#বাঁধনহীন_সেই_বাঁধন_অকারণ|২৭|
#শার্লিন_হাসান
রুদ্র কাবাড খুলতে দেখে তার গোছানো জামাকাপড় কিছুটা এলোমেলো। বিশেষ করে কালো রংয়ের শার্ট আর টিশার্ট গুলো দেখতে পাচ্ছে না।
-আচ্ছা মেঘ তখন কী পোড়াচ্ছিলো?
টনক নড়ে রুদ্রর। মূহুর্তে চোয়াল শক্ত করে নেয়। তখন আবার রুমে মেঘের আগমন।
সেও হাসি দিয়ে বললো,
-রুদ্র স্যার শুনুন না।
-তুমি আমার টিশার্ট পুড়িয়ে ফেলেছো?
-হ্যাঁ!
-কেন?
-কারণ ব্লাক শার্ট পড়ে যাওয়ায় মেয়েরা আপনাকে নিয়ে কমপ্লিমেন্ট দিয়েছে সেজন্য!
-তাতে তোমার কী?
-আপনি জানেন না আমার কী? ভালোবাসী আপনাকে আর আমি ছাড়া অন্য কেউ আপনাকে কমপ্লিমেন্ট দিবে সেটা আমার সহ্য হয় না সেজন্য।
রুদ্র কথা বাড়ায় না। গম্ভীরমুখে বলে,
-আচ্ছা রেডি হয়ে নেও। একটু পর তো আবার বেরুতে হবে।
-যাক বাবা কিছু বলেনি।
মেঘ খুশি হয়। রুদ্র সোজা বেলকনিতে চলে যায়। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে মলিন হাসে রুদ্র। আলিশার জায়গাটা মেঘ নিতে পারবে তো? আলিশা! ভালোবাসার মানুষ, প্রিয় মানুষ ছিলো। সে যেমনই হোক ভালোবাসার মানুষ তো! আর প্রিয় মানুষ সব সময় প্রিয় মানুষই হয়। মেঘ জানলে কষ্ট পাবে তার রুদ্র স্যার তাকে না তার প্রাক্তনকে না, আলিশা রুদ্রর প্রাক্তন না ভালোবাসা। রুদ্র ভালোবাসে আজও আলিশাকে। এতো সহজে কী সব ভুলা যায়? উঁহু! কিছুই ভুলা যায় না। মেঘ! তাকে ভালোবাসে অথচ সে বাসে আলিশাকে। মেঘ দায়িত্ব আর আলিশা তো ভালোবাসা। সব ভুলতে সময় লাগবে রুদ্রর। বাইরের মানুষের সামনে মুভ অন দেখালেও আদৌ রুদ্র ঠিক হয়নি। সে নিজেকে সবার সামনে ভালো থাকার অভিনয়ে প্রেজেন্ট করছে।
মেঘ রেডি হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নেয়। লিভিং রুমে এসে বসতে অন্তি আসে। সাদবিও রেডি হয়ে এসেছে। রাখি যাবে মেহরাব সহ। রুদ্র আসে তাঁদের সবাইকে নিয়ে রওনা দেয় আনায়াদের বাড়ীর উদ্দেশ্য।
******
এরই মাঝে কেটে গেছে তিনদিন। মির্জা বাড়ীতে হইচই! খুশির রোল পড়ে গেছে। সবাই ব্যস্ত ও বটে। নিবরাস সে হসপিটাল আর বাড়ীতে তার দৌড়াদৌড়ি। তবে সামনের পনেরোদিন সে ছুটি কাটাবে।
মিসবাহকে রেডি করে দিয়েছে মাইশা। একটু পর হলুদের অনুষ্ঠান। নিবরাস রেডি হয়ে রুমে বসে আছে। বাইরে মানুষ গিজগিজ করছে।
এরই মাঝে মিসবাহ আসে নিবরাসের রুমে। তার মামুকে উড কালার পান্জাবিতে দারুণ লাগছে। মিসবাহ নিবরাসকে দেখে বলে,
-মামু তোমায় একটু বেশী সুন্দর লাগছে।
-ধন্যবাদ সোনা। তোমায়ও সুন্দর লাগছে।
আনায়াকে সাজিয়ে হলুদ দেওয়ার জন্য বসানো হয়েছে। চৌধুরী পরিবারের সদস্যরা সেজে গুজে ভালোই উপভগ করছে অনুষ্ঠান। চারপাশে মানুষ আর মানুষ। অনুষ্ঠান বাড়ী বলে কথা।
মেঘ,রাখি সাদবি সহ তারা রেডি হয়ে আনায়াকে হলুদ ছোঁয়াতে চলে যায়।
মেঘ শুনেছে আনায়ার বর ডাক্তার। তবে বরকে দেখা হয়নি তার। ইতোমধ্যে অনেক প্রশংসাও শুনেছে বরকে নিয়ে।
রুদ্র একপাশে বসে ফোন স্ক্রোল করছে। মেঘ আসে তখন। রুদ্রকে দেখে বলে,
-চলুন না কয়টা পিকচার তুলি।
-ইন্টারেস্ট নেই।
-থাকবে কী করে? সব শখ তো বউ আসার আগেই পূরণ করে নিয়েছেন।
কিছুটা খোঁচা মেরে কথাটা বলে মেঘ। রুদ্র কথা বাড়ায় না। তখন মেঘ আবারো বলে,
-আরে চলুন কয়েকটা পিকচার তুলি।
-আগামী কালকে তুলবো।
-থাক তুলতে হবে না।
-আচ্ছা যাও গিয়ে শুয়ে পড়ো রাত একটা বেজে গেছে।
-আপনার মন চাইলে আপনি যান।
-হ্যাঁ চলেই যাচ্ছি। আমার মাথা ব্যথা করছে।
-মাথা ব্যথা করছে কেন?
-জানি না। তুমি থাকলে থাকো চলে আসতে চাইলে চলে আসো।
-আচ্ছা আসছি।
রুদ্রর পেছনে মেঘ ও চলে আসে। সাদবিকে বলে দিয়েছে যাতে ফাইজা চৌধুরীকে বলে দেয় তারা চলে গেছে।
তাঁদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে আসে দু’জন। রুদ্র এসেই লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে। মেঘ চেন্জ করে নেয়। রুদ্র ঘুমোচ্ছে সে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
মুখটা কেমন মলিন হয়ে আছে। বেশ মায়া লাগে মেঘের। রুদ্রর চোখের পাতায় নিজের ওষ্ঠ স্পর্শ করে।
-এই মানুষ আমার! একান্ত আমার পরো পারেও এই মানুষটাকে আমার সঙ্গী হিসাবে চাই।
*******
আনায়াকে সাজানো হয়েছে খুব সুন্দর ভাবে। একটু পর বিয়ে পড়ানো হবে। সাদবি,রাখি,মেঘ যায় আনায়ার বরকে দেখতে। হাসি মুখে কথা বলতে,বলতে স্টেজের কাছে পৌঁছায় মেঘ। মিসবাহকে দেখে কিছুটা চমকায়। মিসবাহ এখানে কী করছে? তখন নিবরাসকে দেখে মেঘ। আনায়ার বর তাহলে নিবরাস?
সাদবি,রাখিকে রেখে আড়ালে চলে আসে মেঘ। সে রুদ্রকে খুঁজছে। বিয়ে বাড়ীতে মানুষ গিজগিজ করছে কিন্তু রুদ্রর দেখা মিলেনি। সেই কয়েকঘন্টা আগে দেখেছিলো রুদ্রকে।
নিবরাসের এখানে বিয়ে পড়ানো শেষ হতে আনায়ার রুমে যায় কাজী। রুদ্র নিবরাসের সাথে বসে কথা বলছে। তখন মেঘ কল দেয়। রুদ্র উঠে চলে আসে। এখন নিশ্চয়ই পিকচার তোলার জন্য বলবে।
রাখিকে জিজ্ঞেস করে মেঘকে খুঁজে নেয় রুদ্র। সাদবি সহ তারা বাইরে আসে পিকচার তোলার জন্য।
রুদ্র ও হাসিমুখে পিকচার তুলে।
অতঃপর তারা খাবার খেতে বসে পড়ে। মেঘের অর্ধাঅর্ধি খাওয়া হতে মরিয়ম নওয়াজ আসে। মেঘকে দেখে বলে,
-মেঘ যে! কেমন আছো মা?
-আলহামদুলিল্লাহ আন্টি, আপনি?
-আলহামদুলিল্লাহ! তোমার রিলেটিভ আনায়া?
-হ্যাঁ আমার মামাশ্বশুরের মেয়ে।
-ওহ আচ্ছা। তোমার হাজবেন্ডকে দেখলাম না।
-এনি আমার হাজবেন্ড।
রুদ্রকে দেখিয়ে বলে মেঘ। তখন মরিয়ম নওয়াজ বলেন,
-রুদ্রকে তো চিনি। কথাও হয়েছে কিছুক্ষণ আগে।
-কথাও হয়ে গেছে আন্টি?
-হ্যাঁ তখন নিবরাসের কাছে ছিলো না।
-সেখানে নিশ্চয়ই মেয়ে ছিলে। নিবরাসের সুন্দরী কাজিনরা ও তো ছিলো। এই রুদ্র এমন কেন? বউ দিয়ে হয় না? না! রুদ্র এমন না।
ভাবনা এক সাইডে রেখে খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ে মেঘ।
আনায়ার কাছে আসে। মেয়েটাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। বর-বউয়ের ফটোশুট চলছে। সাথে কিছু নিয়ম-কানুন।
বিদায়ের সময় আসতে সীতারা আহমেদ, জিয়াউর রহমান আনায়াকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেন। একমাত্র মেয়ে! তবে নিবরাসের উপর জিয়াউর রহমানের পুরো বিশ্বাস আছে।
গাড়ীতে উঠে বসে আনায়া। তার পাশের সীটে নিনরাস বসা। দু’জনেই লজ্জা পাচ্ছে। বিশেষত আনায়া যে সবসময় ভাইয়া,ভাইয়া বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলতো সে নাকী ওগো!হ্যাঁ গো বলবে। নিবরাস ভাবছে এই মেয়ে তাকে ভাইয়া ডাকতে,ডাকতে অজ্ঞান করে ফেলবে।
মির্জা বাড়ীতে আসতে কিছু নিয়মকানুন পালন হয়। আনায়াকে সবাই দেখতে আসে। আনায়া চুপচাপ বসে আছে। ভাবছে ভাইয়া কীভাবে বর হয়ে গেলো। এই জন্যই বলে কাউকে ভাইয়া ডাকতে নেই। আজকের ভাইয়া কালকের সাইয়্যা।
নিবরাসের কয়েকজন কাজিন তার রুম সাজানোর কাজে ব্যস্ত। রাতে ডিনার করা শেষ হতে আনায়াকে নিবরাসের রুমে দিয়ে আসা হয়।
তার কিছুক্ষণ পর নিবরাস রুমে প্রবেশ করে। তার অস্বস্তি অনুভব হচ্ছে। কীভাবে কী? আনয়া তার বউ? ভাবতে কেমন লাগছে। যদিও এটা বেশীক্ষণ থাকবে না কয়েকদিন গেলে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।
নিবরাস রুমে প্রবেশ করতে আনায়া সালাম দেয়।
তবে হাসি দমিয়ে রাখতে পারেনি আনয়া। গেমটা সরিয়ে শব্দ করেই হেঁসে দেয়। নিবরাস নিজেও হেঁসে দেয়। আনয়া হাসতে,হাসতে বলে,
-এই তুমি আনায়া না? আমার বউ হলে কীভাবে? আচ্ছা আমায় একটা চিমটি কাটো তো? সত্যি আমাদের বিয়ে হয়েছে?
-ভাইয়া আগে তুমি আমায় চিমটি কাটো। আসলেই আমাদের বিয়ে হয়েছে? ধুর! আমার এতো হাসি পাচ্ছে।
-মনে হচ্ছে সত্যি আমাদের বিয়ে হয়েছে। আচ্ছা সেসব থাক নামাজ পড়তে হবে।
-হ্যাঁ চলো।
দু’জনে নামাজ আদায় করে নেয়। নিবরাস আনায়ার হাতে দেনমোহরের টাকা তুলে দিয়ে বলে,
-আগে দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করলাম। এবার তোমার টাকা তুমি যা খুশি তা করো।
-আচ্ছা ভাইয়া তুমি সারাজীবন আমায় আগলে রাখবে তো?
-হ্যাঁ রাখবো।
-তাহলে টাকা আমার লাগবে না। কোন মাদরাসায় দান করে দিও। আমার তুমি হলেই চলবে।
হাসে নিবরাস। কাবাড থেকে একটা ব্যাগ বের করে আনে। তাতে একটা প্যাক যেটা আনায়ার হাতে ধরিয়ে দেয়। আনায়া খুলে প্যাকেটটা। যেটাতে তসবিহ,জায়নামাজ, আতর,কোরআন রাখা আছে। আনায়া মুচকি হেসে বলে,
-এতে সুন্দর কেন এগুলো? তোমার চিন্তা সত্যি আলাদা রকমের।
-হু! এটা আমার অনপক আগে থেকেই পরিকল্পনা করা। আল্লাহ চেয়েছেন তাই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলো।
-ইউ আর ওয়ান অভ থাউজ্যান্ড।
-ধন্যবাদ তবে এই আমিটা নির্দিষ্ট কারোর। আর নির্দিষ্ট মানুষটা তুমি আনায়া।
-হু!
সবশেষে নিবরাস একটা ডায়মন্ডের নেকলেস আনায়াকে উপহার দেয়। এই তারা গল্প করছে,কখনো বা হাসছে।
******
পরের দিন তাদের বিয়ের রিসিপশন অনুষ্ঠান। আনায়াকে পার্লারে সাজানো হয়েছে। ডার্ক হোয়াইট কালারের লেহেঙ্গা, মেচিং মেকোভার সাথে নিবরাসের দেওয়া ডায়মন্ডের নেকলেস। তেমন একটা গহনা পরেনি আনায়া। নির্দিষ্ট সময় তারা কমিউনিটি সেন্টারে চলে যায়। আনায়া যাওয়ার পরপর নিবরাসের সাথে কিছু ফটোশুট করে রাখে। তার পরপরই তার বাবা- মা,চৌধুরী পরিবারের সবাই আসে। মিসবাহ সে তার মামার সাথে পিকচার তোলে। বউমনির তারিফ করছে একটু পর,পর আর নিবরাসকে খোঁচাচ্ছে আনায়ার তারিফ করার জন্য। এতেই একটু পর পর আনায়া হাসছে। নিবরাস মিসবাহর কাজে একটু পর পর তাকাচ্ছে। মিসবাহ আর ভালো হলো না। নিবরাসকে জ্বালাচ্ছে।
তাদের রিসিপশনে নিবরাসের পরিচিত ডক্টর সাথে কিছু ফ্রেন্ডস ও উপস্থিত ছিলো। আনায়াকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। নিবরাস একটু পর পর তাকাচ্ছে আর হাসছে।
মেঘ রুদ্র ও বর বউয়ের সাথে পিকচার তুলতে যায়। যদিও নিনরাস মেঘকে দেখে চেখ সরিয়ে নেয়। কোন রিয়েক্ট বা প্রশ্ন করে না সে। মেঘ রুদ্র পিকচার তুলে সাইডে চলে আসে।
মেঘ তো আনায়াকে কমপ্লিমেন্ট দিচ্ছে। মেয়েটাকে সত্যি ভীষণ সুন্দর লাগছে। মেঘর কাজে রুদ্র বারবার বিরক্তি নিয়ে তাকাচ্ছে।
-আনায়াকে নিয়ে আর কমপ্লিমেন্ট দিতে হবে না। আমাকে দেখো আমাকে নিয়ে কমপ্লিমেন্ট দাও। মেয়েরা দিলে ঠিকই তো জ্বলো এখন নিজে দিতে পারো না?
-আপনি আমাকে ভালোবাসেন নাকী? যেদিন ভালোবাসবেন মুখ ফুটে বলবেন সেদিনই কমপ্লিমেন্ট দিবো তার আগে না।
-তোমার থেকে কমপ্লিমেন্ট জানতে হলে আমায় তোমায় ভালোবাসতে হবে?
-হুম!
-আচ্ছা যেদিন ভালোবাসবে সেদিন বলবো।
-ঠিক আছে।
রুদ্র মাথা নাড়ায়। সেদিনটা কবে আসবে সেটা বলা মুশকিল।
মেঘ জানে রুদ্র তাকে ভালোবাসে না। আলিশাকে এখনো ভুলতে পারেনি রুদ্র। আর প্রথম ভালোবাসা এতো সহজে কী ভুলা যায়? মেঘ অপেক্ষা করবে! রুদ্র তাকে ভালোবাসবে তার বিশ্বাস।
#চলবে
#বাঁধনহীন_সেই_বাঁধন_অকারণ|২৮|
#শার্লিন_হাসান
(প্রাপ্তবয়স্ক মনস্কদের জন্য উন্মুক্ত)
কেটে গেছে একমাস। সময়ের সাথে সবাই নিজের জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কখনো হাসিমুখে কখনো বিষাদ অন্তরে। তবুও দিন কেটে রাত হয়! খারাপ সময় কাটে আবারো ভালো সময়ের দেখা মিলে।
মেঘ রুদ্রর জীবন ও কেটে যাচ্ছে সময়ের সাথে।
সম্পর্ক আগের থেকে অনেকটা উন্নত হয়েছে। রুদ্রর ছোট,ছোট কেয়ার মেঘকে আনন্দ দেয়। তবে লোকটা স্বল্পভাষী বেশী কথা বলতে চায় না মুখ ফুটে। মেঘই যা বকবক করে।
সন্ধ্যায় রুদ্র ক্লাস টেস্ট খাতা দেখছে। মেঘের খাতা দেখতে মেজাজ বিগড়ে যায় তার। সবচেয়ে কম মার্ক মেঘ পেয়েছে। এতো করে বলে তাও মেয়েটা সিরিয়াস হয়না। মেঘ তখন কফির মগ নিয়ে রুমে আসে। রুদ্রকে দেখে জিজ্ঞেস করে,
-আমার খাতাটা দেখেছেন?
-হ্যাঁ দেখেছি সবচেয়ে হায়েস্ট মার্ক তুমি পেয়েছো।
-আল্লাহ কী বলেন?
মেঘ দৌড়ে আসে। কফির মগটা রেখে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-উফফ স্যার বুঝতে পারিনি আপনার ছোটোখাটো বকা আমার এতো উপকার করবে। এখন আর আমায় ফেলটুস বলতে পারবেন না। আমি হায়েস্ট মার্ক পেয়েছি। ধন্যবাদ স্যার সামনে আরো বেশী গাইডলাইন দিবেন যাতে আমি এ প্লাস পাই।
কথাটা বলে রুদ্রকে ছেড়ে দেয় মেঘ। রুদ্র কপাট রাগ দেখিয়ে বলে,
-ঠিক আছে আরো বেশী গাইডলাইন দিবো। কিন্তু তুমি সবার থেকে কম মার্ক পেয়েছো।
-আপনি না বললেন হায়েস্ট মার্ক?
-ওটা তো রাগ দেখিয়ে। কেমন বোকা মেয়ে তুমি?
-ধুর! আপনি একটা কুঞ্জুস! আমার বেলায় মার্ক দেন না।
-খাতায় লেখা থাকলে তবেই তো দিবো?
-স্যার আপনি জানেন না। পড়ালেখা যেই কঠিন। আর এই কলেজে ভালো মানুষ যায়? আমিও আগে তেমন যেতাম না। আপনি আসার পর আবার নিয়মিত ছিলাম আপনাকে দেখার জন্য! আপনি জানেন স্যার প্রথম এক সপ্তাহ যাওয়ার পর তো আমি নফল নামাজ পড়ে দো’আ করেছি আল্লাহ বিয়েটা যাতে হয়ে যায়। পড়াশোনা আমার জন্য না। বিয়েটা ঠিকই হলো কিন্তু পড়ালেখা বন্ধ হলো না। আসলে স্যার আপনি সম্পর্কের মূল্য বুঝেন না।
-আবার ও সম্পর্কের মূল্য?
-হ্যাঁ স্যার! বউ মানুষ আমি আমাকে রাখবেন বাড়ীতে! আড়ালে তা না কলেজে পাঠাচ্ছেন আবার ছাত্রী হিসাবে ঠিকই অপমান ও দিচ্ছেন বাড়ীতে আসলে বউ। দেখুন আপনি সম্পর্কের কতটা মূল্য দিচ্ছেন।
-আজকেই মূল্য দেবো প্রমিস!
-ন..না না মূল্য দেওয়া লাগবে না। আমি তো জাস্ট কথার কথা বললাম।
-প্রমিস দিয়ে ফেলেছি জান। একদম কথার এফোঁড়ওফোঁড় হবে না। আর তুমি তো জানো রুদ্র এক কথা মানুষ সো…!”
-আমার তো আঠারো হয়নি।
-গতকালকে হয়ে গেছে।
-তো?
-তো? এখন তুমি সম্পর্কের মূল্য বুঝার জন্য পারফেক্ট আমিও একদম লেট করবো না জান। এখন থেকে সুযোগ পেলেই সম্পর্কের মূল্য বুঝাবো তোমায়।
-আরে না! আমি জানি আমিও সম্পর্কের মূল্য বুঝি, আপনিও বুঝেন। আসলে এটা বলতে,বলতে অভ্যাস হয়ে গেছে তো সেজন্য মুখ ফসকে বলে ফেলেছি। আর কখনো বলবো না স্যার।
-তোমার ইচ্ছে বাট আমি তোমাকে প্রমিস দিয়ে ফেলেছি জান।
-দাদীন মনে হয় ডাকছে আমি আসছি।
-আচ্ছা যাও।
মেঘ উঠে আসে। হুদাই! রুদ্রর সামনে কীভাবে যাবে সে? লজ্জা লাগছে তার। নিজেকে কয়েকটা গালিও দিলো মেঘ। কী দরকার ছিলো সম্পর্কের মূল্যর কথা তোলার?
অন্তি,হানির সাথে কথা বলে সময়টা পার করে দেয় মেঘ। সবার সাথে ডিনার করতে বসেছে সে। ডিনার করতে রুদ্র এসেছে কিছুক্ষণ আগে।
সবার ডিনার শেষ হতে মেঘ অন্তি,হানিকে কাজে সাহায্য করলো। রুমে আসতে,আসতে প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। রুদ্র হয়ত শুয়ে পড়েছে। মেঘ নিশব্দে রুমে প্রবেশ করে দরজা লক করে দেয়। রুদ্র ঘুমিয়ে পড়েছে হয়ত। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শুয়ে পড়ে রুদ্রর পাশে।
-আর জীবনেও সম্পর্কের মূল্যর কথা উঠাবো না।
রুদ্র মেঘের দিকে ফিরে তাকে টান দিয়ে নিজের বক্ষস্থলে নিয়ে আসে। নিজের একবাহু দ্বারা কোমর জড়িয়ে নেয়।
-আজকে কিন্তু সম্পর্কের মূল্য বুঝাবো।
-আরে শুনুন না….”
কথা শেষ করার আগে মেঘের ওষ্ঠদ্বয়ের সাথে নিজের ওষ্ঠদ্বয় মিলিয়ে নেয় রুদ্র। প্রিয় পুরুষের ছোঁয়া পেতে অজানা অনুভূতি কাজ করলো। এই অনুভূতি নিত্যান্ত নতুন! এর আগে কখনো এমন হয়নি। তার শখের পুরুষ তাকে চাইছে! খুব করে চাইছে মেঘ সায় দিলো রুদ্রর চাওয়াতে। দু’জনে অন্তর্নিহিত হলো প্রণয়ের পরিণতিতে।
******
হসপিটালে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে নিবরাস। আনায়া তার নাস্তা রেডি করছে। মরিয়ম নওয়াজ দরকারে বাইরে গেছেন। মাইশা মিসবাহকে নিয়ে স্কুলে। নাস্তা টেবিলের উপর রেখে কুকারে ভাত বসিয়ে দিয়েছে আনায়া।
নিবরাস রেডি হয়ে ড্রাইনিংয়ে আসে। নাস্তা খেয়ে ঘড়ির দিকে তাকায়। আধাঘন্টা লেট আছে। আনায়া আসে! নিবরাস তাকে দেখে বলে,
-কিছু লাগবে তোমার?
নিবরাসের কথায় আনায়া হেঁসে দেয়। নিবরাস বুঝেছে তার কথায়ই হেসেছে আনায়া। সে নিজেও হেসে দেয়। আনায়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-এই তোমার হাসি কন্ট্রোলে আনবে? দেখা যাবে ভরা মজলিসে আমি তোমায় কিছু জিজ্ঞেস করলেও তুমি এভাবে দাঁত বের করে হাসবে! লোকে পাগ’ল বলবে। পরে আমায় বলবে, ‘মুয়াম্মার নিবরাস মির্জা পাগ’ল মেয়ে বিয়ে করেছে।’
-আরে ভাইয়া তোমায় ভাইয়া ডাকতে,ডাকতে অভ্যাস হয়ে গেছে সেজন্য জামাই না মানে, তোমার মাঝে জামাই,জামাই ফিলিংসটা আসলে আমার হাসি পায়।
-ধুর! একমাস হয়ে গেলো বিয়ের। এখনো আমায় ভাইয়া মনে হয়? জামাই মনে হয় না?
-আরে না! কী যে বলো না তুমি ভাইয়া।
-ডোন্ট কল মি ভাইয়া। আর কখনো ভাইয়া ডাকবা না। তোমার ভাইয়া ডাক শুনতে শুনতে আমি বোর হয়ে গেছি।
-তাহলে ইউনিক কিছু বলো?
-নিবরাস বলে ডেকো তাও ভালো।
-তাহলে ঠিক আছে নিবরাস ভাইয়া।
-আবারো? ভাইয়া ডাকবে না আমায়।
-সেজন্য বেশী,বেশী ভাইয়া ডাকবো।
-এর পরের বার ভাইয়া ডাক শুনলে মুখ অফ করে দেবো।
-দাঁড়াও আগে হেঁসে নেই।
কথাটা বলে আনায়া চেয়ারে বসে পড়ে। নিবরাস চোখ গরম করে তার দিকে তাকাচ্ছে। তাতেও আনায়ার হাসি বন্ধ হচ্ছে না।
-মনে হচ্ছে হাসি বন্ধ করার জন্য থেরাপি দিতে হবে।
-কী থেরাপি?
-এক গ্লাস পানি নিয়ে আসো তো আনায়া। আমি সোফায় গিয়ে বসলাম।
আনায়া মাথা নাড়ায়। গ্লাসে পানি ঢেলে নিবরাসের কাছে যায়। আনায়ার হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে টেবিলের উপর রাখে।
-আর কিছু লাগবে? আচ্ছা তোমার ফোনটা জানি কই? ফোনে একটা জিনিস আছে আসার সময় নিয়ে আসবে আমার জন্য।
-কী আছে?
-দেখবে ফুলের সুন্দর, সুন্দর তোড়া।
-সুন্দর ভাবে বলো।
-ওই একই হলো! তুমি পিকগুলো দেখে নিও।
-আচ্ছা বায় আমার সময় হয়ে গেছে।
-আরে,আরে দাড়াও!
-কী?
-আমার কপালে চুমু খাও দেখি।
-এখন হাসি পায় না তোমার?
-এবার সত্যি হাসি পাবে।
নিবরাস মুচকি হাসে। আনায়ার কপালে আলতো স্পর্শ করে।
-এবার থেকে প্রতিদিন হসপিটালে যাওয়ার সময়… ”
-বেড রুম থাকতে লিভিং রুমে রোমান্স করছি। কী কপাল দেখো?
-আরে তুমিই তো আনরোমান্টিক।
হাসে নিবরাস। আনায়ার ওষ্ঠে আলতো স্পর্শ করে নিবরাস। পুনরায় কপালে ওষ্ঠ স্পর্শ করে। আনায়া মুচকি হাসে। নিবরাস ‘বায়’ বলে বেড়িয়ে পড়ে।
******
রুদ্র কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নেয়। মেঘ যাবে না। রুদ্র ও আর কিছু বলেনি। এই মেয়েকে কোন রকম এইচএসসি পাশ করাতে পারলেই সে বাঁচে। পড়াশোনায় যা ফাঁকিবাজ এর আর ভার্সিটি যাওয়া লাগবে না। সংসার করবে,বাচ্চা সামলাবে এটাই বেটার এর জন্য।
মেঘ নিচে যায়। অন্তি,হানিকে রান্নার জন্য হেল্প করছে সে। আজকে আরোহী আসবে। কয়েকদিন পর রোশান দেশের বাইরে চলে যাবে। আরোহী এক্সাম শেষ হলে যাবে। সেজন্য যত আয়োজন।
আরিশ,অর্ণব আজকে অফিস যাবে না। আফিয়া চৌধুরী আর আরিয়ান চৌধুরী অফিসের জন্য বেড়িয়ে গেছেন। সাদবিও আজকে কলেজ যাবে না। ফাইজা চৌধুরী আরিশ,অর্ণবের সাথে কথা বলছেন। সাদবিও গিয়ে তাঁদের পাশে বসে। প্রায় তিনমাস হয়ে গেলো তার মায়ের সাথে সম্পর্কছিন্ন! যদিও গত একমাসে সপ্তাহে দুইদিন করে থানায় গিয়ে দেখা করে এসেছে তার মায়ের সাথে। মায়ের করুণ দশা তার আর ভালো লাগছে না। আজকে সে তার বাবার সাথে কথা বলবে। তার মাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য বলবে। কিন্তু রুদ্র! আর কেউই সাদিয়াকে চৌধুরী বাড়ীতে থাকার পারমিশন দিবে না।
সাদবি তাদের সাথে আড্ডায় মনোযোগ দিতে পারছে না। মেঘের কথা মাথায় আসতে সাদবি চটজলদি উঠে পড়ে। মেঘ যদি রুদ্রকে বুঝায়! কিন্তু আদৌ বুঝবে তো? যেখানে সাদিয়া দিনের পর দিন অন্যায় করে এসেছে। অবশ্য এটা তার প্রাপ্য শাস্তি। ভোগ করুক না? মেঘকে আর কী বলবে সাদবি?
দুপুরের দিকে রোশান এবং আরোহী আসে চৌধুরী বাড়ীতে। সবাই মিলে গল্প গুজব! লান্স করে নেয়। আজকে রোশান থাকবে আগামী কালকে চলে যাবে।
সন্ধ্যায় সবাই নাস্তা করে নেয়।
আরিশ,অর্ণব রোশানের সাথে কথা বলছে।
রাইহান চৌধুরীর রুমে যায় সাদবি। সেখানে সাইহান চৌধুরী কিছু কাগজপত্র দেখছে। সাদবি যেতে তাকে বসতে বলে রাইহান চৌধুরী।
-কী দেখছ বাবা?
-ওই টাকা আর কাগজপত্র।
-ওহ! আচ্ছা। মাকে নিয়ে আসবে না?
-কাল সাপ আর সংসারে আনিনা আমি। তোমার মায়ের নামে আশরাফ খান ও কেস দিয়েছে। আয়মানের নামেও তিন তিনটা কেস।
– মাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসো না?
-দেখি কী করা যায়।
সাদবি প্রস্থান করে মেঘের কাছে যায়। মেঘের সাথে বসে আয়মান বর সাদিয়ার কথাই বলছে সাদবি। তার পেছন দিয়ে রুদ্র আসে রুমে। রুদ্রকে দেখে দুজনের কথা অফ হয়ে যায়। রুদ্র ব্রু কুঁচকে তাকায় দু’জন দিকে। সাদবিকে বলে,
-কথা বলা বন্ধ করলে কেন সাদবি? কিছু লুকাচ্ছো?
-না আসলে ভাইয়া!
তখন মেঘ বলে,
-না,না তেমন কিছুই না।
রুদ্রর সন্দেহ হয়। পরে মেঘকে জিজ্ঞেস করবে সেজন্য আর কথা বাড়ায়না। মেঘ,সাদবি রুম থেকে বেড়িয়ে কিচেনের দিকে যায়। রাতের রান্নাবান্না রেডি হচ্ছে। কিছু হেল্প করে মেঘ রুমে চলে আসে। রুদ্র ফোনে স্ক্রোল করছে।
মেঘকে দেখে বলে,
-দরজাটা লক করে এখানে আসো।
মেঘ মাথা নাড়ায়। রুদ্রর সামনে বসতে রুদ্র প্রশ্ন করে,
-তখন কী বলছিলা সাদবির সাথে?
-ওই কিছু না।
-বলো?
-আপনি শোনলে রাগ করবেন।
-এই সাদবি কারোর সাথে রিলেশনে আছে?
-আরে ব্যপারটা এমন না।
-তাহলে?
-ওই সাদিয়া আন্টি। উনি তো দুই মাসের মতো জেলে। এখন তো উনাকে ছাড়িয়ে আনা দরকার। উনার ও একটা সংসার আছে। মানলাম উনি ভুল করেছেন। তবে বাবার ও কিন্তু কম ভুল ছিলো না। সেই হিসাবে উনি একাই শাস্তি ভোগ করছেন এবার মনে হয় উনাকে ছাড়িয়ে আনা দরকার।
রুদ্র জবাব দেয় না। তখন মেঘ বলে,
-আপনি বললে বাবা তাকে নিয়ে আসবে। এখন আপনার মতামত!
-তুমি যেটা বলছো সেটা ঠিক আছে। আচ্ছা সে নাহয় আসবে যদি আবার আমাদের মাঝে অশান্তি করে?
-সেটা বাবা সিদ্ধান্ত নিবেন। আপনি শুধু হ্যাঁ বলেন! ওনাকে ছাড়িয়ে আনুক।
-আচ্ছা বাবাকে বলে দেবো আমি।
-ধন্যবাদ।
রুদ্র জবাব দেয় না। তখন মেঘ বলে,
-পুরোনো কথা মনে করছেন? বাদ দিন না! এই আপনি আলিশা আপুর কথা ভাবছেন তাই না? আপনি আমায় এখনো ভালোবাসেননি।
-বোকা! আমি কখন বললাম ওর কথা ভাবছি?
-বুঝাই যায়। আচ্ছা আমাকে কী ভালোবাসা যায় না? আমি কী ভালোবাসা পাওয়ার অযোগ্য?
-আমি কখন বললাম ভালোবাসা যায় না? আর অযোগ্যই বা কখন বললাম?
-কথা ঘুরাবেন না প্লিজ।
-আরে রাগ করছো কেন? আমি ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারি না। তুমি জানো?
-এই দেড়মাসে আমি আপনার মনে জায়গা করে নিতে পারিনি?
-মেয়ে তুমি বড্ড আবেগী। নিজেকে ছোট করছো কেন?
-ছোটোর কিছু হয়নি। আমি অগোছালো! আমি এলোমেলো আপনি জানেন! আর আমি বারবার আপনার কাছেই নিজেকে এলোমেলো ভাবে উপস্থাপন করি। আমার অগোছালো অনুভূতি আপনার কাছে বেহায়ার মতো বলি।
-তোমাকে নিয়ে পারা যায় না মেঘ।
হাসে মেঘ। রুদ্র তাকায়! মেঘ উঠে চলে যেতে নিবে রুদ্র তার হাত আঁকড়ে ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসে। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
-শুনেছো চঞ্চল মেয়ে? এই অগোছালো তুমিটাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। শুনেছি দ্বিতীয় বার ও কাউকে ভালোবাসা যায়! এই শোনা শব্দটা আমার জীবনে ঘটে গেলো। আমি অনুভূতি প্রকাশে কুঞ্জুস! তোমার মতো সব মুখ ফসকে বলতে পারি না।
#চলবে