🔴বহুব্রীহি (১৩, ১৪, ১৫)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ
সোবাহান সাহেব ভোরবেলায় কাপে করে এক কাপ পানি খেলেন। আর কিছুই খেলেন না। মিনু বললেন, তুমি সত্যি সত্যি কিছু মুখে দেবে না?
না।
কেন?
কেনর জবাবতো দিয়েছি। আমি ক্ষুধার স্বরূপ বুঝতে চাই।
রাগে দুঃখে মিনুর চোখে পানি এসে গেল। একজন বয়স্ক মানুষ যদি এরকম যন্ত্রণা করে তাহলে কিভাবে হয়? মিলির ইউনিভার্সিটিতে যাবার খুব প্রয়োজন ছিল সে গেল না। বাসার আবহাওয়া মনে হচ্ছে ভাল না। বাবার প্রেসারের কি অবস্থা কে জানে। ডাক্তারকে খবর দেয়া প্রয়োজন। তবে এক্ষুনি ছুটে যাওয়ার দরকার নেই। দুপুর পর্যন্ত যাক তারপর দেখা যাবে।
দুপুরে ফরিদ দুলাভাইয়ের অনশনের খবর পেল। তার উৎসাহের সীমা রইল না। কাদেরকে ডেকে বলল, সাবজেক্ট পাওয়া গেছে–অসাধারণ সাবজেক্ট–ছবি হবে ক্ষুধা নিয়ে। ক্ষুধা কি একজন জানতে চাচ্ছে। ক্যামেরা তার মুখের ওপর ধরে রাখা। মাঝে মাঝে ক্যামেরা সরে নানান ধরনের খাবার দাবারের উপর চলে যাচ্ছে। আবার ফিরে আসছে তার মুখে। লোকটার অবস্থা দ্রুত খারাপ হচ্ছে। ক্ষুধার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তৃষ্ণা। ক্যামেরা প্যান করে চলে গেল ঝর্ণায়। বিরবির করে ঝর্ণার পানি পড়ছে–অথচ ঐ মানুষটির মুখে এক ফোঁটা পানি নেই। ক্যামেরা চলে গেল আকাশের মেঘে।
কাদের উৎসাহী গলায় বলল, আবার ছবি হইব মামা?
ফরিদ বলল, ছবি হবে না। মানে? একটা প্রজেক্ট ফেল করেছে বলে সব কয়টা প্ৰজেক্ট ফেল করবে নাকি? বলতে গেলে আজ থেকেই ছবির কাজ শুরু হল। ছবির নাম — হে ক্ষুধা।
কি নাম কইলেন মামা?
হে ক্ষুধা।
হে-কথাডা বাদ দেন মামা। অপয়া কথা। এর আগের বারও হে আছিল। বইল্যা ছবি অয় নাই।
কথা মন্দ বলিস নি। তাহলে বরং হে টা পেছনে নিয়ে যাই। ছবির নাম–ক্ষুধা হে কি বলিস?
মন্দ না।
কাগজ কলম দে। ইমিডিয়েট যেসব চিন্তা মাথায় আসছে সেগুলো নোট ডাউন করে ফেলি। দুলাভাইয়ের সঙ্গেও আলাপ দরকার। ছবিটা যখন তাঁকে নিয়েই হচ্ছে।
কাদের ক্ষীণ স্বরে বলল, আমার কোন পাট থাকত না মামা?
থাকবে! তবে সাইড রোল। সেন্ট্রাল ক্যারেকটার হচ্ছে দুলাভাই! দেখি আপার সঙ্গে ব্যাপারটা আগে ফয়সালা করে নিই।
মিনু রাগ করে বিলুর ঘরে শুয়ে আছেন। সকালে তিনিও নাস্তা করেননি। তার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্যে বাড়ি থেকে চলে যাবার কথাও মনে আসছে। রাগারাগী তাঁর স্বভাবে নেই। তবু সবাই বেশ কয়েকবার তার কাছে ধমক খেয়েছে। তিনি বলে দিয়েছেন কেউ যেন তাকে বিরক্ত না করে। কাজেই ফরিদ যখন বিশাল একটা খাতা হাতে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, আপা আসব?
তিনি কড়া গলায় বলেন, ভাগ এখান থেকে।
তুমি যা বলবে তাই হবে কিন্তু তার আগে তোমার কয়েকটা মিনিট সময় আমাকে দিতে হবে। দুলাভাইকে নিয়ে ছবি করছি আপা। ছবির নাম ক্ষুধা হে। দুলাভাই সেখানে মানুষ না। দুলাভাই হচ্ছেন ক্যামেরা — যে ক্যামেরা ক্ষুধা কি বুঝতে চেষ্টা করছে। পনেরো মিনিটের ছবি। পনেরো মিনিটই যথেষ্ট। শেষ দৃশ্যটা নিয়েছি সুকান্তের কবিতা থেকে। ঘন নীল আকশে পূর্ণিমার চাঁদ। হঠাৎ সেই চাঁদটা হয়ে গেল একটা আটার রুটি। দুটা রোগা রোগা হাত আকাশ থেকে সেই চাদটা অর্থাৎ রুটিটা নামিয়ে এনে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে খেয়ে ফেলল। কেমন হবে। আপা বলতো? অসাধারণ না?
মিনু একটিও কথা না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। ফরিদের সঙ্গে কথা বলা অর্থহীন। সে নিজের মনে বকবক করতে থাকুক।
মানুষের অবহেলা ফরিদকে তেমন বিচলিত করে না। এবারো করল না। আসলে এই মুহুর্তে ক্ষুধা হে ছবির শেষ দৃশ্য তাকে অভিভূত করে রেখেছে। রোগা রোগা দুটা হাত আকাশ থেকে চাঁদটা নামিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে কপ কপি করে খেয়ে ফেলছে। এই দৃশ্যের কোন তুলনা হয় না।
ফরিদ ঘর থেকে বের হয়েই পুতুলের মুখোমুখি পড়ে গেল। ফরিদ কড়া গলায় বলল, এই যে মেয়ে দাড়াও তো। দেখি হাত দুটা মেলতো। পুতুল ভয়ে ভয়ে হাত মেলল।
হুঁ রোগা রোগা হাত আছে— মনে হচ্ছে তোমাকে দিয়ে হবে। তুমি কি একটা কাজ করতে পারবে?
কি কাজ?
অতি সামান্য কাজ। পারবে কি পারবে না সেটা বল।
পুতুল ক্ষীণ স্বরে বলল, পারব।
ভেরী গুড। কাজটা অতি সামান্য। আকাশ থেকে চাদটা টেনে নামাবে তারপর ছিঁড়ে কুচি কুচি করে খেয়ে ফেলবে!
পুতুল অপলক চোখে তাকিয়ে আছে। তার সব চিন্তা ভাবনা এলোমেলো হয়ে গেছে।
ফরিদ দাঁড়াল না— লম্বা লম্বা পা ফেলে বারান্দায় চলে গেল। ছবিটা নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবা দরকার। খুবই ঠাণ্ডা মাথায়। দরকার হলে ছবির লেংথ কমিয়ে পনেরো থেকে দশ মিনিটে নিয়ে আসতে হবে। তবে সেই দশ মিনিটও হবে। অসাধারণ দশ মিনিট — গোল্ডেন মিনিটস!
পর্ব ১৩ শেষ 📌
🔴পর্ব :১৪🔴
যতটা কষ্ট হবে বলে ভেবেছিলেন ততটা কষ্ট সোবাহান সাহেবের হচ্ছে না। কষ্ট একটিই, পরিবারের সদস্যরা সবাই বড় বিরক্ত করছে। এদের যন্ত্রণায় বড় কিছু করা যায় না। দৃষ্টিটাকে এরা কিছুতেই ছড়িয়ে দিতে পারে না। কয়েকটা দিন না খেয়ে থাকা যে কঠিন কিছু না এটা তারা বুঝে না।
সোবাহান সাহেব একটা বড় খাতায় তাঁর অভিজ্ঞতার কথাও লিখে রাখছেন। খুব গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করছেন। তেমন গুছিয়ে লিখতে পারছেন না। কিছুক্ষণ লেখালেখি করলেই মাথায় চাপ পড়ছে। তাঁর ডায়েরীর কিছু কিছু অংশ এরক।–
বুধবার রাত দশটা পাঁচ।
অনশন পর্ব শুরু করা গেল। এই অনশন দাবি আদায়ের অনশন নয়। এই অনশন নিজেকে জানার অনশন। আমি ক্ষুধার প্রকৃত স্বরূপ জানতে চাই। আমি এর ভয়াবহ রূপ জানতে চাই। যদি জানতে পারি। তাহলে হয়তবা ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী সম্পর্কে আমার কিঞ্চিৎ ধারণা হবে। এই যে পৃথিবী জুড়ে হত্যাকাণ্ড হচ্ছে এর মূল কারণগুলোর একটি নিশ্চয়ই ক্ষুধা। আজকের খবরের কাগজের একটি খবর দেখে অত্যন্ত বিষণ্ণ বোধ করেছে। সাভার উপজেলার জনৈক কালু মিয়া অভাবে অতিষ্ট হয়ে তার স্ত্রী, ছয় বছরের পুত্র এবং তিন বছরের কন্যাকে হত্যা করে পুলিশের কাছে ধরা দিয়েছে। স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দিতে বলেছে ক্ষুধার তাড়নায় অতিষ্ট হয়ে সে এটা করেছে। হায়রে ক্ষুধা! অথচ এই সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।
বৃহস্পতিবার ভোর এগারোটা।
আমি আমার পরিবারের সদস্যদের প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করছি। আমি একটা পরীক্ষা করছি তাও তারা করতে দেবে না। তাদের ধারণা হয়েছে অল্প কয়েক ঘণ্টা না খেয়ে থাকার কারণে আমি মারা যাব। মৃত্যু এত সহজ নয়। বিয়াল্লিশ দিন শুধুমাত্র পানি খেয়ে জীবিত থাকার রেকর্ড আছে। এরা এই জিনিসটা বুঝতে চায় না। আমার মৃত্যু প্রসঙ্গে এদের অতিরিক্ত সচেতনতাও আমার ভাল লাগছে না। মৃত্যু একটি অমোঘ ব্যাপার। একে নিয়ে এত মাতামাতি কেন? পবিত্র কোরান শরীফে তো স্পষ্ট উল্লেখ আছে, প্রতিটি জীবিত প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্ৰহণ করিতে হইবে। বর্তমানে ধর্মগ্রন্থ পাঠের একটা প্রবল ইচ্ছা বোধ করছি। ক্ষুধার্তা মানুষ কি পারলৌকিক চিন্তা করে? একটি জরুরি বিষয় লিখে রাখা দরকার বোধ করছি। মিনু বড় কান্নাকাটি করছে। এত কান্নাকাটির কি আছে তাতো বুঝতে পারছি না। বিলু এসে বলে গেল আমি যদি না খাই তাহলে তার মা-ও খাওয়া বন্ধ করে দেবে। এ দেখি আরেক যন্ত্রণা হল।
বৃহস্পতিবার বেলা একটা দশ মিনিট।
ফরিদের ফাজলামির সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে বলে আমার ধারণা। শুনলাম এই গাধা এখন না-কি আমাকে নিয়ে ছবি করবে। ছবির নাম ক্ষুধা হে এই গাধাটাকে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারলে মন শান্ত হত। মিনুর মুখের দিকে তাকিয়ে তা করতে পারছি না। মিনু ফরিদকে বড়ই পছন্দ করে। আমিও করি। কেন করি তা জানি না। ভাল কথা এখন একটু কষ্ট হওয়া শুরু হয়েছে। মাথা ঘুরছে। প্রেসারের কোন সমস্যা কি না কে জানে।
ক্ৰমাগত ধর্ম গ্ৰন্থ পাঠ করার চেষ্টা করছি। পবিত্র কোরান শরীফে যে এত সুন্দর সুন্দর অংশ আছে আগে লক্ষ্য করিনি। মূল আরবিতে পড়তে পারলে ভাল হত। বয়স কম থাকলে আরবি পড়া শুরু করতাম। সেই সময় নেই। এখন ঠিক করেছি। কোরান শরীফের পছন্দের কিছু আয়াত লিখে রাখব।–
If it were His will
He could destroy you
O mankind, and create
Another race: for He
Hath power this to do.
(সূরা নিসা, ১৩৪ নং আয়াত)
আল্লাহ তালা নতুন জাতি সৃষ্টি করার কথা বলেছেন। যদি সত্যি সত্যি তিনি করতেন তাহলে কেমন হত সেই জাতি? তাদের কি ক্ষুধা, তৃষ্ণা, লোভ, কামনা থাকত না? তারা এইসব থেকে পুরোপুরি মুক্ত হত?
ফরিদ চোখে চশমা দিয়ে গভীর মনোযোগে খাতায় শট ডিভিসন করছে। হাতে সময় নেই। দুলাভাইয়ের অনশন চলাকালীন সময়েই কাজটা শেষ করে ফেলতে হবে। একটা ফিস আই লেন্স দরকার ট্রিক শটের জন্যে। এই লেন্সটাই জোগাড় হচ্ছে না।
বাবাজী আসব?
ফরিদ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে তাকাল। এমদাদ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ফরিদ রাগী গলায় বলল, কি চান?
কিছু না। আমার নাতনী অর্থাৎ পুতুল চিন্তার মইদ্যে পড়েছে—আফনে না-কি তারে বলেছেন আসলানের চাঁদ ধইরা নামাইয়া ছিঁড়া কুটি কুটি কইরা খাইয়া ফেলতে।
হ্যাঁ বলেছি।
হতভম্ব এমদাদ দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, খাইয়া ফেলতে বলছেন?
হ্যাঁ বলেছি। কেন কোন অসুবিধা আছে?
এমদাদ শুকনো গলায় বলল, জ্বিনা অসুবিধার কি? অসুবিধার কিছুই নাই।
আপনার কথা শেষ হয়েছে?
জ্বি।
তাহলে দয়া করে ঘর থেকে বের হয়ে যান।
অবশ্যই অবশ্যই।
এমদাদ প্ৰায় ছুটেই ঘর থেকে বের হয়ে এল। এই লোকটির মাথা যে খানিকটা উলট পালট আছে তা সে শুরুতেই বুঝে গিয়েছিল। সেই উলট পালট যে এতখানি তা বোঝেনি। কিন্তু যে আকাশের চাঁদ ছিড়ে কুচি কুচি করে খেয়ে ফেলার কথা ভাবে তাকে সহজ পাগলের দলে ফেলা ঠিক হবে না। এর কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে হবে। পুতুলকেও বলে দিতে হবে যেন এই লোকের ত্ৰি সীমানায় না আসে।
পর্ব ১৪ শেষ 📌
🔴পর্ব :১৫🔴
মনসুরকে আজ বিকেলে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দেবে। সে এখন পুরোপরি সুস্থ। ফুসফুসে পানি ঢুকে যাওয়ার যে জটিলতা দেখা দিয়েছিল তা এখন নেই। আর হাসপাতালে পরে থাকার কোন মানে হয় না। অবশ্যি মনসুর চাচ্ছে আরো কিছু দিন থেকে যেতে। হাসপাতালে বিছানায় শুয়ে থাকতে তার মন্দ লাগে না। বই পত্র পড়া যায়। আরাম করে ঘুমানো যায়। সবচে বড় কথা প্ৰায় দিনই মিলি এসে দেখে যায়। সে হাসপাতাল ছেড়ে দিলে নিশ্চয়ই মিলি তাকে দেখতে আসবে না।
হাসপাতালের বিছানায় মনসুরের বেশির ভাগ সময় মিলির কথা ভেবে ভেবেই কাটে। মিলিকে নিয়ে পেনসিল দিয়ে সে কবিতাও লিখেছে। সম্ভবত কিছুই হয় নি। কাউকে দেখাতে পারলে হত। দেখাতে লজ্জা লাগে। একটা কবিতা এরকম
একটু আগে এসেছিলেন মিলি
চারদিকে তাই এমন ঝিলিমিলি।
মনটা আমার হল উড়ু উড়ু।
বুকের ভেতর শব্দ দুরু দুরু।
যখন মিলি বিদায় নিতে চান
আমি বলি–একটু বসে যান।
হাত বাড়িয়ে আমার দুহাত ধরুন
বাকিটা আর পরা যায় নি। ধরুনের সঙ্গে ভাল কোন মিল পাওয়া যাচ্ছে না। ধরুন, করুন, মরুন। কোনটাই ভাল লাগে না। আপাতত খাতা বন্ধ রেখে মনসুর গভীর মনোযোগে একটা চটি বই পড়ছে। বইটি ইংরেজিতে লেখা। বইয়ের বিষয়বস্তু হচ্ছে মেয়েদের পছন্দ অপছন্দ। বইয়ের লেখক পনেরো বছর গবেষণা করার পর এই বই লিখেছেন এবং এই বইয়ে প্ৰমাণ করে দিয়েছেন যে মেয়েদের বিষয়ে প্রচলিত অধিকাংশ ধারণাই মিথ্যা। আমাদের আগে বিশ্বাস ছিল মেয়েদের রূপের প্রশংসা করলে তার খুশী হন। এই বইয়ের লেখক দেখিয়েছেন যে রূপের প্রশংসায় অধিকাংশ মেয়ে বিরক্ত হয়।
বইটির ব্যাক কিভারে প্রকাশক লিখেছেন–নারী চরিত্র বোঝার জন্য বইটি অপরিহার্য। অবিবাহিত যুবক যারা সঙ্গী খুঁজছেন। বইটি তাদের জন্য বাইবেল স্বরূপ। মনসুরের কাছেও তাই মনে হচ্ছে। বইটা আরো আগে হাতে এলে উপকার হত।
বইটির দ্বিতীয় চ্যাপ্টারের শিরোনাম–রসিকতা ও মেয়ে মানুষ। এখানে লেখক বলছেন–আমাদের একটি ধারণা আছে মেয়েরা রসিকতা পছন্দ করে। ধারণা সঠিক নয়। মেয়েরা রসিকতা একেবারেই পছন্দ করেন না। কারণ কখনো কোন মেয়েকে রসিকতা করতে দেখা যায় না। কেউ যদি মেয়েদের সঙ্গে রসিকতা করে তাহলে মেয়েরা তার সম্পর্কে নিম্নলিখিত ধারণা পোষণ করে। এই ধারণা পাঁচশত মেয়েদের মাঝ থেকে জরিপের মাধ্যমে নেয়া।
ধারণা — শতকরা হিসাবে
লোকটা ফাজিল — ৬৫%
লোকটা চালাবাজ — ২০%
লোকটা বোকা — ১o%
লোকটা চালাক — ২%
বাকি তিন ভাগ মহিলা কোন রকম মন্তব্য করতে রাজি হননি। কাজেই প্রিয় পাঠক আপনি যাই করুন মেয়েদের সঙ্গে রসিকতা করবেন না। যদি করতেই হয় খুব সহজ রসিকতা করবেন যা কোমলমতি শিশুরাও ধরতে পারে। যেসব রসিকতা বুঝতে বুদ্ধির প্রয়োজন ভুলেও সেসব রসিকতা করবেন না। নিমে রসিকতার কিছু নমুনা দেয়া গেল। এসব রসিকতা করা যেতে পারে।
(ক)
স্ত্রী স্বামীকে বলছেন, ওগো পাশের বাসার ভদ্রলোক কত ভাল। অফিসে যাবার সময় রোজ তাঁর স্ত্রীকে চুমু দিয়ে যান। তুমি এ রকম কর না কেন? স্বামী অবাক হয়ে বললেন, আমি কি করে করব? আমি কি ঐ ভদ্রমহিলাকে চিনি?
(মন্তব্য : জরিপে দেখা গেছে শতকরা ২৫ ভাগ মহিলা এই রসিকতা বুঝতে পারে না। তবু হাসে। কাজেই একটু সাবধান থাকা ভাল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যৌন বিষয়ক রসিকতা মেয়েরা না বুঝলেও খুব পছন্দ করে।)
(খ)
শিক্ষক জিজ্ঞেস করছেন সম্রাট শাহজাহান কোথায় মারা গেছেন? ছাত্র বলল, ইতিহাস বই-এ সত্ত্বর পৃষ্ঠায়।
(মন্তব্য : এই রসিকতা শতকরা ৭৮ ভাগ মহিলা বুঝতে পারেন। যারা বুঝতে পারেন না! তাঁরা সাধারণত অবাক হয়ে বলেন, সত্ত্বর পৃষ্ঠায় মারা গেছে? আপনি তাহলে বলতে চাচ্ছেন সত্ত্বর নাম্বারটা আন-লাকি?)
(গ)
এক পাগলের খুব বই পড়ার নেশা। সব বই সে পড়ে না। শুধু নাটকের বই পড়ে। পড়তে পড়তে নাটকের যাবতীয় বই সে পড়ে শেষ করে ফেলল। আরো বই চায়। উপায় না দেখে তখন তাকে এটা টেলিফোন ডিরেক্টরি ধরিয়ে দেয়া হল। সে মহানন্দে দিন দশেক ধরে তাই পড়ছে। তাকে জিজ্ঞেস করা হল–কেমন লাগছে পড়তে?
পাগল বলল, অসাধারণ— তবে চরিত্রের সংখ্যা বেশি। মনে রাখতে একটু কষ্ট হচ্ছে। (মন্তব্যঃ এই রসিকতা কোন মহিলাই ধরতে পারেন না। তবে সবাই খুব হাসেন। কেন হাসেন এটা একটা রহস্য। দেখা গিয়েছে অনেক মহিলা হাসতে হাসতে হিষ্টিরিয়াগ্রস্তের মত হয়ে যান। কাজেই এই রসিকতা করার আগে যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করা ভাল।)
মহিলাদের সঙ্গে রসিকতা করার সময় পাঞ্চ লাইনে যাবার আগেই উচ্চ স্বরে হাসা শুরু করা উচিত। যাতে মহিলারা বুঝতে পারেন কোথায় হাসতে হবে।
মনসুর যখন বইয়ের এই অংশে তখন মিলি ঢুকল। সে ডাক্তারকে বাসায় নিয়ে যেতে এসেছে। কারণ ছাবিবশ ঘণ্টা পার হয়েছে সোরাহান সাহেব তিন কাপ পানি ছাড়া কিছুই খাননি। তার শরীরের তাপ নেমে এসেছে। চোখ হয়েছে লালচে। আগে নিজেই বসে লিখতেন এখন তাও পারছেন না।
মিলি মনসুরের পাশের চেয়ারে বসতে বসতে ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠল। মনসুর হতভম্ব। মিলি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, খুব খারাপ খবর আছে। আপনি আমার সঙ্গে চলুন।
চলবে। 📌