বসন্ত বিকেল পর্ব-০৬

0
21

#বসন্ত_বিকেল
#পর্ব_৬
#নবনী_নীলা

বিয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে মাহা অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো। একটু আগ মুহূর্তে পুরো বাড়ি হইচৈয়ে ভরপুর ছিলো,সে বাড়ি এখন দুশ্চিন্তায় ভার হয়ে রয়েছে। কেউ কেউ নানা কথা রটিয়ে ফেলেছে। যেমন মেয়ে ঘুমের ওষুধ খেয়েছে নাকি? আত্মহত্যা করেনি তো? এদিকে অহনা চট জলদি এম্বুলেন্স ডেকে মাহাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো, সাথে তার বোন আর দুলাভাই গেলো। শুদ্ধ নিজের গাড়ি নিয়ে এম্বুলেন্স ফলো করছে।

এম্বুলেন্স এসে থামলো অহনার দেওয়া একটা হাসপাতালের ঠিকানায়। মাহাকে নার্সরা ভিতরে নিয়ে গেলেন। সাহা আর শাওন বাইরে পায়চারি করছে। দুশ্চিন্তায় তারা কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে মেয়েটার কি হলো?

” আমি বলেছিলাম জোড় করে বিয়েটা না দিতে। দেখলে কি হয়েছে?”, বলেই কেঁদে উঠলো সাহা।
শাওন তাকে একটা বেঞ্চে বসিয়ে বলল,” আহা তেমন কিছুই হয় নি। হয়তো স্ট্রেস নিয়েছে তাই এমন হয়েছে।”

অহনা সবার চেয়ে বেশি টেনশনে আছে। পরিস্থিতি এমন জটিল হবে তার জানা ছিল না। অহনা এই ফাঁকে মাহার কেবিনে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। মাহা সেখানে নিজের অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে। একদম সোজা হয়ে শুয়ে আছে সে। অহনা এগিয়ে গিয়ে বলল,” এই উঠ। অবস্থা তো ভালো না। যদি তোর পুরো ফ্যামিলি এসে পড়ে আমি কিন্তু সামলাতে পারবো না বলে রাখলাম।”

মাহা আস্তে করে এক চোখ খুলে তাকালো। তারপর চট করে উঠে বসে বলল,” সামলাতে পারবি না কেনো? তোর ভরসায় আমি এইসব করেছি। তোর ঐ ডাক্তার ফ্রেন্ড কোথায়? সে আসেনি এখনো? তাকে বলেছিস তো কি বলতে হবে?”

” ওকে তো আমি অনেক কষ্ট করে রাজি করিয়েছি। কিন্তু বাইরে তোর বোন যে কান্না কাটি শুরু করেছে এমন হলে আমি কিছু করতে পারবো না।”বলতে বলতেই দরজায় নক পড়লো।

” আরেহ কিছু হবে না। তুই বাইরে যা।”, বলেই মাহা আবার শুয়ে পড়লো।

অহনা দরজা খুলে দেখে শুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। শুদ্ধ কোনো কথা না বলে ভিতরে এলো। তারপর মাহার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,” এখনো জ্ঞান ফিরেনি?”

অহনা একটা ঢোক গিললো,এই প্রশ্নের উত্তরে সে কি বলবে? অহনা এদিক সেদিক তাকিয়ে বললো,” আমি ঠিক বলতে পারবো না। ডাক্তার একটু পর জানাবে।”

শুদ্ধ কঠিন মুখে অহনার দিকে তাকালো তারপর তাকে বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে বললো। অহনা চলে যেতেই শুদ্ধ চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো।
মাহা প্রতিটা নিশ্বাস খুব সতর্কতার সাথে নিচ্ছে। চোখ খুলবে কি খুলবে না বুঝতে পারছে না। লোকটা এই রুমে কি করছে?

শুদ্ধ এগিয়ে এসে মাহার পাশে বসলো তারপর বলল,” ঐটাই তোমার সেই প্ল্যান তাই না? যা বলতে আমাকে সেদিন ডেকেছিলে?”

মাহা একটা ঢোক গিললো তবুও সে স্থির এবং নিশ্চুপ। নিজের অভিনয় সে চালিয়ে যাচ্ছে।

“তুমি যেটা করেছো এর জন্যে দুটো ফ্যামিলিকে অপমানের শিকার হতে হবে। এই নাটক এই মুহূর্তে বন্ধ করো।” এ কথা শুনে মাহা চোখ খুলে তাকালো তারপর গুটিসুটি মেরে উঠে বসলো। শুদ্ধর চাহনি তীক্ষ্ম।

মাহার পরনে লাল রঙের একটা শাড়ি। শাড়িতে মেয়েদের অপরূপ লাগে এ কথা সত্য। কিন্তু মাহার চেহারায় যেই স্নিগ্ধতা রয়েছে তা অন্য সব মেয়েদের মধ্যে পাওয়া যাবে না। কারণ সে আজ বউ সেজেছে। কপালে টিপ, কানে ঝুমকা, খোপা করা চুলে মেরুন রঙের ওড়না দিয়ে ঢাকা আর হালকা একটু সাজ। তার একটু নড়া চড়ায় হাতে থাকা কাচের চুড়ির ছন ছন আওয়াজ। শুদ্ধ অজান্তেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। নিজের ইচ্ছায় সে আরো কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো। সে প্রতিটা সূক্ষ্ম জিনিস পরখ করে দেখছে মাহার দুচোখের কাজল যেমন তার কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে তার সাথে ওই দুই চোখে ডুবে থাকা ভয় সে দেখতে পাচ্ছে। মেয়েটার উপর তার প্রচণ্ড রাগ করা দরকার কিন্তু আজ রাগ করতে পারছে না। রাগ করলে মাহা যদি কান্না করে দেয়, সে দৃশ্য দেখতে একদমই ভাল্লাগবে না। একটা মেয়ে বউ সেজে কান্না করবে তা হয় না। শুদ্ধ নিজেকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনলো।

মাহা বিড় বিড় করে বললো,” আমি বুঝতে পারিনি এতো সমস্যা হবে। আচ্ছা,বিয়েটা এখনো ভাঙ্গে নি?”

” তুমি বুঝে করেছো নাকি না বুঝে? ডাজন্ট মেটার। বাট যেটা করছো ভুল করেছো। আর এর কনসিকুয়েন্স তো ফেস করতে হবেই। রেডি ফর ইট।”,বলেই শুদ্ধ উঠে দাড়ালো। চলে যেতেই আবার ফিরে তাকিয়ে বললো,” ওহ হ্যাঁ,বিয়েটা কিন্তু হচ্ছে।” বলে সে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।

মাহার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। রাগ টা কার উপর হচ্ছে নিজেই বুঝতে পারছে না।

বাইরের সিচুয়েশন কঠিন। শাওন বেশ হইচই করছে। এতক্ষণ হলো জ্ঞান ফিরেনি কেনো? এইখানে ডাক্তা,নার্স সবাই কোথায়?ডাক্তার আরেকটু হলে হয়তো সব সত্যি বলে ফেলতো। এদিকে অহনার মরো মরো দশা। কিভাবে কি সামলাবে? এই পরিস্থিতিতে শুদ্ধ সবটা সামলে নিলো। মাহা ঠিক আছে এখন। এইসব বলার পর সিচুয়েশন একটু নরমাল হলো।

_____________________

হাসপাতালে বিয়ে এই ঘটনা কেউ কখনও শুনেছে কিনা বলা যায় না। কিন্তু এই ঘটনাই ঘটেছে। এদিকে শাওন সব ব্যবস্থা হাসপাতালেই করে নিলো। বিয়ে বলে কথা পাড়া প্রতিবেশীকে তো এটা নিয়ে মাতামাতি করার সুযোগ দেওয়া যাবে না। শাওন নিজ দায়িত্বে সব করলো। বিয়েটা হাসপাতালেই হয়ে গেলো।

মাহার চোখে মুখে অন্ধকার। এটা তার জীবনে করা সবচেয়ে জঘন্য কাজ। বিয়ে তো ভাঙলোই না এর উপর খরার ঘা হাতে সেলাইন দিয়ে বসিয়ে রেখেছে। এর থেকে এতো সুন্দর করে সেজেছে কয়েকটা ছবি তুললেই হতো। বিয়েটা দিয়েই ছাড়লো। তাও ভালো চেঙ্গিস খান কাউকে কিছু বলেনি। বলে দিলে তো আজ তার ইন্নালিল্লাহ হয়ে যেতো।

অহনা কেবিনের এক কোণে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। আজ শুদ্ধ না থাকলে তার যে কি হতো? ভেবেই ভয়ে তার গা কাটা দিচ্ছে। সাহা কেবিনে এসে মাহাকে দেখলো। তারপর বললো,” আমরা বাড়িতে যাচ্ছি। কত কাজ বাকি। সেলাইন শেষ হলে শুদ্ধ তোকে বাড়িতে দিয়ে আসবে। ঠিক আছে?” মাহা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। ভদ্রতাই তার এখন এক মাত্র বাঁচার উপায়।সাহা চলে যেতে যেতে অহনাকেও নিজের সাথে আসতে বললো।

কিছুক্ষণ পর শুদ্ধ কেবিনে ঢুকে দেখলো। মাহা বসে বসে ঝিমুচ্ছে। দরজার আওয়াজে মাহা সজাগ হলো। তারপর অনেক বিনয়ের সাথে শুদ্ধকে বললো,” সেলাইন টা খুলে ফেলা যায় না? হাতটা ব্যথা হয়ে গেলো।”

শুদ্ধ রুমে থাকা নার্সকে ইশারা করতেই সে মাহার হাতের সেলাইন খুলে দিলো। শুদ্ধ হাসপাতালের কাজ সেরে মাহাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। শুদ্ধ এক দৃষ্টিতে গাড়ি চালাচ্ছে। কেউই কারোর সাথে কথা বলছে না। মাহা এখনো বিস্ময়ের মধ্যে আছে। পাশে বসা এই লোকটার সাথে তার বিয়ে হয়ে গেছে! ভাবতেই তার গা শিউরে উঠছে।

জ্যামে তাদের গাড়ি থামলো। মাহা গাড়ির জানালা খুলে বাইরে তাকালো। একটা ছোট্ট মেয়ে গাজরা ফুলের বালা বিক্রি করছিলো মাহার চোখে পড়লো। মাহার খুব ইচ্ছে হলো। কিন্তু তার কাছে তো টাকাই নেই। মাহা শুদ্ধর দিকে তাকালো। শুদ্ধর দৃষ্টি সামনে স্থির তবুও মাহার দিকে একবার তাকালো। মাহা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাহার দৃষ্টি বলে দিচ্ছে সে কিছু বলতে চায়।

শুদ্ধ দ্বিতীয়বার তাকিয়ে বলল,” এভাবে তাকিয়ে না থেকে কি বলবে বলো।”

মাহা চুপ করে রইলো কিন্তু সে এবারো শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে আছে। শুদ্ধ এবার ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারপর বললো,” হোয়াটস রং উইথ ইউ? এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?”

মাহা চোখ দিয়ে শুদ্ধকে বাইরে থাকা সে মেয়েটির ইশারা করলো। শুদ্ধ ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরে তাকিয়ে মেয়েটিকে দেখলো। তারপর আবার মাহার দিকে তাকিয়ে বলল,” গাজরা লাগবে?”

মাহা অপ্রস্তুত হয়ে দুইবার মাথা নাড়লো। শুদ্ধ মেয়েটিকে ডাক দিয়ে দুইটা বালা কিনে মাহাকে দিলো।গাজরা পেয়ে মাহার চেহারায় খুশির ঝলক উঠলো। সে চটজলদি দুইহাতে দুটো পড়ে নিলো তারপর চুড়ি ভর্তি দুই হাত নাড়িয়ে দেখতে লাগলো। মাহা কিছুক্ষণ পর আবার শুদ্ধর দিকে তাকালো। শুদ্ধর দৃষ্টির ট্রাফিক লাইটের দিকে তবুও সে মাহার দৃষ্টি অনুভব করে, মাহার দিকে তাকালো। তারপর বলল,” আবার কি হয়েছে?”

মাহা নিজের দৃষ্টি সামনের দিকে রেখে বিনয় গলায় শুদ্ধকে ধন্যবাদ জানালো।

শুদ্ধ কথাটা শুনে একটা ভ্রু তুলে তাকালো। হঠাৎ এতো ভালো ব্যবহার! সে বেশ অবাক হয়ে বলল, ইটস ওকে।

মাহা বললো,” কিসের জন্য বললাম জিজ্ঞেস করুন।”

” কিসের জন্য?”,বলেই শুদ্ধ তাকালো।

” এইযে এই কান্ডটা সবাইকে বলে দেননি এই জন্যে।”,বলেই মাহা খেয়াল করলো শুদ্ধর রাগান্বিত দৃষ্টি বাইরে।

মাহা জানালার দিকে তাকাতেই দেখলো মোটর বাইকে করে কিছু বখাটে ছেলে এসে ঠিক মাহার জানালার পাশে ব্রেক করেছে। ওরা কিসব গান গেয়ে যাচ্ছে তাদের দিকে তাকিয়ে। মাহা কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুদ্ধ জানালার গ্লাস বন্ধ করে দিলো।

(চলবে)