বসন্ত বিকেল পর্ব-০৫

0
20

#বসন্ত_বিকেল
#পর্ব_৫
#নবনী_নীলা

” আপনাকে কে এমন হিরো সেজে আমার ভার্সিটির সামনে আসতে বলেছে? আর এসেছেন যখন একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াতে পারেননি?”, মাহা বিরক্ত হয়ে বলল।

” আই ডোন্ট হ্যাভ টাইম ফর দিস ননসেন্স। আর তুমিই আমাকে বলেছিলে তোমার ভার্সিটির সামনে দাঁড়াতে। ডোন্ট ইউ?”,

” আপনি আমাকে কথা না শুনিয়ে ঠিক মতন গাড়িটা চালান। আবার আমি ডেকেছি বলে গাড়ির এক্সিডেন্ট করে দিয়েন না।”, মাহা কথাটা বলে শেষ করতেই তার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলো।

শুদ্ধ কয়েকবার চেষ্টা করলো কিন্তু গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট হলো না। বাধ্য হয়ে সে গাড়ি থেকে নেমে কি হয়েছে সেটা বুঝতে চেষ্টা করলো।

মাহা গাড়িতে বসে যত দোয়া মুখস্ত আছে সব এক এক করে পড়তে থাকলো। সে ভালো কিছু চাইলে তো কখনো কবুল হয় না।

এটা কি হয়ে গেলো! গাড়ির কিছু হলে তার কপালে শনি সোম বুধ সব ঘুরবে। মাহা কিছু বুঝতে না পেরে গাড়ি থেকে নেমে দাড়ালো। মাহা গাড়ি থেকে নামতেই শুদ্ধর তীক্ষ্ম দৃষ্টি তাকে গ্রাস করলো। মাহা অপ্রস্তুত হয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলো। কিন্তু শুদ্ধর চোখে মুখে রাগ ভর্তি।

মাহা এগিয়ে গিয়ে বলল,” গাড়ির কি হয়েছে?”

” তুমি যা বলেছো তাই হয়েছে।” বলেই মাহাকে বেঙ্গ করে ঠোঁট প্রসারিত করলো।

মাহার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে? এবার এই চেঙ্গিস খান যদি বলে আমার কথায় তার গাড়ি নষ্ট হয়েছে তাহলে কি হবে? তাকে বেচলেও তো এই গাড়ির টাকা উঠবে না।

মাহা নরম কিন্তু শুকনো কন্ঠে বললো,” আমি বললেই হলো নাকি? আপনার গাড়ি আগে থেকেই খারাপ ছিলো। অযথা আমার উপর দোষ দিবেন না।”

শুদ্ধ কানে ফোন ধরে ভ্রু কুঁচকে মাহার দিকে তাকালো। তারপর মনে মনে বলল,কত কথা বলতে পারে! শুদ্ধ ফোনে কথা বলতে বলতে একটু দূরে গেলো।

মাহা জায়গায় দাঁড়িয়ে একবার গাড়ির দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার শুদ্ধর দিকে। এই চেঙ্গিস খান আবার তার বাসায় কল দেয় নি তো।কিছু একটা হবেই। আজ তার দিনটাই খারাপ।

শুদ্ধ যেখানে তার গাড়ি ঠিক করে সেই লোককে কল দিয়ে লোকেশন শেয়ার করলো। তারা সময় করে এসে গাড়িটা ঠিক করতে নিয়ে যাবে। শুদ্ধর কিছুক্ষণ পর একটা ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং আছে। মনে হয় আজ সেটাও ক্যান্সেল করতে হবে। শুদ্ধ কথা শেষ করে এসে দেখে মাহা নেই। একটু আগে সে ঠিক গাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো। শুদ্ধ এদিক সেদিক খুঁজতে লাগলো। মেয়েটা মুহুর্তে কোথায় চলে গেলো? শুদ্ধ এগিয়ে কিছুদূর গিয়ে দেখলো। মাহার ফোন কল করতে থাকলো কিন্তু মাহা কল ধরছে না। শুদ্ধর চিন্তা শুরু হলো। যে জায়গায় গাড়ি নষ্ট হয়েছে জায়গাটাও নিরব পরিবেশ। শুদ্ধ বুঝতে পারছে না কি করবে। সে অনবরত মাহাকে কল করতে থাকলো।

কিছুক্ষণ পিছনে তাকিয়ে দেখে মাহা হাজির। মাহাকে সামনে দেখে শুদ্ধর বুক থেকে যেনো একটা পাথর সরে গেলো কিন্তু মুহুর্তেই সে প্রচণ্ড রেগে গিয়ে মাহার দুই বাহু শক্ত করে ধরে তার নিজের কাছে এনে বিস্ফোরিত বললো,” কোথায় গিয়েছিলে? এতোবার কল দিয়েছি কল ফোন ধরো নি কেনো? তোমার কোনো আইডিয়া আছে আমি কত চিন্তায় পড়ে গেছিলাম?”

শুদ্ধর এমন আচরণে মাহা কিছুটা ভয় পেলো। তারপর খুব আস্তে বললো,” আমি পানির বোতল আনতে গিয়েছি।”

শুদ্ধ দুই বহু আরো শক্ত করে ধরে বলল,” এমনটা হলে আমাকে বলতে পারতে না? আর ফোন ধরলে না কেনো?”

মাহা ব্যথায় চোখ মুখ কুচকে বললো,”ছাড়ুন। আমার ব্যথা লাগছে।”,তারপর শুদ্ধর দুই হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,” আমার ফোন সাইলেন্ট করা ছিলো।”

শুদ্ধ নিজেকে সংযত করলো। হয়তো সে একটু বেশি মাথা গরম করে ফেলেছে। যাই হোক এই মুহূর্তে সে ভীষণ রেগে আছে। শুদ্ধ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা ঠাণ্ডা করলো। এই পরিস্থিতিতে তারা দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। মাহা নিজের হাতে থাকা পানির বোতল থেকে বার বার পানি খাচ্ছে। আরেকটু হলে তো হাত খুলে ক্রিকেট খুলতো এই চেঙ্গিস খান। এর মধ্যে মায়া মমতা বলে তো দেখি কিছুই নেই।

শুদ্ধ এদিক ওদিক তাকালো। এইদিকে গাড়ি নেই। গাড়ি পেতে হলে আরেকটু এগিয়ে যেতে হবে। শুদ্ধ শুদ্ধ ঘাড় ঘুরিয়ে মাহার দিকে তাকালো, সে এখনো পানি খেয়ে যাচ্ছে। শুদ্ধ তাকাতেই সে পানি খাওয়া বন্ধ করে বোতলের ছিপ আটকে দিলো।

শুদ্ধ থমথমে গলায় বলল,” একটু হেঁটে সামনে যেতে হবে।”

মাহা শুদ্ধর সাথে হাঁটা দিলো। হাঁটতে হাঁটতে মাহা দেখলো সে পিছনে পরে আছে শুদ্ধ তার অনেক আগে। এতো তাড়াতাড়ি হাটে কিভাবে লোকটা? মাহা আরেকটু তারাতারি হাঁটতে গিয়ে একটা হোঁচট খেলো। মাহার কন্ঠ শুনে শুদ্ধ পিছনে তাকিয়ে দেখে মাহা কত পিছনে। শুদ্ধ মাহার কাছে এসে বলল,” ঠিক আছো?”

” আপনি একটু আস্তে হাঁটতে পারেন না? আমি তো হাঁপিয়েই গেলাম।”,বলেই কয়েকটা নিশ্বাস ফেলল। এর মধ্যে শুদ্ধ নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,”আচ্ছা।আসো আমার সাথে।”

মাহা আড় চোখে তাকালো। তারপর মনে মনে বলল, হাত ধরলে না জানি আবার হাত মচকে দেয়। মাহা শুদ্ধকে এক মিনিট বলে নিজের ব্যাগ থেকে একটা রুমাল বের করে শুদ্ধর হাতে দিয়ে বলল,” রুমালটা শক্ত করে ধরুন।” শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে রুমালের দিকে তাকালো। তারপর রুমালটা এক প্রান্ত ধরতেই মাহা অপর প্রান্ত ধরে বললো,” এইবার চলুন।”

দুজনে রুমালের দুই প্রান্ত ধরে একসাথে হাঁটতে লাগলো। মাহা কিছুদূর হেঁটে বললো,” আপনাকে যেই কারণে ডেকেছি সেটাই তো বলা হয় নি। কিন্তু এখন কথাটা বলবো কি বলবো না সেটাই ভেবে পাচ্ছি না।”
শুদ্ধ চুপ করে গাড়ির খোঁজ করছে।

_____________

মাহা বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রাত বাজলো আটটা। সে ভয়ে ভয়ে বাড়িতে ঢুকলো। এতো রাত করে সে আগে কখনো বাড়ি ফিরেনি। তার ধারণা ছিলো সবাই প্রচুর চেঁচামেচি করবে। প্রথমেই তাই হয়েছে তার মা ঝাড়ু হাতে এগিয়ে আসতে নিলো কিন্তু যখন শুনলো মাহা শুদ্ধর সাথে ছিল। সবাই চুপ হয়ে গেলো। কেউ আর তাকে কিছুই বললো না। একি অবস্থা! তার বাড়ির মানুষ যে এইভাবে পল্টি মারবে কে জানতো।

মাহা ফ্রেশ হয়ে এক কাপ চা নিয়ে বসলো। লোকটাকে যে কারণে ডেকেছিল সেটা তো বলাই হয় নি। কি করবে কিভাবে করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব। মাহা উপায় না পেয়ে অহনাকে কল দিয়ে বলল,” আমার দ্বারা কিছুই হবে না বুঝলি?”

” আবার কি হয়েছে?”

” কিছুই হয় নি। যে কারণে গেলাম তার কিছুই হয় নি।”

” তবে আমি কিছু জানতে পেরেছি। মনে হয় এই কারণেই শুদ্ধ বিয়েটা করতে চায় না।”

মাহা আগ্রহ নিয়ে বললো,” কি কারণ?”

” আমি শুদ্ধর আইডিতে কিছুই পাই নি। পরে ফ্রেন্ডলিস্টে একটা কমন ফ্রেন্ড পেলাম। তাকে জিজ্ঞেস করেই জানলাম ঘটনা কি?”

“জলদি বল।”

” শুদ্ধর নওশীন নামের একটা মেয়ের সাথে প্রেম ছিলো। এবং তাদের এনগেজমেন্টও হয়েছিল। মেয়েটা নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে বেশি ফোকাস ছিলো। এনগেজমেন্টের দুই বছর পর যখন দুই ফ্যামিলি বিয়ের আয়োজন করতে চায়। তখন মেয়েটি একটি শর্ত রাখে…”

” কি শর্ত?”

” মেয়েটা মানে নওশীন চেয়েছিল শুদ্ধকে তার সাথে নিউ ইয়র্কে নিয়ে যেতে। যেহেতু সে পি এইচ ডি করবে তাই তাকে নিউ ইয়র্কে থাকতে হবে সে চেয়েছিল শুদ্ধ যেনো তার সাথেই থাকে। এইদিকে শুদ্ধ নিজের মাকে একা রেখে কোথাও যাবে না পরিষ্কার জানিয়ে দেয়। নওশীন নিজের ক্যারিয়ার কম্প্রোমাইজ করতে পারবে না,এই নিয়ে অনেক কথা বার্তা হয়। ওদের নিজেদের ভিতরে তিক্ততা তৈরি হয় তারপর একদিন নওশীন এনগেজমেন্টের আংটি ফেরত দিয়ে নিউ ইয়র্কে চলে যায়।”

মাহা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর ভাবলো আহারে লোকটার বিয়ে ভেঙে গেছে।

ওদিকে অহনা বলল,” হয়তো এই কারণেই শুদ্ধর আর বিয়েতে ইন্টারেস্ট নেই। মায়ের কথা রাখতে হয়তো রাজি হয়েছে।”

” আমার কি এই কাহিনী শুনে খুশি হওয়া উচিত নাকি দুঃখ পাওয়া উচিত?” মাহা প্রশ্ন করলো। অথচ যার দুঃখে থাকার কথা সে তো দেখি বিন্দাস আছে।

(চলবে)