বাতাস বলে দেয় পর্ব-১০

0
18

#বাতাস_বলে_দেয়
#ফারহানা_কবীর_মানাল

১০.
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। রোদের তাপ তীব্র, বাতাসের ভাপে হালকা গরম। আরিফ বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। ইনান আমার কোলে, ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে বিছানায় শুইয়ে দিতে দিতে বললাম, “হামজা জিজ্ঞেস করছিল– শার্টের খোঁজে যাব কখন?”

আরিফ চোখ মেললো না। ভাবলেশহীন গলায় বলল, “তুমি কি বলেছ? কখন যাবে?”

“তোমাকে জিজ্ঞেস না করে কি বলব?”

“গেলে এখন যাওয়া যায়। দুপুরে ভীড় কম থাকে। হামজাকে গিয়ে বলো তৈরি হয়ে নিতে। মিনিট দশেকের মধ্যে বের হব।”

“আমিও কি তোমাদের সাথে যাব? আসলে আমার একটু কাজ ছিল। কাপড়ের দোকানে যেতে হবে।”

“চলো। ইনানকে কী করবে? সাথে নিয়ে যাবে?”

“আম্মাকে জিজ্ঞেস করব। বললে সাথে নিয়ে যাব।”

“ঠিক আছে। আমি রেডি হচ্ছি। যা করবে তাড়াতাড়ি করো।”

শাশুড়ি মা বিছানায় বসে পান চিবুচ্ছেন। আমাকে দেখে স্বাভাবিক গলায় বললেন, “কিছু বলবে নাকি?”

“আসলে আম্মা, আমার একটু মার্কেটে যেতে হবে। কিছু কেনাকাটা করতে হবে। আপনার ছেলের সাথেই যাব। ইনান ঘুম, ওকে কী আপনার কাছে রেখে যাব?”

“দু’দিন পরপর কিসের এত কেনাকাটা? সেদিনও তো কত কিছু কিনে নিয়ে এলে। আজকে আবার কী কিনবে? কিছু লাগলে আরিফকে বলে দাও। ও নিয়ে আসবে।”

“আমার জিনিস হলে ওকে বলতে সমস্যা ছিল না। হিমির জন্য কিনতে হবে। মেয়েলী ব্যাপার, তাই আমাকে বলেছিল। আশা করি বুঝতে পারছেন।”

“ওহ! ঠিক আছে যাও। তাড়াতাড়ি চলে আসবে। দেরি করবে না।”

মাথা দুলিয়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস গোপন করলাম। মানুষ কত অদ্ভুত!

বাইরে বেশ গরম। অটোরিকশায় বসে আছি। গায়ে বাতাস লাগছে। তবুও গরম কমছে না। আরিফ বলল, “এত বড় মার্কেটে অনেক দোকান। কতগুলোয় খোঁজ করব?”

হামজা বলল, “কাজ না হওয়া পর্যন্ত যতগুলো দোকান দেখতে হবে, দেখব।”

আরিফ কিছু বলল না। বাইরে তাকিয়ে রইল। অটোওয়ালা বলল, “কাপড় কিনবেন নাকি?”

আমি একটু হেসে বললাম, “হ্যাঁ, বাচ্চার কাপড়। একজনের গায়ে দেখে পছন্দ করেছে। সে বলছে সব দোকানে পাওয়া যায় না। তা-ই।”

“ওহ! মার্কেটের শেষ মাথায় একটা নতুন দোকান উঠেছে। গিয়ে দেখতে পারেন। ওইখানে সব পাওয়া যায়।”

উনার কথায় প্রথমে সেই দোকানেই গেলাম। কয়েকটা ছেলে দোকানের মধ্যে বসে ঝিমাচ্ছে। আমাদের দেখে হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। হড়বড় করে বলল, “কি লাগবে বলুন। আমাদের এখনে সব আছে।”

আরিফ গম্ভীর মুখে শার্টটা ওদের দেখাল। বলল, “এমন শার্ট পাওয়া যাবে?”

ছেলেটা শার্ট হাতে নিলো। একটু সময় নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল।

“না স্যার, এমন শার্ট আমাদের এখানে পাওয়া যায় না। এর বাইরে অন্যকিছু দেখাব?”

“প্রয়োজন নেই।”

ছেলেটা বিরক্ত চোখে তাকাল। দুপুরের ভাতঘুম ভেঙে যাওয়ায় সে বেশ বিরক্ত। তারপর কিছু বিক্রি হয়নি। বিরক্ত হবারই কথা। দশ-বারোটা দোকান ঘুরেও শার্টের হদিস করতে পারলাম না। হামজা বেশ ক্লান্ত গলায় বলল, “এভাবে হবে না। অন্য উপায় বের করতে হবে।”

“কি করতে চাইছেন?”

“যা চোখে দেখবেন তা কানে শোনার দরকার কি? আসুন আমার সাথে।” বলেই সে নিজের শার্টের কলার টানল। আরিফ হিসহিসিয়ে বলল, “ভাব দেখলে মনে হয় সিনেমার শুটিং করছে।”

আমি ওর দিকে হাসলাম। সে আড়চোখে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না।

হামজা বাজারের সবচেয়ে বড় দোকানে ঢুকল। শার্ট দেখিয়ে বলল, “এটা কি আপনার দোকান থেকে কেনা?”

একজন কর্মচারী এগিয়ে এসে শার্ট দেখল। সহজ গলায় বলল, “স্যার, বাজারের সবচেয়ে বড় দোকানটা আমাদের। প্রতিদিন হাজার হাজার টাকার কাপড় বিক্রি হয়। সামান্য একটা শার্টের কথা আলাদাভাবে মনে রাখা সম্ভব না।”

হামজা একটু হাসল। পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে ছেলেটাকে দেখাল।

“পুলিশের লোক। তদন্ত করছি। তোমার বসকে ডেকে এসো। কুইক!”

ছেলেটা মেকি হেসে এক ভদ্রলোককে ডেকে নিয়ে এলো। লোকটার চেহারা বেশ চমৎকার। হাস্যজ্জ্বল মুখে চিন্তা ছাপ। সে বিনয়ের সঙ্গে বলল, “কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”

হামজা গম্ভীর গলায় বলল, “এই শার্ট কি এই দোকানের?”

ভদ্রলোক শার্ট দেখল। বেশ ভালো করে দেখল। সহজ গলায় বলল, “না স্যার। এমন শার্ট আমাদের দোকানে নেই। আজ-কাল এসব কেউ পরে না। খুব বেশি বিক্রি হয় না, তাই রাখি না।”

“বাজারের কোন দোকানে পাওয়া যায় বলতে পারবেন?”

“ইমম! এখান থেকে সোজা গিয়ে বামে একটা দোকান আছে। ওর কাছে থাকলেও থাকতে পারে।”

হামজা বেরিয়ে গেল। আমি একটু হেসে অন্য কাপড় দরদাম করতে লাগলাম। আরিফ বলল, “চাইলে কিনতে পারো।”

“দেখছি।”

সময় নষ্ট করলাম না। পছন্দ হচ্ছে না বলে বেরিয়ে গেলাম। হামজা দোকানদারের সাথে কথা বলছে। দোকানদার চিন্তিত মুখে তার কথা শুনছে।

“ঠিকভাবে দেখে বলুন। এটাই সেই শার্ট?”

দোকানদার বলল, “জ্বি স্যার, এটাই সে-ই শার্ট। এক ভদ্রলোক কাপড়টা নিয়েছিল। বাজারের অন্য দোকানেও খুঁজেছে। পায়নি। পরে আমার কাছে এসেছে। অর্ডার দিয়ে গিয়েছিল। দুই সপ্তাহ পরে দিতে পেরেছি।”

“এটা এমন কি শার্ট যে এত করে খোঁজ করছিল?”

“সে কথা তো বলতে পারব না। মোবাইলে ছবি তুলে নিয়ে এসেছিল। বলেছিল– খুব পছন্দ হয়েছে।”

“কতদিন আগের কথা? কে নিয়েছিল বলতে পারবেন?”

“হ্যাঁ, পারব। খাতায় উনার নাম আর মোবাইল নম্বর লেখা ছিল। দেখে বলছি।”

হামজা আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসল। দোকানদার খাতাপত্র ঘেঁটে দেখে বলল, “লোকটার নাম মোহন। এই হচ্ছে মোবাইল নম্বর। বেশ দাম দিয়ে শার্টটা কিনেছিলেন।”

আমি আরিফের মুখের দিকে তাকালাম। সে-ও বেশ অবাক হয়েছে। হামজা নম্বর টুকে নিলো। দোকানদারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি আরিফের সাথে কাপড় দেখতে লাগলাম।
প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে তিনজনে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম। নিরিবিলি দেখে একটা চেয়ারে বসলাম।

হামজা বলল, “দেখলেন তো, সাধারণ মানুষের উপকার করার চেয়ে লোকজন পুলিশের উপকার করতে চায়।”

“উপকার নয়, ক্ষমতার কাছে নত হওয়া পুরনো ব্যাপার। সৃষ্টির শুরু থেকে এই নিয়ম চলে আসছে। এটা এমন এক জিনিস যে জিনিসে মধুর সাথে বি’ষ মেশানো থাকে। মানুষ পতঙ্গের মতো ক্ষমতার পেছনে ছুটতে থাকে। মনুষ্যত্ব, নীতি-নৈতিকতা সবকিছু বিকিয়ে দেয়।”

“ভালো বলেছে। আরিফ ভাই, আপনি বোধহয় মোহনকে চেনেন।”

বিস্মিত গলায় বললাম, “আপনি কিভাবে বুঝলেন?”

“ভাইয়ের মুখ দেখে বুঝতে পেরেছি। যাইহোক, এই কে’সের সাথে তার কোন সম্পর্ক আছে?”

আরিফ বলল, “মোহন আমার কলিগ। কে’সের সাথে সম্পর্ক আছে কি-না জানা নেই। তবে সুরভি আপার সাথে কানেক্টেড ছিল।”

“একটু যদি ব্যাখ্যা করতেন।”

“করব। তার আগে তোমাকে একটা কথা দিতে হবে। এবং বুকে হাত রেখে বলতে হবে– তুমি তোমার কথা রাখবে।”

“কি এমন বলবেন? কি কথা দিতে হবে?”

“এখন আমি যা বলব সে কথা আমার বাবা-মায়ের কাছে বলতে পারবে না। কোন আত্মীয় স্বজনের কাছেও বলতে পারে না। নিজের বুকে দা’ফ’ন করে দেবে।”

“কথা দিচ্ছি। কাউকে বলব না। যা-ই বলেন না কেন– সে-সব আমার সাথে দা’ফ’ন হবে।”

আরিফ তাকে টাকার ব্যাপারে সব বলতে আরম্ভ করল। হামজা খুব আগ্রহ সাথে আরিফের কথা শুনছে, ক্রমশ তার কপাল কুঁচকে যাচ্ছে।

“সবই তো শুনলে। তবে এই শার্টের ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। কেন করেছে তা-ও জানি না।”

“মোহনের সাথে দেখা করতে হবে। সরাসরি কথা বলতে হবে। এমনও হতে পারে সে-ই এই খু’নটা করেছে। আরিফ ভাইয়ের কাঁধে দোষ চাপানোর জন্য উনার মতো শার্ট কিনেছি।”

আরিফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ক্লান্ত গলায় বলল, “মোহনের বাড়ির ঠিকানা জানি। চাইলে এখনও নিয়ে যেতে পারি। তবে আমার মনে হয় ওকে এখন বাড়িতে পাব।”

“অফিসে পাব?”

“সঠিক জানি না।”

আমি বললাম, “তুমি উনাকে কল কেন দিচ্ছ না? মোহন ভাইয়ের সাথে তোমার সম্পর্ক ভালো। দেখা করতে চাইলে নিশ্চয়ই না করবে না।”

হামজা বলল, “সবকিছু এমন সহজ সমীকরণে হবে না। মোহন যদি এসবে জড়িত থাকে– তবে আরিফ ভাই দেখা করতে চাইলেই স’ন্দে’হ করবে।”

“তাহলে এখন কি করতে চাইছেন?”

“সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। রাতে উনাদের বাড়িতে যাব। হুট করে যাব যেন কোন অযুহাত দাঁড় করাতে না পারে।”

আরিফ মাথা দোলালো। আমি বললাম, “ ইনানের আব্বু, আমি একটু হিমির সাথে দেখা করতে যাব৷ ওকে এই জিনিসগুলো দিতে হবে।”

হামজা বলল, “চলুন। আমিও আপনাদের সাথে যেতে চাই। হিমির সাথে কথা আছে।”

তিনজনে রওনা হলাম। বেলা পড়ে এসেছে। হিমির সাথে কথাবার্তা শেষে আর বাড়িতে ফিরলাম না। সোজা মোহনদের বাড়িতে গেলাম। নাইমার কথা শুনে হিমি বেশ খুশি হয়েছে। উজ্জ্বল গলায় বলেছে– এবার আমি নিশ্চিন্ত হতে পারলাম। বাড়ির ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি আওয়াজ আসছে। আরিফ বলল, “এখন যাওয়া ঠিক হবে না।”

হামজা তার কথা শুনল না। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যেতে লাগল। উপায় না দেখে আমরা দু’জনও তার পিছনে যেতে লাগলাম।

মোহন বলল, “আরিফ ভাই! আপনি এখন এখানে? কোন সমস্যা হয়েছে?”

আরিফ মেকি হেসে বলল, “এখান দিয়ে যাচ্ছিলাম। তাই ভাবলাম ঘুরে যাই।”

মোহন কিছু বলবে তার আগে এক মহিলা কথা বলে উঠল। ঝাঁঝালো গলায় বলল, “বাড়ি তো না যেন সরাইখানা। যে যখন খুশি চলে আসছে।”

মোহন তেঁ তেঁ উঠল।

“বাড়ি কি তোর? তোর ইচ্ছেমতো সবাই আসবে?”

“না না, আমার বাড়ি হবে কেন? তোমার বাড়ি, তোমার কথামতো সব চলবে। ভাত রাঁধব, চাল নেই, অথচ চালের বস্তা খুলতে দিচ্ছ না। মনে হচ্ছে চালের বস্তায় হীরা-জহরত লুকিয়ে রেখেছ।”

মোহন তার কথার জবাব দিলো না। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা ভুল সময়ে এসেছেন, আসলে আমার একটু কাজ আছে। এখন কথা বলতে পারছি না। অন্যদিন আসবেন। কেমন?”

হামজা অত্যন্ত তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “আমার মনে হয় আমরা ঠিক সময়েই এসেছি। জানেনই তো আরিফ ভাইয়ের বোন হিমি সুরভির খু’নের দায়ে গ্রে’ফ’তা’র হয়েছে। আমি এই ব্যাপারটা তদন্ত করছি। আপনার চালের বস্তায় কি আছে দেখতে চাই।”

“এটা কোন ধরনের অ’স’ভ্য’তা? লোকের বাড়ি ঢুকে আপনি হু’ম’কি দিতে পারেন না।”

“পুলিশ নিশ্চয়ই পারে। অপেক্ষা করুন। তাদের ডাকছি।”

“সময় নষ্ট করার দরকার নেই। আসুন আমার সাথে। নিজেকে কষ্ট দিবেন না।”

হামজা মোহনের পেছনে গেল। আমরাও গেলাম। মোহন চালের বস্তা উপুড় করে মেঝেতে সব চাল ঢেলে দিলো। বিরক্ত গলায় বলল, “শান্তি হলে এখন যেতে পারেন।”

হামজা বলল, “কথা শেষ হয়নি।”

“বলুন, কি বলতে চান? আমি খু’ন করেছি?”

হামজা তাকে শার্ট দেখিয়ে বলল, “এই শার্টটা আপনার?”

“না আমার না।”

“অর্ডার দিয়ে বানিয়ে এসেছেন, আর এখন বলছেন আপনার না?”

“দেখুন, অবান্তর কথাবার্তা বলবেন না। এই শার্ট আমার না।”

“তাহলে এই মোবাইল নম্বরটা কার?”

“আমার।”

“অদ্ভুত ব্যাপার! শার্ট আপনার না। আপনি কেনেনি। কিন্তু অর্ডারের সাথের নাম আপনার, মোবাইল নম্বর আপনার।”

“জানি না। জানতেও চাই না। আপনারা এখন আসতে পারেন।”

হামজা কিছু বলবে তার আগে সে তাকে থামিয়ে দিলো। স্পষ্ট গলায় বলল, “পুলিশের ভয় দেখিয়ে কোন লাভ হবে না। ইচ্ছে করলে তাদের সবকিছু বলে দিতে পারেন। তাছাড়া আপনারা না বললেও আমি বলব। রাত দুপুরে এভাবে হ’য়’রা’নি করার জন্য ক্ষমা করব না। আরিফ ভাই! আপনার থেকে এটা আশা করিনি।”

আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না। আরিফের সাথে বেরিয়ে এলাম। আমরা বেরিয়ে আসার পরপরই বাড়ির ভেতরে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হলো। মোহন নামের লোকটা খুব কুৎসিত ভাষায় বউকে গা’লি’গা’লা’জ করছে, বোধহয় গায়ে হাত তুলছে। মহিলার কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সে-ও সমানে কথার জবাব দিচ্ছে।

পথে কেউ কোন কথা বললাম না। বাড়ি ফিরে দেখি শাশুড়ি মা মুখ গোমড়া করে বসে আছে। ভেবেছিলাম ঝগড়া করবে কিন্তু তিনি তেমন কিছু বললেন না। হিমির ব্যাপারে জানতে চাইলেন শুধু। রাতে বেশ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। আজ খুব ক্লান্ত লাগছে। ঘুম চোখ বুঁজে আসছে।

সকাল সকাল নাইমার কল পেলাম। সে বেশ শান্ত গলায় বলল, “আপনাদের সাথে কথা আছে। কোথায় দেখা করবেন?”

“তুমি কোথায় দেখা করতে চাইছ?”

“আগেরদিন যেখানে দেখা করেছিলাম ওখানে আসলে আমার জন্য একটু সুবিধা হতো। এর বাইরে আপনাদের পছন্দ থাকলেও বলতে পারেন।”

“সমস্যা নেই। আমরা আসছি। কখন আসব?”

নাইমার সময় বলে কল কেটে দিলো। নাইমার কথা বলতেই হামজা বেশ উৎসাহ দেখাল। আরিফ বলল, “আজ আমি যেতে পারব না। অফিসে যেতে হবে। কাজ আছে। তানজিলা তুমি হামজার সাথে চলে যেতে পারবে? দরকার হলে আমি তোমাদের নামিয়ে দিতে পারব। তবে থাকতে পারব না।”

যদিও ইচ্ছে করছিল না, তবুও হ্যাঁ বললাম। সকালের খাওয়া শেষে বের হলাম। ঘুরতে বেরিয়ে ইনান বেশ খুশি। হাসছে। আধফোটা বুলিয়ে নানান কথা বলছে।

নাইমা বলল, “সুরভি যে বাড়িতে থাকত, আমি সেখানে গিয়েছিলাম।”

হামজা বলল, “কিভাবে গেলেন? আর সেখানে কি হয়েছে?”

“সেখানে তেমন কিছু হয়নি। বাসা ভাড়ার অযুহাতে গিয়েছিলাম। বাড়ির মালিক বলল– বাসা খালি নেই। পরে আসতে। উনাকে বেশ কয়েকবার অনুরোধ করার পর চিলেকোঠার একটা ঘর দেখালেন।”

“এতটুকুই? এর জন্য এখানে ডেকে এসেছেন! আমি তো ভাবলাম, সবকিছুর সমাধান করে ফেলেছেন।”

নাইমা তার কথায় গুরুত্ব দিলো না। আমার দিকে ফিরে বলল, “আমি একটা জিনিস খেয়াল করেছি। ওই বাড়ির প্রতিটা বাসায় বেশ কয়েকটা জানালা আছে। আপনারা সেদিন যেখানে বসে খাবার খাচ্ছিলেন সেই ঘরে কি জানালা ছিল?”

মনে করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছু মনে পড়ল না। মলিন গলায় বললাম, “খেয়াল নেই৷ ঠিক বলতে পারছি না।”

নাইমা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। হামজা বলল, “দোতলায় জানালা দিয়ে খু’ন? এমন আজগুবি কথা কেউ কী কখনো শুনেছে? খু’নি নিশ্চয়ই ভূত ছিল। হা হা হা।”

নাইমা বেশ রাগী গলায় বলল, “আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন। জানালা দিয়ে খু’ন করা কি অসম্ভব কিছু?”

“সে কথা থাক। শুনেছি নতুন কারো সাথে পরিচিত হলে আপনি তাকে চকলেট দেন। আমাকে তো দিলেন না।”

নাইমা ব্যাগ থেকে চকলেট বের করে হামজার দিকে বাড়িয়ে দিলো। সহজ গলায় বলল, “আমি কখনো আপনার সাথে পরিচিত হয়নি।”

হামজা মুচকি হাসল। চকলেট নিতে নিতে বলল, “হামজা।”

নাইমা তার কথার জবাব দিলো না। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল, “জানালা দিয়ে খু’ন– এটা কোন নতুন ব্যাপার না। হাত ভালো হলে বেশ দূর থেকেও নিশানায় আ’ঘা’ত করা যায়।”

“এখন তুমি কি করতে চাইছ?”

“আর একবার ওই বাড়িতে যেতে চাই। আগেরদিন ভালো করে দেখতে পারিনি। মকবুল সাহেব সাথে ছিলেন।”

হামজা উঠে দাঁড়াল। ব্যস্ত গলায় বলল, “চলেন তাহলে। গিয়ে দেখি, আপনার কথা কতটা ঠিক।”

নাইমা কথা বাড়াল না। তিনজনে মকবুল সাহেবের বাড়ির সামনে নামলাম। নাইমা বলল, “আপু, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবেন আমরা বাসা খোঁজ করছি।”

মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বললাম। হামজা বিরক্তি নিঃশ্বাস ফেলল। নাইমা চারপাশ দেখতে দেখতে বলল, “সুরভির বাসা ওইপাশে। তার বাসার এদিকে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। ছোট একটা মাঠের মতো। ওখানে গিয়ে দেখতে চাই।”

মাঠটা বেশ ছোট। ফাঁকা জায়গা বলা চলে। বেশ কয়েকটা গাছ আছে। নাইমা গাছগুলো ধরে দেখতে লাগল। হামজা বলল, “ভাব দেখে মনে হচ্ছে গাছের সাথে কথা বলছে।”

আমি বললাম, “আপনার কি কোন সমস্যা হচ্ছে? সমস্যা হলে যেতে পারেন। অহেতুক ওর কাজে ভুল ধরছেন কেন?”

সে কথার জবাব দিলো না। নাইমা বলল, “এখানে কেউ আছে। মনে হচ্ছে কেউ আমাদের অনুসরণ করছে।”

“কে অনুসরণ করবে? আর কেনই বা করবে?”

“জানি না আপু। তবে কেউ আছে।”

হামজা বলল, “আপনি কিভাবে বুঝলেন কেউ আছে?”

“আতরের গন্ধ পাচ্ছি। খুব হালকা তবে আছে। বাতাসে মিশে আছে।”

“বাবাহ! এত তীক্ষ্ণ নাক? চার পায়ে কোন প্রাণীর নাকও এমন তীক্ষ্ণ।”

নাইমা শীতল চোখে তাকাল। শান্ত গলায় বলল, “আপনি কি আমায় নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছেন? এমনটা ভাবলে ভুলে যান। আমি প্রফেশনাল কোন গোয়েন্দা নই। তেমন কিছু বুঝিও না। শুধু হিমি কথায় এসব করছি। ওর শুভাকাঙ্ক্ষী হিসাবে। এর বেশি কিছু নয়।”

হামজা কিছু বলল না। নাইমার দিকে তাকিয়ে রইল৷

চলবে