বাবুই নীড়ে তারা দু’জন-০৭
-মেহরিমা আফরিন
সেসময় হেমন্ত ঋতু চলছিলো।প্রকৃতিতে নাতিশীতোষ্ণ ঠান্ডা বাতাস।রাতের দিকে শীত শীত ভাব একটু বাড়ে।সন্ধ্যার পর বাড়ির সামনের ডালে বসে একটা পাখি খুব চমৎকার সুরে ডাকে।রিধির এই ডাকটা ভালো লাগে।সন্ধ্যার পর ইশতিয়াকই জানালা খুলে পর্দা টেনে দেয়।রিধিমা গোল গোল চোখে নিরীহ মুখে তার দিকে তাকায়।
ইশরা সাধারণত এই সময়ে তনুদের ঘরে থাকে।তনু আর ইয়াস তাকে রাখে নিজেদের কাছে।ইশতিয়াক তখন সবে মাত্র অফিস করে বাড়ি ফিরে।রিধিমা চুপচাপ বসে থাকে তার অপেক্ষায়।ইশতিয়াক আসে।হাত থেকে ঘড়িটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখে।ব্যাগটা রাখে টেবিলের এক পাশে।তার টাই খুলে শার্টের প্রথম দু’টো বোতাম উন্মুক্ত করে হাত মুখ ধুয়ে আসে।
এসে রিধির পাশে বসে।এসে তার মাথায় হাত রেখে কোমল স্বরে বলে,”রিধি! খেয়েছো তুমি?”
“হ্যাঁ,খেয়েছি।তুমি খেয়েছো?”
“হ্যাঁ।”
ইশতিয়াক ওর পাশে বসে।আলতো করে হাত বুলায় মাথায়।রিধিমা তখন কেমন যে বোকার মতো চোখে তার দিকে তাকায়।দীর্ঘদিন নির্ঘুম থাকায় চোখের নিচে পরতের মতো কালি জমে গেছে।ইশতিয়াক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”তুমি ঘুমাও না?”
“ঘুমাই তো।একটানা ঘুম আসে না।”
“আসো,আমার কাছে আসো।”
এক আহ্বানেই রিধিমা যায়।ইশতিয়াকের বুকের এক পাশে ছোটো একটা বেড়ালের বাচ্চার মতো গুটি পাকিয়ে শোয়।নরম,কোমল হাত দিয়ে তার শার্টের একাংশ খাঁমচে ধরে।ধরে জানতে চায়,”ইশতিয়াক! আমি কি পাগল?আমি পাগল হতে চাই না জানো?”
“ধ্যাত!তুমি কেন পাগল হবে?তুমি কোনো ব্রাইট স্টুডেন্ট তুমি জানো?”
রিধিমা আর কথা বলে না।ইশতিয়াক ওকে দুই হাতে আগলে ধরে বলে,”তোমাকে যখন প্রথমবার দেখেছি,তখনই অদ্ভুত অদ্ভুত অনুভূতি হলো।তখনই জানতাম,তোমার সাথে আমার বিয়ের আলাপ চলছে।তোমার দিকে তাকালামও সেই চোখে।কল্পনা করলাম,এই মেয়েটি আমার ঘরনি হলো।কল্পনা করে খুব আরাম পেতাম জানো?”
রিধিমা বলল,”আমি কেমন বউ ইশতিয়াক?”
“তুমি খুব দারুণ বউ।তুমি দারুণ বলেই প্রত্যেকবার তোমাকে আঘাত করার পর আমার ভীষণ কষ্ট হতো।আমি তোমার একেবারে চুপ হয়ে যাওয়া নিতে পারি না রিধি।”
রিধিমা হাসলো।কোনো কথা না বলে আগের মতোই ইশতিয়াকের বুকের সাথে মিশে থাকলো।ইশতিয়াক এখন প্রায় রোজ এই কাজ করে।ইশরা কে তনুদের ঘাড়ে চাপিয়ে রিধিমার সাথে বসে বসে গল্প করে।রিধিমা বহুদিন হলো গল্প করে না।ইশতিয়াককে পেলে সে মন খুলে কথা বলে।
সেই ঘটনার পর প্রথমবার বাড়িতে এসে সে ইশতিয়াকের হাতে একটা ওড়না ধরিয়ে দিয়ে বলল,”আমি যখন পাগলামি শুরু করবো,তখন তুমি এটা দিয়ে আমাকে বেঁধে রাখবে কেমন?”
ইশতিয়াক হাসলো ওর কথা শুনে।ওড়না টা ক ঝাড়ায় হাত থেকে ফেলে দিয়ে ওকে নিজের কাছে টেনে আনলো।এনে ওর কপালে,গালে,ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলল,”এটার প্রয়োজন নেই।অমন করে পাগলামি থামে নাকি?আমি তোমাকে আদর দিয়ে সামলাবো বুঝলে?”
সে কথা শুনে রিধিমার নাক মুখ লাল হয়ে উঠে।ইশতিয়াকের তখন অনুভব হয়,এক সন্তানের মা বাবা হওয়ার পরেও তাদের ভেতর প্রেম শব্দের যথেষ্ট ঘাটতি আছে।তারা দম্পতি,অথচ প্রেমিক প্রেমিকা না।ইহা ভারি অন্যায়।এটা হতে দেওয়া যায় না।
সময়টা বের করলো ইশতিয়াকই।নিজেকে বোঝার সময়,নিজেদের বোঝার সময়।
সে প্রথমে যার কাছে রিধিকে নিয়ে গিয়েছিল কাউন্সিলিংয়ের জন্য,তার নাম তরিকুল।তরিকুল তার স্কুল জীবনের বন্ধু।সে মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছে।এমন ধরণের কেস সে আগেও সামলেছে।রিধিকেও তার সামনে বসানো হলো।তরিকুল একাই তার সাথে কথা বলল।প্রায় ঘন্টাখানেকের মতো।
এরপর তাকে অন্য রুমে বসিয়ে সে ইশতিয়াক কে ডেকে নিল।
জানতে চাইলো,”তুই নাকি তোর প্রথম বিবাহবার্ষিকী ভুলে গিয়েছিলি?”
ইশতিয়াক মাথা নামিয়ে বলল,”হ্যাঁ।”
“ভেরি ব্যাড।এই জিনিসটা মেয়েদের সেন্টিমেন্ট কে খুব আঘাত করে।আরেকটা প্রশ্ন,তুই কি রেগে গেলে উচ্চ স্বরে কথা বলিস?”
“হ্যাঁ।”
“দিস ইজ অলসো ভেরি ব্যাড।ও তোমার স্ত্রী।তোমার বাড়িতে,তোমার ফ্যামিলি মেম্বাররা থাকা অবস্থায় তুমি যদি ওর সাথে উঁচু স্বরে কথা বলো,তাহলে ভেতর থেকে সে খুব অপমানিত বোধ করবে।এটা অনুচিত।”
“আমি জানি,আমি অন্যায় করেছি।কিন্তু যখন আমি জিনিস গুলো আর সহ্য করতে পারতাম না,তখন আমি চেঁচিয়ে ফেলতাম।তারপর সরিও বলতাম।”
“দ্যাট ডাজন্ট ম্যাটার এট অল।”
“আমি আসলে নিজেই দিন কে দিন নিজের ভুল বুঝতে পারছি,তরিকুল।”
তরিকুল ঝুঁকলো।গলা নামিয়ে চাপা স্বরে বলল,”সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়েছে তোমাদের।তোর উচিত ছিলো,মেয়েটাকে সময় দেওয়া,তার সাথে কথা বলা,তাকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া।তুই তাকে ভালোবাসিস।অথচ মেয়েটার ভেতরের দোলাচাল বুঝিস না।অথচ তার ভালো অনুভূতি,মন্দ অনুভূতি সবকিছু বোঝা তোর দায়িত্ব।তুই বলছিস,তুই তাকে ভালোবাসিস।কিন্তু নিজেদের বিবাহ বার্ষিকী মনে রেখে স্বামীর জন্য ফুলের তোড়া আর চিঠি লিখে অপেক্ষা করা মানুষটি তোর স্ত্রী,তুই না।তুই একটা মা ছাড়া বড়ো হওয়া মেয়ের কাছে পরিপূর্ণ নারীর সমস্ত গুণ আশা করিস।অথচ তুই এই কথা বুঝতে পারিস না যে প্রচন্ড একাকীত্বে বেড়ে উঠেছে ঐ মেয়েটা।ইনসিকিউরিটি তে ভুগতে থাকা একটা মেয়েকে দিনকে দিন ইনসিকিউরড করেছিস তুই।তোর কি একবারও নিজেকে অপরাধী মনে হয় না?ইউ আর নট ভিকটিম।কোনোদিন রিধিকে জিজ্ঞেস করেছিস,কেন সে এমন দমে গেল?কেন সে নিরবতা বেছে নিল?”
রিধির আসল কাউন্সিলিং পারতো একমাত্র তার স্বামী।যার সাথে সে কথা বলতে চায়,যার সাথে সে সবকিছু বলে ফেলতে পারে,যার কাছে রিধি আশা রাখে,যাকে রিধি ভালোবাসে।রিধিমা দেখা যেত তার সাথে একটু কথা বলার জন্য অনেকটা সময় বসে থাকতো।ইশতিয়াক এসে ওর মাথায় হাত রাখলেই ওর মন ভালো হতো।
ইশতিয়াক একদিন ওর হাতে কয়েকটা কাগজ তুলে দিয়ে বলল,”মনে করো এটা একটা প্রিন্টার।তোমার ভেতরের যতো কথা জমা আছে,যতো কিছু তুমি আমাকে বলতে চাও,যতোকিছু তুমি আমাকে জানাতে চাও,সব তুমি এখানে লিখবে।একদম সময় নিয়ে,পুরো রাত নিয়ে।কোনো পয়েন্ট বাদ দিবে না।তোমার মনের সবকিছু এখানে লিখবে।লিখে আমার অফিস ব্যাগে রাখবে।কেমন?”
রিধিমা বলল,”এভাবে কি আর হয় নাকি?কতো কিছুই ভুলে গেছি আমি।”
“কিছুই ভুলো নি।লিখতে শুরু করো।সব আপনা আপনি মনে পড়বে।”
রিধিমা রাতে কাগজগুলো নিয়ে বসলো।ইশরার দায়িত্ব নিল ওর বাবা।সে খুব ভালো বাচ্চা সামলাতে পারে।বিশেষ করে ইশরাকে।
সবাই যখন ঘুমে তখন রিধিমা লিখতে শুরু করলো।প্রথমে মনে হলো,সে কিছুই লিখতে পারবে না।কিন্তু যখন লিখতে শুরু করলো,তখন তার মনে হলো,এই জীবনের সমস্ত মান অভিমান সে এক বসায় লিখে ফেলেছে।
প্রিয় ইশতিয়াক,
তুমি জেনে অবাক হবে,তুমি আমার জীবনের একমাত্র ব্যক্তি যাকে আমি চিঠি লিখেছি।তুমি জেনে আরো অবাক হবে,তুমি আমার জীবনের একমাত্র ব্যক্তি যার সাথে মন খারাপ হলে আমি তার শার্ট জড়িয়ে ধরে কান্না করি।এই কাজ তুমি বাদে আর কারো সাথে আমি করি নি।আমার মনে হয়,তোমার শার্টে তোমার ঘ্রাণ মিশে আছে।আমি তোমার ঐ ঘ্রাণেই তোমার অস্তিত্ব বুঝে নেই।কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য,এতোখানি তোমাকে চাওয়ার পরেও তোমার ধারণা,আমি তোমাকে ভালোবাসি না।
তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে পারিবারিক ভাবে,সম্বন্ধ করে।বাংলাদেশের অধিকাংশ মেয়েই এধরনের বিয়ের পর স্বামীকে ভালোবাসতে সময় নেয় কিছুটা।ভালোবাসা তো কোনো প্রতিযোগিতা না ইশতিয়াক।এটা একটা সাধনা।সময়ের ব্যাপার।
বিয়ের পর আমি পুরোদস্তুর সংসারী হয়ে উঠেছিলাম।স্বামী হিসেবে তোমার কোনো চাওয়া অপূর্ণ রেখেছি বলে মনে হয় না।যতোবার হাত বাড়িয়ে ডেকেছো তুমি আমায়,ততবার আমি সাড়া দিয়েছি।আমি বাধ্য মেয়ের মতো নিজেকে বার বার সমর্পণ করেছি তোমার সামনে।তুমি ডেকেছো,আর আমি মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছি,এমনটা কখনো হয়েছে?
বিয়ের পর আমার অনেক অনেক পরিকল্পনা ছিলো।পড়াশোনা নিয়েও ভাবছিলাম।এরমধ্যে ইশরা চলে এলো।আমি কনসিভ করলাম।তোমাকে জানাতেই খুশিতে তুমি উন্মাদ হয়ে গেলে।কিন্তু আমরা তো তখন বাচ্চা নেওয়ার প্ল্যান করি নি ইশতিয়াক।ঐ সন্তানটা তো আনওয়ান্টেডই ছিলো।আমি রিপোর্ট দেখে প্রচন্ড ভেঙে পড়লাম।তুমি আমার ভেঙে পড়া দেখে আমায় ভুল বুঝলে।বললে,এই সম্পর্কে আমার কোনো এক্সাইটমেন্ট নেই।আমি নাকি নিজের বাচ্চার প্রতি অন্যায় করছি।আমি স্বার্থপর হয়ে গেছি।
একবার বুকে হাত রেখে বলো তো,ইশরা পৃথিবী তে আসায় তুমি ঠিক কি হারিয়েছো?কি এমন ত্যাগ করেছো তুমি যার কারণে তুমি ভালো হলে,আর আমি হলাম স্বার্থপর?চাকরি গেছে তোমায়?যায় নি।উল্টো প্রমোশন হয়েছে।প্রচন্ড যন্ত্রনায় নয় মাস ছটফট করেছো তুমি?করো নি।অন্য আট দশটা সাধারণ মাসের মতোই মাস কেটেছে তোমার।সিজারের পর নিজের জীবনীশক্তির অর্ধেক ক্ষয়ে ছিলে তুমি?না।বাচ্চা হওয়ার পর মাস তিনেক বিছানায় পড়েছিলে তুমি?পড়ো নি।আমি পড়েছি।ঐ সমস্ত কিছুর ভেতর দিয়ে আমি গিয়েছি।
স্ত্রী ছিলাম আমি তোমার।প্রচন্ড বিশ্বাস করে একটা কথা বলেছিলাম তোমাকে।ইশরা পেটে আসার পর একদিন তোমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম,বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একটি ছেলেকে পছন্দ করতাম আমি।একপাক্ষিক পছন্দ।তাকে আমি জানাই নি কোনোদিন।সেও আর জানে নি কোনো ভাবে।তুমি সবটা শুনলে।আমি ভেবেছিলাম,তুমি স্বাভাবিক ভাবে নিবে সবটা।কারণ তুমিই জানতে চেয়েছিলে এই ব্যাপারে।বলেছিলে অতীত নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই তোমার।অথচ আমার সংসারে সবচেয়ে বড় অশান্তি শুরু হলো এরপরই।
আগেও আমাদের ভেতর টুকটাক ঝামেলা হতো।কিন্তু তুমি কখনো এর জন্য আমার অতীত টেনে আনতে না।অথচ যবে থেকে তুমি ঐ কথাটা জানলে,তবে থেকে তোমার ধারণা,আমার সব মন খারাপের কারণ আমার অতীতের সেই এক তরফা অনুভূতি।বিষয়টা আমার জন্য খুব লজ্জাজনক।তুমি সবকিছুকে টেনে ঐদিকে নিবে জানলে আমি কোনোদিন তোমাকে ঐ কথা বলতাম না।
আজ তোমাকে জানাতে চাই,তোমার ধারণা ভুল।আমি ঐ ছেলেকে আর মনে রাখিনি।কবুল বলার আগেই আমি আমার ভেতরের ঐ রিধিমাকে গলা টিপে মেরে তোমাকে আপন করে নিয়েছিলাম।অথচ তুমি,আমার স্বামী হয়ে কথায় কথায় আমাকে খোঁচা দিতে।
একবার মনে আছে?ঈদের দিন রাতে।আমি বেশ ক্লান্ত ছিলাম।তুমি আমার কাছে এলে।বরাবরের মতো আমি নিজেকে তোমার হাতে সপে দিলাম নির্ভার হয়ে,নিশ্চিন্তে।তুমি বরাবরই আধিপত্য দেখিয়েছো।আমি সাদরে সেটা গ্রহণ করেছি।
সেই রাতে তুমি যখন প্রচন্ড বেপরোয়া আর উন্মত্ত হয়ে উঠলে,তখন আমি কেবল অনুরোধ করে বললাম,ইশতিয়াক!আজ আমি ক্লান্ত।প্লিজ একটু আস্তে ধরো আমায়।তখন তুমি ছিটকে সরে গেলে আমার থেকে।অথচ কথাটা আমি আপন ভেবে বলেছিলাম তোমায়।কারণ তুমি তো আমার আপনই।
তুমি শুধু সরেই গেলে না।সরে গিয়ে তুমি একটা নোংরা অপবাদ দিলে আমায়।বললে,তুমি নাকি আমার প্রথম প্রেম না।তাই আমি দূরে ঠেলেছি তোমায়।সেদিন অপমানে,লজ্জায়,আত্মগ্লানিতে আমার শরীর পুড়ে গেল রীতিমতো।তুমি এই কথা বললে?দিনের পর দিন যার সাথে অন্তরঙ্গ হয়েছো তুমি,যার গর্ভে তোমার সন্তান বড়ো হয়েছে,যার শরীরের উপর তুমি যখন খুশি নিয়ন্ত্রণ চালিয়েছো,তার উপর তুমি এতো বিশ্রী অপবাদ দিলে।কেন?কোনো মেয়ে কি তার ভালোবাসার মানুষ কে কোনোদিন না বলতে পারে না?বলতে পারে না থেমে যেতে?এটাতে তুমি আমার অতীত টেনে আনবে?এতো ইনসিকিউর তুমি?এতো ফর্মাল আমাদের সম্পর্ক?যে ক্লান্তিময় একটি দিনে আমি আমার স্বামীকে থামিয়ে দিতে পারবো না?আমাদের সম্পর্কটা কি কেবল শরীরের ইশতিয়াক?মানসিক কিছু নেই বুঝি এখানে?
যাই হোক।সে কথা ছাড়ো।তোমার থেকে আদর নেওয়া আমার খুব পছন্দ।সেদিন সত্যিই ক্লান্ত লাগছিলো ভীষণ।কিন্তু আমাকে ভুল বোঝাই তো তোমার ধর্ম।
ইশরার জন্মের পর আমার হতাশাকেও তুমি গুরুত্ব দাও নি তেমন।অথচ আমার ভেতর কি চলেছে কেবল আমিই জানি।মাস্টার্সে আমাদের ব্যাচের মধ্যে রেঙ্ক করেছিলাম আমি।আমি আমাদের ব্যাচের সবচেয়ে বেশি গ্রেড পয়েন্ট পাওয়া স্টুডেন্ট।অথচ আমি মাস্টার্সের পর আর পড়তেই পারলাম না।ওদিকে আমার ফ্রেন্ডরা সব নানারকম ডিগ্রী নিতে ব্যস্ত।
একটা সরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ গ্রেড নিয়ে বের হওয়ার জন্য কতোখানি পরিশ্রম করতে হয় তুমি নিশ্চয়ই জানো।অতোখানি পরিশ্রমের পরেও আমার কোনো ক্যারিয়ার হলো না।আমার পেটে বাচ্চা এলো,আমি মা হলাম।
অথচ এই ব্যাপারটা নিয়েও আমি দুঃখ করতে পারতাম না,হতাশা দেখাতে পারতাম না।দেখালেই তুমি নারাজ হতে।বলতে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি আমি।অথচ রিধিমা কোনোদিন আত্মকেন্দ্রিক হতে শিখে নি ইশতিয়াক।জীবনের নানা দশায় আমি বেঁচে ছিলাম নানারকম মানুষের জন্য।
বিবাহিত জীবনের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী ভুলে যাওয়া তোমার জন্য অতি সাধারণ একটি ব্যাপার হতে পারে।কিন্তু আমার মতো একটি মেয়ে যে কি না সবসময় ইনফেরিওর কমপ্লেক্সিটিতে ভুগে,যে বিশ্বাস করে তাকে কেউ ভালোবাসে না,তার জন্য এই ব্যাপারটা খুবই সাংঘাতিক।তুমি আমার ধারণা কে সঠিক প্রমাণ করেছো।
কিন্তু এক সময় আমি বুঝলাম,তুমি আমাকে ভালোবাসো।খুব বেশি ভালোবাসো।তখন আমি এক্সপেক্ট করতে শুরু করলাম,তুমিই প্রতিবার সংকোচ ভুলে এগিয়ে আসবে।এটা হয়তো তোমার কাছে টেকেন ফর গ্র্যান্টেড মনে হতে পারে।কিন্তু আমার জন্য সেটা ছিলো আমার সমস্ত অন্যায় আবদারের জায়গা।কারণ আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম,একমাত্র ইশতিয়াকই আছে যে কিনা আমার নিরবতার বিপরীতে আমাকে ভালোবাসা দেয়।তোমার কাছে অন্যায় আবদার করেছি,কারণ আমি জানতাম তুমি কখনোই এসবের কারণে আমাকে ছেড়ে যাবে না।
কিন্তু লং টার্মে বোধহয় বিষয় গুলো খারাপ।তুমি হয়তো এতো অবহেলা নিতে পারো নি।
কিন্তু আমি তোমাকে জানাতে চাই,আমি তোমায় ভালোবাসি।দিনের পর দিন একজন লোকের সাথে সংসার করার পরেও তাকে ভালো না বাসার কোনো কারণ থাকতে পারে না।আমি আবারও বলছি,একটি ছেলেকে আমি খুব পছন্দ করতাম।কিন্তু এই পছন্দের কথা সে জানতো না,আমি জানাই নি।
বিয়ের পর আমি আর তাকে মনে রাখিনি।আমার জীবন জুড়ে এই তোমরাই ছিলে।দুঃখিত! তোমাকে আমি বুঝতে পারি নি।প্রথম কদম বাড়াতে বাড়াতে যে একসময় কেউ ত্যক্ত হয়ে উঠতে পারে,সেটা আমি ভাবিনি।
আমি একশো রকম কারণে মন খারাপ করতাম।কিন্তু ঐ একশো কারণ ছেড়ে তুমি বার বার একটা কারণই বড় করে দেখতে।তুমি আমার প্রথম প্রেম না।একথা সত্যি।কিন্তু তুমি প্রথম মানুষ যার জন্য আমি চিঠি লিখেছি।তুমি প্রথম মানুষ যার জন্য আমি রাত জেগে অপেক্ষা করেছি।তুমি প্রথম মানুষ,যার জন্য আমি শাড়ি পরতে শিখেছি।তুমি প্রথম মানুষ,যে আমাকে ভালোবাসা শিখিয়েছে।
এই পত্রখানা স্ত্রী হিসেবে আমার ব্যর্থতার প্রতীক।কারণ আমি তোমায় আমার দিকটা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি।তবুও সব শেষে তোমাকে জানাতে চাই,আমি তোমাকে ভালোবাসি।ইশরার বাবাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।তোমার সাথে আমার ডিভোর্স হলে আমি বোধহয় সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে যেতাম।ইশতিয়াক! তোমাকে ধন্যবাদ,আমায় পাগল না বানানোর জন্য।
চলবে-