বাবুইপাখির অনুভূতি পর্ব-০১+০২+০৩

0
542

#বাবুইপাখির অনুভূতি
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🕊️
— পর্বঃ০১+০২+০৩
_________________

ভরা বিয়ে বাড়ির মধ্যে ফাঁকা একটা রুমে ভয়ে জড়সড় হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি আমি। ভয়ে হাত পা কাঁপছে প্রায়। না জানি সামনের রক্তিম বর্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকা ছেলেটি কি করে আমার সাথে। এই সব হয়েছে ওই বদমাশ বাচ্চাটার জন্য কাকে বলেছি লাভ লেটারটা দিতে আর কাকে দিয়েছে ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে কয়েকটা থাপ্পড় দিয়ে আসি। কিন্তু এখন কে বাঁচাবে আমায়?’

কিছুক্ষণ আগে…

আজ আমার বান্ধবী রিনির বোনের বিয়ে। সেই উপলক্ষেই বিয়ে বাড়িতে আসা। অবশ্য এই একটা কারন বললে একটু ভুল হবে ভেবেছিলাম আজ আমার প্রান প্রিয় ছোট বেলার ভালোবাসার মানুষ নীরব ভাইয়াকে লাভ লেটার দিয়ে প্রপোজ করবো। সেই অনুযায়ী নীরব ভাইয়ার জন্য একটা লাভ লেটার লিখেছিলাম আমি। কিন্তু কে জানতো এই লাভ লেটারই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। ভাইয়াকে নিজ হাতে লাভ লেটার দেওয়ার সাহস হচ্ছিল না তাই একটা ছোট্ট বাচ্চাকে দিয়ে লাভ লেটারটা পাঠিয়ে ছিলাম নীরব ভাইয়ার দিকে কিন্তু বান্দর বাচ্চাটা ভুল করে নীরব ভাইয়ার জায়গায় অন্য একটা ছেলেকে লেটারটা দিয়ে দিল। ব্যস হয়ে গেলো কাগজের উপরে লাভ লেটার লেখা দেখেই ছেলেটি তো রাগে আগুন বাহিরে সবার সামনে সিনক্রিয়েট করতে চাইনি তাই ফাঁকা রুমে নিয়ে এসে দাঁড় করালো আমায়।

বর্তমানে…

কথাগুলো একের পর এক মাথায় আসতেই ভয়ে ঢক গিলে তাকালাম আমি সামনের ছেলেটির দিকে। চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই গিলে ফেলবে আমায়। আমার ভাবনার মাঝেই সামনের ছেলেটি রাগী কন্ঠ নিয়ে বললো,

‘ তোমার সাহস কি হলো এই ‘আদ্রিয়ান মাহামুদ’ কে লাভ লেটার দেওয়ার?’

ছেলেটির কন্ঠ শুনে ভয়ে আত্মা কেঁপে উঠলো আমার। এখন কি বলবো আমি সত্যিটা বলে দেই কিন্তু যেভাবে রেগে আছে আমার কথাগুলো বিশ্বাস করবে তো। আমাকে চুপ থাকতে দেখে আবারো রেগে বললো ছেলেটি,

‘ হোয়াই আর ইউ ডোন্ট টক টু মি, ইস্টুপিট লেডি?’

আদ্রিয়ানের কথা শুনে ভয়ে কেঁপে উঠল ‘আহি’। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বললো সে,

‘ আসলে?’

‘ হোয়াট রাবিশ কুইকলি এনসার মি?’

এবার তো পারে আহি কান্নায় নিচে গড়িয়ে পড়ে। ভীষণভাবে কান্না পাচ্ছে তাঁর। এ কোন মহা বিপদে পড়লো সে। আহিকে এখনও চুপ থাকতে দেখে রাগে আগুন জ্বলছে আদ্রিয়ানের মাথায়। প্রচন্ড রেগে আছে না জানি রাগের বসে কি করে সে?’ আহি বুঝতে পারছে না সামান্য একটা লাভ লেটারটারের জন্য কেউ এতটা রেগে যায় নাকি। আদ্রিয়ান রেগে আহির দিকে এগোতে এগোতে বললো,

‘ তুমি কথা বলছো না কেন? হোয়াই এনসার মি?’

আদ্রিয়ানের কাজে ভয়ে পিছিয়ে যায় আহি। এক পর্যায়ে পিছাতে পিছাতে দেয়ালের সাথে লেগে যায় আহি। আহি প্রচন্ড ভয় পেয়ে বলে উঠল,

‘ বিশ্বাস করুন আমার কোনো দোষ নেই সব ওই বাচ্চাটার দোষ আমি তো…

আহি আর কিছু বলার আগেই আদ্রিয়ানের ফোনটা বেজে উঠল। আদ্রিয়ান বেশি কিছু না ভেবেই ফোনটা হাতে নিলো উপরে তার বন্ধু নিলয়ের নাম দেখে ফোনটা তুললো সে তারপর বললো,

‘ হ্যালো।’

‘ কি করছিস আদ্রিয়ান তাড়াতাড়ি বাহিরে বেরিয়ে আয় মেয়েটার হয়তো তোকে ভালো লেগেছে তাই লাভ লেটারটা দিয়েছে বিয়ে বাড়িতে এই রকম একটু আকটু হয় তুই রাগ করিস না তাড়াতাড়ি বাহিরে চলে আয় আমাদের ফিরতে হবে তো,বেশি রাগারাগি করিস না এতে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না তাড়াতাড়ি চলে যায় তোকে আর এখানে থাকতে হবে না?’

নিলয়ের কথা শুনে আদ্রিয়ান কিছুক্ষন চুপ থেকে কড়া নজরে তাকিয়ে রইলো আহির দিকে। এই একটা ছেলে যার কথা আদ্রিয়ান সবসময় শোনে। আদ্রিয়ান ফোনটা কেটে কড়া নজরে আহির দিকে তাকিয়ে আঙুল দেখিয়ে বললো,

‘ নেক্সট টাইম তোমায় যেন আর কোনোদিন আমার সামনে না দেখি?’

বলেই হন হন করে বেরিয়ে গেল আদ্রিয়ান। আদ্রিয়ান বের হতেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নিলয়ও চললো আদ্রিয়ানের পিছন পিছন। আদ্রিয়ান যেতেই বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগলো আহি। এই প্রথম কোনো ছেলেকে দেখে ভয় পেলো আহি। ভয়ের চোটে কিছু বলতেই পারলো না। মনে হচ্ছিল আর কিছুক্ষন হলেই জানটা বেরিয়ে যাবে,আহি বুকে হাত দিয়েই বলতে লাগলো,

‘ কি লোকরে বাবা এটলিস্ট চিঠিটা তো পড়া উচিত ছিল তাহলেই তো বুঝতে পারতো ওটা ওনার জন্য ছিল না জাস্ট উপরের লেখাটা দেখেই এত রেগে গেল। কিন্তু আমার চিঠিটা তো ওনার কাছেই রয়ে গেল এখন আমি নীরব ভাইয়াকে কি দিবো তার থেকেও বড় কথা আমার চারদিন বসে লেখা চিঠিটা লোকটা নিয়ে চলে গেল। না না আহি এক্ষুনি গিয়ে চিঠিটা নিয়ে আসতে হবে সাথে সত্যিটাও বলতে হবে তারপর ওই বদমাইশ বাচ্চাটাকেও দেখতে হবে হুহ।’

ভেবেই ভাড়ি লেহেঙ্গা ধরে রুম থেকে বেরিয়ে গেল আহি।’

____

রাগে ফুসতে ফুসতে বিয়ে বাড়ির ভিতর থেকে বের হলো আদ্রিয়ান আর নিলয়। আদ্রিয়ান তো রেগেই বললো,

‘ শুধুমাত্র তোর জন্য মেয়েটাকে ছেড়ে দিলাম না হলে, কত বড় সাহস আদ্রিয়ানকে লাভ লেটার দেয়।’

‘ কুল ডাউন আদ্রিয়ান এত রেগে যাওয়ার কি আছে মানছি তুই মেয়েদের একদম পছন্দ করিস না কিন্তু তাই বলে ওইভাবে ভয় দেখাবি কতটা ভয় পেয়েছিল মেয়েটা।’

‘ তুই কি ওই মেয়েটার সাপোর্ট নিয়ে কথা বলছিস?’

‘ আরে না আচ্ছা বাদ দে ওইসব, চল এখন।’

বলেই ড্রাইভার সিটে গিয়ে বসলো নিলয়। আদ্রিয়ানও বেশি কিছু না ভেবে বসে পড়লো নিলয়ের পাশের সিটে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। এই জন্যই বিয়ে বাড়িতে আসতে চাই নি সে শুধুমাত্র নিলয়ের জোরাজোরিতে আর তাদের বিজনেস পার্টনার আফজাল সাহেবের মেয়ের বিয়ে তাই এসেছিল সে। না হলে এইসব বিয়ে বাড়ি টিয়ে বাড়ি একদম পছন্দ করে না আদ্রিয়ান। আদ্রিয়ান গাড়িতে বসে সিট বেল লাগিয়ে জোরে নিশ্বাস ফেললো। আদ্রিয়ান বসতেই নিলয় গাড়ি স্টার্ট দিলো এমন সময় হুট করেই সেখানে দৌড়ে এগিয়ে আসলো আহি। আহিকে দেখেই আরো রাগ বাড়লো আদ্রিয়ানের। রাগী লুক নিয়েই বললো সে,

‘ আবারো ওই মেয়েটা নিলয় কুইকলি এখান থেকে চল।’

উওরে নিলয়ও আর কিছু না বলে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চললো নিজেদের গন্তব্যের দিকে। কারন সে বুঝতে পেরেছে এখানে বেশিক্ষণ থাকলে বড়সড় একটা ঝড় উঠবে।

আহি আদ্রিয়ানের দিকে এগিয়ে এসে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,

‘ বিশ্বাস করুন ওই লেটারটা আপনার জন্য ছিল না প্লিজ আমার লেটারটা আমায় ফেরত দিয়ে যান।’

আদ্রিয়ান আহির অর্ধেক কথা শুনলেও উওরে কিছু না বলে গাড়ি করে চলে গেল আর আহি গাড়ির পিছনে কিছুক্ষন দৌড়েও আর ধরতে পারলো না। ইচ্ছে করছে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কান্না করতে। কত কষ্ট করে ওই চিঠিটা লিখে ছিল সে নীরবের জন্য কিন্তু সব ভাবতেই জোরে কান্না পাচ্ছে তাঁর।’

‘ প্রত্যেকবার আমার সাথেই এমন কেন হয়?’

এমন সময় আহির হাত ধরে টান দিলো একটা ছেলে তারপর বললো,

‘ আপি আমার চকলেট?’

হুট করে কোনো বাচ্চার কন্ঠ কানে আসতেই চোখ ফিরে তাকালো আহি ছেলেটির দিকে। এই ছেলেটাই হলো সেই ছেলেটা যাকে বলেছিল আহি নীরবকে চিঠিটা দিতে কিন্তু বাচ্চাটা ওই রাগী হনুমানটাকে দিয়ে দিল। আহি রেগে বললো,

‘ তোকে চকলেট দিবো দাড়া দিচ্ছি তোকে চকলেট বান্দর ছেলে তোর জন্য আমার চিঠি হনুমানটা নিয়ে গেল।’

বলেই রাগে তেড়ে আসতে লাগলো আহি ছেলেটার দিকে। আহির কাজে ছেলেটি ভয় পেয়ে দৌড়ে পালালো। এরই মধ্যে সেখানে এসে হাজির হলো রিনি আহিকে এতটা রেগে যেতে দেখে বললো সে,

‘ কি হয়েছে নীরব ভাইয়াকে চিঠিটা দিতে পারিস নি সরি দোস্ত ওদিকে একটু বিজি ছিলাম তাই আসতে পারি নি।’

রিনির কথা শুনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো আহি। আহিকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো রিনি,

‘ আজও পারিস নি।’

উওরে ‘না’ বোধক মাথা নাড়ালো আহি। তারপর সবকিছু খুলে বললো আহি রিনিকে। সব শুনে রিনি তো চরম অবাক এত কিছু হয়ে গেল অথচ সে কিছু বুঝতে পারে নি। রিনি কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো আহিকে,

‘ যাক বাদ দে তুই আবার আরেকটা চিঠি লিখে বলিস নীরব ভাইয়াকে এখন চল আপুকে বিদায় দিতে হবে।’

বলেই আহির হাত ধরে চললো রিনি। আহিও বেশি কিছু না ভেবে মন খারাপ করে চললো রিনির সাথে। এটা নতুন কিছু নয় এর আগেও অনেক বার আহি নীরবকে প্রপোজ করার চেষ্টা করছিল কিন্তু সাহসের অভাবে কিছুই বলতে পারে। যতবারই নীরবের সামনে গিয়ে কিছু বলবে বলবে ভেবেছে তখনই কোনো না কোনো কারনে আঁটকে পড়েছে সে। তাই ভেবেছিল আহি মুখে নয় চিঠি লিখে জানাবে সব কিন্তু ভাবতেই দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসলো তাঁর।’

___

বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে সবাই কারন এখন বিয়ের কনেকে বিদায় জানানো হবে সবাই বেশ মন খারাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহিও মন খারাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাইকে কাঁদতে দেখে তাঁরও কান্না পাচ্ছে। এমন সময় তার মাথায় হাত রাখলো নীরব তারপর বললো,

‘ Don’t cry?’

নীরবের কথা শুনে হকচকিয়ে উঠলো আহি। সাথে আরো জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করলো সে। আহি এত জোরেই কাঁদতে লাগলো যে আশেপাশের সবাই কনেকে ছেড়ে আহির দিকে তাকিয়ে রইলো।আহির কাজে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল নীরব। আশেপাশে তাকাতেই সবাইকে আহির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বেশি কিছু না ভেবেই আহির হাত ধরে অন্য সাইডে নিয়ে গেল নীরব। তারপর কিছুটা অবাক হয়ে আহির দিকে তাকিয়ে বললো সে,

‘ তোকে কাঁদতে বারন করলাম আর তুই কি না আরো জোরে জোরে কাঁদছিস?’

উওরে আরো জোরে কাঁদতে কাঁদতে লাগলো আহি। আহির কাজে বিষন্ন ভরা কন্ঠ নিয়ে বললো নীরব,

‘ আরে তুই কাঁদছিস কেন?’

নীরবের কথা শুনে আহি কান্না ভেঁজা কন্ঠ নিয়েই বললো,

‘ সব সময় আমার সাথেই এমন কেন হয় নীরব ভাইয়া?’

‘ কি হয় কি হয়েছে সেটা তো বলবি?’

‘ সেটা শুনে তুমি কি করবে?’

‘ যাহ বাবা আমায় বলবি না?’

‘ না বলবো না।’

‘ আচ্ছা ঠিক আছে তোকে কিছু বলতে হবে না এখন কাঁদিস না।’

বলেই আহির চোখের পানি মুছে দিলো নীরব। তারপর বললো,

‘ তোকে না বলেছি হুটহাট কাঁদবি না কাঁদলে তোকে একদম ভালো লাগে না বুঝলি।’

নীরবের কথা শুনে আহি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো নীরবের দিকে কিন্তু কিছু বললো না….
!
!
!
!
!
#চলবে…..

#বাবুইপাখির_অনুভূতি🕊️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🕊️
— পর্বঃ০২
_________________

দেয়ালের সাথে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিয়ান। চোখ দিয়ে লাল আভা বের হচ্ছে তার আর ওনার এমন কাজে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে আহি তার দিকে। হুট করে আদ্রিয়ান কোথা থেকে চলে এলো ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না আহি। অন্যদিকে আদ্রিয়ান রেগে আহির গলা চেপে ধরে বললো,

‘ তোমার সাহস কি হলো আমায় লাভ লেটার দেওয়ার?’

হুট করে এমন ভয়ানক কান্ড দেখে হকচকিয়ে বিছানা ছেড়ে চোখ খুলে শোয়া থেকে উঠে বসলো আহি। আশেপাশে তাকাতেই সে বুঝতে পারলো সে রিনিদের বাড়িতে রিনির বিছানায় ঘুমিয়ে আছে তার মানে কিছুক্ষন আগে যা দেখলো তা স্বপ্ন ছিল। কথাটা মাথায় আসতেই চোখ তুলে তাকালো আহি। কি ভয়টাই না পেয়েছে সে বাবা গো বাবা ওটা চোখ ছিল নাকি অন্যকিছু। আই উইস আর কোনোদিন যেন ওই রাগী লাল চোখওয়ালা হনুমানের সাথে দেখা না হয়। ভেবেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আহি। শরীরটা একটু ক্লান্ত থাকায় বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল সে কিন্তু এখন ঠিক আছে। দিন দুপুর এইরকম ভয়ানক স্বপ্ন দেখবে সে এটা একদমই কল্পনার বাহিরে ছিল আহির। গলায় হাত দিয়েই এগিয়ে চললো সে ওয়াশরুমের দিকে।’

____

ক্লান্ত শরীর নিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো আদ্রিয়ান প্রচন্ড ক্লান্ত সে। আর তার পাশেই সোজাসুজি সোফায় গায়ের কোটটা খুলে গা এলিয়ে দিলো নিলয় সেও বড্ড ক্লান্ত। বিয়ে বাড়ি মানেই হলো এক গা লোকজন হইচই চেঁচামেচি আরো কত কি সবকিছুতেই চরম বিরক্ত লাগছিল আদ্রিয়ানের ভালো হয়ে সে ফিরে এসেছে। হঠাৎই বলে উঠল নিলয়,

‘ আজ সত্যি খুব ক্লান্ত লাগছে আমার?’

‘ আমারও।’

এরপর দুজনই কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। হঠাৎই নিলয় বলে উঠল,

‘ আজ তাহলে যাই বস কাল অফিসে দেখা হবে?’

নিলয়ের কথা শুনে চোখ বন্ধ করেই ক্লান্তি মাখা কন্ঠে বললো আদ্রিয়ান,

‘ ঠিক আছে মাই পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট।’

আদ্রিয়ানের কথা শুনে হাসলো নিলয় তারপর গায়ের কোটটা হাতে নিয়ে চললো সে। হঠাৎই নিলয়ের কোটের পকেট থেকে আহির দেওয়া সেই লাভ লেটারটা পড়ে গেল নিচে। নিচে কিছু পড়তেই নিলয় চটজলদি নিচ থেকে কাগজটা উঠালো তারপর লেটার দিকে তাকিয়ে একপলক হেসে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো সে,

‘ দোস্ত তোর লাভ লেটার?’

নিলয়ের কথা শুনে চোখ খুলে তাকালো আদ্রিয়ান তারপর ঠোঁট উল্টে বললো সে,

‘ হোয়াট?’

উওরে হাসলো নিলয়। নিলয়ের হাসি দেখে কিছুটা ক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়ে বললো সে,

‘ ও টাকে ফেলে দিস নি কেন?’

‘ মনেই ছিল না তখন যে পকেটে রেখেছিলাম তবে যাই বল মেয়েটার কিন্তু সাহস আছে বারন করা সত্বেও আবার গাড়ির সামনে আসলো?’

‘ তোর কোনো কাজ না থাকলে চিঠিটা যাওয়ার সময় রাস্তায় ফেলে দিস।’

‘ এমন করিস কেন দেখতো কত সুন্দর করে চিঠিটা সাজিয়েছে মেয়েটা আমি তোকে পড়ে শোনাবো?’

নিলয়ের কথা শুনে ফট করে উঠে দাঁড়ালো আদ্রিয়ান তারপর চোখ গরম করে নিলয়ের দিকে এগিয়ে এসে বললো,

‘ তুই যাবি আমার সামনে থেকে?’

‘ আরে বাবা যাচ্ছি তো রেগে যাচ্ছিস কেন?’

এই বলে চিঠিটা আদ্রিয়ানের রুমে থাকা বুকশেলফের উপরে রেখে বললো নিলয়,

‘ এখানে চিঠিটা রেখে গেলাম ভালো লাগলে পড়ে দেখিস আবার ফেলে দিস না কিন্তু,যতই হোক লাভ লেটার বলে কথা।’

বলেই দৌড়ে পালালো নিলয়। আর আদ্রিয়ান কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না চরম বিরক্ত লাগছে তাঁর। আদ্রিয়ান বেশি কিছু না ভেবে হন হন করে উপরে চলে গেল। আর গোলাপি খামের ভিতর থাকা চিঠিটা পড়ে রইলো তাঁর বুকশেলফ জুড়ে।’

______

বিকেল_৫ঃ০০টা…

বাড়ি যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে আহি। গায়ে থাকা ভাড়ি লেহেঙ্গা খুলে ফেলেছে অনেক আগেই। বর্তমানে একটা গোলাপি রঙের জর্জেট থ্রি-পিচ পড়ে দাঁড়িয়ে আছে সে আয়নার সামনে।’এমন সময় সেখানে এসে হাজির হলো নীরব আহিকে উল্টোদিক ফিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো সে,

‘ হয়েছে তোর এখন তো বের হতে হবে?’

উওরে মুচকি হেঁসে পিছন ফিরে বললো আহি,

‘ হুম হয়েছে। আমায় কেমন লাগছে ভাইয়া?’

উওরে আহির মাথা থেকে পা অবদি স্ক্যান করে বললো নীরব,

‘ রোজ যেমন লাগে তেমন।’

নীরবের কথা শুনে আহি মুখ ভাড় করে বললো,

‘ তুমিও না ভাইয়া কখনো আমার প্রশংসা করই না।’

‘ এত প্রশংসা করে কি হবে শুনি?’

‘ যাও তো তুমি আমি আসছি।’

উওরে হাল্কা হেঁসে চোখে চশমাটা ঠিক করে বেরিয়ে গেল নীরব। নীরব হলো আহির প্রতিবেশী প্লাস বন্ধু একই বিল্ডিং এর উপর নিচ ফ্লাটে থাকে তাঁরা। সেই ছোট বেলা থেকেই একসাথে আছে দুজন। নীরব আহির থেকে দু’বছরের বড়। নীরবের এই বিয়েতে আসার কারন হলো দুইটা এক রিনি তাকে ইনভাইট করে ছিল আর দুই রিনির বড় ভাই সোহানের বেস্ট ফ্রেন্ড সে। সে হিসেবেও ইনভাইটেট নীরব। তাই তো না চাইলেও আসতে হয়েছে তাকে।’

রিনিদের বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে আহি, সোহান নীরবসহ নীবরের আরো দুটো ছেলেফ্রেন্ড সাথে মীরা। মীরাও নীরবের বন্ধু একই সাথে পড়ে তাঁরা। তবে এই মেয়েটাকে একদম পছন্দ হয় না আহির। কারন সবসময় নীরবের গায়ের সাথে চিপকে চিপকে থাকে সে। যেটা একদমই অপছন্দের বিষয় আহির। অতঃপর সবাইকে বিদায় জানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো নীরব ওঁরা। সবার আড়াল থেকে কিছুটা দূরে আহির হাত ধরে টেনে নিয়ে আসলো রিনি। রিনির এমন কাজে আহি অবাক হয়ে বললো,

‘ তোর আবার কি হলো, হাত ধরে টানছিস কেন?’

‘ শোন আজ নীরব ভাইয়াকে প্রপোজ করতে পারিস নি ঠিক আছে কিন্তু কাল আবার প্রপোজ করবি এইবার না পারলে আমি নিজে গিয়ে নীরব ভাইয়াকে বললো তোর কথা।’

‘ না বোন প্লিজ এমন করিস না।’

‘ এমনটা না চাইলে আজ রাতের মধ্যে আর একটা চিঠি লিখে কাল ভার্সিটি গিয়ে নীবর ভাইয়াকে দিবি বুঝলি।’

‘ এক রাতের মধ্যে লিখতে হবে আগের টা লিখতে আমার চারদিন লেখেছিল।’

‘ ওতশত জানি না কালকের মধ্যে প্রপোজ করবি মানে করবি তা না হলে..

রিনির পুরো কথা শেষ করার আগেই আহি বলে উঠল,

‘ প্লিজ বোন রাগ করিস না আমি তো ট্রাই করি কিন্তু কিছুতেই হয়ে ওঠে না।’

আহির কথা শুনে এক প্রকার রেগেই বললো রিনি,

‘ কচু করোস তুই। সেই স্কুল লাইফ থেকে তুই শুধু ট্রাই করেই যাচ্ছিস কিন্তু কিছু করতে আর পারছিস না। এরপর দেখবি অন্যকেউ এসে নীরব ভাইয়ার হাত ধরে নিয়ে যাবে তুই কিছু করতেও পারবি না। এমনিতেও ওই মীরা আপুকে আমার মটেও সুবিধার মনে হচ্ছে না তাই বলছি সময় থাকতে বলে ফেল আহি।’

রিনির কথা শুনে আহিরও বেশ খটকা লেগেছে সত্যি তো যদি তার আগে নীরব ভাইয়ার লাইফে অন্যকেউ চলে আসে তাহলে সে কি করবে? না না এমনটা হতে দেওয়া যাবে না কালই সে আবার নীরবকে প্রপোজ করবে। আর এবার প্রপোজ করেই ছাড়বে। কথাগুলো ভেবে আহি রিনির দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ তুই ঠিকই বলেছিস আমি কাল নীরব ভাইয়াকে প্রপোজ করেই ছাড়বো।’

‘ এই না হলে কথা। একদম ভয় পাবি না ফট করে চিঠিটা নীরব ভাইয়ার হাতে দিয়ে চট করে চলে আসবি, আর শোন আমি কাল বা পরশু ভার্সিটি না গেলেও দু’দিন পর ঠিক যাবো আর গিয়ে যেন শুনি তুই প্রপোজ করতে পেরেছিস নীবর ভাইয়াকে।’

‘ হুম।’

এমন সময় আহির নাম ধরে ডাক দিলো নীরব। নীরবের কন্ঠ শুনে আহিও রিনিকে বাই বলে দৌড়ে চললো ওদের সাথে। আর রিনি নিরাশ হয়ে আহির যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে বললো,

‘ এবার পারবি তো আহি নাকি এবারও,,

ভাবতেই ছোট্ট দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসলো তাঁর।’

_____

গাড়িতে চুপচাপ বসে আছে আহি। তার সামনেই নীরব মীরা সাথে ওদের দুজন বন্ধুরাসহ সবাই মিলে হাসাহাসি করছে আর আড্ডা দিচ্ছে। সবার মাঝে নিজেকে কেমন যেন বনমানুষ বলে মনে হচ্ছে আহির। আহি যাও একটু বলবে তাও মীরার সাথে নীরবের হাসাহাসি করে কথা বলাটার জন্য মোটেও ভালো লাগছে না আহির। তাই তো সে একদম চুপচাপ হয়ে বসে আছে। ছোট্ট একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো আহি।

‘ হয়তো রিনি ঠিকই বলেছে আমি বলতে বলতে নীরব ভাইয়ার লাইফে অন্যকেউ চলে আসবে।’

কথাগুলো মনে মনে ভেবে বড্ড মন খারাপ হয়ে গেল আহির। চুপচাপ নিজের মাথাটা জানালার পাশে হেলিয়ে দিলো আহি আর ভাবলো…

নীরবের সাথে আহির প্রথম আলাপ হয়েছিল স্কুলে বসে। তখন আহির বয়স ছিল সাত কি আট আর নীরবের দশ কি এগারো। সেদিন স্কুলে যেতেই একটা ছেলের সাথে তুমুল বেগে ঝগড়া লাগে আহির সাথে। এক পর্যায়ে সেই ছেলেটা ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় আহিকে আর তখনই সেখানে হাজির হয় নীরব। গোলগাল ফর্সা চেহারার একটা ছেলে,নীরব ছোট বেলা থেকেই গোল ফ্রেমের চশমা পড়ে। এখনও পড়ে আর এই চশমাতেই বেশ সুন্দর লাগে নীরবকে। নীরবের নামটাও যেমন নীরব তেমনি ছেলেটাও শান্ত সৃষ্ট আর নীরব টাইপের। আহি তো সেদিন ছোট্ট নীরবকে দেখেই ভালো লাগার মুহূর্তে চলে যায়। যদিও তখন সে ভালোবাসা নামেও যে কিছু আছে সেটা জানতো না। নীরব সেদিন দৌড়ে এসে আহির দিকে নিজের হাত এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘ ঠিক আছো তুমি?’

উওরে ‘হ্যা’ বোধক মাথায় নাড়িয়ে নিজের হাত এগিয়ে দিয়েছিল আহি। এরপর নানা ভাবেই তাদের সাথে কথা হয় আর শুরু হয় বন্ধুত্ব দুজনেই দুজনের প্রতিবেশী হওয়ায় আরো বেশি ভালো বন্ধুর সম্পর্ক তৈরি হয় তাদের। একসাথে স্কুলে যাওয়া, একসাথে খেলাধুলা, পড়াশোনাও একসাথে করতো দুজন। ছোট বেলা থেকেই আহি পড়াশোনায় তেমন ভালো নয় অংক তো তার মাথায় ঢুকতেই চায় না,অন্যদিকে নীরব ছিল তার একদম উল্টো মেধাবী আর ক্লাসের টপ বয় হওয়া একজন স্টুডেন্ট। অংক তার কাছে যেন পানির মতো সহজ। আর এই কারনেই নীরব সেই ছোট বেলা থেকেই পড়াশোনায় হেল্প করে আহিকে। আর আহি সে তো নীরবেই বার বার মুগ্ধ, তার চেহারা,তার পড়াশোনার ধরন, তার স্টাইল সবকিছু। আর সেই মুগ্ধতাই এখনও বয়ে চলছে আহির মাঝে। কখন যে নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেললো নীরবকে বুঝতেই পারে নি আহি। কিন্তু ছোট বেলাটা এখন হারিয়ে গেছে আগে নীরব প্রায় কাছাকাছি থাকতো কিন্তু এখন অনেক দুরত্ব ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস ফেললো আহি।’

হঠাৎই কারো মুখে নিজের নাম শুনে নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলো আহি। সামনেই নীরবের দিকে তাকাতেই আবারো মুগ্ধতা এসে গ্রাস করলো তাকে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রইলো সে নীরবের দিকে। গোল ফ্রেমের চশমা, হাতে কালো ঘড়ি,গায়ে ফুল হাতার ওয়াইট টিশার্ট,কালো জিন্স চুলগুলো সুন্দর করে সাজানো। যেন এক অন্যরকম ধ্যানে আঁটকে পড়েছে আহি। আচমকাই আহির ধ্যানের মাঝখানে ওর মাথায় চাটি মেরে বললো নীরব,

‘ কোন ভাবনায় মগ্ন তুই সেই কখন থেকে ডাকছি তোকে কানে যাচ্ছে না আমরা চলে এসেছি বের হ গাড়ি থেকে।

হুট করে নীরবের এমন কাজে আর কথা শুনে হকচকিয়ে উঠলো আহি তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বললো সে,

‘ না মানে..

‘ রাখ তোর না মানে চল তাড়াতাড়ি সবাই চলে গেছে শুধু তুই আমিই রয়ে গেছি।’

এতটুকু বলে আহির হাত ধরে টেনে গাড়ি থেকে বের করলো নীরব তারপর চললো নিজেদের গন্তব্যের দিকে।’….
!
!
!
!
!
#চলবে…..

#বাবুইপাখির_অনুভূতি🕊️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🕊️
— পর্বঃ০৩
_________________
জোৎসা ভরা রাতে জানালার কার্নিশ বেয়ে বয়ে আসছে ফুড়ফুড়ে ঠান্ডা বাতাস। বাতাসে জানালার দু’পাশ জুড়ে থাকা সাদা পর্দাগুলো উড়ছে বারংবার। যদিও এই মুগ্ধ করা রাতের সৌন্দর্যের ওপর বিন্দুমাত্র মাথা ব্যাথা নেই আহির। সে তো ব্যস্ত এখন জানালার পাশ দিয়েই থাকা পড়া টেবিল বসে প্রেমপত্র লিখতে। খাতায় কিছুক্ষন লিখেই আবার খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলছে টেবিলের পাশ দিয়ে থাকা ডাস্টবিনের ঝুলির মধ্যে। এসবে প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে আহির। চারদিন আগেও এমন হয়েছিল কিন্তু তারপরও লিখেছিল সে। আজ ভেবেছিল একটু নতুনভাবে নিজের অনুভূতিগুলো সাজাবে আহি। কিন্তু বার বার ব্যর্থ সে। প্রচন্ড বিরক্ত নিয়েই নিজের কপালটা খাতার ওপর চেপে ধরে কিছুটা চেঁচিয়ে বললো আহি,

‘ উফ আমার ধারা এসব প্রেমপত্র লেখালেখি হবে না।’

বলেই নিজের মাথার চুল ধরে টানতে লাগলো আহি। সাথে নেকা কান্না জুড়ে দিয়ে বললো,

‘ কেন যে তখন ওই বাচ্চাটার কাছে চিঠিটা দিয়ে ছিলাম,ধুরো ভালো লাগছে না। আমার সাথেই বার বার এমন কেন হয় আমার কপালটাই খারাপ। কালও যদি প্রপোজ করতে না পারি তাইলে শালার আর বলবোই না। কিন্তু না বললে যদি নীরব ভাইয়ার জীবনে অন্য কেউ এসে পড়ে তখন, ওহ নো, না না এখন এসব ভাবা যাবে না আহি? তাড়াতাড়ি চিঠিটা কমপ্লিট করতে হবে।

ভেবেই টেবিলের ওপর থেকে মাথাটা উঠিয়ে আবারো লিখতে শুরু করলো আহি। ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় রাত বারোটার কাছাকাছি। আকাশে তাঁরারা তখন ঝলমল করছিল প্রায়। আর আহি কলমের আবরণ দিয়ে নিজের অনুভূতিগুলো গুছিয়ে না পারলেও অগোছালোভাবে সাজাচ্ছিল খাতায়।’

________

গভীর রাত তখন রক্তের ছাপ ছাপ দাগ পড়ে আছে একটা পুরনো ভাঙাচোরা বাড়ির ফ্লোরের চারপাশ দিয়ে। বাড়িটা একদমই পুরনো আর ধুলোবালিতে ঘেরা। এসবের মাঝেই একদম গুটিশুটি মেরে হাত পা বাঁধা অবস্থায় ফ্লোরে বসে আছে একটা অল্প বয়সের ছোট বাচ্চা। ভয় হচ্ছে তাঁর খুব ভয় হঠাৎই সেখানে হাতে বন্দুক নিয়ে চলে আসলো একটা মধ্যম বয়স্ক লোক, লোকটাকে দেখেই ভয়ে শরীর কাঁপছে বাচ্চা ছেলেটির। লোকটি বাচ্চাটার মুখের ভিতর বন্দুক ধরতেই আরো ভয় পেল বাচ্চাটি। হঠাৎই সেখানে ঘেউঘেউ করতে করতে উপস্থিত হলো একটা কুকুর এতে আরো ঘাবড়ে যায় বাচ্চাটি। সাথে লোকটাও কিছুটা ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসে বাচ্চাটার কাছ থেকে এমন সময় হঠাৎই গুলির শব্দ আসতেই বাচ্চাটা ঘাবড়ে গিয়ে তাকালো সামনে। তার চোখের সামনেই অচেতন অবস্থায় পড়লো সেই ছোট্ট কুকুরটি যেটা কিছুক্ষন আগেই চেঁচিয়েই তাঁর কাছে আসতে নিচ্ছিল কুকুরের নিথর দেহ দেখে সাথে কুকুরটির ছটফট করা আর্তনাদ করা দেখে

‘শরীর কেঁপে উঠল আদ্রিয়ানের এমন সময় সেখানে আর কিছু দেখার আগেই চোখ খুলে তাকালো আদ্রিয়ান। সাথে সাথে ঘেমে যাওয়া শরীর নিয়ে চটজলদি বিছানা ছেড়ে লাফ মেরে উঠে বসলো সে। চারপাশে তাকাতেই সে বুঝতে পারলো আজ আবার সে একই স্বপ্ন দেখলো যে স্বপ্ন তাকে সেই ছোট বেলা থেকে এখনও ঘুমাতে দিচ্ছে না। আদ্রিয়ান নিজের মাথাটা চেপে ধরে বসে রইলো কতক্ষন তারপর বিছানার পাশে থাকা টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পুরো পানিটা খেয়ে নিলো। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো সে রাত তখন দুটো বেজে পঞ্চান্ন মিনিট প্রায় তিনটের কাছাকাছি। জোরে এক নিশ্বাস ফেলে জানালার দিকে তাকালো সে। রাতের জোৎসা ভরা আলোতে প্রায় সবকিছুই দেখা যাচ্ছে। আদ্রিয়ান কিছুক্ষন আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,

‘ কবে আসবে সেদিন যেদিন আমার এই ভয়ংকর স্বপ্ন ভুলে নিশ্চিতে ঘুম হবে? কবে এই রাতের ছায়া আমার পিছু ছাড়বে…

ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস ফেললো আদ্রিয়ান।’

____

পরেরদিন সকালে তুমুল বেগে দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হলো আহি। কারন আজ তার ভার্সিটি যেতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এই সব হয়েছে কাল রাতে দেরি করে ঘুমানোর জন্য। কাল শেষ রাতে লাভ লেটার লিখতে লিখতে টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল আহি আর সেই ঘুম ভেঙেছে সকাল ৯ঃ০০টায়। ভাবতে ভাবতে বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশা করে চললো সে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। হয়তো প্রথম ক্লাস আজ মিস যাবে আহির।

ভার্সিটির ক্লাস শেষে নীরবের ক্লাসের সামনে উঁকি ঝুঁকি মারছে আহি। কিন্তু আশেপাশে কোথাও নীরবকে দেখছে না সে। হঠাৎই তার সামনে এসে বললো মীরা,

‘ তুমি এইভাবে উঁকি মারছো কেন আহি?’

মেয়েলি কন্ঠ শুনতেই হকচকিয়ে উঠল আহি। নিজের মাথাটাকে উপরে উঠাতেই মীরাকে দেখে মেজাজ বিগড়ে গেল তার। তবে তেমন কিছু না ভেবেই বললো আহি,

‘ না মানে?’

‘ জানি নীরবকে খুজতে এসেছো তাই না?’

মীরার কথা শুনে আহি অবাক হয়ে বললো,

‘ তুমি কি বুঝলে?’

‘ না বোঝার কি আছে তুুমি তো বেশিরভাগ সময় নীরবের জন্যই এই ক্লাসে আসো কিন্তু আজ তো নীরব নেই?’

এবারের কথা শুনে আহি আরো অবাক হয়ে বললো,

‘ নেই মানে কোথায় গেছে ভাইয়া?’

‘ তা তো জানি না তবে পিন্সিপালের সাথে বের হতে দেখলাম এইমাত্র।’

নীরবের কথা শুনে আহি মন খারাপ করে বললো,

‘ ওহ।’

‘ হুম।’

‘ ওকে থ্যাংক ইউ আপু।’

‘ ইট’স ওকে।’

উওরে আহি আর কিছুু না বলে মন খারাপ করে বেরিয়ে গেল ভার্সিটি থেকে। আর মীরাও কিছুক্ষন আহির যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে চললো নিজের গন্তব্যের দিকে….

______

হসপিটালে একজন লেডিস ডাক্তারের চেম্বারে চুপচাপ বসে আছে আদ্রিয়ান। একাই এসেছে আজ এমনিতে নিলয় আসে তার সাথে কিন্তু আজ সে একাই এসেছে। আদ্রিয়ানের ভাবনার মাঝেই সেখানে এসে উপস্থিত হলো একজন মধ্যম বয়স্ক লেডিস ডক্টর মিসেস লিনা। আদ্রিয়ানকে দেখেই বললেন উনি,

‘ আজ তুমি একাই এসেছো আদ্রিয়ান?’

ডক্টরের কথা শুনে আদ্রিয়ানও নীরব কন্ঠে বললো,

‘ হুম।’

আদ্রিয়ানের কন্ঠ যেন আজ একটু অন্যরকম লাগলো মিসেস লিনার। উনি ওনার চেয়ারে বসতে বসতে বললো,

‘ কি হয়েছে আদ্রিয়ান তোমার কি মন খারাপ?’

ডক্টরের কথা শুনে আদ্রিয়ান মাথা নিচু করেই বললো,

‘ না তেমন কিছু নয়।’

আদ্রিয়ানের কথা শুনে মুচকি হেঁসে বললেন মিসেস লিনা,

‘ আমি কি তোমায় আজ থেকে দেখছি আদ্রিয়ান, সেই ছোট বেলা থেকে তুমি আমার কাছে আসছো, তোমাকে একটু হলেও বুঝতে পারি আমি কি হয়েছে বলো আমায়?’

মিসেস লিনার এবারের কথা শুনে আদ্রিয়ান ওনার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ আমি কি কখনো ঠিক হবো না আন্টি?’

আজ যেন আদ্রিয়ানকে একটু বেশি আপসেট লাগছে মিসেস লিনার। উনি ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,

‘ তোমার সমস্যাটা তো তোমার শরীরে নয় আদ্রিয়ান, যে ঔষধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে। তোমার সমস্যাটা হলো ভয়। সেই ছোট বেলার স্মৃতি যেটা তুমি এখনও তোমার সাথে বয়ে নিয়ে চলছো,এই ভয়টা তোমাকে দূর করতে হবে আদ্রিয়ান।

‘ কিন্তু কি করে করবো? আমি তো চাই এটা আমার কাছ থেকে দূরে চলে যাক কিন্তু কিছুতেই যেতে চায় না।’

‘ একটা জিনিস কি আদ্রিয়ান তুমি তোমার ভয়কে যত আশকারা দিবে সে ততই তোমায় গ্রাস করবে। তখন তুমি খুব ছোট ছিলে তাই আমার কথাগুলো বুঝতে পারো নি কিন্তু এখন তো বড় হয়েছো এবার তো বুঝতে হবে।’

মিসেস লিনার কথা শুনে আদ্রিয়ান মন খারাপ করেই বললো,

‘ আমি তো চাই ডক্টর আমার ভয়টা চলে যাক কিন্তু সেই রাতের দৃশ্য কিছুতেই আমায় ছাড়তে চায় না,আমার মস্তিষ্কে মিশে গেছে একদম কিছুতেই বের হতে চায় না।’

‘ ডোন্ট ওয়ারি আদ্রিয়ান চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে আসলে ছোট বেলার ভয় তো তাই এমন হচ্ছে তবে বেশি ভেবো না সব ঠিক হয়ে যাবে। টেনশন কম নেও,আর নিজেকে সময় দেও দেখবে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

উওরে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মাথা নাড়ালো আদ্রিয়ান। এরই মধ্যে সেখানে একজন নার্স এসে বললো,

‘ ম্যাডাম আপনাকে বড় স্যার ডাকছে?’

উওরে লিনাও বলে উঠল,

‘ ঠিক আছে তুমি যাও আমি আসছি।’

‘ ওকে ম্যাডাম।’

বলেই নার্সটি চলে গেল। নার্সটি যেতেই মিসেস লিনা তাকালো আদ্রিয়ানের দিকে তারপর বললো,

‘ তুমি কি কিছুক্ষন বসবে আদ্রিয়ান?’

‘ না, আমার কিছু কাজ আছে।’

‘ ওকে আদ্রিয়ান বেশি টেনশন নিও না সব ঠিক হয়ে যাবে।’

উওরে হাল্কা হেঁসে বেরিয়ে গেল আদ্রিয়ান হসপিটালের ভিতর থেকে। মিসেস লিনা হলো আদ্রিয়ানের ছোট বেলার সাথী,আদ্রিয়ানকে একদম ছেলের মতো ভালো বাসেন উনি। আদ্রিয়ানের বাবা মা নেই। সেই ছোট বেলায় নিজের একটা ছোট্ট ভুলের জন্যই আজ সে অনাথ? সব থেকেও যেন কিছু নেই তাঁর।’

____

মন খারাপ করেই রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল আহি। হাতে তার কাল রাতের লেখা সেই চিঠি। আহির এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে সে কোনোদিন বলতেই পারবে না নীরবকে। যতই বারই ভালোবাসার কথা বলতে গেছে ততবারই কোনো না কোনো সমস্যায় পড়তে হয়েছে তাকে। আহির ইচ্ছে করছে চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে দিক রাস্তায়। এই ভেবেই চিঠিটা খাম থেকে বের করে খুলে হাতে নিলো কিন্তু ছিঁড়তে গিয়েও ছিঁড়তে পারলো না।

‘ ধুরো কিছু ভালো লাগছে না।’

হঠাৎ একটা বাতাস আসতেই আহির হাত আলগা থাকায় হাতে থাকা চিঠিটা উঁড়ে গিয়ে পড়লো একটা গাড়ির পিছনে। আহি চিঠিটার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ তুইও যা একটা তো হনুমান নিয়ে চলে গেছে আরেকটা বাতাস তুই নিয়ে যা।’

বলেই আহি এগিয়ে গেল সামনে থাকা গাড়িটার কাছে। তারপর বেশি কিছু না ভেবে চিঠিটা নিচ থেকে উঠিয়ে সামনে তাকাতেই আদ্রিয়ানকে দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। শুকনো ঢোক গিলে বললো আহি,

‘ উনি এখানে কি করছে? ওহ সিট এখন কি করবি আহি? তোকে এখানে দেখলে তো আবার রেগে যাবে,, না জানি এবার রেগে গিয়ে সত্যি সত্যি তের গলা চেপে ধরে। কিন্তু আশেপাশে তেমন কিছু নেই ও তো যে তুই লুকাবি।’

এই বলে আশেপাশে তাকিয়ে আহি গাড়িটার কাছে এসে পিছনের দরজাটা খুললো গাড়ি লক না থাকায় খুশি হয়ে আহি গাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়লো।’

অন্যদিকে আদ্রিয়ান সেও হেঁটে এসে ওই গাড়িতেই বসলো কারন গাড়িটা আদ্রিয়ানেরই। আদ্রিয়ান ড্রাইভিং সিটে বসে সিট বেল লাগিয়ে ছোট একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট দিলো।

এদিকে আহি পড়লো মহা বিপদে।
‘ একেই বলে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। কি দরকার ছিল এই গাড়িটায় বসার উফ এখন কি করি?’ আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?’ ধুর সবসময় আমার সাথেই এমন কেন হয় খেলমু না যা।’

আদ্রিয়ান মন খারাপ করেই এগিয়ে গেল অনেকদূর হঠাৎই লুকিং গ্লাসে তাকাতেই পিছনে কিছু একটা আছে দেখে পিছন ফিরে আহিকে দেখে মুহূর্তে মেজাজ বিগড়ে গেল তাঁর চটজলদি গাড়িতে ব্রেক কষে রাগী কন্ঠে বললো,

‘ ইউ?’

আদ্রিয়ানের কথা শুনে ভয়ে শুঁকনো ঢোক গিলে হাল্কা হাসলো আহি।’
!
!
!
!
!
#চলবে…..