🔴বহুব্রীহি (পর্ব :৭, ৮)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ
সোবাহান সাহেব তাঁর মাছের সমস্যা নিয়ে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছেন। সম্পর্কে জানার জন্যে তিনি ময়মনসিংহের এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির ফিসারি ডিপার্টমেন্টে টেলিফোন করেছিলেন। দেখা গেল তারা আমেরিকার মাছ সম্পর্কে প্রচুর জানেন। দেশি মাছ সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না। বইপত্রও নেই। সোবাহান সাহেব বললেন, বিদেশি মাছ সম্পর্কে জেনে কি হবে?
অধ্যাপক ভদ্রলোক রাগী গলায় বললেন, দেশি বিদেশি প্রশ্ন তুলছেন কেন? আমরা মাছ সম্পর্কে জানি, একটা স্পেসিস সম্পর্কে জানি। দেশি মাছ সম্পর্কে একেবারে কিছুই জানি না তাওতো না। বই পত্রে লেখা হচ্ছে, গবেষণা হচ্ছে।
কি গবেষণা হচ্ছে?
কি গবেষণা হচ্ছে তা আপনাকে বলতে হবে না-কি? কেন হবে না? আমি একজন নাগরিক। আমাদের টাকায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলছে। কাজেই আমাদের জানবার অধিকার আছে।
অধ্যাপক ভদ্রলোক রাগে আগুন হয়ে বললেন, অধিকার ফলাবেন না।
কেন অধিকার ফলাব না? আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন? এ রকম রেগে গেলে ছাত্র পড়াবেন কিভাবে?
আমার ছাত্র পড়ানো নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না।
কেন হবে না?
অধ্যাপক ভদ্রলোক খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। সোবাহান সাহেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগেও চেষ্টা করলেন। সেখানেও এই অবস্থা। অধ্যাপকরা অত্যন্ত সন্দেহজনক ভঙ্গিতে জানতে চান— আপনি কে? মাছ সম্পর্কে জানতে চান কেন?
সোবাহান সাহেব মৎস্য বিভাগের অফিসে গেলেন। সেখানকার অবস্থা ভয়াবহ। বড় দরের সব অফিসাররাই হয় মিটিং-এ নয় সেমিনারে, কয়েকজন দেশের বাইরে। এরচে ছোটপদের অফিসারা হয় টুরে কিংবা ব্যস্ত। একজনকে পাওয়া গেল, তিনি তেমন ব্যস্ত না। চা খেতে খেতে চিত্ৰালী পড়ছেন। সোবাহান সাহেব হুট করে ঢুকে পড়লেন। ভদ্রলোক বিরক্ত মুখে বললেন, কি চান?
মাছ সম্পর্কে আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
কেন?
কারণ আপনারা মৎস্য বিভাগের লোক।
বলুন কি ব্যাপার।
আপনি পত্রিকাটা আগে পড়ে শেষ করুন তারপর কথা বলব।
ভদ্রলোক পত্রিকা নামিয়ে কঠিন চোখে তাকালেন। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, বলুন কি বলতে চান?
সোবাহান সাহেব বললেন, দেশে এই যে মাছের তীব্ৰ অভাব তাই নিয়ে কদিন ধরে চিন্তা-ভাবনা করছিলাম।
আপনাকে চিন্তা-ভাবনা করতে বলেছে কে?
সোবাহান সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। থমথমে গলায় বললেন, দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি কি দেশের সমস্যা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে পারব না?
অবশ্যই পারবেন। চিন্তা করে কি পেলেন সেটা যদি অল্প কথায় বলতে পারেন, বলুন। গল্প করলেতো আমাদের চলে না, অফিসের কাজকর্ম আছে।
আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছে। আমরা যদি এক বছর মাছ না খাই। যদি মাছরা একটা বছর নির্বিঘ্নে বংশ বিস্তার করতে পারে তাহলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
ভাল কথা এটা আমাকে বলছেন কেন?
আপনাকে বলছি কারণ আপনারা যদি জনগণকে বোঝাতে পারেন, মাছ না খাওয়ার একটা ক্যাম্পেইন যদি করেন। তাহলে.
আপনি একটা কথা বলবেন আর ওমি আমরা ঢাক ঢোল নিয়ে সেই কথা প্রচারে লেগে যাব, এটা মনে করলেন কেন?
আমার কথায় যদি যুক্তি থাকে তাহলে আপনারা কেনইবা প্রচার করবেন। না?
আপনার কথায় কোনই যুক্তি নেই।
যুক্তি নেই?
জ্বি না। প্রথমত দেশে মাছের কোন অভাব নেই। সরকার মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে যেসব প্রকল্প হাতে নিয়েছেন সেই সব প্রকল্প খুব ভাল কাজ করছে। ফিস প্রোটিনে আমরা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ।
স্বয়ংসম্পূর্ণ?
অবশ্যই। বিদেশেও আমরা মাছ রপ্তানি করছি। চিংড়ি মাছ এক্সপোর্ট করে কি পরিমাণ ফরেন এক্সচেঞ্জ আমাদের আসে। আপনি জানেন?
জি না।
আপনার জানার দরকারও নেই। আজে বাজে জিনিস নিয়ে মাথা গরম করবেন না এবং আমাদের সময় নষ্ট করবেন না।
সোবাহান সাহেবের মুখ লজ্জায় অপমানে কালো হয়ে গেল। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। মানে বসা ভদ্রলোক সিনেমা পত্রিকাটি মুখের উপর তুলে ধরতে ধরতে নিজের মনে বললেন, পাগল ছাগলে দেশ ভর্তি হয়ে গেছে।
সোবাহান সাহেব হতভম্ব হয়ে বললেন, আপনি আমাকে পাগল বললেন?
আরে না ভাই আপনাকে বলি নাই। দেশে আপনি ছাড়াও তো আরো পাগল আছে? আচ্ছা এখন যান স্নামালিকুম।
সোবাহান সাহেব ঘরে ফিরলেন প্রবল জ্বর নিয়ে। বাড়ির গেটের সামনে মিলি দাঁড়িয়েছিল, সে বাবাকে দেখে চমকে উঠে বলল, তোমার এই অবস্থা কেন বাবা? কি হয়েছে?
সোবাহান সাহেব জড়ালো গলায় বললেন, আমাকে পাগল বলেছে। মুখের উপর পাগল বলেছে।
মিলি বিস্মিত হয়ে বলল, কে তোমাকে পাগল বলেছে?
কে বলেছে সেটাতো ইস্পটেন্ট না। পাগল বলেছে এটাই ইস্পটেন্ট। মোটেই না বাবা। পাগল কোন গালাগালি নয়। পাগল আদরের ডাক। পৃথিবীর সমস্ত প্রতিভাবান লোকদের আদর করে পাগল ডাকা হয়।
মেয়ের কথায় সোবাহান সাহেব খুব যে একটা সান্ত্বনা পেলেন তা নয়। রাতে ভাত খেলেন না। সন্ধ্যার পর পরই ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রইলেন। মানুষের কুৎসিত রূপ তাঁকে বড় পীড়া দেয়।
ফরিদ রাতে খাওয়া শেষে দুলাভাইকে দেখতে এল। বিছানার পাশে বসতে বসতে বলল, কে নাকি আপনাকে পাগল বলেছে, আর তাতেই আপনি চুপসে গেলেন।
তোমাকে পাগল বললে কি তুমি খুশী হতে?
আমাকে বললে আমি ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতাম। যদি দেখতাম আমাকে পাগল বলার পেছনে যুক্তি আছে, তাহলে সহজভাবে ট্রথকে একসেপ্ট করতাম। এখন আপনি বলুন, কেন সে আপনাকে পাগল বলল? আপনি কি করেছিলেন বা কি বলেছিলেন?
আমি শুধু বলেছিলাম এক বছর যদি আমরা মাছ না খাই তাহলে মাছরা নির্বিঘ্নে বংশ বিস্তার করবে। মাছের অভাব দূর হবে।
এই বলায় সে আমাকে পাগল বলল?
হ্যাঁ।
ঐ ভদ্রলোকের উপর আমার রেসপেক্ট হচ্ছে দুলাভাই। আপনাকে পাগল বলার তার রাইট আছে। এর চেয়ে খারাপ কিছু বললেও কিছু বলার ছিল না। একটা মাছের পেটে কতগুলি ডিম থাকে? মাঝারি সাইজের একটা ইলিশ মাছে ডিম থাকে নয় লক্ষ সাতষট্টি হাজার। মাছের সব ডিম ফুটে যদি বাচ্চা হয়, মাছের কারণে নদী নালা বন্ধ হয়ে যাবে। প্ৰবল বন্যা হবে। মাছ চলে আসবে ক্ষেতে খামারে। ক্ষুধার্থ মাছ সব ফসল খেয়ে শেষ করে ফেলবে। পুরো দেশ চাপা পড়ে যাবে এক ফুট মাছের নিচে। কি ভয়াবহ অবস্থা চিন্তা করে দেখুন দুলাভাই।
সোবাহান সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। মনে মনে বললেন, গাধার গাধা। ঘর অন্ধকার বলে ফরিদ সোবাহান সাহেবের তীব্র বিরক্তি টের পেল না। সে মহা উৎসাহে বলে চলল, আপনি মনে হয় আমার কথা ঠিক বুঝতে পারছেন না, কিংবা বুঝতে পারলেও বিশ্বাস করছেন না। আমি প্রমাণ করে দিচ্ছি। ধরুন আমাদের দেশে মাছের মোট সংখ্যা একশ কোটি। খুব কম করে ধরলাম মোট ংখ্যা তারচে অনেক বেশি। একশ কোটি মানে টেন টু দি পাওয়ার এইট। টেন বেস লগারিদমে এটা হল আট। এই মাছের অর্ধেক যদি স্ত্রী মাছ হয় তাহলে টেন বেস লগে কি দাঁড়ায়? আচ্ছা এক কাজ করা যাক, টেন বেস না ধরে নেচারেল লগারিদমে নিয়ে আসি। এতে পরে হিসেবে সুবিধা হবে।
সোবাহন সাহেব থমথমে গলায় বললেন, বহিস্কার, এই মুহুর্তে বহিস্কার।
ফরিদ বিস্মিত হয়ে বলল, আমাকে বলছেন?
হ্যাঁ, তোমাকে বলছি। বহিস্কার, বহিস্কার।
আমি খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে চাচ্ছি দুলাভাই যে আপনার আচার-আচরণ পরিষ্কার ইংগিত করছে…
আবার কথা বলে, বহিস্কার।
ফরিদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। তার মনটা খারাপ হয়ে গেছে, বেশ খারাপ। অবশ্যি তার মন খারাপ কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হয় না, আজো হল না–নিজের ঘরে ঢোকা মাত্র মন ভাল হয়ে গেল। রাত কাটানোর খুব ভাল ব্যবস্থা করা আছে। ভিডিও ক্লাব থেকে স্পার্টকার্স ছবিটা আবার আনা হয়েছে, এবারে প্রিন্ট বেশ ভাল। আজ রাতে ছবি দেখা হবে। ছবি দেখার ফাঁকে ফাকে ডিসকাশন হবে কাদেরের সঙ্গে। ছবির খুঁটিনাটি কাদের এত ভাল বোঝায়ে ফরিদ প্রায়ই চমৎকৃত হয়। যেমন স্পটাকার্স ছবির এক অংশ স্পটাকর্সের সঙ্গে নিগ্রো গ্লাডিয়েটরের যুদ্ধ হবে। যুদ্ধের আগের মুহুর্তে দুজন একটা ঘরে অপেক্ষা করছে। উত্তেজনায় স্পার্টাকার্স কেমন যেন করছে। তার অস্থিরতা দেখে নিগ্রো হেসে ফেলল। অসাধারণ অংশ। ফরিদ বলল, দৃশ্যটা কেমন কাদের? কাদের বলল, বড়ই চমৎকার মামা কিন্তুক বিষয় আছে।
কি বিষয়?
হাসিটা কম হইছে। আরেকটু বেশি হওনের দরকার।
উঁহু, বেশি হলে নান্দনিক দিক ক্ষুন্ন হবে।
কিন্তুক মামা, হাসি যেমন হঠাৎ আইছে তেমন হঠাৎ গেলে ভাল হইত। এই হাসি হঠাৎ যায় না, ঠোঁটের মইধ্যে লাইগ্যা থাকে।
ফরিদ সত্যি সত্যি চমৎকৃত হল। এ রকম প্রতিভা, বাজার করে আর ঘর বাট দিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে ভাবতেই খারাপ লাগে।
মামা কি করছ?
কিছু করছি নারে মিলি। আয়।
মিলি ঘরে ঢুকল। হাসি মুখে বলল, তোমাদের ছবি এখনো শুরু হয় নি?
না।
আজ কি ছবি?
স্পটাকার্স।
স্পটাকার্স না একবার দেখলে।
একবার কেন হবে, এ পর্যন্ত পাঁচবার হল। ভাল জিনিস অনেবার দেখা যায়।
আচছা মামা এই যে তুমি কিছুই কর না, খাও দাও ঘুমাও, ছবি দেখ, তোমার খারাপ লাগে না?
না তো। খারাপ লাগবে কেন? তুই যদি পৃথিবীর ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করিস তালে জানতে পারবি পৃথিবীর জনগষ্ঠির একটা বড় অংশ এভাবে জীবন কাটিয়ে দেয়। জনগষ্ঠির ইকুইলিব্রিয়াম বজায় রাখার জন্যেই এটা দরকার। জনতা এই অকৰ্মক অংশের কাজ হচ্ছে কর্মক অংশগুলোর টেনশন এ্যাবজাৰ্ভ করা। অর্থাৎ শত এ্যাবজাৰ্ভারের মত কাজ করা।
সব ব্যাপারেই তোমার একটা থিওরী আছে, তাই না মামা?
থিওরী বলা ঠিক হবে না, বলতে পারিস হাইপোথিসিস। থিওরী আর হাইপোথিসিস কিন্তু এক না—
চুপ করতো মামা।
তুই দেখি তোর বাবার মত হয়ে যাচ্ছিস। সব কিছুতে চুপ কর, চুপ কর।
মিলি গম্ভীর গলায় বলল, আজ তোমার থিওরী শুনতে আসিনি মামা। আজ এসেছি তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতে।
আমি কি করলাম?
তুমি খুব অন্যায় করেছ মামা।
অন্যায় করেছি?
হ্যাঁ করেছ। বাবার স্বভাব চরিত্র তুমি খুব ভাল করেই জান। তুমি জান বাবা কত অল্পতে আপসেট হয়। সব জেনেশুনে তুমি তাকে আপসেট কর। মাছের সমস্যাটা নিয়ে বাবা একদিন ধরে ভাবছে, হতে পারে তার ভাবনাটা ঠিক না। কিন্তু কেউ যেখানে ভাবছে না। বাবাতো সেখানে ভাবছে।
তা ভাবছে।
তাকে আমরা সাহায্য না করতে পারি–ডিসকারেজ করব কেন?
এসব উদ্ভট আইডিয়াকে তুই সাপোর্ট করতে বলছিস?
হাঁ বলছি। এতে বাবা শান্তি পাবে, সে বুঝবে যে সে একা না।
তুই এমন চমৎকার করে কথা বলা কোথেকে শিখলি?
সিনেমা দেখে দেখে শিখিনি —এইটুকু বলতে পারি।
তোর কথা বলার ধরন দেখে অবাকই হচ্ছি–ছোটবেলায় তো হাবলার মত ছিলি।
কি যে তোমার কথা মামা। আমি আবার কবে হাবলার মত ছিলাম?
মিলি উঠে দাঁড়াল। ফরিদ বলল, আচ্ছা যা তোর কথা রাখলাম। স্ট্রং সাপোর্ট দেব।
মিলি বলল, সবকিছুতেই তুমি বাড়াবাড়ি কর মামা, স্ট্রং সাপোর্টের দরকার নেই।
তুই দেখ না কি করি।
মিলি চিন্তায় পড়ে গেল। মামার কাজ কর্মের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। কি করে বসবে কে জানে। মামাকে কিছু না বলা বোধ হয় ভাল ছিল। মিলি নিজের ঘরে চলে গেল। মনটা কেন জানি খারাপ লাগছে। মন খারাপ লাগার যদিও কোন কারণ নেই। ইদানিং ব্যাপারটা ঘন ঘন ঘটছে। অকারণে মন খারাপ হচ্ছে।
আফা ঘুমাইছেন?
মিলি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল রহিমার মা দাঁড়িয়ে আছে।
কি ব্যাপার রহিমার মা?
একটা সমস্যা হইছে আফা।
কি সমস্যা। চশমা দেওনের পর থাইক্যা সব জিনিস দুইটা করে দেখি।
বল কি?
হ আফা। এই যে আফনে চেয়ারে বইয়া আছেন মনে হইতাছে দুইখান আফা। একজন ডাইনের আফা একজন বায়ের আফা।
মিলি অবাক হয় তাকিয়ে রইল। রহিমার মা বলল, টেবিলের উপরে একখান গেলাস থাকে তখন আমি দেখি দুইখান গেলাস, এই দুই গেলাসের মাঝামাঝি হাত দিলে আসল গেলাস পাওয়া যায়।
কি সর্বনাশের কথা। চশমা পরা বাদ দাও না কেন?
অত দাম দিয়া একখান জিনিস কিনছি বাদ দিমু ক্যান? সমিস্যা একটু হইতাছে, তা কি আর করা কন আফা, সমিস্যা ছাড়া এই দুনিয়ায় কোন জিনিস আছে? সব ভাল জিনিসের মইদ্যে আল্লাহতালা মন্দ জিনিস ঢুকাইয়া দিছে। এইটা হইল আল্লাহতালার খুদরত। যাই আফা।
রহিমার মা চলে যাচ্ছে। পা ফেলছে খুব সাবধানে, কারণ সে শুধু যে প্রতিটি জিনিস দুটা করে দেখছে তাই না ঘরের মেঝেও উঁচুনিচু দেখেছে। তার কাছে মনে হচ্ছে চারদিকে অসংখ্য গর্ত। এসব গর্ত বাঁচিয়ে তাকে সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। চশমা পড়া খুব সহজ ব্যাপার নয়।
মিলির পড়ায় মন বসছে না। সে বাতি নিভিয়ে বারান্দায় এস। দাঁড়াল। উপর থেকে টগর এবং নিশির খিলখিল হাসি শোনা যাচ্ছে। এত রাতেও বাচ্চা দুটি জেগে আছে। এদের কোন ঠিক ঠিকানা নেই। কোনদিন সন্ধ্যা না মিলতেই ঘুমিয়ে পড়ে আবার কোনোদিন গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। আনিস সাহেব বাচ্চা দুটিকে ঠিকমত মানুষ করতে পারছেন না। সারাদিন কোথায় কোথায় নিয়ে ঘুরেন। আগের স্কুল অনেক দূরে কাজেই তারা এখন স্কুলেও যাচ্ছে না।
ভদ্রলোকের উচিত আশেপাশের কোন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া। তিনি তাও করছেন না।
বাচ্চাদের হাসির সঙ্গে সঙ্গে একবার তাদের বাবার হাসি শোনা গেল। কি নিয়ে তাদের হাসাহাসি হচ্ছে জানতে ইচ্ছ করছে— নিশ্চয়ই কোন তুচ্ছ ব্যাপার। এমন নির্মল হাসি সাধারণত তুচ্ছ কোন বিষয় নিয়েই হয়।
মিলির ধারণা সত্যি। অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়েই হাসােহাসি হচ্ছে। আনিস তার ছেলেবেলার গল্প করছে, তাই শুনে একেকজন হেসে গড়িয়ে পড়ছে। আনিসের ছেলেবেলা সিরিজের প্রতিটি গল্পই এদের শোনা, তবু কোন এক বিচিত্র কারণে গল্পগুলো এদের কাছে পুরানো হচ্ছে না।
নিশা বলল, তুমি খুবই দুষ্ট ছিলে তাই না বাবা?
না দুষ্ট ছিলাম না। আমার বয়েসী ছিলেদের মধ্যে আমি ছিলাম। সবচে শান্ত। তবু কেন জানি সাবই আমাকে খুব দুষ্ট ভাবত।
বাবা আমরা কি দুষ্ট না শান্ত?
তোমার খুবই দুষ্ট কিন্তু তোমাদের সবাই ভাবে শান্ত। অনেক রাত হয়ে পড়েছে এসো শুয়ে পরি।
টগর বলল, আজ ঘুমুতে ইচ্ছা করছে না।
কি করতে ইচ্ছা করছে?
গল্প শুনতে ইচ্ছা করছে। তোমাদের বিয়ের গল্পটা কর না বাবা।
এই গল্পতো আনেকবার শুনেছি, আবার কেন?
আরেকবার শুনতে ইচ্ছা করছে।
এই গল্প শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমুতে যাবে তো?
হ্যাঁ যাব।
তোমার মা ছিল খুব চমৎকার একটি মেয়ে…
নিশা বাবার কথা শেষ হবার আগেই বলল, আর ছিল খুব সুন্দর।
হ্যাঁ খুব সুন্দরও ছিল। তখনো আমি তাকে চিনি না। একদিন নিউমার্কেট বইয়ের দোকানে বই কিনতে গিয়েছি, একই দোকানে তোমার মাও গিয়েছে…
টগর বলল, মার পরণে আসমানী রঙের একটা শাড়ি।
হ্যাঁ তার পরণে আসমানী রঙের শাড়ি ছিল।
নিশা বলল, সে বই কিনতে গিয়েছে কিন্তু বাসা থেকে টাকা নিয়ে যায় নি।
আনিস হেসে ফেলল।
নিশা বলল, হাসছ কেন বাবা?
তোমরা দুজনে মিলেইতো গল্পটা বলে ফেলছি, এই জন্যেই হাসি আসছে। চল আজ শুয়ে পড়া যাক। ঠান্ডা লাগছে।
তারা আপত্তি করল না। বিছানায় নিয়ে শোয়ানো মাত্র ঘুমিয়ে পড়ল। অনেকদিন পর আনিস তার খাতা নিয়ে বসল। উপন্যাসটা যদি শেষ করা যায়। নিতান্তই সহজ সরল ভালবাসাবাসির গল্প। অনেকদূর লেখা হয়ে আছে কিন্তু আর এগুলো যাচ্ছে না। একেই বোধ হয় বলে রাইটার্স ব্লক, লেখক চরিত্র নিয়ে ভাবতে পারেন, মনে মনে কাহিনী অনেক দূর নিয়ে যেতে পারেন কিন্তু লিখতে গেলেই কলম আটকে যায়। যেন অদৃশ্য কেউ এসে হাত চেপে ধরে, কানে কানে বলে–না তুমি লিখতে পারবে না।
আনিস রাত তিনটা পর্যন্ত জেগে দুপৃষ্ঠা লিখল। ঘুমুতে যাবার আগে সেই দুই পৃষ্ঠা ছিড়ে কুচি কুচি করে ফেলল।
পর্ব ৭ শেষ 📌
🔴পর্ব :৮🔴
খাবার টেবিলে ফরিদের নাশতা সাজানো। ফরিদ নাশতা খেতে আসছে না সে বাগানে বসে আছে। তাকে দেখেই মনে হচ্ছে সারারাত ঘুম হয়নি। অঘুমোজনিত ক্লান্তির সঙ্গে এক ধরনের চাপা উত্তেজনাও তার মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মিলিকে খবর পাঠানো হয়েছে। ফরিদ অপেক্ষা করছে মিলির জন্যে। মিলি ইউনিভার্সিটিতে যাবার জন্যে তৈরি হয়েই নিচে নামল। মামার খোজে বাগানে গেল।
একটা ব্যাপার মামা?
সারারাত ঘুম হয়নিরে মিলি।
তাতে তো তোমার খুব অসুবিধা হবার কথা না। প্রচুর ঘুম তোমার একাউন্টে জমা আছে। বছর খানেক না ঘুমালেও কিছু হবে না।
তোর কি খুব তাড়া আছে?
হ্যাঁ আছে। এগারোটায় ক্লাস, এখন বাজে দশটা দশ।
আজকের ক্লাসটা না করলে হয় না?
না হয় না। ব্যাপারটা কি বলে ফেল।
অদ্ভুত একটা আইডিয়া মাথায় চলে এসেছে। অন্ধকারে যেন একটা এক হাজার ওয়াটের বাতি জ্বলে উঠল।
তাই না-কি?
দুলা ভাইয়ের মৎস্য ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিলাম। কি করে তাকে সাপোর্ট করা যায় এই সব ভাবতে ভাবতে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছি। হঠাৎ মাথার মধ্যে দপ করে হাজার পাওয়ারের বাতি জ্বলে উঠল। আমি ইউরেকা বলে লাফিয়ে উঠলাম।
আইডিয়া পেয়ে গেল?
রাইট। আইডিয়া পেয়ে গেলাম, ছবি বানাব।
ছবি বানাবে মানে?
দেশের মৎস্য সম্পদ নিয়ে একটা শর্ট ফ্রিম। মাছের জীবন কথা বলতে পারিস। মাছদের জীবনে আনন্দ-বেদনার কাব্য। ছবির নামও ঠিক করে ফেললাম। ছবির নাম–হে মাছ।
হে মাছ?
হ্যাঁ–হে মাছ। এই ছবি যখন রিলিজ হবে তখন চারদিকে হৈ চৈ পরে যাবে। মৎস্য সমস্যার এটু জেড পাবলিক জেনে যাবে। দুলাভাই যা চাচ্ছিলেন তাই হবে তবে অনেক তাড়াতাড়ি হবে। এক গুলিতে যুদ্ধ জয় যাকে বলে।
ছবি যে বানাবে টাকা পাবে কোথায়?
কোন মহৎ কাজ কখনো টাকার অভাব আটকে থাকে বল?
মামা যাই, আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।
একদিন ইউনিভার্সিটিতে না গেলে কি হয়?
অনেক কিছু হয়। তুমি তোমার চিন্তা ভাবনা করতে থাক পরে শুনব।
ফরিদ সারা দুপুর দরজা বন্ধ করে বসে রইল। কাদেরের কাজ হল কিছুক্ষণ পর পর চা এনে দেয়া। ফরিদ কোথায় যেন পড়েছিল তামাকের নিকোটিন ক্রিয়েটিভিটিতে সাহায্য করে। কাদেরকে দিয়ে সিগারেট আনানো হল। সিগারেটের ধূয়া মাথা ঘুরা, বমি ভােব এবং কাশি তৈরি ছাড়া অন্যকোনভাবে সাহায্য করল না। দুপুরে ফরিদ কিছু খেল না— শুধু একটা টোস্ট বিসকিট এবং আধা কাপ দুধ। কারণ ফুল স্টমাকে ক্রিয়েটিভ কাজ কিছু হয় না। জগতে বড় বড় ক্রিয়েটিভ কাজ করছে। প্রতিভাবান ক্ষুধার্তা মানুষ। ক্ষুধার সঙ্গে প্রতিভার ঘনিষ্ট যোগাযোগ আছে।
সন্ধ্যা নাগাদ হে মাছ চিত্ৰনাট্যের খসড়া তৈরি হয়ে গেল। প্রথম পাঠক সৈয়দ মোহাম্মদ কাদের। ফরিদ বলল, কেমন বুঝছিস কাদের?
কাদের গাঢ় স্বরে বলল, বোঝাবুঝির কিছু নাই মামা–ফাডাফাডি জিনিস হইছে!
ক্লাইমেক্সগুলো কেমন এসেছে?
কেলাইমেক্সের কথা কইয়া আর কাম কি মামা? ফলে পরিচয়। এই দেহেন শইলের লোম খাড়া হইয়া গেছে। হাত দিয়ে দেহেন।
ফরিদ হাত দিয়ে দেখল— যে কোন কারণেই হোক কাদেরের গায়ের লোম সত্যি সত্যি খাড়া হয়ে আছে।
কাদের!
জ্বি মামা।
এখনো ফাইন্যাল করিনি। তবে মনে হচ্ছে তোকে একটা রোল দেব।
কি কইলেন মামা?
নৌকার হতদরিদ্র মাঝির ভূমিকা তোর পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
কাদের স্তম্ভিত। সে মূর্তির মত বসে রইল। নড়াচড়া করতে পারল না।
সোবাহান সাহেবের শরীর আজ বেশ ভাল। জ্বর নেই। ক্লান্তির ভাব ছাড়া তার কোন শারীরিক অসুবিধাও নেই। তিনি যথারীতি বারান্দায় তার ইজিচেয়ারে বসে আছেন। তার কোলে বিশাল খাতা। যার মলাটে লেখা মৎস্য সমস্যা। আজ আবার মৎস্য সমস্যা নিয়ে বসেছেন। বাংলাদেশের মাছের পূর্ণ তালিকা এখনো তৈরি হয়নি। ছোট প্ৰজাতির মাছগুলোর একেক অঞ্চলে একেক নাম। এও এক যন্ত্রণা।
রহিমার মা সোবাহান সাহেবের সামনে বসে আছে। মাছের নাম বলছে। বেশ কিছু নাম সোবাহান সাহেব তার কাছ থেকে পেয়েছেন।
কি নাম বললে?
দাঁড়কিনি মাছ।
দাঁড়কিনি মাছ? সত্যি সত্যি এই নামে কোন মাছ আছে না বসে বসে বানোচ্ছ? দাঁড়কাকের কথা জানি। দাড়কিনিতো কখনো শুনিনি।
আছে, আফনে লেহেন–পিতল্ল্যা মাছ।
পিতল্ল্যা মাছ?
জ্বি।
সেটা কেমন?
খুব ছোড, লেজ আছে।
ফাজলামি করছ না-কি রহিমার মা? লেজ তো সব মাছেরই আছে। এমন কোন মাছ আছে যার লেজ নেই?
থাকতেও পারে। আল্লাহর কুদরতেরতো কোনো সীমা নাই।
আচ্ছা তুমি এখন যাও।
নামডা লেখছেনতো–পিতল্ল্যা মাছ। পিতলের লাহান রং এই কারণে নাম পিতল্ল্যা মাছ।
সোবাহান সাহেব পিতল্ল্যা মাছ লিখলেন। তবে ব্রাকেটে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে রাখলেন।
আনিসকে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখা গেল। তার সঙ্গে টগর এবং নিশা। আনিস হাসিমুখে বলল, স্নামালিকুম স্যার।
টগর এবং নিশাও সঙ্গে সঙ্গে বলল, স্নামালিকুম স্যার, স্নামালিকুম স্যার।
যাচ্ছচ কোথায় আনিস?
কোথাও না। ওদের নিয়ে একটু হাঁটতে বের হয়েছি। আপনি কি করছেন?
আমি মাছের নাম লিখছি। তোমাকে বলেছিলাম না মৎস্য সমস্যা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছি। আমাদের দেশ হচ্ছে মাছের দেশ অথচ মাছের কি ভয়াবহ আকাল।
তাতো বটেই।
দুটা মিনিট দাড়াওতে আনিস–আমি নামগুলো তোমাকে পড়ে শুনাচ্ছি। দেখ কোন নাম বাদ পড়েছে কিনা।
সোবাহান সাহেব পড়তে শুরু করলেন— রুই,কাতল, মৃগেল, পাঙ্গাশ, চিতল, বোয়াল, কালি বাউস, নানিদ, চিংড়ি, কৈ, মাগুর, শিং, পুঁটি, শোল, মহাশোল, রিঠা, ভেটকি, টেংরা, খইলসা, কাইক্যা, পাবদা, লাটি, বাতাসী, আইড়, বাইম, তপসে, নলা, ফইল্যা, দাঁড়কিনি, পিতল্ল্যা— কিছু কি বাদ পড়ল আনিস?
আনিস কিছু বলার আগেই নিশা বলল— ইলিশ বাদ পড়েছে স্যার। সোবাহান সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। সত্যি সত্যি ইলিশ বাদ পড়েছে। এটা কি করে হল? আসল মাছটাই বাদ পড়ে গেল। সোবাহান সাহেব ক্ষীণ স্বরে বললেন, এটা কেমন করে হল আনিস? এত বড় ভুল কি করে করলাম?
আনিস হাসিমুখে বলল, এটা কোন বড় ভুল না, খুবই সাধারণ ভুল—যা আমরা সব সময় করি। যে জিনিস চোখের সামনে থাকে তাকে আমরা ভুলে যাই। যে ভালবাসা সব সময় আমাদের ঘিরে রাখে। তার কথা আমাদের মনে থাকে না। মনে থাকে হঠাৎ আসা ভালবাসার কথা।
ঠিকই বলেছ আনিস।
স্যার যাই, স্নামালিকুম।
তিনি জবাব দিলেন না। টগর বলল, স্যার যাই স্নামালিকুম। নিশাও বলল, স্যার যাই স্নামালিকুম। সোবাহান সাহেব হেসে ফেললেন। হঠাৎ তার কাছে মনে হল এই পৃথিবী বড়ই আনন্দের স্থান। এই পৃথিবীতে বাস করতে পারার সৌভাগ্যের জন্যে তিনি নিজের প্রতিই খানিক ঈর্ষা অনুভব করতে লাগলেন।
খাবার টেবিলে হে মাছের চিত্ৰনাট্য নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। খেতে বসেছে মিলি এবং ফরিদ। মিলির চিত্ৰনাট্য বিষয়ক কথাবার্তা শোনার আগ্ৰহ নেই, কিন্তু ফরিদ শোনাবেই। ফরিদ গম্ভীর গলায় বলছে—
সব মিলিয়ে চরিত্র হচ্ছে চারটি। জেলে, জেলের স্ত্রী, খেয়া নৌকার মাঝি এবং একটা চোর।
মিলি বলল, মাছ নিয়ে ছবি এর মধ্যে আবার চোর কেন?
পুরোটা না শুনেই কথা বলিস এটাই হচ্ছে তোর বড় সমস্যা। চোরের প্রয়োজন আছে বলেই চোর আছে। একটা হাই ড্রামা স্টোরী। এখানে. টেনশন বিন্ড আপ করতে চোর লাগবে। জেলের নিজস্ব কোন নৌকা নেই, সে খেয়া নৌকায় করে মাছ মারতে বের হয়েছে। সেই নৌকায় বসে আছে। একজন চোর। ওপেনিং শটে— নৌকা দেখা যাচ্ছে। দিনের অবস্থা ভাল না। ঢেউ উঠেছে। নৌকা টালমাটাল করছে। ফাস্ট ডায়লগা জেলে দিচ্ছে–ক্যামেরা জুম করে জেলের মুখে চলে গেল, মিলি শুনছিসতো কি বলছি?
হ্যাঁ শুনছি।
জেলে বলল, ও মাঝি ভাই, একখান গীত গান। মাঝি বলল, পেডে যদি ভাত না থাহে, গীত আইব ক্যামনে। জেলে বলল, কথা সত্য। নদীত নাই মাছ। তখন হঠাৎ কি মনে করে যেন মাঝি গান ধরল, ও আমার সোনা বন্ধুরে ও আমার রসিয়া বন্ধুরে। এই গানের সঙ্গে সঙ্গে জাল ফেলা হবে। ক্যামেরা মাঝির মুখ থেকে কাট করে চলে যাবে জালে। সেখান থেকে কাট করে পানিতে, কাট করে লং শটে নৌকা। কাট মিড ক্লোজ আপে তোর মুখ।
আমার মুখ মানে?
জেলের স্ত্রীর ভূমিকায় তুই অভিনয় করছিস। দুঃখ, অভাব অনটনে পর্যুদস্ত বাংলার শাশ্বত নারী। হৃদয়ে মমতার সমুদ্র, পেটে ক্ষুধার অগ্নি।
মামা, তোমার এসব ঝামেলায় কিন্তু আমি নেই।
আমি কি বাইরে থেকে আটিষ্ট আনিব না-কি? নিজেদেরই কাজ করতে হবে। আমি পৃথিবীকে দেখিয়ে দেব— অভিনয়ের অ জানে না। এমন মানুষ নিয়েও ছবি হয় এবং এ ক্লাস ছবি হয়। ডায়ালগ মুখস্ত করে ফেলবি, পরশু থেকে রিহার্সেল।
মিলি বিরক্ত গলায় বলল, তোমার এই পাগলামীর কোন মানে হয় মামা? মুখে বললেই ছবি হয়ে যাবে? টাকা-পয়সা লাগবে না?
আমার কি টাকা পয়সার অভাব? দুলাভাইয়ের কাছে আমার কত টাকা জমা আছে তুই জানিস? প্রয়োজন হলে মগবাজারের বাড়ি বিক্রি করে দেব। মরদক বাত, হাতিকা দাঁত। একবার যখন বলে ফেলেছি–
হবে না। শুধু শুধু—
আগেই টের পেয়ে গেছিস শেষ পর্যন্ত কিছু হবে না? জীবন সম্পর্কে এমন পেসিমিস্টক ভিউ রাখবি না। মনটাকে বড় কর।
আর কে কে অভিনয় করছে তোমার ছবিতে?
এখানো ফাইন্যাল হয় নি। ডাক্তার ছোকরাকে বলে দেখব, আর দেখি নতুন ভাড়াটে আনিস রাজি হয় কি-না।
ওরা ছবিতে অভিনয় করবে। কেন?
শিল্পের প্রতি মমত্ববোধ থেকে করবে। মহৎ কাজে শরিক হবার স্পিরিট থেকে করবে। আনিস ছোকরাকে আজ রাতেই ধরব।
মিলি তাকিয়ে আছে মামার দিকে। সে যে খুব উৎসাহ বোধ করছে তা মনে হচ্ছে না।
আনিস আছ না-কি?
আনিস দরজা খুলল। ফরিদকে দেখে অবাক হলেও ভাব ভঙ্গিতে তার কোন প্ৰকাশ হল না। সে হাসি মুখে বলল, স্নামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম। তুমি করে বললাম। কিছু মনে করনিতো? আমি মিলির মামা।
জ্বি আমি জানি। আসুন ভেতরে আসুন।
ভেতরে যাব না। কাজের কথা সেরে চলে যাব। খুব ব্যস্ত। ছবির স্ত্রীপ্ট করছি, মাছ নিয়ে শর্ট ফ্রিম বানাচ্ছি। নাম হচ্ছে হে মাছ।
তাই না কি?
হ্যা! তাই। এখন কথা হচ্ছে তুমি কি ছবিতে অভিনয় করবে? এক গাদা কথা বলার দরকার নেই। বল হ্যাঁ কিংবা না।
আনিস হকচকিয়ে গেল। কেউ তাকে অভিনয়ের জন্যে ডাকতে পারে তা তার মাথায় কখনো আসে নি। ফরিদ বলল, আমার ছবিতে একটা চোরের ক্যারেক্টার আছে। এই জন্যেই তোমার কাছে আসা নয়ত আসতাম না। তোমার চেহারায় একটা চোর চোর ভাব আছে।
আনিস হতভম্ব হয়ে বলল, আমার চেহারায় চোর চোর ভাব আছে?
হ্যাঁ আছে।
আনিস বিস্মিত গলায় বলল, নিজের সম্পর্কে আজে বাজে কথা অনেক শুনেছি, কিন্তু আমার চেহারা চোরের মত এটা এই প্রথম শুনলাম।
সত্যি কথা আমি পেটে রাখতে পারি না। বলে ফেলি। তুমি আবার কিছু মনে করনি তো?
জ্বি না, কিছু মনে করিনি।
অভিনয় করবে, না করবে না?
করব। এ জীবনে অনেক কিছুই করেছি। অভিনয়টাই বা বাদ থাকবে কেন?
ফরিদ হৃষ্টচিত্তে নিচে নেমে এল। এখন ডাক্তার ছোকরা রাজি হলেই কাজ শুরু করা যায়। তবে ছোকরার ব্রেইন বলে কিছু নেই। তার কাছ থেকে অভিনয় আদায় করা কষ্ট হবে। ব্যাটা হয়তো রাজিও হতে চাইবে না। ফরিদের ধারণা ডাক্তার এবং ইনজিনিয়ার এই দুই সম্প্রদায়, অভিনয় কলার প্রতি খুব উৎসাহী নয়। আজ রাতেই ব্যাপারটা ফয়সালা করে ফেললে কেমন হয়?
ফরিদ কাদেরকে পাঠাল মনসুরকে ডেকে আনতে। মনসুর সঙ্গে সঙ্গে চলে এল। মনে হল যেন কাপড় পরে এ বাড়িতে আসার জন্যে তৈরি হয়েই ছিল। মনসুরের সঙ্গে ফরিদের নিম্নলিখিত কথোপকথন হল।
ফরিদ : তোমাকে একটি বিশেষ কারণে ডেকেছি। অসুখ বিসুখের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই।
মনসুর : জ্বি বলুন।
ফরিদ : আচ্ছা স্ত্রী হিসাবে মিলি কি তোমার জন্যে মানানসই হবে বলে মনে হয়? মিলি আবার একটু বেঁটে, ভেবে চিন্তে বল।
মনসুর : (তোতলাতে তোতলাতে) জ্বি মামা, অবশ্যই হবে। বেঁটে কি বলছেন? পারফেক্ট হাইট। মানে আমার ধারণা-মানে—
ফরিদ : মিলি স্বামী হিসেবে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে?
মনসুর : অবশ্যই পারব। একশ বার পারব।
ফরিদ : তাহলে কাল থেকে রিহার্সেল শুরু করে দাও।
মনসুর : (বিস্মিত) কিসের রিহার্সেল?
ফরিদ : মিলি করবে জেলে স্ত্রীর ভূমিকা আর তুমি হচ্ছে জেলে।
মনসুর : আমি মামা কিছুই বুঝতে পারছি না।
ফরিদ : ছবি বানাচ্ছি। শর্ট ফ্রিম। সেখানে তোমার ভূমিকা হচ্ছে অভাব অনটনে পর্যুদস্ত জেলে, আর মিলি তোমার স্ত্রী।
মনসুর : ছবির কথা বলছেন? ফরিদ : অফকোর্স ছবির কথা বলছি। তুমি কি ভেবেছিলে?
মনসুর : (শুকনো গলায়) একগ্লাস ঠাণ্ডা পানি খাব। একগ্লাস ঠাণ্ডা পানি খেয়ে মনসুর ক্ষীণ স্বরে বলল, মিস মিলি কি আমার সঙ্গে অভিনয় করতে রাজি হবেন?
সেতো রাজি হয়েই আছে।
তাই নাকি–আরেক গ্রাস পানি খাব।
মনসুর দ্বিতীয় গ্লাস পানি খেয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় জানাল যে, সে অতি আগ্রহের সঙ্গে মিস মিলির অভিনয় করবে।
তুমি আগে অভিনয় করেছ?
জ্বি না। অসুবিধা হবে না–আমি শিখিয়ে দেব। অভিনয় কঠিন কিছু না। জাল ফেলতে জান?
শিখে নেবে।
জ্বি আচ্ছা।
মাথাটা কাল পরশু কামিয়ে ফেল।
ডাক্তার হকচকিয়ে গেল। টোক গিলে ভয়ে ভয়ে বলল, কি বললেন মামা?
মাথাটা কামিয়ে ফেলতে বললাম। জেলেদের মাথায় থাকে কদমছাট চুল। মাথা না কামালে ঐ জিনিস পাব কোথায়? কোন অসুবিধা আছে?
জ্বি না। কোন অসুবিধা নেই। আপনি যা বলবেন তাই করব।
ভেরি গুড।
অভিনয় নিয়ে মিস মিলির সঙ্গে কি একটু কথা বলতে পারি?
ফরিদ বিরক্ত হয়ে বলল, তার সঙ্গে আবার কি কথা? সে অভিনয়ের জানে কি? যা জানতে চাইবে আমাকে প্রশ্ন করলেই জানবে।
ডাক্তার বলল, জি আচ্ছা।
চলবে। 📌