

শুদ্ধ হাতের ইশারায় মাহাকে সামনে থাকা আয়নাটার দিকে তাকাতে বলে বললো,” কে ঝগড়া করছে নিজেই দেখো।”

মাহা দাঁতে দাঁত চিপে নিজের রাগ চেপে হন হনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাবে এমন সময় রিধি সেখানে উপস্থিত হলো। মাহার চেহারায় একটা বিশেষত্ব আছে। তার আনন্দ, দুঃখ, রাগ সব তার চেহারায় ভেসে ওঠে। যেমন এখন তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে মহা বিরক্ত এবং প্রচণ্ড রাগান্বিত।

রিধি মাহাকে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করল,” কি ব্যাপার? কিছু হয়েছে?”

তারপর নিজের ভাইয়ের দিকে তাকালো আড় চোখে। নিজের অনুমান সঠিক মনে করে রিধি বলল,” তোমাকে ভাইয়া কিছু বলে নি তো?”

মাহা কিছু বলল না কিন্তু নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ। খুব চালাকির সাথে সে নিজের সম্মতি প্রকাশ করে দাঁড়িয়ে রইলো।

রিধি নিজের ভাইয়ের দিকে কঠিন দৃষ্টি করে মাহাকে বলল,” তুই মায়ের রুমে যাও আমি একটু আসছি।” মাহা গুটি গুটি পায়ে আফরোজা বেগমের রুমের দিকে হাঁটা শুরু করে।

রিধি কোমরে দুই হাত দিয়ে নিজের ভাইকে বলল, “তোমাকে তো আমি এর আগে এক কথার চেয়ে বেশি দুই কথা বলতে শুনিনি। ভালোই ঝগড়ুটে হয়েছো দেখছি।”

“শাট আপ। আমি ওকে কিছুই বলিনি। ওকে দেখে ছোট মনে হতে পারে কিন্তু কথায় সবার আগে সে।ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া।”

“মাহার বয়স না হয় কম কিন্তু তোমার বয়স তো কম না তাহলে তুমি কেন ওর কথা এত গায়ে মাখছো?” বলে রিধি একটা ভ্রু তুলে তাকালো। তারপর আস্তে আস্তে নিজের হাসি প্রসারিত করল। রিধির এমন হাসিতে শুদ্ধ বেশ ক্ষিপ্ত হলো। রিদিকে নিজের রুম থেকে বের করে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সে দরজা আটকে দিল।

মাহা যেমনটা চিন্তা করেছিল ব্যাপারটা আসলে ওরকম না এই বাড়িতে মানুষের সংখ্যা ছয় জন। ড্রাইভার মালি এদেরকে যদি না ধরে তাহলে বাড়িতে মানুষের সংখ্যা মাত্র দুইজন। যদি বাড়িতে রিধি থাকতো তাহলে হয়তো বাড়ির মানুষের সংখ্যা বেড়ে তিন হতো কিন্তু রিধি জার্মানিতে নিজের পড়াশোনা করছে। সে দেশে ফিরেছে শুধুমাত্র নিজের ভাইয়ের বিয়ে অ্যাটেন্ড করতে। মাহার আশ্চর্যের সীমা রইল না দুইজন মানুষ এত বড় বাড়িতে থাকে কিভাবে।

মানুষ হিসাবে আর শুদ্ধর মা ও বোনকে তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। কিন্তু ছেলেটা চেঙ্গিস খান সেটা অন্য ব্যাপার।

শুদ্ধর মা আজ তার সাথে নানা গল্প করলো। কিভাবে শুদ্ধর বাবা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। তারপর শুদ্ধর বড় ভাই তাদেরকে আগলে রেখেছে। শুদ্ধর বড় ভাই নিজের পরিবার নিয়ে থাকে জার্মানিতে। রিধি নিজের হায়ার স্টাডিজের জন্য তার বড় ভাইরের কাছেই থাকছে। শুদ্ধ পড়ে আছে তার মায়ের জন্য। শুদ্ধকে নিয়েও অনেক কথা তাকে শুনতে হয়েছে। শুদ্ধ কেমন ভালো স্টুডেন্ট ছিলো। নিজের ব্যবসা কিভাবে সে অল্প বয়সেই দাঁড় করিয়েছে আরো কত কি! সব বললেও কেনো জোর করে শুদ্ধকে বিয়েতে রাজি করিয়েছে এ ব্যাপারে তিনি কিছুই বলে নি। মাহা ও চুপ ছিলো।

ফিরবার সময় মাহা অর্ধেক রাস্তা একদম চুপ ছিলো। কিছু একটা নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলো সে। তারপর হঠাৎ সে শুদ্ধকে গাড়ি থামাতে বললো।

মাহার কথায় শুদ্ধ কথায় ব্রেক কষলো। তারপর বলল,” কি হয়েছে?”

মাহা নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,” আমার আপনার সাথে কথা আছে।”

_________________

শুদ্ধ ও মাহা একটা ক্যাফেতে বসলো। মেনু থেকে শুদ্ধ অর্ডার দিল ক্যাপাচিনো আর মাহা অর্ডার দিলো কোল্ড কফি। পছন্দে যেমন বিপরীত আচরণে দুইজন দুই মেরুর মানুষ। মাহা কোনো ভঙ্গিতা করলো না। সে সব ব্যাপারেই ভীষণ স্পষ্টবাদী।

” দেখুন। বিয়ে হোক কিংবা আকদ হোক। আমি আমার সবটুকু দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করবো। প্রেম বিয়ে এইসবে আমার কোনো আগ্রহ নেই। তাই আমি তো ঝামেলা করবোই। এর থেকে ভালো হয় যদি আপনি নিজে সাহস করে এই বিয়েতে না করে দেন।”

” আর ইউ স্টুপিড? তোমার কি মনে হয় আমি আমার মাকে বলিনি?”

মাহা রেগে গিয়ে বলল,”দেখুন বার বার আমাকে এইভাবে স্টুপিড বলবেন না। আপনি আমাকে না বললে আমি জানবো কিভাবে? একে তো আপনি কথা বলার সময় অর্ধেক কথা বলে থেমে জান। পুরোটা না বললে আমি বুঝবো কিভাবে? আমি কি আপনার মনের খবর রাখি?”

“আর তুমি যে কারোর কথা শেষ নাহতেই নিজেরটা বলা শুরু করো? তার বেলায় কি!”

এই মুহূর্তেই ওয়েটার এসে হাজির তাদের এমন উত্তেজিত কথাবার্তায় সে বুঝে উঠছে না কি করবে। মাহা ওয়েটারকে দেখে চুপ করে রইলো। ওয়েটার চলে যেতেই সে বলল সে শুকনো কন্ঠে বললো,” আচ্ছা আপনি বলুন আমি শুনছি। আমার কোল্ড কফি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আপনি কথা বলুন আমি আপনাকে ডিস্টার্ব করবো না।”

মাহা খাবার পেলে কথা বলা পছন্দ করে না। সে তখন পৃথিবীর সব কথা হজম করে ফেলতে পারে।

শুদ্ধ নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এ কার খপ্পরে পড়লো সে? শুদ্ধ খেয়াল করলো এক মুহূর্ত স্থির হয়ে নেই মেয়েটা। কখনো পা নাড়ছে কখনো এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ভীষণ বিরক্তি হচ্ছে তার।

শুদ্ধকে চুপ থাকতে দেখে মাহা বললো,” আশ্চর্য! কথা বলার সময় দিয়েছি এখন কথা বলছেন না কেনো?”

শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে বললো,” কি বলবো?”

” বিয়েতে হ্যাঁ করেছেন কেনো ঐটাই বলুন।” বলেই সে আবার কফির স্ট্র নিজের মুখে নিলো।

শুদ্ধ ভেবেই পাচ্ছে না সে কোন বিপদে পড়েছে? এইভাবে একটা মেয়েকে সে নিজের জীবন বৃত্তান্ত বলবে না।সে কাউকেই নিজের জীবন নিয়ে কিছু বলে না। তার স্বভাবে এমনটা নেই। তার জীবনের সবকিছুই একান্ত তার নিজের। শুদ্ধ কিছু না বলে বাইরে তাকিয়ে রইলো।

” পরে আবার ঠিকই আমাকে বলবে আমি কথা বলতে দেই নি। এখন কথা বলতে বলছি চুপ করে আছে।” কিছুক্ষণ থেমে মাহা আবার বললো,”আচ্ছা আপনার প্রেম টেম আছে নাকি?” বলেই বেশ আগ্রহ নিয়ে শুদ্ধর দিকে তাকালো। মুখে তার এক শয়তানি হাসি।

শুদ্ধ কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল,” নান অফ ইউর বিসনেস।”

পরক্ষনেই মাহার মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেলো। এমন সিরিয়াস হয়ে বলছে তার মানে তো সিউর লোকটা মজনু। মেয়েটা হয়তো ছেঁকা দিয়েছে তাই কথা বলতে চাচ্ছে না এই ব্যাপারে।

মাহা গলা ঠিক করে বললো,” বলতে না চাইলে জোর করছি না। কিন্তু আপনার আমাকে গন্ডগোল পাকাতে সাহায্য করতে হবে।”

শুদ্ধ আবারো ভ্রু কুচকে বললো,” মানে?”

” মানে হলো, নিজের বিয়ে নিজে ভাঙবো। আর আমাকে সাহায্য করবেন আপনি। বুঝতে পেরেছেন!” বলেই মাহা হাসলো আপন মনে।

শুদ্ধ মনে মনে বলল নিশ্চয়ই কোনো স্টুপিড প্ল্যান করবে তারপর নিজে ফাঁসবে আমাকেও ফাঁসাবে। নিজের কথা ভেবে তার নিজের আফসোস হচ্ছে।

” কি হলো? কি ভাবছেন? আপনাকে কিন্তু হেল্প করতে হবে। আর আপনার মা অনেক ভালো, আমার ওনাকে কষ্ট দেওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। আপনার মা অনেক ভালো বউমা ডিজার্ভ করে।”,

” ইয়েস অফ.. কো” শুদ্ধ বাকিটা বলার আগেই মাহা নিজেই বলতে শুরু করলো,” যদিও আমার থেকে ভালো তো কোথাও খুঁজেও পাবে না। আপনি বললে আমি আমার থেকে একটু কম ভালো খুঁজে দিতে পারবো।”

শুদ্ধ তাকিয়েই আছে। কি বলবে সে? তার কি কোনো কথা বলার প্রয়োজন আছে? কিভাবে চুপ করানো যাবে এই মেয়েকে। শুদ্ধ একটু ভাবলো তারপর একটু এগিয়ে গিয়ে মাহার চোখের দিকে তাকাতেই মাহা স্থির হয়ে গেলো। চোখ বড় বড় করে তাকালো সে।

শুদ্ধ চোখে চোখ রেখে বললো,” তুমি আমার সাথে বেশি ফ্রাঙ্ক হয়ে যাচ্ছো না?”

মাহা কয়েকবার চোখের পলক ফেলল। এক মুহূর্তের জন্য ভাবনায় পড়ে গেলো সে। মনে হচ্ছে সব সময়ের মতন এবারো প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কথা বলে ফেলেছে সে। মাহা শুদ্ধর দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললো,” আমার বাসায় যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।”

শুদ্ধ এক গাল হেসে বিড় বিড় করে বললো,” যাক মনে তো পড়েছে।”

( চলবে )