বসরাই গোলাপের ঝাড় পর্ব-১৮

0
790

#বসরাই_গোলাপের_ঝাড়
#ফারহানা_কবীর_মানাল

১৮.
বাগানের পরিবেশ বেশ নির্জন। মাঝে মাঝে হাড় কাঁপানো শীতল হাওয়া আসে, গাছের পাতায় সরসর শব্দ হয়। চারদিকে সুনসান নীরবতা। তখনও অন্ধকার খুব একটা কাটেনি। সবে পুবের আকাশ লাল হতে শুরু করেছে। ঘন কুয়াশা চারদিকে। কূপের পানি ছোঁয়া জলীয়বাষ্প আকাশে গিয়ে মিলিয়েছে। মনে হচ্ছে বিশাল সমুদ্রের শুরু। সে সাগরের শেষ হয়েছে আকাশের অদূরে, সবুজ প্রান্তে। যে বাগানে নরম কোমল দূর্বাঘাস বিছানো, সারি সারি ফলের বাগান, মনোরম পরিবেশ। নাইমার শরীর একটু দুলে উঠল। কনক বলল, “কি ভাবছিস? চিৎকার করবি?”

নাইমা বরফ শীতল গলায় বলল, “একটা প্রশ্ন ছিল।”

“এখনও কি জানতে চাস? এতো কিসের কৌতুহল তোর?”

“যখন তুমি জানতে বসরাই গোপালের ঝাড় নিয়ে আমার কৌতুহল আছে, তাহলে কেন সেদিন রোহানের সোয়েটার কিনতে গিয়েছিলে?”

“আমি তখনও কিছু জানতাম না। আনিস অসভ্য আমায় কিছুই বলেনি। জিনিসগুলো হারিয়ে যাবার পর সবটা জানিয়েছে। আমি জানলে কখনোই বাড়ি থেকে বের হতাম না। প্রয়োজনে ওগুলো আলাদা জায়গায় সরিয়ে রাখতাম।”

“ওহ! ভাবলাম – সবটা জেনে কেন বাইরে গিয়েছিলে!”

“কিভাবে জানব? তুই আনিসকে নজরে রেখেছিস, দু’দিন দেখে ফেলেছিস। এসবের কিছুই সে আমায় বলেনি। আব্বা আংটি দেবার পর প্রশ্ন করায় সবটা খুলে বলেছে।”

“কোন আংটি?”

“আব্বা কুড়িয়ে পেয়েছিল। পরে আমাদের দেখালো। ওই দেখে জিজ্ঞেস করতেই সব বলেছে। ভেবেছিস কত সাহস? আমার জিনিস হারিয়ে যায়, অথচ আমায় কিছু জানায় না। যাইহোক অনেক কথা বলে ফেলেছি বোন। আমাকে বাঁচতে হলে যে তোমাকে ম’র’তে হবে।”

“সত্যি কি কখনও লুকিয়ে রাখা যায় আপা? তুমি কি তা পারবে? আজ থেকে বহুবছর পর এই সত্য সবাই জানবে। কে বলতে পারে হয়তো আজ বা কালই জেনে গেল!”

কনক নাইমার বাহু ধরে তাকে আর একটু নিজের কাছে টেনে নিলো। ভ্রু কুঁচকে বলল, “সত্যি কথা বল, আর কাকে এই রহস্যের কথা বলেছিস? হাবিব আর নববীকে কিছু বলিসনি তাই না?”

“না আপা, কাউকে কিছু বলিনি। সত্য প্রকাশ পাবার জন্য কাউকে কিছু বলে যাবার প্রয়োজন হয় না।”

কনক হালকা হাসল। সেই হাসি দেখতে ভালো লাগল না। সে নাইমাকে কূপের খুব কাছে নিয়ে গিয়ে মাথা পানিতে চুবিয়ে ধরল। নাইমা গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। পারছে না। যেন ভেতর থেকে জমে গিয়েছে। পানি বরফের থেকেও ঠান্ডা, মনে হয় শরীর জমে যাবে। নাইমা নিজের বোকামির জন্য খানিকটা আফসোস করতে লাগল। অনেক সময় ছিল- সে চাইলে চিৎকার করতে পারত অথবা দৌড়ে পালানোও কোন বড় ব্যাপার ছিল না। কিন্তু না! সে তা করেনি, কনকের কথায় হতভম্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে ছিল। উপদেশ দেওয়া খুব সহজ কাজ। মুখে বলা আর কাজে করে দেখানো যদি একই কথা হতো তবে দুনিয়া অনেক আগেই পাল্টে যেত।
কনক নাইমার সাদাসিধে বড় বোন। যে জীবনের ভ’য়ং’ক’র রূপ দেখেনি। স্বামীর সেবা করেছে, তার হুকুম মেনে সবটা পালন করেছে। বাপের বাড়ি থেকে টাকা নিয়েছে। কারণে অকারণে মায়ের পাশে বসে কেঁদেছে। সে কিভাবে এমন ভ’য়ং’ক’র দুর্বিষহ চরিত্রের অধিকারী হতে পারে! এ যে স্বপ্নেও কল্পনা করা যায় না। নাইমাও মানতে পারেনি। স্বপ্ন আর বাস্তবতার তফাৎ করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে। বারবার মনে হয়েছে- এটা স্বপ্ন। এইতো এখুনি ঘুম ভেঙে যাবে। কিন্তু না। এটা স্বপ্ন নয়, স্বপ্নের থেকে অনেক বেশি ভ’য়ং’ক’র বাস্তব। যা মেনে নেওয়া খুব বেশি সহজ কাজ নয়। মারাত্নক রকমের কঠিন কাজ। শেষ মুহুর্তে তার মনে হলো- বড়জোর আর কয়েক সেকেন্ড নিঃশ্বাস আটকে রাখতে পারবে। বরফ শীতল পানিতে মুখ চুবিয়ে রাখা যায় না।

মানিক মিয়া খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠেন। ফজরের নামাজ পড়ে কূপের কাছে এসে পানি নিয়ে যান। এক গ্লাস উষ্ণ গরম পানিতে মধু মিশিয়ে পান করেন। বাকি পানিটুকু দিয়ে চা তৈরি হয়। চায়ের পানি ফোটানোর সময় লেবু পাতা অথবা তেজপাতা মেশানো হয়। আজ সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হবে। বাড়ির এই পরিবেশে কেউ তাকে চা করে দিবে না। তিনি নামাজ শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। নিঃশব্দে দরজা সরিয়ে আনিসের ক’ব’রের পাশে এসে দাঁড়ালেন। হাতে করে গ্লাস নিয়ে এসেছেন। চা না হোক এক গ্লাস পানি খাওয়া জরুরি। ছোটবেলা থেকে এই নিয়ম মেনে আসছেন। তার দাদা জাহাজে করে মক্কা শরিফ গিয়েছিলেন। সেখান থেকে সাথে করে দু’বোতল জমজমের পানি নিয়ে এলেন। দু’বোতল পানি দীর্ঘ সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়, অথচ তিনি এই রহমত থেকে বঞ্চিত হতে চান না। বুদ্ধি পরামর্শ করে শহর থেকে লোক ডেকে আনলেন। কূপের পানি বিশুদ্ধ করতে কিসব ওষুধ মেশানো হলো। নানান ঝামেলা শেষে সেই দুই বোতল পানি কূপে ঢেলে দেওয়া হলো। তিনি ওছিয়ত করলেন – তার বংশের সবাই যেন ফজরের নামাজ শেষে এই পানি পান করে। আনিস মিলি সে ওছিয়তের ধার না ধারলেও মানিক মিয়া অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। মনে আলাদা রকমের শান্তি পান। তিনি কূপের দিকে হাঁটলেন। বিদ্যুৎগতিতে এসে কনককে সরিয়ে দিয়ে বললেন, “কি করছিলে তুমি? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার?”

কনক হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “আব্বা আমি কিছু করিনি। নাইমা মুখ ধুচ্ছিল। আমার কথা বিশ্বাস না হলে ওকে জিজ্ঞেস করে দেখেন।”

মানিক মিয়া নাইমার দিকে তাকালেন। নাইমা মাটিতে বসে পড়েছে বুকে হাত দিয়ে ক্রমাগত নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। তিনি কনকের হাত চেপে ধরলেন। তীক্ষ্ণ গলায় বাড়ির সবাইকে ডাকতে লাগলেন। উনার চিৎকার সবাই খুব দ্রুত কূপের কাছে হাজির হলো। হাবিব নাইমার কাছে গিয়ে বলল, “কি হয়েছে তোর? এই অবস্থা কিভাবে হলো?”

নাইমা কথা বলতে পারল না। ভাইয়ের হাত জড়িয়ে ধরল। মানিক মিয়া বললেন, “বউমাকে তার বোনকে কূপের পানিতে চুবিয়ে ধরেছিল। ঠিক সময় না আসলে হয়তো এতক্ষণে মে’রেও ফেলত।”

কথা শেষ করে তিনি আঁড়চোখে কনকের দিকে তাকালেন। কনকের শরীর ঘেমে গেছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। শরিফা বেগম এগিয়ে দিয়ে কনকের বাহু চেপে ধরলেন। বললেন, “বেয়াই এসব কথা সত্যি বলছে? বল?”

কনক জবাব দিলো না। তিনি প্রচন্ড জোরে কনকের ডান গালে থা’প্প’ড় মা’র’লে’ন। কনক কয়েক পা পিছিয়ে গেল। মানিক মিয়াও একটু টলে উঠলেন। খানিক বাদে বাদে তার মাথায় ভেতর চক্কর দিয়ে উঠছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। পালানোর উপায় নেই। মানিক মিয়া খুব শক্ত করে তার হাত ধরে রেখেছে। কনকের ইচ্ছে হলো- হাতখানা কে’টে দৌড়ে পালাতে!

এমনিতেই বাড়িতে যথেষ্ট লোক ছিল। এই ঘটনার পর একে একে বাকিরাও জড় হতে লাগল। মহিউদ্দিন সাহেব শরাফত উল্লাহকে কল দিয়েছে। শরাফত বলেছে, ‘থানায় সামান্য একটু কাজ আছে। শেষ করে আসছি। খুব বেশি দেরি হবে না। বড়জোর মিনিট ত্রিশ।”

ঘরের অনেকটা অংশ ফাঁকা। শরাফত বাইরের লোক ঢুকতে দেয়নি। যারা আছে পরিবারের সদস্য এবং আত্নীয়। হাবিব বলল, “বড় আপা, তুমি হঠাৎ নাইমাকে কেন মা’র’তে গেলে? কি হয়েছে তোমার?”

কনক জবাব দিলো না। মুখ ফিরিয়ে নিলো। তার চোখ-মুখ কঠিন হয়ে আছে। নাইমা ততক্ষণে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। এক গ্লাস গরম দুধ পান করেছে। সে বলল, “ভাইয়া, লুকোচুরি আর কিছু নেই। ওইসব ধনসম্পদের মালিক দুলাভাই নয়। আপা! সে-ই সবকিছু করেছে।”

হাবিব ভ্রু কুঁচকে ফেললো। বাকিদের চোখে-মুখে বিস্মিত ভাব ছড়িয়ে আছে। মিলি বলল, “কোন ধনসম্পত্তি? কিসের কথা বলছ তোমার?”

নববী পাশে বসে ছিল। সে বেশ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “জানতেন না নাকি? আপনার ভাই ভাবী চো’রাকারবারির সাথে যুক্ত। আসল নকল মিলিয়ে দামী দামী অলংকারের ব্যবসা করে। এর মধ্যে হীরাও আছে।”

“না, আমি জানি না। আমি কিভাবে জানব?”

শরাফত বলল, “এসব কথা আপনারা পুলিশকে আগে বলেননি কেন? কেন লুকিয়েছেন?”

হাবিব বেশ সহজ গলায় বলল, “আপনাকে বেশ কয়েকবার কল দিয়ে বলেছি- আমি কিছু কথা বলতে চাই। খুব জরুরি। আপনি কখনও গুরুত্ব দেননি।”

“সময় সুযোগ হয়নি। কাজে থাকি। ব্যস্ত থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়।”

“অথবা মোটা অংকের বকশিস পেয়েছেন!”

শরাফত তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “মুখ সামলে কথা বলুন।”

“অবশ্যই বলব। আপনার বড় স্যার আসুক। তার সামনে বলব। আপনাকে খুব বেশি ভরসা করতে পারছি না।”

হাবিবের কথা শেষ হবার পরপরই ডিআইজি সাহেব ভেতরে ঢুকলেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন, “গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো আগে শেষ করবেন।”

মানিক মিয়া গোটা ঘটনা খুলে বললেন। বেশ গুছিয়ে সবকিছু বললেন। বলতে গিয়ে খেয়াল করলেন তার ঠোঁট কাঁপছে। সবকিছু শোনার পর ডিআইজি সাহেব নাইমার কাছে গিয়ে বসলেন। কোমল গলায় বললেন, “এর পেছনের কারণ কি? কেন তোমার সাথে এমন করছে?”

নাইমার চোখ বন্ধ করে দম খিঁচে বলল, “দুলাভাই অর্থাৎ আনিস সাহেব আমাদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। হঠাৎ একদিন রাতে দেখি আমাদের বাড়ির সামনে একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। দুলাভাই কারোর সাথে কথা বলছেন। লোকটাকে দেখিনি। আবছা ছায়া ছিল। দুলাভাই আমায় দেখে দ্রুত ভেতরে চলে এলেন, লোকটা ট্রাক নিয়ে চলে গেল। পরে একদিন ভোর রাতের দিকে দেখি উনি লুকিয়ে লুকিয়ে বসরাই গোপালের ঝাড়ের দিকে যাচ্ছে। আমাদের বাড়িতে বেশ অনেক বড় বসরাই গোপালের ঝাড় আছে। কেমন যেন সন্দেহ হলো। আগেও ছিল। উনি কাউকে গাছের আশেপাশে যেতে দিতেন না। বাড়ির কেউ গেলে সাথে সাথে গিয়ে নানান কথাবার্তা বলতেন। আমিও উনার পিছু নিয়েছিলাম। আব্বা এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। পরে আপাকে কিছু টাকা দিয়ে মার্কেটে পাঠিয়ে বাড়ি খালি করলাম। খুঁজতে গিয়ে ঝাড়ের ভেতরে মাটির নিচে একটা পুটুলি পেলাম। ওই নিয়ে ভাইয়ার শশুর বাড়িতে চলে গেলাম। ভাবী ভাইয়া ওখানে ছিল। ওদেরকে সবকিছু খুলে বললাম। তারপরই শুনি রোহান মানে আপার ছেলে পানি পড়ে গেছে, হাসপাতালে জীবন-ম’র’ণ অবস্থা। ফেরত আসলাম। দুলাভাইকে বললাম, উনি জিনিস ফেরত চেয়ে হুমকি দিলেন। অবশ্য বুঝিয়েও বলেছেন। শেষবার সিদ্ধান্ত নিলাম পুলিশকে জানিয়ে দেব। আমরা চাচ্ছিলাম দুলাভাই নিজে সবটা স্বীকার করুক। তাহলে শা’স্তি কিছুটা হলেও কম হবে। আপা, রোহানের কথা ভেবেই ভাইয়া এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
সেদিন সন্ধ্যার পর দুলাভাইয়ের সাথে চটপটি খাবার কথা বলে হাসপাতালের নির্জন দিকটায় যাই। হঠাৎই দুলাভাই আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন, উনার বুকে গু’লি লাগল। তারপর আজ সকালে আপা আমাকে এখানে ডেকে আনলো। বলল, ‘এসবের জন্য সে দায়ী। সবকিছু তার কথামতো হয়েছে।’

এতটুকু বলে নাইমা থামল। লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, “দুলাভাই আমায় আরও একটা বলেছেন। উনার একটা ডাইরি আছে। সেখানে সব লেখা আছে।”

ডিআইজি সাহেব বললেন, “কোথায় সেই ডাইরি?”

“আমার কাছে। আপনি বললে এনে দিতে পারি।”

নাইমা নববীর হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো। কনকের ঘরে গিয়ে ডাইরি এনে ডিআইজির হাতে দিলো। তিনি ডাইরি হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলেন। কনকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।”

কনক অসম্ভব শান্ত এবং বিনম্র গলায় বলল, “আমি কি কিছু সময় পেতে পারি? পরিবারের সাথে শেষ কিছু কথা বলতে চাই।”

ডিআইজি সাহেব অসম্ভব কোমল গলায় বলল, “নিশ্চয়ই পারো।”

শরিফা বেগম তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “তোর মতো মেয়ের সাথে আমাদের কারোর কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না। লোভের কারণে নিজের স্বামীকে মে’রে ফেলেছিস, বোনকে মা’র’তে চেয়েছিস এরপরও আমাদেরকে নিজের পরিবার বলছিস কোন মুখে?”

কনক সরল চোখে তাকাল। শান্ত স্বাভাবিক গলায় বলল, “মানুষকে বিশ্বাস করা থেকে কণ্টকাকীর্ণ পথে হাঁটা অনেক কম কষ্টের। কাঁ’টার আ’ঘা’ত আমাদের কষ্ট দেয়, নিশ্চিত বিষয়। তবে আমরা যাদের বিশ্বাস করি – কখনও কষ্ট দেবে না, এই ভেবেই বিশ্বাস করি। আনিসকে আমার নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলাম। অবশ্য সে-ই আমায় রাস্তাঘাটে বিরক্ত করত। ভালোবাসার প্রস্তাব দিত। অল্প বয়স, নি’ষি’দ্ধ অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। মা বাবাকে বলে হাত-পা ধরে অবশেষে আমাদের বিয়ে হয়। ভেবেছিলাম- ভালোবাসার মানুষকে চিরতরে নিজের করে পেয়েছি। আমার মতো সুখী আর কে-ই বা হতে পারে! ভালো চলছিল সবকিছু। স্বামীর প্রতি অঘাত ভালোবাসা, বিশ্বাস, আনুগত্য নিয়ে সংসার সামলাচ্ছিলাম। ঘটনা যখন জানতে পারি, তখন রোহান আমার পেটে। আনিস অন্য মেয়েদের সাথে সম্পর্ক রাখে। শুধু কথাবার্তা বলে না, সবকিছুই! মনে হচ্ছিল নিজেকে শে’ষ করে ফেলি। বাচ্চার কথা ভেবে কিছু করতে পারলাম না। মা’কে সব খুলে বললাম। আজ আমার পরিচয় দিতে অস্বীকার করা সুশীল মা সেদিন আমায় বলেছিল- ‘একবার বাড়ির মানুষের সম্মান নষ্ট করে বিয়ে করেছিস। এখন আবার পোয়াতি হয়ে বাড়ি ফিরতে চাইছিস? আবার আমাদেরকে সবার সামনে ছোট করতে চাস? নিজে পছন্দ করার সময় এসব মনে ছিল না? যেমন আছো তেমন করে সংসার করো। পারলে নিজের স্বামীকে বুঝিয়ে বলো। আমি তোমার আব্বাকে কিছু বলতে পারব না।’ আমি বললাম, ‘আব্বা এমন করলে কি তুমিও মেনে নিতে মা?’
মা আমায় থা’প্প’ড় মা’র’ল। আর যা কিছু বলল তা আর এখন বলতে চাই না। ভেতর থেকে চুরমার হয়ে যাওয়া জীবন্ত লা’শ আমিটা শশুর বাড়ি ফিরে এলাম। বহুদিন নিরবে সরেছি। কষ্ট পেয়েছি, কেঁদেছি, কয়েকবার ম’র’তেও বসেছিলাম। কেউ আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়ায়নি, আদর করে বুকে আগলে নেয়নি। জ’ল’ন্ত আ’গু’নে একাই পু’ড়ে’ছি। তারপর হঠাৎই একদিন সব ভয়ে কে’টে গেল। অনাগত সন্তানের জন্য মন, আত্মা, আবেগ-অনুভূতি, ভালোবাসা-ঘৃ’ণা, রাগে-অভিমান সবকিছু নিজের ভেতরে ক’ব’র দিয়ে দিলাম। যেন আবার আমার পুণর্জন্ম হয়েছে। এমন এক আমি! যাকে কেউ কষ্ট দিতে পারে না। আ’ঘা’ত করতে পারে না। প্রস্তরখন্ডের থেকেও কঠিন, বরফের থেকেও শীতল, আগুনের থেকেও অনেক বেশি উত্তপ্ত!”

শরিফা বেগম মাথা নিচু করে রেখেছেন। কনক খানিকটা সময় নিয়ে বলল, “সবকিছু ভুলে থাকব। তবে আমারও তো কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। নিজেকে টাকা নেশায় জড়িয়ে ফেললাম। টাকা হলে সব কেনা যায়। সোনা-দানা, খাবার-দাবার, কাপড়-চোপড় সবকিছু। এভাবে এক শুভাকাঙ্ক্ষীর সাথে পরিচয়। তিনি আমায় এসব চোরাচালানের ব্যবসার কথা বলেন। তাদের সাথে কাজ করতে বলেন। রাজি হই। একদিন হঠাৎই জানতে পারি নাইমা সব জেনে গেছে। আনিসকে বলেছে তাকেও ব্যবসার ভাগিদার করতে হবে। যার মনে কারোর প্রতি দয়ামায়া নেই। সে কেন নিজের বোনকে ভালোবাসবে? আমিও বাসিনি। মে’রে ফেলতে চেয়েছি। লোক ঠিক করলাম। গু’লি করবে। নাইমা ম’রে’নি- ম’র’ল আনিস। আনিসের মৃ’ত্যুতে খুশি হয়েছি সত্যি, তবে নাইমাকে নিয়ে ভয় দূর হলো না। ওকেও মে’রে ফেলার পরিকল্পনা করলাম।”

এতক্ষণ সবাই চুপচাপ শুনছিল। কেউ কথা বলেনি। আনিসের মা হঠাৎ বলে উঠলেন, “নিজের স্বামীকে মে’রে ফেললে? কষ্ট হলো না? রোহানের কথাও ভাবলে না?”

“আপনারা কখনও ভেবেছেন? অন্তঃসত্ত্বা আমাকে যখন আপনার ছেলে অমানুষের মতো মা’র’ত তখন মনে হয়নি নাতির কি হবে?”

তিনি আর কিছু বললেন না। কনক ইশারায় নববীকে কাছে ডাকল। নববী একটু এগিয়ে গেল। কনক তার গালে হাত রেখে বলল, “তোমায় খুব হিংসা করতাম, জানো? সহ্যই করতে পারতাম না। একটা মেয়ে কতটা ভাগ্যবতী হলে হাবিবের মতো স্বামী পায়। যে বউয়ের সব খেয়াল রাখে, ভালোবাসে, সবার বিরুদ্ধে গিয়ে তার পাশে দাঁড়ায়। অনেক অন্যায় করেছি তোমার সাথে, পারলে আমাকে মাফ করে দিও।”

কথাগুলো শেষ করে সে নিজের গলায় ব্রুজের সূচালো অংশ ঢুকিয়ে দিলো। কথার ফাঁকে কখন যেন নববীর ওড়না থেকে খুলে নিয়েছে। নববী চিৎকার করে উঠল। হাবিব দৌড়ে গিয়ে কনককে ধরল। কনক ভাইয়ের গালে হাত রাখল। ডিআইজি সাহেব বললেন, “এভাবে বসে থাকা যাবে না। জলদি গাড়িতে তুলন। তিনি নিজের হাতে ব্রুজ টেনে বের করে ফেললেন। গলা থেকে ফিনকি দিয়ে র’ক্ত বের হচ্ছে। একটা ব্রুজের আ’ঘা’তে কি এমন করে র’ক্ত বের হয়!

কনককে তুলে নিয়ে শরাফতের গাড়িতে বসালো। গাড়ি খুব দ্রুত চলছে। সূর্যের আলো ফুটে গেছে। চারদিক রোদে চকচক করছে। কনক হাবিবের গায়ে হাত রাখল। মিইয়ে যাওয়া গলায় ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে বলল, “একটা খু’নেরও যে শা’স্তি, দুইটা তিনটেরও তাই। সত্যি একটা কথা বলে যাই ভাই। সোহেলকে আমি মে’রে’ছি। রোহানকে আমিই বলেছিলাম ওকে যেন ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দেয়।”

হাবিব সম্পূর্ণভাবে অসাড় হয়ে গেছে। কথা বলতে পারছে না। যেন তার নিঃশ্বাসও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কনক অস্পষ্ট দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে এক পলক তাকালো। তারপরই চোখ বন্ধ করে ফেলল। গাড়ি চলছে। নিজের গতিতেই চলছে। বাতাসের শোঁশোঁ শব্দ হচ্ছে, দুই একটা গাড়ির হর্ণ শোনা যায়। লোকের কোলাহল। কোনকিছুই যেন আর হাবিবের কানে পৌঁছাল না। সে ঠায় বসে রইল।

চলবে