🔴বহুব্রীহি (পর্ব :১, ২)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ
উঁচু দেয়ালে ঘেরা পুরানো ধরনের বিশাল দোতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে এবং পেছনে গাছগাছলিতে জঙ্গলের মত হয়ে আছে। কিছু কিছু গাছের গুড়ি কালো সিমেন্টে বাধানো। বাড়ির নাম নিরিবিলি, শ্বেত পাথরে গেটের উপর নাম লেখা, অবশ্যি র এর ফোঁটা মুছে গেছে। পাড়ার কোন দুষ্ট ছেলে হারিয়ে যাওয়া ফোঁটাটা বসিয়ে দিয়েছে ব এর উপর। এখন বাড়ির নাম নিবিরিলি।
সাধারণত যেসব বাড়ির নাম নিরিবিলি হয়, সেসব বাড়িতে সারাক্ষণই হৈ চৈ হতে থাকে। এই মুহুর্তে এ বাড়িতে অবশ্যি কোন হৈ চৈ হচ্ছে না। বাড়ির প্ৰধান ব্যক্তি সোবাহান সাহেবকে বারান্দার ইজি চেয়ারের পা মেলে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। তাঁর মুখ চিন্তাক্লিষ্ট। চোখে সুস্পষ্ট বিরক্তি।
সোবাহান সাহেব বছর দুই হল ওকালতি থেকে অবসর নিয়েছেন। কর্মহীন জীবনে এখনো অভ্যস্ত হতে পারেন নি। দিনের শুরুতেই তার মনে হয়। সারাটা দিন কিছুই করার নেই। তাঁর মেজাজ সেই কারণ ভোরবেলায় খুবই খারাপ থাকে। আজ অন্য দিনের চেয়েও বেশি খারাপ, কেন তা তিনি বুঝতে পারছেন না। শরৎকালের একটা চমৎকার সকাল। ঝকঝকে রোদ, বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ। এ রকম একটা সকালে মন খারাপ থাকার প্রশ্নই আসে না।
সোবাহান সাহেবের গায়ে হলুদ রঙের একটা সুতির চাদর। গলায় বেগুনি রঙের মাফলার। আবহাওয়া বেশ গরম, তবু তিনি কেন যে মাফলার জড়িয়ে আছেন তা বোঝা যাচ্ছে না। তার হাতে একটা পেপার ব্যাক, ডিটেকটিভ গল্প। কাল রাতে বত্ৰিশ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়েছিলেন। গত একটা ঘণ্টা ধরে তেত্রিশ নম্বর পৃষ্ঠা পড়তে চেষ্টা করছেন, পারছেন না। বার বার ইচ্ছে করছে বই ছিড়ে কুটি কুটি করে ফেলে হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলতে। তেত্রিশ পৃষ্ঠায় নেইল কাটার দিয়ে খুঁচিয়ে মীথ নামে একটি লোকের বা চোখ তুলে নেবার বিষদ বর্ণনা আছে। সোবাহান সাহেব অবাক হয়ে পড়লেন— চোখ উপড়ে তুলে নেবার সময়ও মিঃ স্মীথ রসিকতা করছে এবং গুন গুন করে গাইছে–লন্ডন ব্রীজ ইজ ফলিং ডাউন।
কোন মানে হয়? যে লেখক এই বইটি লিখেছে সোবাহান সাহেবের ইচ্ছে করছে তার বা চোখটা নেইল কাটার দিয়ে তুলে ফেলতে।
সোবাহান সাহেবের ছোট মেয়ে মিলি চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় ঢুকল। বাবার সামনের গোল টেবিলে কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে হাসিমুখে বলল, বাবা তোমার চা।
সোবাহান সাহেব থমথমে গলায় বললেন, কিসের চা?
চা পাতায় তৈরি চা, আবার কিসের?
এখন কেন?
তুমি সকাল আটটায় এক কাপ চা খাও এই জন্যে এখন। সকাল আটটা কিছুক্ষণ আগে বাজল?
সোবাহান সাহেব থমথমে গলায় বললেন, পিরিচে চা পড়ে আছে কেন? চা থাকবে চায়ের কাপে!
তাই আছে বাবা, পিরিচে এক ফোঁটা চা নেই। তুমি ভাল করে তাকিয়ে লেখ।
তিনি চায়ের কাপ হাতে নিলেন। মনে মনে ঠিক করলেন চা অতিরিক্ত মিষ্টি হলে বা মিষ্টি কম হলে মেয়েকে প্ৰচণ্ড ধমক দেবেন। কাউকে ধমকাতে ইচ্ছা! করছে। তিনি অত্যন্ত মনমরা হয়ে লক্ষ্য করলেন, চা-য়ে চিনি ঠিকই আছে। চা আনতে আনতে ঠাণ্ডাও হয় নি, যতটুকু গরম থাকার কথা ততটুকুই আছে, বেশিও না কমও না।
মিলি বলল, সব ঠিক আছে। বাবা?
তিনি জবাব দিলেন না। মিলি হালকা গলায় বলল, ভোরবেলা তোমার জন্যে চা আনতে যা ভয় লাগে। একটা না একটা খুঁত ধরে বিশ্ৰী করে বিকা দাও। বাবা, তোমার পাশে খানিকক্ষণ বসব?
সোবাহন সাহেব এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না। মিলি, গোল-টেবিলের এক কোণায় বসল। তার বয়স একুশ। একুশ বছরের একটা আলাদা সৌন্দৰ্য আছে। সেই সৌন্দর্যে সে ঝলমল করছে। তার পরনে কমলা রঙের শাড়ি। শরৎকালের ভোরের সঙ্গে এই শাড়িটি চমৎকার মানিয়ে গেছে। মিলি হাসিমুখে বলল, এই গরমে গলায় মাফলার জড়িয়ে আছ কেন বাবা? দাও খুলে দেই।
সোবাহান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, খোলার প্রয়োজন মনে করলে নিজেই খুলতাম। মাফলার খোলা খুব জটিল কোন বিষয় নয় যে দ্বিতীয় ব্যক্তির সাহায্য লাগবে।
মিলি হেসে ফেলল। হেসেই চট করে মুখ ঘুরিয়ে নিল, বাবা তার হাসি দেখতে গেলে রেগে যেতে পারেন। মিলি মুখের হাসি মুছে বাবার দিকে তাকাল। হাসি অবশ্যি পুরোপুরি গেল না— তার চোখে ঝিলমিল করতে লাগল। বাবা, রোজ ভোরে তুমি একটা ঝগড়া বাধাতে চাও কেন বলতো? ভোরবেলা তোমার ভয়ে আমি অস্থির হয়ে থাকি।
এই বলে মিলি আবার হেসে ফেলল। এখন তার হাসি দেখে মনে হল না। বাবার ভয়ে সে অস্থির। সোবাহান সাহেব কিছুই বললেন না। বই খুললেন, তেত্রিশ পৃষ্ঠাটা পড়ার একটা শেষ চেষ্টা করা যাক।
মিলি বলল, তুমি মোর্ডার ইন দা ডার্ক পড়ছ? অসাধারণ একটা বই–তাই না বাবা?
সোবাহান সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, অসাধারণ?
হ্যাঁ অসাধারণ, স্মীথ নামের একটা লোকের বা চোখ নেইল কাটার দিয়ে খুঁচিয়ে তুলে ফেলা হয়…
এটা অসাধারণ? লোকটার সাহস তুমি দেখবে না? লোকটা তখন গান গাইতে থাকেলন্ডন বীজ ইজ ফলিং ডাউন, ফলিং ডাউন….। তারপর কি হয় জান? এই অবস্থায় সে কোক করে একটা লাথি বসায় মাডারারটার পেটে। মার্ডারার এক মুহুর্তের জন্যে অন্যমনস্ক হতেই সে উপড়ে তোলা চোখটা ছিনিয়ে তিনতলার জানোলা দিয়ে নিচে লাফ দেয়। তার চোখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। তীব্ৰ ব্যথায় সে দিশাহারা, তবু সে ছুটে যায় একটা হাসপাতালে, ডাক্তারকে হাসি মুখে বলে–ডাক্তার সাহেব। আপনি কি এই চোখটা জায়গামত বসিয়ে দিতে পারেন? যদি পারেন তাহলে আপনাকে আমি লন্ডন শহরের সবচেয়ে বড় গোলাপটি উপহার দেব। সৌভাগ্য ক্রমে সেই হাসপাতালে তখন ছিলেন ইউরোপের সবচেয়ে বড় আই সার্জন ডঃ এসিল নায়ার। তিনি— সোবাহান সাহেব থমথমে গলায় বললেন, সে লোকটার চোখ লাগিয়ে দিল?
হ্যাঁ, অপটিক নার্ভ গুলি জোড়া লাগিয়ে দিল—?
এই কুৎসিত বইটাকে তুই বলছিস অসাধারণ? বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী যে ইকনমিক্সে অনার্স পড়ছে সে এই বইকে বলছে অসাধারণ?
ইকনমিক্সে সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, বইটা আমার সামনে ছিঁড়ে কুটি কুটি কর।
কি বললে বাবা?
বইটা কুটি কুটি করে ছিড়ে ফেল, আমি দেখি।
মিলি আঁৎকে উঠে বলল, এই বই আমার না বাবা। আমার এক বান্ধবীর বই। আমি এক সপ্তার জন্যে ধারা এনেছি।
বই যারই হোক–নষ্ট করা দরকার। সমাজের মঙ্গলের জন্যেই দরকার। আমি এই বিষয়ে দ্বিতীয় কোন কথা শুনতে চাই না। আমি দেখতে চাই যে বইটা কুটি কুটি করে ফেলা হয়েছে।
আমার বইতো না বাবা। আমার বই হলে একটা কথা ছিল।
বললাম তো এই বিষয়ে আমি আর কোন আগুমেন্ট শুনতে চাই না। ডেস্ট্রয়।
মিলি বেশ কিছুক্ষণ। হতভম্ব ভঙ্গিতে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল, কেঁদে ফেলার চেষ্টা করল, কাঁদতে পারল না। কেঁদে ফেলতে পারলে বইটা রক্ষা করা যেত। সোবাহান সাহেব বললেন, কি ব্যাপার বসে আছিস যে? কি বলছি কানে যাচ্ছে না?
মিলি উঠে দাঁড়াল। বাবার কোল থেকে বই নিয়ে ছিড়ে কুচি কুচি করে ফেলল। এই সময় তার চোখে পানি এসে গেল। মিলি জানে চোখের পানি দেখা মাত্র তার বাবার মেজাজ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এখন ঠাণ্ডা হলেই বা লাভ কি? সর্বনাশ যা হবার তাতো হয়েই গেছে। ছেড়া বইতো আর জোড়া লাগবে না। মৌসুমীকে সে কি জবাব দেবে তাই ভেবে মিলির চোখ। আবার জলে ভরে উঠছে। সে ছেড়া বই চারদিকে ছড়িয়ে ছুটে ভেতরে চলে গেল। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বারান্দায় ঢুকল ফরিদ।
ফরিদ, মিলির মামা। সাত বছর বয়স থেকে এই বাড়িতেই আছে। পাঁচ বছর আগে অঙ্কে অনার্স পাস করেছে। এম. এ. করেনি। কারণ তার ধারণা তাকে পড়াবার মত বিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নেই। এম. এ. পড়া মানে শুধু শুধু সময় নষ্ট। বর্তমানে তার দিন কাটছে ঘুমিয়ে। অল্প যে কিছু সময় সে জেগে থাকে সেই সময়টায় সে ছবি দেখে। অধিকাংশই আর্ট ফ্রিম। কোন কোন ছবি ছয় সাত বার করেও দেখা হয়। বাকি জীবনটা সে এই ভাবেই কাটিয়ে দিতে চায় কি-না জিজ্ঞেস করলে অত্যন্ত উচ্চ মার্গের একটা হাসি দেয়। সেই হাসি অতি মধুর, তবু কেন জানি সোবাহান সাহেবের গা জুলে যায়। ইদানীং ফরিদকে দেখা মাত্র তাঁর ব্ৰহ্মতালু গরম হয়ে উঠে, ঘাম হয়। আজও হল। তিনি তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আগেকার আমলে মুনি ঋষিরা হয়ত এই দৃষ্টি দিয়েই দুষ্টদের ভস্ম করে দিতেন। ফরিদ তার দুলাভাইয়ের দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ কণ্ঠে বলল,
What a lovely day.
ফরিদের খালি গা। কাঁধে একটা টাওয়েল। মুখ ভর্তি টুথপেস্টের ফেনা। কথা বলতে গিয়ে ফেনা তার গায়ে পড়ে গেল এতে তার মুগ্ধ বিস্ময়ের হের ফের হল না। সে আনন্দিত স্বরে বলল, দুলাভাই শরৎকালের এই শোভার কোন তুলনা হয় না। অপূর্ব অপূর্ব! আমার মনটা দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছে দুলাভাই। I am dissolving in the nature.
সোবাহান সাহেব মেঘ গর্জন করলেন, ফরিদ এসব কি হচ্ছে আমি জানতে পারি?
নেচারকে এপ্রিসিয়েট করছি দুলাভাই। নেচারকে এপ্রিসিয়েট করায় নিশ্চয়ই কোন বাধা নেই।
টুথপেস্টের ফেনায় সারা গা মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে সেই খেয়াল আছে?
তাতে কিছু যায় আসে না দুলাভাই।
যায় আসে না?
না।
খালি গায়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছ, রাস্তায় লোকজন চলাচল করছে তাতেও তোমার অসুবিধা হচ্ছে না?
জ্বি না। পোশাক হচ্ছে একটা বাহুল্য।
পোশাক একটা বাহুল্য?
জি। আমি যখন খালি গা থাকি তখন প্রকৃতির কাছাকাছি থাকি। কারণ প্রকৃতি যখন আমাদের পাঠান তখন খালি গায়েই পাঠায়। এই যে আপনি জাব্বা জোব্বা পরে বসে আছেন এসব খুলে পুরো দিগম্বর হয়ে যান দেখবেন অন্য রকম ফিলিংস আসবে।
স্তম্ভিত সোবাহান সাহেব বললেন, তুমি আমাকে সব কাপড় খুলে ফেলতে বলছ?
জ্বি বলছি।
সোবাহান সাহেব লক্ষ্য করলেন তাঁর ব্ৰহ্মতালুতে জুলুনি শুরু হয়েছে, গা ঘামছে। এসব হার্ট এ্যাটাকের পূর্ব লক্ষণ কিনা কে জানে। তাঁর মৃত্যু হার্ট এ্যাটাকে হবে একটা তিনি বুঝতে পারছেন, ফরিদের কারণেই হবে। কত অবলীলায় কথাগুলো বলে কেমন হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
ফরিদ বলল, আপনি চোেখ মুখ এমন শক্ত করে বসে আছেন কেন দুলাভাই? আনন্দ করুন।
আনন্দ করব?
হ্যাঁ করবেন। জীবনের মূল জিনিসই হচ্ছে আনন্দ। এমন চমৎকার একটা সকাল। আচ্ছা দুলাভাই রবি ঠাকুরের ঐ গানটার কথাগুলো আপনার মনে আছে–আজি এ শারদ প্ৰভাতে–মনে আছে? প্রথম লাইনটা কি–আজি এ শারদ প্ৰভাতে, না-কি হেরিনু শারদ প্ৰভাতে?
সোবাহান সাহেব বললেন, তুমি দয়া করে আমার সামনে আসবে না।
ফরিদ বিস্মিত হয়ে বলল, কেন?
আবার কথা বলে, যাও বলছি আমার সামনে থেকে। বহিষ্কার, বহিষ্কার।
কি যন্ত্রণা আবার সাধু ভাষা ধরলেন কেন? বহিষ্কার আবার কি? বলুন বেড়িয়ে যাও। মুখের ভাষাকে আমাদের সহজ করতে হবে। দুলাভাই, তৎসম শব্দ যত কম ব্যবহার করা যায় ততাই ভাল।
যাও বলছি আমার সামনে থেকে। যাও বলছি।
যাচ্ছি। যাচ্ছি। বিনা কারণে আপনি এ রকম রেগে যান কেন এই ব্যাপারটাই আমি বুঝি না।
ফরিদ চিন্তিত মুখে ঘরের ভেতর ঢুকল। সোবাহান সাহেবের স্ত্রী তার কিছুক্ষণ পর বারান্দায় এসে বললেন, তুমি কি মিলিকে কিছু বলেছ? ও কাঁদছে কেন?
সোবাহান সাহেবের মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল, একুশ বছর বয়েসী। একটা মেয়ে যদি কথায় কথায় কেঁদে ফেলে তাহলে বুঝতে হবে দেশের নারী সমাজের চরম দুদিন যাচ্ছে।
কথা বলছি না কেন, কিছু বলেছ মিলিকে? মেয়ে বড় হয়েছে এখন যদি রাগারগি কর।
সোবাহান সাহেব শীতল গলায় বললেন, মিনু তোমাকে এখন একটা কঠিন কথা বলব, মন দিয়ে শোন— আমি তোমাদের সংসারে আর থাকব না।
তার মানে, কোথায় যাবে তুমি?
সেটা এখনো ঠিক করিনি। আজ দিনের মধ্যে ঠিক করব।
মিনু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। সোবাহান সাহেব বললেন, একটা অপ্রিয় ডিসিসান নিলাম। বাধ্য হয়েই নিলাম।
বনে জঙ্গলে গিয়ে সাধু সন্ন্যাসী হবে?
এই বিষয়ে তোমার সঙ্গে কোন কথা বলতে চাই না।
সোবাহান সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। মিনু বললেন, যাচ্ছ কোথায়?
তিনি এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। অতি দ্রুত গেট খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন। তার বাড়ির সামনের রাস্তার ওপাশেই এখন একটা মাইক ভাড়ার দোকান হয়েছে। সারাক্ষণ সেখানে থেকে হ্যালো মাইক্রোফোন টেস্টিং ওয়ান-টু–খ্ৰী। হ্যালো মাইক্রোফোন টেস্টিং ওয়ান-টু–গ্ৰী হয়। এখন হচ্ছে না। এখন তারা একটা রেকর্ড বাজাচ্ছে হাওয়া সে উড়তা যারে মেরা লাল দু পাট্টা মলমল। এই লক্ষ কোটি বার শোনা গান শুনে মেজাজ আরো খারাপ হবার কথা, তা হল না। সোবাহান সাহেব লক্ষ্য করলেন–গানটা শুনতে তাঁর ভাল লাগছে। তিনি এর কারণ বুঝতে পারলেন না। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন, আকাশ ঘন নীল, নীল আকাশে সাদা মেঘের স্তূপ। আকাশ এবং মেঘ দেখতেও তার ভাল লাগল। তাঁর মনে হল— মানব জীবন বড়ই মধুর। এই জীবনের আনন্দ হেলা ফেলার বিষয় নয়।
পর্ব ১ শেষ 📌
🔴পর্ব :২🔴
মানব জীবন বড়ই মধুর এই কথা সবার জন্যে সম্ভবত প্ৰযোজ্য নয়। গ্ৰীন ফার্মেসীর নতুন ডাক্তার মনসুর আহমেদের জন্যে তো অবশ্যই নয়। তার কাছে মনে হচ্ছে–মানব জীবন অর্থহীন যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই রকম মনে করার আপাত দৃষ্টিতে তেমন কোন কারণ নেই। সে মাত্র ছয়মাস আগেই ইন্টার্নশীপ শেষ করে বের হয়েছে। এর মধ্যেই ভোলা উপজেলায় স্বাস্থ্যু কমপ্লেক্সে একটা চাকরিও পেয়েছে। ঢাকা ছেড়ে যাবার ইচ্ছা নেই বলে ঐ চাকরি সে নেয়নি। আপাতত সে গ্রীন ফার্মেসীতে বসছে। গ্রীন ফার্মেসীর মালিক কুদ্দুস সাহেব তাকে ফার্মেসীর উপরে দুটি ঘর ছেড়ে দিয়েছেন। মনসুর ঐ ঘর দুটিতে সংসার পেতে বসেছে। প্রতিদিন কিছু রুগী টুগীও পাচ্ছে। বড় কিছু নাসর্দি জ্বর, কাশি, ডায়রিয়া। একদিন অল্পবয়সী একটা মেয়েকে নিয়ে মেয়ের মা এসেছিলেন, চেংড়া ডাক্তার দেখে মেয়ের অসুখ প্রসঙ্গে কিছু বললেন না। গম্ভীর গলায় বললেন, না থাক আপনাকে দেখতে হবে না। আমার দরকার একজন বয়স্ক ডাক্তার। আপনি তো নিতান্তই বাচ্চা ছেলে।
কুদ্দুস সাহেব বললেন, ডাক্তারদের কোন বয়স নেই। আপা। ডাক্তার হচ্ছে ডাক্তার। আর এর বয়স কম হলে কি হবে জাত-সাপ।
জাত সাপের প্রতি রুগী বা রুগীনির মা কারোরই কোন আগ্রহ দেখা গেল না। রুগীনি বলল, আমি উনাকে কিছু বলব না মা।
এ রকম দু একটা কেইস বাদ দিলে রুগী যে খুব খারাপ হচ্ছে তাও না। ভিজিটের টাকা চাইতে মনসুরের লজ্জা করে। ঐ দায়িত্ব কুদ্দুস সাহেব খুব ভাল ভাবেই পালন করছেন।
দশ টাকা কি দিচ্ছেন ভাই? উনার ভিজিক কুড়ি টাকা। বয়স কম বলে অশ্রদ্ধা করবেন না–গোল্ড মেডালিস্ট।
মনসুর বিব্রত গলায় বলেছে, কুদ্দুস ভাই, সব সময় গোল্ড মেডেলের কথা বলেন। কোন মেডেল ফেডেল তো আমি পাই নি।
কুদ্দুস সাহেব নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেছেন, পাওয়ার দরকার নেই। মানুষের মুখেই জয়। মানুষের মুখেই ক্ষয়। মুখে মুখে মেডেলের কথাটা রটে যাক। সুটকেস খুলে কেউতো আর মেডেল দেখতে আসবে না।
এসব মিথ্যা কথা বলে। লাভ কি?
নাম ফাটবেরে ভাই নাম ফাটবে। তোমার নাম ফাটা মানে ফার্মেসীর উন্নতি। ফার্মেসীর উপর বেঁচে আছি। ফর্মেসীর উন্নতি দেখতে হবে না?
কুদ্দুস সাহেবের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। তিনি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফার্মেসীতে বসে থাকেন। সারাক্ষণ কথা বলেন। মানুষটাকে মনসুরের বেশ ভাল লাগে। তাঁর বকবকানি এবং উপদেশ শুনতেও মনসুরের খারাপ লাগে না।
তোমার সবই ভাল বুঝলে ডাক্তার, তবে তোমার একটা বড় সমস্যা কি জান? তোমার কোন উচ্চাশা নেই।
সেটা সমস্যা হবে কেন?
এইটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। দু ধরনের মানুষের উচ্চাশা থাকে না, মহাপুরুষদের এবং বেকুবদের। তুমি এই দুদলের কোন দলে সেটা বুঝতে পারছি না। সম্ভবত দ্বিতীয় দলে।
আমাকে নিয়ে ভাবার দরকার নেই।
দরকার থাকবে না কেন, অবশ্যই আছে। এ রকম ইয়াং একজন ছেলেগোল্ড মেডালিস্ট, অথচ তার কোন উচ্চাশা নেই—
কি মুশকিল গোল্ড মেডেলের কথা আবার বলছেন?
ঐ একই হল। পেতেও তো পারতে। আমি যা বলছি তার সারমর্ম হচ্ছেসুযোগ খুঁজতে হবে। বিলেত আমেরিকা যেতে হবে, এফ আর সি এস, এম আর সি পি হয়ে এসে রুগীদের গলা কেটে পয়সা করতে হবে। আলিশান দালান তুলতে হবে—
আমার এত সব দরকার নেই। আমি সুখেই আছি।
সুখে আছ?
হ্যাঁ সুখে।
মনসুর আসলেই সুখে আছে। তার উপর সংসারের দায়-দায়িত্ব কিছু নেই। তার বাবা ময়মনসিংহ শহরে ওকালতি করেন। দেশের বাড়ির অবস্থা মন্দ নয়। ময়মনসিংহের এত বড় বাড়িতে মানুষ বলতে বাবা-মা এবং ছোট বোন নীলিমা। মনসুরকে টাকা রোজগার করে সংসার চালানোর দায়িত্ব নিতে হচ্ছে না। উল্টা প্রতিমাসে মনসুরের বাবা এক হাজার করে টাকা পাঠিয়ে ছোট একটি চিঠি লিখেন। প্রতিটি চিঠির ভাষা এবং বক্তব্য এক।
বাবা মনু,
টাকা পাঠালাম। শরীরের যত্ন নেবে। তুমি ঢাকা শহরে কেন পড়ে আছ তা বুঝতে পারছি না। তোমার নিজের শহরে প্র্যাকটিস করতে অসুবিধা কি? একটা ভাল জায়গায় তোমার জন্য চেম্বার করে দেবার সামর্থ পরম করুণাময় আল্লাহতালা আমাকে দিয়েছেন পত্রপাঠ মন স্থির করে আমাকে জানাবে।
–ইতি তোমার আকবা।
পুনশ্চ ১ : আরো টাকার দরকার হলে লিখবে। এই নিয়ে সংকোচ করবে না। টাকা-পয়সা তোমাদের জন্যেই।
পুনশ্চ ২ : তোমার মার ইচ্ছা তোমার একটা বিবাহ দেন। ব্যাপারটা ভেবে দেখা। তোমার এখন পচিশ চলছে। আমি চব্বিশ বছর বয়সে তোমার মাকে বিবাহ করি। বিবাহের জন্যে এটাই উপযুক্ত বয়সী।
পুনশ্চ ৩ : তোমার নিজের কোন পছন্দ থাকলে আমাদের কোনই আপত্তি নাই, এটা তোমাকে বলে রাখলাম।
বাবার চিঠির সঙ্গে মার চিঠি থাকে। সেই চিঠিতে নানান অবান্তর কথার সঙ্গে একটি মেয়ের কথা থাকে। পুরো চিঠি জুড়ে থাকে সেই মেয়ের রূপ এবং গুণের বর্ণনা এবং সেই রূপবতী এবং গুণবতীর কয়েকটি রঙ্গীন ছবি।
গত সপ্তাহের চিঠিতে যে মেয়ের কথা ছিল তার নাম রূপা।
মনসুরের মা লিখেছেন—
বাবা মনু, এই মেয়েটির দিকে একবার তাকাইলে চোখ ফিরাইতে ইচ্ছা! করে না। বড়ই রূপবতী মেয়ে। আচার ব্যবহারেও চমৎকার। এই সবই হয়েছে বংশের গুণ। মেয়ের মাতুল বংশ খুবই উচ্চ। নান্দাইল রোডের সরদার পরিবার। এক ডাকে সবাই চিনে। মেয়ে মমিনুন্নেসা কলেজে বি এ ফাস্ট ইয়ারে পড়ে। মেট্রিক ফাস্ট ডিভিসন এবং জেনারেল অংকে লেটার পেয়েছিল। অসুখ নিয়ে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেয়ার ফল বেশি ভাল হয় নাই। মেয়ে খুব ভাল গান গায়। কলেজের সব ফাংশনে নজরুল গীতি গায় এবং খুব প্রশংসা পায়। মেয়ের তিনটি ছবি পাঠালাম। তোমার পছন্দ হলে আরো কথাবার্তা বলব।
চিঠির সঙ্গে খুব সেজেগুজে তোলা তিনটা ছবি। একটা ছবিতে সে টেলিফোন তুলে কার সঙ্গে কথা বলছে। একটায় অবাক বিস্ময়ে পৃথিবীর দিকে অর্থাৎ ক্যামেরার লেন্সের দিকে তাকিয়ে আছে। অন্য ছবিটা ফুলের বাগানে তোলা। আউট অব ফোকাস হওয়ায় মেয়েটাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না, ফুলগুলো বড় সুন্দর এসেছে।
এসব চিঠি এবং চিঠির সঙ্গে ছবি পেতে মনসুরের মন্দ লাগে না। ভালই লাগে। কোন এক লজাবনত তরুণীর সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে এই কল্পনাও তার কাছে মধুর বলে মনে হয়।
গ্ৰীন ফার্মেসীর জীবন এবং তার সঙ্গে মধুর কিছু কল্পনায় তার সময় ভােলই কাটছিল। একটা মেয়ে হঠাৎ করে এসে সব এলোমেলো করে দিল। ঐ মেয়েটার কারণে কদিন ধরেই মনসুরের মনে হচ্ছে–মানব জীবন একটা যন্ত্রণা বিশেষ। তার রাত্রে ভাল ঘুম হচ্ছে না। হজমের অসুবিধা হচ্ছে। ঘটনাটা এ রকম
গত বুধবারে খুব মেঘলা ছিল। দুপুরে টিপটপ করে বৃষ্টি শুরু হল। কুদ্দুস সাহেব ভাত খেতে গেছেন। দোকানের এক কর্মচারী মজনু বলল, স্যার আপনি একটু বসেন আমি লাস্ত্রী থেকে কাপড় নিয়ে আসি। মনসুর বলল, যাও আমি আছি। মজনু চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটি মেয়ে এসে ঢুকল। পরণে সাধারণ নীল রঙের একটা শাড়ি। মাথার চুল খোপা করা। খোপা ভাল করে করা হয়নি–চুল এলোমেলো হয়ে আছে। মেয়েটির দিকে তাকিয়েই মনসুরের কেমন যেন লাগতে লাগল। এমন সুন্দর মানুষ এই পৃথিবীতে আছে? ছেলেবেলার রূপকথার বইয়ে যেসব বন্দিনী রাজকন্যার ছবি থাকে এই মেয়ে তার চেয়েও লক্ষ গুণ সুন্দর। কেমন মায়া মায়া চোখ, সমস্ত চেহারায় কি অদ্ভুত একটা স্নিগ্ধ ভাব। মেয়েটা এত সুন্দর যে তার দিকে তাকাতে পর্যন্ত মনসুরের কষ্ট হচ্ছে।
মেয়েটা নরম স্বরে বলল, আপনাদের কাছে স্যাভলনি বা ডেটল জাতীয় কিছু আছে?
মনসুর কাঁপা গলায় বলল, জ্বি আছে।
মাঝারি সাইজের একটা ফাইল দিন।
এক্ষুণি দিচ্ছি। আপনি বসুন। ঐ চেয়ারটায় বসুন।
মেয়েটি বিস্মিত গলায় বলল, বসতে হবে কেন? জিনিসটা দিন চলে যাই। দাম কত?
মনসুর কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, দাম লাগবে না।
মেয়েটি আরো অবাক হয়ে বলল, দাম লাগবে না কেন?
না মানে কোম্পানি থেকে আমরা অনেক স্যাম্পল ফাইল পাইতো–এটা হচ্ছে একটা স্যাম্পল ফাইল।
মেয়েটি বিরক্ত গলায় বলল, স্যাম্পল ফাইল আমাকে দেবার দরকার নেই। অন্য কাউকে দেবেন। দাম কত বলুন?
দামতো আমি জানি না।
দাম জানেন না মেন?
আমাদের কর্মচারি লন্ড্রীতে গেছে। ও সব জানে। এক্ষুণি এসে পড়বে।
আপনি তাহলে কে?
আমি ডাক্তার। মানে এই ফার্মেসীতে বসি। সকাল বিকাল দুবেলাই থাকি। আপনি ঐ চেয়ারটায় বসুন।
বসতে পারব না। আমার তাড়া আছে। আমার মা বটিতে হাত কেটে ফেলেছেন। হাতে ডেটল দিতে হবে।
মনসুর অসম্ভব ব্যস্ত হয়ে বলল, চলুন যাই ড্রেস করে দিয়ে আসি। কাটা ছেড়া ছোট হলেও একে অবহেলা করা ঠিক না। সেপটিকে হয়ে যেতে পারে।
মেয়েটি খুবই অবাক হল। কেমন যেন অদ্ভুত চোখে তাকাতে লাগল। শান্ত গলায় বলল, মার হাতের কাটা এমন কিছু না।
মজনু এই সময় ফিরে এল। মেয়েটা টাকা দিয়ে স্যাভলনের শিশি হাতে নিয়ে চলে গেল। মনসুরের সারাটা দিন আর কোন কাজে মন বসল না। আশ্চর্যের ব্যাপার সেই রাতে সে ঘুমাতে পারল না। একটা মেয়েকে একবার দেখে কারোর এমন হয়?
দ্বিতীয় দিনে মেয়েটির সঙ্গে আবার দেখা। বই খাতা নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিল। ভাগ্যিস ঠিক সেই সময়ে মনসুর বের হয়েছিল সিগারেট কিনতে। মনসুর জীবনে যা কোনদিন করেনি। তাই করল, এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার মা ভাল আছেন?
মেয়েটি বিস্মিত হয়ে বলল, আমাকে বলছেন?
মনসুর থাতমত খেলে বলল, জি।
আপনাকে তো আমি চিনতে পারছি না।
আমি গ্রীন ফার্মেসীতে বসি। ডাক্তার। আপনি এক বোতল স্যাভলন। কিনে নিয়ে গেলেন। আপনার মার হাত কেটে গিয়েছিল।
ও আচ্ছা মনে পড়েছে। মা ভাল আছেন। আমি এখন যাই, কেমন?
মেয়েটি তাকে চিনতে পারল না। এই দুঃখে দ্বিতীয় রাতেও মনসুরের ঘুম এল না। দুটা সিডাকসিন খেয়েও সে সারা রাত জেগে কাটাল। মেয়েটির সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সে এখন জানে। তার নাম মিলি। ভাল নাম ইয়াসমীন। ইকনমিক্সে অনার্স পড়ে–সেকেন্ড ইয়ার। যে বাড়িতে থাকে। সে বাড়ির নাম নিরিবিলি। বাড়ির গেটে একটা সাইবোর্ড ঝুলে, সেখানে লেখা–কুকুর হইতে সাবধান। যদিও সে বাড়িতে কুকুর নেই। মেয়েটি বিকেলে বাড়ির ছাদে একা হাঁটাহাঁটি করে। সে ইউনিভার্সিটিতে যায় সকাল আটটায়। রাস্তার মোড় পর্যন্ত হেঁটে যায়। তারপর রিকশা নেয়। রিকশার হুড তুলে না। সব সময় শাড়ি পরে। মেয়েটার নিশ্চয়ই অনেক শাড়ি। এখন পর্যন্ত এক শাড়ি দুবার পরতে মনুসর দেখেনি। মেয়েটি ফ্ল্যাট স্যান্ডেল পরে। অবশ্যি সে বেশ লম্বা, হিল পরবার তার প্রয়োজন নেই।
মেয়েটি তাকে চিনতে পারে কি-না এটা পরীক্ষা করবার জন্যে আজ সকালে সে মেয়েটার ইউনিভার্সিটিতে যাবার সময় সামনাসামনি পরে গেল। মেয়েটি চোখ তুলে তাকে দেখল। মনসুর কাঁপা গলায় বলল, ভাল আছেন?
মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, আমাকে বলছেন?
মেয়েটির চোখে অপরিচিতের দৃষ্টি। লজ্জায় এবং দুঃখে মনসুরের চোখে প্রায় পানি এসে গেল। আর তখন মেয়েটি বলল, ও আচ্ছা। আপনি গ্ৰীন ফার্মেসীর ডাক্তার সাহেব। জি আমি ভাল।
মনসুর হড়বড় করে বলল, আপনার মায়ের সেই কাটাটা কি সেরেছে?
মেয়েটি এই প্রশ্নে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। তারপর আর কোন কথা না বলে রিকশায় উঠে গেল। রাগে এবং লজ্জায় মনসুরের ইচ্ছা করল। লাইট পোষ্টে নিজের মাথা সজোরে ঠুকে দেয়। কেন সে বোকার মত তার মার হাত কাটার কথা জিজ্ঞেস করল? মেয়েটি নিশ্চয়ই তার বোকামী নিয়ে মনে মনে হাসছে। কে জানে বাড়িতে গিয়ে তার মাকেও হয়ত বলবে। কি লজ্জা। কি লজ্জা।
কুদ্দুস সাহেব বললেন, তোমার কি হয়েছে মনসুর বল তো।
কিছু হয়নি।
কিছু হয়নি বললে তো আমি বিশ্বাস করব না। কিছু একটা হয়েছে তো বটেই–রাতে ঘুম হয়?
ঘুমের একটু অসুবিধা হচ্ছে?
বদ হজমও হচ্ছে তাই না?
জ্বি।
মনে হচ্ছে পৃথিবীটা খুব খারাপ জায়গা—ঠিক না?
জ্বি।
সবই খুব পরিচিত লক্ষণ। আমি যখন ইন্টারমিডিয়েট পড়ি তখন আমার মধ্যে এসব লক্ষণ প্ৰকাশ পেয়েছিল। এটা একটা জীবাণু ঘটিত অসুখ।
হ্যাঁ জীবাণু ঘটিত। এ সব জীবাণুর উৎপত্তি হয় কেন এক সুন্দরী তরুণীর চোখে। জীবাণুর নাম হচ্ছে প্ৰেম-জীবাণু। ইংরেজিতে বলে Love bug, ঠাট্টা করছি না ভাই, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। জীবাণুর প্রথম আক্রমণে নার্ভাস সিস্টেম উইক হয়ে যায়। তারপর লিভার ক্ষতিগ্ৰস্ত হয়।
কি সে বলেন।
সত্যি কথা বলছি রে ভাই। খুবই সত্যি কথা— এখন বল মেয়েটা কে?
কেউ না।
সোবাহান সাহেবের মেয়ে মিলি নাতো?
মনসুরের চোখ মুখ লাল হয়ে গেল। কুদ্দুস সাহেব বললেন, আগেই সন্দেহ হয়েছিল এখন তোমাকে দেখে পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম। তোমার অবস্থাতো দেখি কাহিল।
মনসুর ক্ষীণ স্বরে বলল, আপনি যা ভাবছেন তা না।
আমি কিছুই ভাবছি না। ভাবাভাবির ফাঁক তুমি রাখনি। এখন আমার উপদেশ শোন, সহজ পাচ্য খাবার খাবে। বেশি করে ডাবের পানি খাবে। সকাল বিকাল লাইট একসারসাইজ। প্ৰেম জীবাণুঘটিত অসুখের কোন চিকিৎসা নেই। জীবাণুগুলো ভাইরাস টাইপ, কোন ওষুধেই কাজ করে না। সময়ে রোগ সারে। টাইম ইজ দ্যা বেষ্ট হিলার। সতীনাথের বিরহের গানগুলো শুনতে পোর। এতেও অনেক সময় আরাম হয়— ঐ যে আমি এধারে তুমি ওধারে, মাঝে নদী কুলকুল বয়ে যায়। টাইপ গান।
ঠাট্টা করবেন না কুদ্দুস ভাই। ঠাট্টা তামাশা ভাল লাগে না।
ঠিক বলেছি, এই সময় ঠাট্টাটা অসহ্য লাগে। কেউ ঠাট্টা করলে ইচ্ছা করে টান দিয়ে জিভ ছিড়ে ফেলি। রোগের কঠিন সংক্রমণের সময় এটা হয়। অল্পতেই নাৰ্ভ ইরিটেটেড হয়।
মনসুর ক্ষীণ স্বরে বলল, আমাকে কি করতে বলেন?
কিছুই করতে বলি না। মিলি অল্প বয়েসী মেয়ে হলে চিঠি লিখতে বলতাম—–এর সেই ষ্টেজ পার হয়ে এসেছে। চিঠি লিখলে সবাই সেই চিঠি পড়ে শুনাবে এবং হাসােহাসি করবে। তুমি যদি আগবাড়িয়ে কথা বলতে চাও, তোমাকে ভাববে ভ্যাবলা। এক মনে আল্লাহকে ডাকা ছাড়া তো আমি আর কোন পথ দেখি না। যাকে বলে আধ্যাত্মিক চেষ্টা। মাঝে মাঝে এই চেষ্টায় কাজ হয়। দৈব সহায় হয়। হঠাৎ হাতে দেখবে মেয়েটা রিকসা এ্যাকসিডেন্ট করেছে। ধরাধরি করে তাকে এইখানে আনা হল। তুমি ফাস্ট এইড দিলে। দেখা গেল অবস্থা সুবিধার না। তুমিই তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে। মেয়েটাকে ব্লাড দিতে হবে। ব্লাড গ্রুপ এ পজেটিভ। দেখা গেল তোমারও তাই। তুমি ব্লাড দিলে। মেয়েটি করুণ গলায় বললে, আপনি আমার জন্যে অনেক করলেন। আপনাকে ধন্যবাদ। তুমি গাঢ় গলায় বললে, ধন্যবাদ পরে হবে। আগে সুস্থ হয়ে উঠ।
মনসুর বলল, চুপ করুনতো কুদ্দুস সাহেব, আপনার কথা শুনতে ভাল व्लां96छ না।
কুদ্দুস সাহেব বললেন, সেটা তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। করব কি বল, কথা বলা হয়ে গেছে। অভ্যাস। তোমার অবস্থা দেখে খারাপও লাগছে। আল্লাহর উপর ভরসা রাখা। তাতে যদি কিছু হয়।
কিছু হল না। প্রেমের ক্ষেত্রে দৈব কখনোই সহায় হয় না। গল্পে, সিনেমায় হয়। জীবনটা গল্প সিনেমা নয়। জীবনের নায়িকারা, নায়কদের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হলেও চিনতে পারে না। স্যাভলনের শিশি। কিনতে একবারই ফার্মেসীতে আসে। দ্বিতীয়বার আসে না। গল্পে উপন্যাসে নায়িকারা ঘন ঘন অসুখে পড়ে। ডাক্তার নায়ক তখন চিকিৎসা করে তাকে সারিয়ে তুলে। বাস্তবের নায়িকাদের কখনো কোন অসুখ হয় না, আর হলেও অন্য ডাক্তাররা তার চিকিৎসা করেন।
অবশ্যি মনসুরের বেলায় দৈব সহায় হল। শরৎকালের এক সন্ধ্যায় তার ডাক পড়ল নিরিবিলিতে। সোবাহান সাহেবের প্রেসার মাপতে হবে। তাঁর প্রেসার হাই হয়েছে। মাথা ঘুরছে। ব্লাড প্রেসার নামক ব্যাধিটির উপর, কৃতজ্ঞতায় মনসুরের মন ভরে গেল। বারান্দায় মিলি দাঁড়িয়েছিল। এও এক অকল্পনীয় সৌভাগ্য। বারান্দায় সে নাও থাকতে পারত। মিলির সঙ্গে দেখা না হলেও কিছু করার ছিল না। মিলির জন্যে তো আর তাকে ডাকা হয়নি। মিলি বলল, স্লামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
আপনার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি।
মনসুর হতভম্ব। বলে কি এই মেয়ে। এই কথাগুলো কি সত্যি সত্যি বলছে না মনসুর কল্পনা করছে? কল্পনা হওয়াই সম্ভব। নিশ্চয়ই কল্পনা। হেলসিনেশন।
আপনাকে বলেছে বোধ হয়। বাবার ব্লাড প্রেসার মাপার জন্যে আপনাকে খবর দেখা হয়েছে।
জ্বি বলেছে।
আপনার সঙ্গে একটা গোপন ষড়যন্ত্র করার জন্যে আমি দাঁড়িয়ে আছি।
জ্বি বলুন। আপনি যা বলবেন তাই হবে।
যদি দেখেন বাবার প্রেসার খুব হাই না। তবু বলবেন হাই। বাবার রেস্টের দরকার। ভয় না দেখালে তিনি রেস্ট নেবেন না। আপনি মিথ্যা করে বলতে পারবে না?
জ্বি না।
মিলির দৃষ্টি তীব্ৰ হল। মনসুর বলল, আমি মিথ্যা বলতে পারি না।
মিথ্যা বলতে পারেন না?
জ্বি না।
ও আচ্ছা, আমার জানা ছিল না। আপনাকে দেখে আর দশটা সাধারণ মানুষের মতাই মনে হয়েছিল, যারা প্রয়োজনে কিছু মিথ্যা-টিথ্যাও বলতে পারে। আপনি যে অসাধারণ তা বুঝতে পারি নি।
আপনি কি রাগ করলেন?
কথায় কথায় রাগ করা আমার স্বভাব না। আসুন, দোতলায় যেতে হবে। বাবা দোতলায়। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় ওঠার পর মনসুর নার্ভাস ভঙ্গিতে বলল, একটা ভুল হয়ে গেছে।
কি ভুল?
প্রেসার মাপার যন্ত্র ফেলে এসেছি।
সেকি, প্রেসার মাপার জন্যেইতো আপনাকে ডাকা হয়েছে–সেই জিনিসই আপনি ফেলে এসেছেন? আপনি মানুষ হিসেবে শুধু যে অসাধারণ তাই না, মনে হচ্ছে খুব ভুলো মন।
আমি এক দৌড়ে নিয়ে আসব। যাব। আর আসব।
আপনাকে যেতে হবে না। আমি কাদেরকে পাঠাচ্ছি, ও নিয়ে আসবে।
না না। আমিই যাই। এক মিনিট।
মনসুর অতি দ্রুত সিঁড়ি টপকাচ্ছে। সেই দ্রুত সিঁড়ি ভাঙা দেখে মিলির মনে হল–একটা একসিডেন্ট হতে যাচ্ছে, হবেই হবে। না হয়েই যায় না। আর তখনি হুড়মুড় শব্দ হল। ডাক্তার সাহেব মাঝ সিড়ি থেকে বলের মত গড়িয়ে নিচে নামতে লাগলেন। শব্দ শুনে সোবাহান সাহেব এবং মিনু বেরিয়ে এলেন, ফরিদ বেরিয়ে এল, বাসার কাজের ছেলে কাদের ছুটে এল।
সোবাহান সাহেব বললেন, এ কে?
মিলি বলল, ডাক্তার সাহেব। তোমার প্রেসার মাপতে এসেছেন।
প্রেসার মাপতে এসে মাটিতে শুয়ে থাকার কারণ কি?
পা পিছলে পড়ে গেছেন বাবা।
পা পিছলে পড়েছে টেনে তুলবি না? হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
মিলিকে টেনে তুলতে হল না, মনসুর নিজেই উঠল। সার্টের ধূলা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, একদম ব্যথা পাইনি। সত্যি বলছি।
তার চারপাশের লোকজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। সোবাহান সাহেব কি একটা বলতে গিয়েও বললেন না। মনসুর বলল, এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খাব। সোবাহান সাহেব বললেন, অবশ্যই খাবে। মিলি একে নিয়ে ফ্যানের নিচে বসা। কাদের এগিয়ে এসে বলল, আমারে ধইরা ধইরা হাঁটেন। ডাক্তার সাব। চিন্তার কিছু নাই, উপরে আল্লা নিচে মাটি।
নিচে মাটি এমন কোন লক্ষণ মনসুর পাচ্ছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে সে চোরাবালির উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পা ডেবে ডেবে যাচ্ছে। ঘরটাও মনে হচ্ছে একটু একটু দুলছে। কে যেন বলল, বাবা তুমি এখানে বস।
কে বলল কথাটা? ঐ মহিলা না? ইনি বোধ হয় মিলির মা। তাকে কি সালাম দেয়া হয়েছে? স্নামালিকুম বলা দরকার না? দেরী হয়ে গেছে বোধ হয়। দেরী হলেও বলা দরকার।
নিন পানি নিন।
মনসুর পানি নিল। নিয়েই ক্ষীণ স্বরে বলর, স্নামালিকুম। বলেই বুঝল ভুল হয়ে গেছে। কথা এমন জিনিস একবার বলা হয়ে গেলে ফিরিয়ে নেয়া যায় না। মনসুর লক্ষ্য করল তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। সে নিশ্চয়ই খুব উল্টা পাল্টা কিছু বলেছে। টেনশনের সময় তার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। মনসুর অবস্থা স্বাভাবিক করার জন্যে শব্দ করে হাসল। অবস্থা স্বাভাবিক হল না মনে হল আরো খারাপ হয়ে গেল।
ফরিদ বলল, ছোকরার মনে হয় ব্রেইন ডিফেক্ট হয়ে গেছে। কেমন করে হাসছে দেখুন না দুলাভাই। অবিকল পাগলের হাসি। সোবাহান সাহেব বললেন, একজন ডাক্তারকে খবর দেয়া দরকার।
ফরিদ বলল, ডাক্তার কিছু করতে পারবে বলেতো মনে হচ্ছে না। আমার ধারণা ব্রেইন হেমারেজ। হোয়াট এ পিটি, এ রকম ইয়াং এজ।
চলবে।