বাতাস বলে দেয় পর্ব-২২ এবং শেষ পর্ব

0
13

#বাতাস_বলে_দেয়
#ফারহানা_কবীর_মানাল

(শেষ অংশ)
আরিফ বলল, “এসব পরিকল্পনার ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম না। রোজকার মতো সেদিনও অফিসের জন্য বেরিয়েছিলাম। অফিসের গেট পর্যন্ত আসতেই মোহন আমাকে ডেকে নিয়ে গেল। তার সাথে একটা ক্যাফেতে গিয়ে বসলাম। মোহন কফির অর্ডার করল। কফি খাওয়ার পরপরই মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করতে লাগল। তারপর আর কিছু মনে নেই। যখন চোখ খুলল– তখন আমি হাত-পা বাঁ’ধা অবস্থায় পড়ে আছি। পুরনো আসবাবপত্রে ঠাঁসা একটা ঘরে, আশেপাশে কেউ নেই। জানালার ফাঁক ফোকড় গলে সামান্য দিনের আলো ঢুকছে। ওভাবেই চব্বিশ ঘন্টার বেশি পড়ে ছিলাম। খিদেয় তেষ্টায় ম’রি’ম’রি অবস্থা। তারপর মুখ ঢাকা একজন লোক খাবার পানি দিয়ে গেল। শাসিয়ে বলল– পালানোর চেষ্টা করবি না। তোর জন্য বড়সড় কাজ অপেক্ষা করছে।”

দারোগা সাহেব বললেন, “তারপর কি হলো?”

“তারপর, ওরা বলল– ইনান হাসপাতালে। ওকে বি’ষ দেওয়া হয়েছে। বাঁচাবে কি-না এটা আমার উপর নির্ভর করে আছে। যদি আমি ওদের কথা মেনে নিই তাহলেই ইনান বাঁচতে পারব এবং ওরা আমার সমস্ত লোন শোধ করে দেবে। আমার মনে হয়েছিল– এটাই একমাত্র পথ। এমনিতেই সবকিছু হারিয়ে পথে বসতাম। আমার জীবনের বিনিময়ে যদি পরিবারের সবাই ভালো থাকতে পারে তাহলে ক্ষতির কিছু নেই। তাছাড়া আমি একটা অপদার্থ! আমি না থাকলে পৃথিবীর কোন ক্ষ’তি হবে না।”

“এসব কাজ কারা করেছে সে ব্যাপারে আপনি কিছু জানতেন না?”

“না, আমি এসবের কিছু জানতাম না। আমার সাথে যারা কথা বলত তাদের কেউই আমার পরিচিত নয়। ওদের মুখ ঢাকা থাকত। চেহারার গড়ন, কণ্ঠস্বর কোন কিছুই পরিচিত নয়।”

দারোগা সাহেব ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। আরিফ বলল, “তারপর এই চিঠি, গিফট এসবের ব্যাপারেও আমি কিছু জানতাম না।”

“জানতেন না? কিন্তু ওগুলো তো আপনার হাতে লেখা। এমন নয় তো যে আপনি এখনও আমাদের মিথ্যে বলছেন?”

“না, আমি যা বলছি সবকিছুই সত্যি। চিঠি দু’টো আমি লিখেছি তবে উদ্দেশ্য ভিন্ন ছিল। অফিসে কাজের ফাঁকে ট্রুথ এন্ড ডেয়ার নামে একটা খেলা খেলে ছিলাম। সেখানে আমাকে ওমন দু’টো চিঠি লিখতে বলা হয়েছিল। এমন কিছু হতে পারে কখনো কল্পনাও করিনি।”

“বেশ ভালো।”

নাইমা বলল, “ইনানকে কে বি’ষ দিয়েছে? শহিদুল সাহেব, আপনি দিয়েছেন?”

শহিদুল হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। নাইমা বলল, “আসলেই কি আপনি দিয়েছেন নাকি কেউ আপনাকে সাহায্য করেছে? সুমি আপু এসব করেনি তো?”

শহিদুল বললেন, “সুমি আমার কথামতো কাজ করেছে শুধু। এখানে তার কোন দায়বদ্ধতা নেই।”

নাইমা অল্প হাসল। সরল গলায় বলল, “জানি না আপনি কেন সুমিকে বাঁচাতে চাইছেন। তবে আমার জানামতে এই কাজের সাথে সে জড়িত আছে৷ এমন কি অ্যান্টিমনি পটাসিয়াম টারট্রেটের বুদ্ধিটাও উনার মাথা থেকেই এসেছে।”

সুমি খেঁকিয়ে উঠল।

“এই মেয়ে! অহেতুক দো’ষ দিবে না। কি প্রমাণ আছে তোমার কাছে?”

নাইমা বলল, “আপনি রসায়ন বিভাগ থেকে অনার্স শেষ করে ফরেনসিক সায়েন্সে মাস্টার্স শেষ করেছেন। এসব যৌগের ব্যাপারে আপনার চেয়ে ভালো আর কে বুঝবে? তাছাড়া ‘অ্যান্টিমনি পটাসিয়াম টারট্রেট’ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে থাকা কেমিক্যাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাওয়া যায়। আপনার বড় বোন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার না? সেখানে একটু খোঁজ নিলেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। তাছাড়া এখানে আমার মুখের কথার কোন দাম নেই। সিদ্ধান্ত যা নেওয়ার আদালত নিবে।”

সুমি সত্যিকার অর্থে নিভে গেল। দারোগা সাহেব বললেন, “তাহলে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। শহিদুল সাহেব, মোহন এবং সুমিকে হেফাজতে নেওয়া হলো। আদালত খুব তাড়াতাড়ি এই কে’সের সিদ্ধান্ত শোনাবে। আরিফ সাহেব আপনার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত শোনানো হবে। প্রশাসনকে মিথ্যা তথ্য দেওয়াও একটা অ’প’রা’ধ। মকবুক সাহেব আপনাকেও গ্রে’ফ’তা’র করা হচ্ছে। শেষ বয়সে টাকার জন্য মান-মর্যাদা সবই হারালেন।”

আরিফ মাথা নিচু করে ফেলল। মকবুল সাহেব বললেন, “আমাকে মাফ দেন। টাকার জন্য অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি৷ আমি সব টাকা ফিরিয়ে দেব৷ দরকার হয় আরও বেশি দেব। আমাকে ছেড়ে দেন।”

দারোগা সাহেব তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। হামজার চোখ চকচক করছে। রোহান হালকা উৎফুল্লভাব নিয়ে এদিক-ওদিক দেখছে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে খুব মজা পাচ্ছে।

থানা থেকে বের হওয়ার পর হামজা নাইমার কাছে গেল। সরল গলায় বলল,“আপনি বেশ বুদ্ধিমান। ভবিষ্যতে যদি আবারও একসাথে কাজ করার সুযোগ পাই হাতছাড়া করব না। বরং আমার সৌভাগ্য মনে করব।”

নাইমা লম্বা শ্বাস নিলো। শান্ত গলায় বলল, “আর কখনো দেখা হোক তা চাই না। হিমিকে নির্দোষ প্রমাণ করতে অনেক সাহায্য করছেন। আরিফ ভাইয়ের ব্যাপারেও সাহায্য করেছেন। সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন। শুভ কামনা রইল।”

হামজা হাসিহাসি মুখ করে তাকাল। মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল, “আপনার জন্যও শুভ কামনা রইল।”

কথাগুলো বলতে গিয়ে তার মুখের হাসি মুছে গেল। সে ব্যস্ত পায়ে সামনের দিকে হেঁটে যেতে লাগল। হঠাৎই তার মন খারাপ হয়ে গেছে। চোখ জ্বালা করছে। চোখে পানি আসার আগে এমন করে চোখ জ্বালা করে।

রোহান বলল, “ভদ্রলোক এভাবে চলে গেল কেন? ওকে ফিরিয়ে দিয়েছ হ্যাঁ?”

নাইমা তার দিকে তাকাল। সরু গলায় বলল, “এই কে’সে আপনার আগমন বেশ রহস্যময়। হঠাৎ করে চলে এসেছেন। তারপর সবকিছুতে ছিলেন? কে আপনি? কেন এত সময় নষ্ট করছেন?”

রোহান মাথা চুলতে হাসল। চিকন গলায় বলল, “যদি বলি– কোন কারণ ছাড়াই এসব করেছি। তুমি কি বিশ্বাস করবে?”

“একদমই না। কখনো বিশ্বাস করব না।”

“গোয়েন্দাদের এই এক স্বভাব। সবকিছুতেই স’ন্দে’হ করে। যাইহোক, সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তোমার এখন বাড়ি ফেরা উচিত।”

“আপনি আমার কথার জবাব দেননি।”

“জবাব চাই হ্যাঁ? তাহলে আগামীকাল বিকেলে নদীর পাড়ে ওই চায়ের দোকানে এসো। তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেব।”

নাইমা বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তানজিলা বলল, “নাইমা তুমি এত পেছনে পড়ে গেলে কেন? তাড়াহুড়ায় তোমার সাথে কথাই বলা হলো না।”

“সমস্যা নেই আপু। একটু ক্লান্ত লাগছে। বাড়ি ফিরব।”

“ওহ আচ্ছা! তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসব? আমাদের জন্য তুমি যা করলে, কি বলে যে তোমায় ধন্যবাদ দেব!”

“ঠিক আছে৷ আমি তেমন কিছুই করিনি। যতটুকু যা করতে পেরেছি সবটাই হিমির জন্য৷ ও-ই আমাকে ডাকতে বলেছিল৷ এতদিনে দৌড়ঝাঁপ আজ শেষ। এরপর আর অপেক্ষা করতে হবে না। দুশ্চিন্তায় কা’টা’তে হবে না। এই কে’স থেকে আমার ছুটি মিলল।”

তানজিলা নাইমার হাত ধরল। অসম্ভব কোমল গলায় বলল, “তোমার দাওয়াত রইল। একদিন আমাদের বাড়িতে আসবে। তোমার ভাইয়া ভাবীকেও নিয়ে আসবে। আমি নিজে গিয়ে তোমাদের নিয়ে আসব।”

নাইমা হাসল। ইনানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “ডাক্তার যা যা বলেছি সবকিছু খুব যত্নসহকারে মেনে চলবেন।”

কথাগুলো বলেই সে অটোরিকশা উঠে গেল। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে৷ পশ্চিম আকাশ বেশ লাল। লাল রোদের মাঝে কালো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। চমৎকার লাগছে দেখতে।

সন্ধ্যা মিলিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। হিমি ইনানকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে৷ রেশমা বেগম বললেন, “অবশেষে আল্লাহ রহমত করেছেন। বৃহস্পতিবার শুনানি শেষ হলে আমি নফল রোজা রাখব।”

তানজিলা আঁড়চোখে শাশুড়ির দিকে তাকাল। কিন্তু কিছু বলল না। তার জীবনের অনিশ্চয়তা কে’টে গিয়েছে৷ হিমি বাড়ি ফিরে এসেছে। আরিফ নির্দোষ। খু’নের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। ইনানও আগের চেয়ে সুস্থ। এর চেয়ে ভালো আর কি-ই বা হতে পারে? কিন্তু আসলেই কী তাই? বাড়ির দলিলপত্র এখনও ব্যাংকে জমা। টাকারও কোন হদিস নেই। এই বাড়ি ছাড়তে হলে তারা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

বৃহস্পতিবার সকাল,
তানজিলা বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাত চালাচ্ছে। আজ কে’সের শুনানি। দেরি করা যাবে না। সে তড়িঘড়ি করে সব কাজ শেষ করতে চাইছে, পারছে না৷ যত তাড়াতাড়ি করতে যাচ্ছে, ততই যেন দেরি হয়ে যাচ্ছে।

হিমি বলল, “ভাবী, তুমি এত তাড়াহুড়ো করো না। এখনও অনেক সময় বাকি।”

“তোমার ভাইয়ের জন্য একটু খাবার বানাচ্ছি। ওখানে কি খেয়ে থাকছে কে জানে। জিজ্ঞেস করলে ঠিকভাবে বলে না। এড়িয়ে এড়িয়ে যায়।”

“চিন্তা করো না। আজকেই হয়তো বাড়ি ফিরে আসবে। তখন ভালোমন্দ রান্না করে খাওয়াবে।”

“সে না হয় বুঝলাম। ইনান কি করছে?”

“ইনান আব্বুর সাথে খেলছে। তোমার কিছু লাগলে বলো। আমি করে দিচ্ছি।”

“লাগবে না। এইতো সব হয়ে এসেছে। ওহ ভালো কথা! নাইমা কি কোর্টে আসবে?”

“জানি না। কল দিয়েছিলাম। বলল– ওর শরীরটা ভালো লাগছে না। তবে আসার চেষ্টা করবে।”

তানজিলা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। হাতের কাজ শেষ করে তৈরি হতে চলে গেল। গা কুটকুট করছে। গোসল না করলে স্বস্তি পাবে না।

নাইমা বিছানায় শুয়ে আছে। তার শরীরটা বেশি ভালো না। হালকা জ্বর, সামান্য মাথা ব্যাথা করছে। হয়তো মনটাও একটু খারাপ। তবে সে-কথা সে স্বীকার করছে না। এতটুকু কারণে তার মন খারাপ হবে এই ব্যাপারটাই যেন মানতে পারছে না।
সে সেদিন বিকেলে নদীর পাড়ে গিয়েছিল। সারা বিকেল অপেক্ষা করেছে। রোহান আসেনি। তারপরেও অনেক জায়গায় তার খোঁজ করেছে। থানার সামনের রাস্তায়, হাসপাতালে। কোথাও তার খোঁজ পায়নি৷ যেন সে কপ্পুরের মতো উবে গিয়েছে। নাইমা পাশ ফিরে বালিশ জড়িয়ে ধরল। বিড়বিড় করে বলল, “একটা মানুষ কি এভাবে হারিয়ে যেতে পারে? এমন নয় তো যে তার কোন ক্ষ’তি করেছে!”
সে ভাবতে চাইল না। চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল। তার গা আবারও গরম হয়ে উঠেছে। কেমন যেন শীত শীত করছে। বোধহয় জ্বর বাড়ছে।

বিচারকের চেহারায় ভারিক্কি ধরনের ছাপ আছে। বেঁটেখাটো এক বৃদ্ধ। গোলগাল চেহারা। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। চুল দাঁড়ি সব পেকে গিয়েছে। তিনি গ্লাসের ঢাকনা সরিয়ে সামান্য পানি পান করলেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “সবকিছু খুব যত্নসহকারে বিবেচনা করে দেখেছি। অর্থের লোভ মানুষকে অন্ধ করে দেয়। যে যত শক্তিশালী এবং ক্ষমতাবান হয় তার পরিনতিও ততটা ভ’য়ং’ক’র হয়। আরিফ সাহেব, আপনি আমাদের ত’দ’ন্তে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন, যার ফলে আমরা ভুল পথে সময় নষ্ট করেছি। আপনি জানেন, এটি ১৮৬০ সালের দ’ণ্ড’বি’ধি’র ১৮২ ধারায় শা’স্তি’যো’গ্য অ’প’রা’ধ। এই অ’প’রা’ধে তিন মাস কা’রা’দ’ণ্ড বা দশ হাজার টাকা জ’রি’মা’না করছি।”

আরিফ মাথা নিচু করে রইল। তানজিলার চোখ টলমল করছে৷ সে ভেবেছিল– আরিফ আজ ছাড়া পেয়ে যাবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। তিন মাসের অপেক্ষা বাড়ল।

বিচারক সাহেব কলম হাতে নিয়ে কিছু লিখলেন। শহিদুল আলমের দিকে তাকিয়ে বললেন, “হ’ত্যা’কা’ণ্ডের জন্য দ’ণ্ড’বি’ধি’র ৩০২ ধারায় মৃ’ত্যু’দ ণ্ডে দ’ণ্ডি’ত, প্র’তা’র’ণার দায়ে ৪২০ ধারায় ৭ বছরের স’শ্র’ম কা’রা’দ’ণ্ড ও ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা জ’রি’মা’না, এবং মা’দ’ক’দ্র’ব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৬(১) ধারায় আজীবন কা’রা’দ’ণ্ড ও ১ লক্ষ টাকা জ’রি’মা’না প্রা’প্ত হয়েছেন। খুব দ্রুত এই রায় কার্যকর করা হবে। এবং আপনার অফিসের যে সকল কর্মচারীদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন সবাইকে তাদের প্রাপ্ত টাকা বুঝিয়ে দিবেন৷ এবং আপনার সকল অবৈধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হলো।”

তিনি একে একে অন্যদের ব্যাপারেও রায় ঘোষনা করলেন। শহিদুল শান্ত চোখে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ-মুখে বিরক্তি এবং ভীতির ছাপ স্পষ্ট। ভদ্রলোক বেশ ভালোই চলছিলেন। তবুও কেন এসবে জড়িয়ে গেলেন। ওই কথাটা বোধহয় ঠিক– সত্যি কখনো লুকিয়ে রাখা যায় না। কর্মফল ভোগ করতেই হয়।

রেশমা বেগম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “তিনমাস দেখতে দেখতে চলে যাবে৷ বড় কিছু হয়নি তাই রক্ষা। টাকাও পাওয়া গিয়েছে। বাড়ি নিয়ে আর কোন চিন্তা রইল না।”

আকরাম সাহেব তার গায়ে হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে দিলেন। শুনানি শেষে হামজা বলল, “অনেকদিন হলো এখানে এসেছি। আজ আমায় ফিরতে হবে৷ আব্বা কল দিয়েছিল বাড়িতে কিছু কাজ পড়ে গেছে।”

রেশমা বেগম বললেন, “আর কয়টা দিন থেকে গেলে ভালো হতো না? এতদিনের নানান তালবাহানায় সেভাবে যত্নআত্তি করতে পারিনি।”

হামজা বলল, “আবার আসব খালা। ক’দিন পর এসে ঘুরে যাব৷”

তিনি আর কথা বাড়ালেন না। আকরাম সাহেব হামজার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিলেন৷ দু’দিন ধরে তিনি এই খাম পকেটে গিয়ে ঘুরছেন। দেওয়ার সময় করে উঠতে পারছেন না। অবশেষে আজকে দিলেন। তার নিজেকে অনেকটা হালকা মনে হতে লাগল।

দিন যায় না যেন পানি যায়। দেখতে দেখতে তিন মাস শেষ। অপেক্ষার প্রহর শেষে তানজিলা আজ জে’লখানার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে৷ খানিকক্ষণ বাদেই আরিফ ফিরবে। চিরকালের মতো তার কাছে ফিরবে। একটা মেয়ের কাছে এর চেয়ে সুখের মুহূর্ত আর কি হতে পারে? সংসারে তো ওঠাপড়া লেগেই থাকে, সবকিছু মানিয়ে গুছিয়ে সময় পার করে দেওয়ার নামই তো জীবন।

আরিফ ফিরল হাসিমুখে। ফিরেই ইনানকে কোলে নিয়ে অসংখ্য চুমু খেতে লাগল। তানজিলা বলল, “তোমার শরীর ভালো আছে?”

আরিফ তার দিকে হাসল। সিন্ধ কোমল হাসি। সে হাসি দেখতে ভালো লাগে। রেশমা বেগম চোখে পানি নিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। আকরাম সাহেব মুখ গম্ভীর করে রেখেছেন। তবে তিনি নিজের খুশি চাপা দিতে পারছেন না। তার চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে। হিমি ক্রমাগত হাসছে। নানান কথা বলছে।
যেন গোটা পরিবার নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। গ্রীষ্মের তাপদাহে পু’ড়ে যাওয়া বৃক্ষ যেমন বৃষ্টির পানিতে সতেজ হয়ে যায়। তেমনই আরিফের ফিরে আসায় গোটা পরিবার হেসে উঠেছে। সবাই কথাবার্তা বলছে, হাসছে।

খানিকটা দূর থেকে একজোড়া চোখের মালিকও তাদের দেখছে৷ তার চোখের দৃষ্টি বেশ তী’ক্ষ্ণ এবং ঘৃ’ণায় পরিপূর্ণ। হাতের আঙুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। চোখের মালিক নিজের চোয়াল শক্ত করে ফেলল। হিসহিসিয়ে বলল, “যতখুশি হেঁসে নাও। সুখ বেশিদিন সহ্য হবে না।”

সমাপ্ত