বাবুই নীড়ে তারা দু’জন পর্ব-০৬

0
4

বাবুই নীড়ে তারা দু’জন-০৬
-মেহরিমা আফরিন

মা কে নানুভাই শহরের খুব নামকরা একজন ডাক্তারের সাথে দেখা করালো।তিনি সাইকিয়াট্রিস্ট।মায়ের সাথে কথা বললেন তিনি।ভদ্রলোকের নাম মাহমুদ মিজান।তিনি খুব ধৈর্য সহকারে মায়ের কথা শুনলেন।মায়ের দুঃখ,মায়ের কষ্ট-সব।
শুনে বললেন,”কে বলল তুমি পাগল?যে বলে তুমি পাগল,সে নিজেই একটা পাগল।”

মা হাসলো।আনন্দিত মুখে বলল,”সত্যি?সত্যি আমি পাগল না?”

“না।একদমই না।তুমি কেবল কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছো।এমন তো আমাদের সাথেও হয়।এইটুকুতে কেউ পাগল হয় নাকি?”

মা আশ্বস্ত হলো।পরমুহূর্তেই আবার তার চোখ ভিজে উঠল।ডাক্তার মাহমুদ মিজান তার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন,”কি হয়েছে রিধিমা?কি নিয়ে কষ্ট হয় তোমার?আমাকে বলো।”

মা ভয়ানক মন খারাপ করে বলল,”আমার মা অনেক অল্প বয়সে মারা গেছে।আমার জন্মের পর মা কে আমি খুব কম পেয়েছি।বিয়ের পর থেকে ওর মা কেই আমি মা ডাকি।আমি কখনো উনার সাথে কোনো বেয়াদবি করি নি।না কোনোদিন তার কোনো আদেশ অমান্য করেছি।কিন্তু মা বলেছে,আমার মতো পাগলের সাথে নাকি তার ছেলেকে রাখবেন না।আমার খুব কষ্ট হয় এই কথা ভাবলে।”

“মন খারাপ করতে নেই রিধিমা।তোমার বয়সই বা কতো?এমন ছোটো খাটো জিনিস সংসারে চলতেই থাকে।এসব এতো গভীরে গিয়ে ভাবতে নেই।”

“গভীরে ভাবি না।তবুও ভাবতে ভাবতে কেমন যে বুকে গিয়ে লাগে সবকিছু।মা আমাকে একবারো ফোন দেয় নি।”

“তুমি দিয়েছিলে?”

“জি।ধরে নি।”

মা খুব আগ্রহ নিয়ে বাবার অপেক্ষা করছিল।বাবা আসবে,এমন কোনো প্রতিজ্ঞা সে করে নি।কিন্তু তবুও মায়ের দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো,ইশতিয়াক আসবে।এসে মায়ের হাত ধরে তাকে নিজের ঘরে নিয়ে যাবে।ঐ ঘরটা তো মায়েরও।তাই না?

কিন্তু মায়ের ধারণা মতো বাবা এলো না।মা তার নম্বরে ফোন করেও তাকে পায় নি।নম্বরটা বন্ধ দেখাচ্ছিল।নানুভাই এসে রোজ গল্প করতো তার সাথে।মা কথায় কথায় কেমন যে হারিয়ে যেত।নানুভাই তার মাথায় হাত রেখে ডাকতো,”রিধি! রিধি! ”
তখন হুশ হতো মায়ের।মা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,”বাবা! ইশরা তো ইশতিয়াকের জান।মেয়ের জন্য হলেও সে আসবে দেখো।”

শেষ কথাটা বলতে গিয়ে মায়ের গলা ধরে আসে।বাবা তার জন্য আসবে না।আসলে হয়তো আমার জন্য আসতে পারে।কারণ আমি বাবার জান।মা তো আর তার জান না।এই কথাটা কেন যে মা কে আঘাত করে খুব।মা আলতো করে নানুভাইয়ের কাঁধে মাথা রেখে উদাস গলায় বলে,”জানো বাবা?তোমাকে একটা দুঃখের কথা বলি।আমাকে কেউ ভালোবাসে না জানো?”

এরপর নয়দিন অতিবাহিত হওয়ার পর বাবা আর মা আবার মুখোমুখি হলো।এই সিদ্ধান্ত টা আমার দাদুভাই নিলো।এভাবে তো আর একটা সম্পর্ক ভেস্তে দেওয়া যায় না।এভাবে তো সবটা চলতে পারে না।এটা বিয়ে।শব্দের ভার আছে একটা।তার উপর দেড় বছর বয়সের একটা বাচ্চাও আছে।অবশ্যই ব্যাপারটা কোনো ছেলেখেলার বিষয় না।

সেদিন দাদুবাড়ির সবাই নানার বাসায় এলো,চট্টগ্রামে।মা তাদের আসার খবর শুনতেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল।মা ভাবলো,তারা হয়তো আমাদের ফিরিয়ে নিতে আসছে।কিন্তু এমন কিছুই হলো না।মায়ের আনন্দ,উৎসাহ সব তাদের আগমনের কিছু সময়ের ভেতরই ফিকা হতে শুরু করলো।

সবাই বসার ঘরে বসলো।বাবা বসলো ডান দিকের একটা সোফায়।মা গুটি গুটি পায়ে নানুর হাত ধরে সেখানে এলো।আমি।তখন চাচ্চুর কোলে বসে বসে নিজের মতো শব্দ করছি,খেলছি।চারপাশের থমথমে আমেজ বোঝার মতো বুদ্ধি আমার নেই।

মা চুপচাপ নানুভাইয়ের পাশ ঘেঁষে বসলো।বাবা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো তার দিকে।দীর্ঘদিন তেষ্টায় থাকা পথিক একটুখানি পানির দেখা পেলে যেভাবে তাকায়,ঠিক ঐভাবে।তারপর আবার সাবধানে চোখ সরিয়ে নিল।বাবার কপালে একটা ব্যান্ডেজ।মা অপরাধীর মতো মুখ করে সেদিকে তাকালো।বাবা কোনো বিকার দেখালো না।চোখের ইশারায় দাম্পত্য কিভাবে চলে,আমি জানি না।সেটা আমার ডিকশনারির বাইরে।

যাই হোক।সেই মহা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শুরু হলো।নানুভাই আলোচনায় খুব বেশি মনোযোগ দিলো না।মায়ের প্রতি তার তীব্র ভালোবাসা ছিলো।মা বাদে নানুভাইয়ের আর কিছু ছিলো না।মায়ের মতো ভদ্র সদ্র একটি মেয়ের সাথে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন এমন দুর্ব্যবহার করবে,নানুভাই সেটা কল্পনাও করতে পারে নি।যেই অপমানবোধে নানুভাই আর সম্পর্ক ঠিক করার তাড়না দেখায় নি।কি করবে?পায়ে ধরবে তাদের?কোন অপরাধে পা ধরবে?এমন স্পর্শকাতর একটা বিষয়ে যারা এমন ছেলে মানুষি করেছে,তাদের সাথে আর কিসের বোঝাপড়া করবে নানুভাই?

দাদুভাই বলল,”ইশতিয়াক আর রিধিমা আড়াই বছরের মতো সংসার করেছে।দেড় বছরের একটা বাচ্চাও আছে তাদের।কেন বিষয়গুলো এতো জট পাকাচ্ছে আমি জানি না।কিন্তু এর একটা সমাধান প্রয়োজন।আমার মনে হয় তাদের এক সাথে বসা প্রয়োজন।”

দাদুভাই থামলো।দিদুন একটু ভয় পেয়ে বলল,”একসাথে বসবে মানে?”

“মানে নিজেদের মধ্যে কথা বলবে।নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিবে।এদের সংসার।সিদ্ধান্ত তো এদেরই হবে।তাই না?”

দিদুন দুশ্চিন্তায় মাথা নাড়লো।দাদুভাই বলল,”রিধি! তুমি কি সবকিছু মিটমাট করে আবার সংসার করতে চাও মা?”

মা যেন এই কথাটা শুনবে বলেই বসেছিল।দাদুভাই বলতেই সে দ্রুত মুখ তুলল।তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বলল,”জি।আমি সংসার করতে চাই,বাবা।”

বাবা নড়েচড়ে বসলো।শার্টের হাতা টানতে টানতে একনজর তাকালো মায়ের দিকে।অতি শান্ত আর মনোযোগী দৃষ্টি।দাদুভাই হয়তো বাবাকে কিছু বলতো।
তার আগেই দিদুন কেমন যে ভয়ে ভয়ে বলল,”এতো কিছুর পরেও আপনি ঐ মেয়ে কে জিজ্ঞেস করছেন ইশতিয়াকের বাবা?আমি নিজের চোখে সবটা দেখেছি।বিশ্বাস না হলে তনুকে জিজ্ঞেস করুন।বড় বৌমা নিজের মধ্যে থাকে না।ওর কোনো হুশ ছিলো না যখন সে ঐভাবে আমার ছেলেকে মারছিলো।আমি পারবো না।আমি পারবো না ঐরকম করে আমার ছেলেকে তার কাছে ছেড়ে দিতে।আগে বড় বৌমা সুস্থ হবে।তারপর সব কথা।আমি আমার ছেলের সাথে তাকে আর এক ঘরে রাখতে চাই না,ইশতিয়াকের বাবা।”

মা নিচের ঠোঁটা কামড়ে ধরে দ্রুত মাথা নামিয়ে নিলো।হয়তো চায় নি কাঁদতে।তবুও কেঁদে ফেলল আচমকা।সেই শব্দে বাবা সহ পুরো ঘরের মানুষজন চমকে উঠলো।
দুই হাতে সোফাটা খাঁমচে ধরে মা একেবারে ভেঙে পড়লো।

আবেগপ্রবণ মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়লে মানুষজন বোধহয় এতো আশ্চর্য হয় না।কিন্তু অত্যন্ত চাপা স্বভাবের একটি মেয়ে যখন ঘর ভর্তি মানুষের সামনে মাথা নামিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে,তখন আপনাআপনি মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠে।মনে হয়,খুব অস্বাভাবিক কিছু ঘটে যাচ্ছে।সেদিন সেই সন্ধ্যায় মায়ের কান্নাও অষ্টম আশ্চর্যের মতোই অবিশ্বাস্য মনে হলো সবার।কারণ,আমার মা কাঁদে না সহজে।আমার মা ভাঙে,তবে প্রকাশ করে না।আমার মা আবেগ ধরে রাখলেও,আবেগশূন্য না।

মা বহু কষ্টে কান্না থামিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”স..স রি।”

বলে সে চোখ মুছে অপরাধী মতো মুখে বাবার দিকে তাকালো।বাবার হতভম্ব চোখ জোড়া,মায়ের অনুশোচনায় জর্জরিত চোখের সাথে মিলতেই মা ফুপিয়ে উঠে বলল,”ইশতিয়াক! আই…আই অ্যাম সরি।তুমি আমাকে মাফ করে দাও।তুমি এখন থেকে আমার হাত পা বেঁধে রেখো।আর পাগলামি করবো না আমি।”

বলে মা আবার মাথা নামিয়ে নিলো।হঠাৎ করে,বসার ঘরটা কেমন যে ঝড়ের আগের পরিবেশের মতো থমথমে হয়ে উঠলো।আমিই নিরবতা কাটিয়ে ভুম ভুম তাপ তাপ করে চেঁচিয়ে উঠলাম মাঝে মাঝে।

মা নানুভাইয়ের পাশটায় বসে একটু পর পর শ্বাস টানছিলো।আর কোনো কথা সে বলে নি।ক্ষমা চাওয়া অপরিহার্য ছিলো।সে চেয়েছে।সে সংসার করতে চায়,এই কথা জানানো প্রয়োজন ছিলো,সে জানিয়েছে।অন্য পাশের মানুষ কে সংসার করতে জোর করার অধিকার তার নেই।তাই সে কাজ করা থেকে মা নিজেকে দূরে রাখলো।

বাবাই উঠে দাঁড়ালো প্রথমে।প্রত্যেক বার প্রথম কদম বাবাই বাড়িয়েছে।এইবার কেন ব্যতিক্রম হবে?
বাবা ধীর পায়ে হেঁটে মায়ের সামনে গিয়ে বসলো,হাঁটু গেড়ে।মা একটু চমকে উঠে সরে যেতে চাইলো।বাবা খপ করে ধরে ফেলল তার হাতটা।

মা কান্না থামিয়ে শীতল চোখে তাকালো তার দিকে।বাবা স্বর নামিয়ে মারাত্মক আদর দিয়ে বললেন,”রিধি! আমার ইশুর মা! তুমি কেমন আছো?তুমি কেন মাফ চাইছো আমার কাছে?আই অ্যাম সরি।সরি ফর নট আন্ডারস্ট্যান্ডিং ইউর পয়েন্ট অব ভিউ।আমি একবারও তোমায় বুঝিনি রিধি।আই শ্যুড বি সরি ফর দ্যাট।নট ইউ।”

মা অন্য হাতে বাবার হাতটা আঁকড়ে ধরে বলল,”ইশতিয়াক! তুমি….তুমি বলো তুমি আমাকে ছেড়ে দিচ্ছো না তো?”

“ইম্পসিবল।প্রশ্নই আসে না।তুমি আমার স্ত্রী।তুমি..” বাবা মায়ের কাছ থেকে গিয়ে সবার দিকে একনজর তাকিয়ে বলল,”তুমি আমার জান,রিধি।আই লাভ ইউ।”

বাবা উঠে গিয়ে মায়ের পাশে বসলো।মা একেবারে চেপে বসলো বাবার গায়ের সাথে।মা কে ঐভাবে আগলে ধরেই বাবা সবার দিকে চেয়ে দৃঢ় গলায় বলল,”আমি রিধির সাথেই থাকতে চাই।রিধি যদি মেরেও ফেলে আমাকে,আমি তবুও তার সাথেই থাকতে চাই।আমি এই পুরো জীবনে স্ত্রী হিসেবে শুধু রিধিমাকেই চাই।এরপর থেকে রিধিকে যে পাগল বলবে,সে যেন আমাকে আর ছেলে বলে না ডাকে।”

দিদুন একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।মা ফ্যালফ্যাল করে তাকালো বাবার দিকে।বাবা মায়ের গালের পাশে হাত রেখে বলল,”রিধি! কি লাগবে তোমার বলো? কি চাই বলো আমাকে।”

“ইশতিয়াক।”

“বলো।”

“তুমি,,,,তুমি কি আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে?”

বাবা নিঃসংকোচে জড়িয়ে ধরলো।মায়ের শরীরটা যেন আছড়ে পড়লো তার উপর।নিজের সমস্ত প্রভার খাটিয়ে মা তাকে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরলো।বাবা তাকে প্রশ্রয় দিলো।তার পিঠে স্বভাব মতো হাত বুলাতে বুলাতে বলল,”আর কাঁদে না রিধি।তোমার চোখ দু’টো খুব বাজে হয়েছে কাঁদতে কাঁদতে।”

“ইশতিয়াক! ইশতিয়াক! তুমি আমার একটা কথা শোনো।”

“বলো।”

“আমি তোমাকে খুব পছন্দ করি।তোমার মতো পছন্দ আমি আর কাউকে করি নাই।”

“আমি জানি।”

মা তাকে জড়িয়ে ধরেই তার গালের সাথে নিজের গালটা চেপে ধরল।বসার ঘরের লোকজন,তাদের দৃষ্টি,লোকলজ্জা কিংবা আনুষ্ঠানিকতা সেদিন আর ইশতিয়াক-রিধি দম্পতির কাছে ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো না।সেদিন তারা ভাবলো নিজেদের নিয়ে।একেবারে খাঁদের কিনারায় চলে যাওয়া সম্পর্কটা হঠাৎ করে দু’জনের প্রচেষ্টায় এমন করে বেঁচে গেল,যেন রিধি আর ইশতিয়াক নতুন করে ঘর বাঁধলো আরেকবার।

চলবে-