বসরাই গোলাপের ঝাড় পর্ব-০৬

0
445

#বসরাই_গোলাপের_ঝাড়
#ফারহানা_কবীর_মানাল

৬.
বেশ কিছুদিন ধরে রাতে তার ঘুম হয় না। বেশিরভাগ সময় জেগে থাকে। কখনও চোখের পানি ফেলে, কখনও বা চাপা কষ্ট নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আজ রাতেও নববীর ঘুম হলো না। শেষরাতের দিকে তন্দ্রামতো হলো। তন্দ্রায় দেখল স্বপ্ন। সোহেল ফুলের তৈরি বিছানায় শুয়ে আছে। তার চারপাশে অসংখ্য প্রজাপতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাশ দিয়ে নদী বয়ে যাচ্ছে। নদীর পানি কাঁচের মতো স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার। তলদেশের লাল নীল পাথরগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সে ছেলের পাশে গিয়ে বসল। মাথায় হাত রেখে কোমল গলায় বলল, “ভালো আছিস বাবা?”

সোহেল চোখ খুলল। তার রূপ-চেহারা আগের থেকে কয়েকশো গুণ বেড়ে গেছে। যেন শরীর থেকে আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। সোহেল হাসল। মা’কে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি খুব ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”

“ভালো আছি বাবা। মায়ের কথা মনে পড়ে না?”

“মনে পড়ে তো। আমার প্রজাপতি বন্ধুরা বলেছে – তুমিও খুব তাড়াতাড়ি আমার কাছে চলে আসবে। বাবাও আসবে। তাছাড়া এখানে আমার অনেক বন্ধু আছে। ওদের সাথে খেলা করি। ফুলের বাগানে ঘুরে বেড়াই। আকাশে উড়ে অনেক দূরে চলে যাই।”

“ভয় করে না বাবা?”

“না মা, এখন আর কিছুতেই ভয় করে না। সবকিছু খুব সহজ মনে হয়। দেখো আমার বিছানা। সদ্য ফোটা গোলাপের পাপড়ি দিয়ে তৈরি। এই ফুল কখনও নষ্ট হয় না। শুকিয়ে যায় না।”

নববী বিছানায় হাত রাখল। ছেলেটা কত কথা শিখে গেছে। অথচ কয়েকদিন আগে বাবা মা দাদা এই সামান্য কিছু শব্দ বলতে পারত। সে ঘুমের মধ্যে অনেকক্ষণ কাঁদল। তারপর হঠাৎই জেগে উঠল। ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে। দূর থেকে দোয়েলের ডাক ভেসে আছে। পাখিটা যেন কাউকে ডাকছে। হাবিব তখনও ঘুম। নববী একটু এগিয়ে গিয়ে তার কপালে হাত রাখল। হাবিব মাথাভর্তি ঘন-কালো চুল। সে চুলে হাতের আঙুল হারিয়ে ফেলা কি খুব দোষের কিছু হবে?

হাবিব বলল, “জাগলে কখন?”

“একটু আগেই। ঘুম ভেঙে গেছে।”

“কাঁদছিলে?”

নববী জবাব দিলো না। হাবিব তার গালে হাত রাখল। নরম হাতে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, “ডিম লাইনটা পাল্টে ফেলা দরকার। সবকিছু পরিষ্কার দেখা যায়।”

নববী কিছু বলল না। দীর্ঘ সময় হাবিবের হাতখানা মুখে চেপে ধরে রইল। হাবিব নববীর দিকে ঝুঁকে এসে বলল, “আজ কোথাও ঘুরতে গেলে কেমন হয়?”

“বোধহয় ভালো হবে না। কাল শুক্রবার। বাড়িতে কাজ আছে।”

“আপনার সারাদিনের চব্বিশ ঘন্টা সময় থেকে আমার জন্য দুই এক ঘন্টা বরাদ্দ রাখা যায় না?”

নববী নিচু গলায় হ্যাঁ বলল। হাবিবের সাথে ঘুরতে তার খারাপ লাগে না। বরং ভালো লাগে। খুব ভালো লাগে। কিন্তু অন্যদের ব্যাপারটা ভালো লাগবে না। আড়ালে আবডালে নানান কথা শোনাবে।

“ঘুরতে যেতে অসুবিধা বুঝলাম। আমার সাথে জামায়েতে নামাজ পড়তেও কি অসুবিধা?”

“না না। এসব কি কথা?”

“প্রমাণ দাও।”

“কি প্রমাণ দিতে হবে?”

“যদি তুমি বিশেষভাবে আমার কপাল স্পর্শ করো। তাহলেই প্রমাণ হবে তুমি রাজি আছো।”

নববী মাথা নিচু করে ফেলল। আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। পূবের আকাশে একটা তারা দেখা যাচ্ছে। এই তারার একটা বিশেষ নাম আছে। শুকতারা। যে দিনের সূচনার প্রকাশ করে। রাতের আঁধার কে’টে গেছে এমন বার্তা বয়ে আনে। হাবিব শেষ পর্যন্ত নিজের কথায় অটল থাকলো। সকালের খাবার শেষে নববীকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো। কনক বলল, “ভাব দেখে আর বাঁচি না। কালকে ছেলের মিলাদ আর আজকেই দু’জন ঢ্যাংঢ্যাং করতে করতে বেরিয়ে গেল। লজ্জা না থাকলে যা হয় আর কি!”

নাইমা পাশে বসে সকালের নাস্তা করছিল। সে খাওয়া থামিয়ে বলল, “যখন তুমি ভরা সমাজের এমনকি বাবা মায়ের সামনে দুলাভাইয়ের গা ঘেঁসে বসে থাকো, তখন তোমার লজ্জা করে না?”

“আজ-কাল খুব কথা শেখেছিস দেখছি। একটা কথাও মাটিতে পড়ছে না।”

“অন্যায় দেখলে চুপ থাকা কাপুরুষের লক্ষন। তোমার সমস্যাটা ঠিক কোথায় আপা? তুমি ভাবীর মতো সুন্দর নও এজন্যই তাকে এতো হিংসা করো?”

“অমন কপাল পো’ড়া মেয়েকে কে হিংসে করে? তাছাড়া গায়ের রং সাদা হলেই কেউ সুন্দর হয়ে যায় না। শ্যামলা রঙের মধ্যেও অনেক সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে। তোর তো চোখ নেই, তুই দেখবি কিভাবে?”

“চেহারার কথা বলছি না আপা। আল্লাহর সৃষ্টি সবই সুন্দর। আমি বলেছি মন-মানসিকতা কথা। কুৎসিত মনের মানুষরা ভালো মনের মানুষকে পছন্দ করে না।”

কনক নাইমার গালে থা’প্প’ড় মা’র’তে যাবে ঠিক তখনই নাইমা তার হাত ধরে ফেলল। শান্ত গলায় বলল, “আমি দূর্বল নই আপা। বিনা অপরাধে কেউ আমায় আ’ঘা’ত করতে পারে না। কষ্ট দিতে পারে না।”

শরিফা বেগম খানিকটা দূর থেকে ছুটে এলেন। মেয়েদের হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “এসব কি করছিস? বাড়িতে মেহমান আছে। মানসম্মান নষ্ট করতে চাস?”

কনক নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। নাইমা শান্ত ভঙ্গিতে বাকি খাবার শেষ করল। যেন কিছুই হয়নি।

নববী মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে দু’টো গোলাপ। একটার রং টকটকে লাল, অন্যটা কটকটে হলুদ। হাবিব কিনে দিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে লালের থেকে হলুদ ফুলটা বেশি সুন্দর। সে নিজের সবটুকু সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে। হাবিব বাইক নিয়ে আসেনি, সে রিকশা ঠিক করতে গেছে। ব্যাপারটা নববীর কাছে ভালো লাগেনি। রিকশায় ঘোরা মানে তার চালক সাথে থাকবে। দু’জনের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি ভালো লাগে না। আবেগের বশে কিছু বলে ফেললে পরক্ষণেই লজ্জায় পড়তে হয়। হাবিব দূর থেকে হাত উঁচু করতে করতে নববী কাছে আসলো। বিরক্ত গলায় বলল, “একটা রিকশাও পেলাম না। কেউ ওদিকে যেতে চাইছে না।”

“কোনদিকে যেতে চাইছে না?”

“আমরা যেদিকে যেতে চাচ্ছি সেদিকে।”

“আমরা কোথাও যেতে চাচ্ছি না। যেতে চাচ্ছ তুমি এবং কোথায় যাবে তা আমার জানা নেই।”

হাবিব উজ্জ্বল চোখে তাকালো। ঝলমলে গলায় বলল, “পাস্তা খাবে? সাথে একটা আইসক্রিম।।”

“খেতে ইচ্ছে করছে না কিছু।”

“আরে চলোই না। সামনে একটা নতুন রেস্তোরাঁ খুলেছে। শুনেছি ভালো পাস্তা বানায়। অফিসেও এই নিয়ে কথাবার্তা হয়। এসো এসো।”

সে নববীর হাত ধরে টানতে টানতে দোকানের ভেতর নিয়ে গেল। একটা পাস্তা অর্ডার করল। নববীকে সবথেকে কোণার টেবিলে বসিয়ে বলল, “তুমি খাও। আমি এক মিনিটে আসছি। যাবে না কোথাও।”
কথাগুলো বলেই সে বেরিয়ে গেল এবং তার এক মিনিট শেষ হলো পঁচিশ মিনিটের মাথায়। হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, “খাওয়া শেষ হয়েছে?”

নববী তখনও কিছু মুখে তোলেনি। সে ডানে বামে মাথা দোলালো। হাবিব বলল, “আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে বুঝি? খাইয়ে দিতে হবে?”

নববী কড়া চোখে তাকাল। হাবিব কোমল হাসি হাসল। ভালো লাগলো দেখতে। খাওয়া শেষ করার পরপরই দু’জনে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গেল। নববী অবাক গলায় বলল, “তুমি বাড়িতে গিয়ে বাইক নিয়ে এসেছ?”

“জ্বি মেডাম। নিয়ে এসেছি।”

“এত তাড়াতাড়ি কিভাবে? তুমি!”

“আমার দিকে তাকাও। আমি ঠিক আছি তাই না?”

নববী মুখ ঘুরিয়ে নিলো। হাবিব বলল, “বাইকে উঠে এসো। রাগারাগি বাড়িতে গিয়েও করা যাবে।”

নববী বাইকের পিছনে গিয়ে বসল। হাবিব খুব শান্ত ভঙ্গিতে গাড়ি চালায়। আজও তেমনই চালাচ্ছে। সে গ্রামের ভেতর যেতে লাগল। পিচঢালা রাস্তার দু-পাশে সবুজ গাছপালা। কখনও কখনও ধানের ক্ষেত চোখে পড়ে। যতদূর দৃষ্টি যায় সোনালি ধানের শিষ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কেউকেউ শষ্যের ভারে কিছুটা নুয়ে পড়েছে। রাস্তা খুবই পরিষ্কার। যেন মাত্রই ঝাড়ু দেওয়া হয়েছে। হাবিব প্রায় দুই ঘন্টা বাইক চালালো। এখানে রাস্তা শেষ। নদীর শুরু হয়েছে। নদীর ওপারে অন্য জেলা। রাস্তার পাশে একটা ঝুপড়ি দোকান। তারা দু’জন দোকানের বেঞ্চিতে বসল। হাবিব বলল, “চাচা এক কাপ চা দেবেন?”

বয়স্ক ভদ্রলোক চা বানাচ্ছে। চা বানানোর ধরণ খুবই পরিষ্কার। কেতলিতে পানি ফুটছে। ভদ্রলোক অনেক সময় নিয়ে চায়ের কাপ পরিষ্কার করল। ক্ষীণ গলায় বলল, “বাবারা কোথা থেকে এসেছ? ওইপার যাবে নাকি?”

“না চাচা। এমনিতেই ঘুরতে এসেছি।”

ভদ্রলোক নানান কথা জিজ্ঞেস করল। অথচ সাথে থাকা মেয়েটির ব্যাপারে কোন আগ্রহ প্রকাশ করল না। এমনকি চোখ তুলে তাকালো না পর্যন্ত। হাবিবের ব্যাপারটা ভালো লাগল। সে চায়ের কাপ হাতে একটু দূরে সরে গেল। নববীকে ইশারায়
চায়ের দিকে দেখাল। সে হাবিবের হাত থেকে কাপটা নিয়ে তাতে ঠোঁট ছোঁয়ালো। আ’গু’ন গরম চা থেকে ধোঁয়া উঠছে। জিভ পুড়ে যায়। দু-জনের চা পান করা শেষ হতে সময় লাগল। হাবিব গিয়ে কাপ ফেরত দিলো। কয়েকটা চিপসের প্যাকেট কিনে দোকানীর দিকে দু’শ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “রেখে দিন। আপনার চায়ের স্বাদ অপূর্ব।”

ভদ্রলোকের চোখ চকচক করছে। ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি। তাদের দু’জনের বাড়ি ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। শরিফা বেগম বললেন, “তোরা খেয়ে এসেছিস?”

হাবিব সহজ গলায় না বলল। তারপর নিজের ঘরে চলে গেল। নববীও তার পেছনে ঘরে চলে এলো। হিজাব খুলে চুল ছেড়ে দিলো। একজোড়া চোখ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন এমন রূপবতী মেয়ে সে আগে কখনও দেখেনি। অনেকদিন বাদে নববী হাসল। লাজুক গলায় বলল, “তাকিয়ে আছো কেন?”

“ভালো লাগছে।”

মহিউদ্দিন সাহেব উঠানে দাঁড়িয়ে আছেন। গ্রামের কয়েকজন লোকের সাথে কথা বলছেন। কালকের খাবার-দাবার বিলি করার কাজে এরা দায়িত্ব পালন করবে। বাবুচির সাথে কথা শেষ। তিনি সাদা ভাতের আয়োজন করতে বলেছেন। সাথে গরুর গোশত, ডাল, আলুর দম। এর বাইরে মিষ্টি দই থাকবে। মহিউদ্দিন সাহেব ভেবেছিলেন বিরিয়ানি রান্না করবেন, তবে কেউই তাতে মত দেয়নি। শুধুমাত্র নববী বাবা বলেছেন, “বেয়াই সাহেব, একটা কাজ করলে কেমন হয়? বাচ্চারা এখানে পরোটা মিষ্টি দিয়ে সকালের নাস্তা করল। তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে ফিরে যাবে।”

প্রস্তাবটা মহিউদ্দিন সাহেবের পছন্দ হয়নি। তিনি অন্য রকম কিছু ভেবে রেখেছেন। আত্মীয় স্বজনরা কেউ নিমন্ত্রিত না। শুধু নববীর বাবা মা এবং আনিসের বাড়ির লোক আসবে। মহিউদ্দিন সাহেবের কোন ভাই-বোন নেই। থাকলে তাদেরকে বলা যেত। গ্রামের ছোট বাচ্চারাও আসবে। সব মিলিয়ে প্রায় দেড়শো দুইশো লোকের আয়োজন। উঠানে সবটা জুড়ে পর্দা টানানো হয়েছে। বিকেলের মধ্যে টেবিল চেয়ার চলে আসবে। ভাবসাব দেখে বোঝার উপায় নেই এ বাড়িতে কোন শোক আছে।
কাজের সময় খুব দ্রুত পার হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে গেল। বাইরে হৈচৈ এর শব্দ। কয়েকজন মিলে টেবিল চেয়ার ঠিক করছে। পাশেই তিনজন মিলে মুরগী জ’বা’ই করছে। কথা ছিল শুধু গরুর গোশত রান্না হবে। নববীর বাবা গিয়ে মুরগী কিনে এনেছেন। রোস্ট করবেন। উঠানে বেশ কয়েকটা লাইট জ্বালালো হয়েছে। সে আলোর তীব্রতা এতো বেশি যে গোলাপের ঝাড়ে কয়টা ফুল আছে তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আনিস গোলাপ ঝাড়ের কাছে একটা চেয়ার নিয়ে বসে আছে। বাচ্চারা সেদিকে আসলে রাগী গলায় সরে যেতে বলছে।

প্রায় রাত আটটার দিকে মিলি বাড়িতে ঢুকলো।
শরিফা বেগমকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী গলায় বলল, “আন্টি, আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন? আপনি তো দেখছি আগের থেকে সুন্দর হয়ে গেছেন। কিভাবে নিজেকে এমন মেইনটেইন করেন? আমাদেরকেও একটু বলেন।”

শরিফা বেগম তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। ঝলমলে গলায় বলল, “থাক হয়েছে। হাত-মুখ ধুয়ে এসো। নাস্তা করবে।”

“না আন্টি। আমার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। পরে খাবো।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। কনককে বলছি গেস্ট রুমের দরজা খুলে দিতে।”

“ওহ আন্টি! আপনাদের বাড়িটা কত বড়। সিরিয়াসলি, এত মানুষজন। তারপরও সবার আলাদা আলাদা রুম আছে।”

শরিফা বেগম হাসলেন। মিলি বলল, “হাবিব ভাইকে দেখছি না যে? উনি ঠিক আছেন তো? যে শোক কাটিয়ে উঠলেন। ভাবতেই কষ্ট লাগে।”

নাইমা পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। সে শেষ কথাগুলো শুনল। এবং কঠিন মুখে বলল, “কষ্ট লাগলে খানিকক্ষণ হাত-পা ছড়িয়ে কান্না করুন। ভালো লাগবে।”

মিলি মেকি হাসল। শরিফা বেগম কিছু একটা বলতে গিয়েও বললেন না। বাড়িতে কাজের শেষ নেই। পেঁয়াজ রসুন বাছতে হবে। মশলাপাতি আগে থেকে গুছিয়ে রাখতে হবে। শীতকালের বেলা, সকাল থেকে রান্না শুরু করলে পারা যাবে না। সারারাত ভীষণ ব্যস্ততায় কাটল। সকাল থেকে রান্নাবান্না শুরু হয়েছে। মহিউদ্দিন সাহেব খুব পরিপাটি করে কাজ করছেন। সবদিকে নজর রেখেছেন। জুমার নামাজের পর মিলাদ। সকালের দিকে ইমাম সাহেব একবার এসেছিলেন। কথাবার্তা বলে সোহেলের ক’ব’র জিয়ারত করে চলে গেছেন। সব আয়োজন খুব সুন্দরভাবে শেষ হলো। সোহেলের জন্য দোয়া করার সময় মহিউদ্দিন সাহেব চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে লাগল। হাবিবসহ বাকিরাও খুব কেঁদেছে। যারা তাদের কোন আত্মীয় না, বিশেষ পরিচিতও নয়, এমন মৃ’ত্যুর সংবাদ তাদের চোখেও পানি এনেছে। নিরিবিলি নিঝুম মসজিদের শান্ত পরিবেশ হঠাৎই কান্নার শব্দে ভারী হয়ে উঠেছে। ইমান সাহেব পরপর দু’বার চোখ মুছলেন।
এতিমখানা থেকে বাচ্চারা চলে এসেছে। দু’জন হুজুর তাদের সাথে করে নিয়ে এসেছেন।
বাচ্চারা সবাই তৃপ্তি করে খাবার খেয়েছে। বড়রাও বিশেষ ঝামেলা করেনি। রান্না ভালো। অভিযোগের সুযোগ নেই। ফেরার সময় প্রত্যেক বাচ্চার হাত এক প্যাকেট বিরিয়ানি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাতের খাবার হিসাবে। মহিউদ্দিন সাহেব শহরের হোটেল থেকে বিরিয়ানি আনিয়েছেন।

সব ঝামেলা মিটতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। সবাই যার যার কাজে চলে গেছে। নববীর মা বাবাও ফেরত গিয়েছেন। বলেছেন কিসব কাজ আছে। কেউ আর অমত করেনি। সবকিছুর মধ্যে কনকের মুখ বেশ ভার। এতো আয়োজনের পরেও বিরিয়ানির প্যাকেট দেবার ব্যাপারটা সে কিছুতেই মানতে পারছে না। কয়েকবার আনিসের কাছে গিয়ে ফোসফাস করেছে। আনিস বিশেষ খেয়াল দেয়নি।

রাত এগারোটার দিকে শরিফা বেগম বিছানায় গেলেন। সারাদিনের ব্যস্ততার পর তার শরীরটা বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বাড়িতে কয়েকজন মহিলারা মিলে দোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নববীর কান্না চোখে দেখা যায়নি। মিলিও হাউমাউ করে কাঁদছিল।
মহিউদ্দিন সাহেব বললেন, “মুখ শুকিয়ে গেছে। ঘুমিয়ে পড়ো।”

শরিফা বেগম বিছানায় উঠে বসলেন। অচেতন গলায় বললেন, “একটা কথা ভেবেছি। হাবিবকে বলতে হবে।”

“কি কথা?”

“নববীকে কিছুদিনের জন্য তার বাপের বাড়িতে রেখে আসুক। মায়ের কাছে থাকলে ভালো থাকবে।”

“এই ব্যাপারটা আমার মাথাও এসেছে। নববীর ভাই রয়ে গেছে। তার সাথে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যায় না।”

শরিফা বেগম ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। প্রথম কাজে ঝামেলা হয়নি। পরবর্তী ব্যাপারগুলো এমন হলেই হয়।

চলবে