বাবুই নীড়ে তারা দু’জন-০৮
-মেহরিমা আফরিন
ইশতিয়াক আজ বাড়ি ফিরলো এক গুচ্ছ টিউলিপ হাতে নিয়ে।ঢাকা শহরে টিউলিপ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর।তবুও সে আনলো।তনুশ্রী তখন ইশরা কে কোলে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলো।ইশতিয়াক জানতে চাইলো,”রিধি কোথায় তনু?”
“ভাবি রান্নাঘরে।”
“কেন?”
“ইশরার জন্য খিচুড়ি রান্না করছে।”
“ওহহ্।”
ইশতিয়াক ঘরে গেল।গিয়ে কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে এলো।এসে কিছুক্ষণ ঘরজুড়ে পায়চারি করলো।তারপর ফুলটা হাতে নিয়ে আয়নায় একবার নিজের প্রতিবিম্ব দেখলো।
সে আগেও দুই তিনবার এনেছিল টিউলিপ।তবে উপলক্ষ ছিলো তখন।আজ কোনো বিশেষ উপলক্ষ নেই।আনতে ইচ্ছে হলো,তাই আনা।
রিধিমা আজকাল চুপচাপ বসে তার দিকে তাকায়।কোনো কথা বলে,কিছু জানতেও চায় না।শুধু তাকায়।ইশতিয়াক ওর গালে হাত রেখে যখন জিজ্ঞেস করে,”তোমার কিছু হয়েছে রিধি?”
তখন শুধু মাথা নাড়ে।
ইশতিয়াকের ধারণা,সে এখনো অপরাধবোধে ভুগছে।মনে মনে সে লজ্জিত।আবার অনুতপ্তও।এর মধ্যে সে এটাও বিশ্বাস করে,তার মাথার ঠিক নেই।সবকিছু মিলিয়ে মেয়েটা কেমন ম্লান হয়ে গেছে।এই ম্লান হওয়াতেও তার ভয়।মানুষ যদি ভাবে সংসারে মন নেই তার?এই কথা সত্যি না।সংসারে তার মন আছে।
ইশতিয়াক খাটে গিয়ে বসলো।রিধিমা তড়িঘড়ি পায়ে ঘরে এসে বলল,”ইশতিয়াক! তুমি এসেছো?কফি দিবো তোমাকে?”
ইশতিয়াক চোখ তুলে তাকালো।শান্ত মুখে বলল,”না।ইশু কোথায়?”
“মার কাছে।খেলছে।”
“খাইয়েছো?”
“জি।”
“এদিকে আসো।”
রিধিমা হকচকিয়ে গেল।দরজা বন্ধ করে ইশতিয়াকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,”কি?”
ইশতিয়াক উঠে গিয়ে ফুলগুলো বাড়িয়ে দিলো রিধিমার সামনে।রিধি তাকালো সেদিকে।বলল,”এসব কি?”
“এই ফুলের নাম টিউলিপ।”
“সেটা জানি।হঠাৎ ফুল?”
“দিতে পারি না?”
রিধি ফুলগুলো হাতে নিলো।হেসে বলল,”অবশ্যই পারো।ধন্যবাদ তোমাকে।”
রিধিমা সব গুলো ফুল হাতে নিলো।ফুলের সাথে একটা চিরকুটও ছিলো।তাতে লিখা আছে-
আমি পৃথিবীর সবচেয়ে দারুণ মেয়েটিকে ভালোবাসি।
যেই মেয়ে বাদে ইশতিয়াক আর ইশরা দুই মিনিটও থাকতে পারে না,আমি সেই মেয়েটিকেই ভালোবাসি।
অথচ মেয়েটি ভালোবাসে টিউলিপ কে।তাই তার জন্য এক গুচ্ছ টিউলিপ।”
রিধিমা খুটিয়ে খুটিয়ে লিখাটা পড়লো।পড়ে মুখ গম্ভীর করে বলল,”চ্যাট জিপিটি?”
ইশতিয়াকের মুখটা চুপসে গেল।মন খারাপ করে,চূড়ান্ত রকমের হতাশ মুখে বলল,”এতো ভেবে লিখলাম।আমার আবেগটা তুমি চ্যাট জিপিটি বলে উড়িয়ে দিলে?”
রিধিমা হাসলো।এগিয়ে এসে ইশতিয়াকের একটা গালে হাত রেখে বলল, আমি জানি তুমি লিখেছো।রোবেটের লিখায় এতো মায়া দয়া থাকে না।”
“এই লিখাতে আছে?”
“হ্যাঁ।”
রিধিমা বলল,”এবার বলো,তুমি কি খাবে?”
ইশতিয়াক ওর হাতটা টেনে ধরে বলল,’কিছু খাবো না।তুমি এখানে আসো।’
রিধিমা কপাল কুঁচকে তার কাছে এলো।ইশতিয়াক তাকে তার এক পায়ের উপর বসিয়ে দিয়ে তার কপালের চুল গুলো সরিয়ে কানের পেছনে গুজে দিলো।
রিধিমা হাসলো।ইশতিয়াক ওর দুই হাত ধরে বলল,”এতো ঘেমেছো কিভাবে?”
“রান্নাঘরে ছিলাম।ইশরাও আজকাল অনেক জ্বালাতন করে।এক জায়গায় বসে খায় না।ওর পেছনে ছুটতে ছুটতেই এই অবস্থা আমার।’
“রাতে আমি খাওয়াবো ওকে।তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে।”
ইশতিয়াক আলতো করে ঠোঁটটা চেপে ধরে রিধিমার নোয়ানো চিবুকের সাথে।এরপর একটু সময় নিয়ে চুমু খেলো।ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,”রিধি! মন খারাপ তোমার?”
রিধিমা আরক্ত মুখে মাথা নাড়লো।নামানো স্বরে বলল,”মন তো ভালো ইশতিয়াক।তোমার মনে হচ্ছে আমার মন খারাপ?”
“উঁহু।এমনিই।মা কিছু বলেছে তোমায়?”
“না তো।কি বলবে?”
রিধিমা ফিক করে হেসে দিল।বলল,”একটু ভয় পায় মনে হয়।”
“তোমার এতে মন খারাপ হয়?”
“কখনো না।আমার বরের যখন সমস্যা নেই,মানুষের সমস্যা দিয়ে কি যায় আসে ইশতিয়াক?”
ইশতিয়াক ওর হাতটা ছেড়ে দিয়ে ওকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরল।খুব আগ্রহ ভরে জানতে চাইলো,”তুমি যে সেদিন বললে,তুমি আমায় ভালোবাসো,তুমি সত্যি আমায় ভালোবাসো?তোমার লিখা পড়ে মনে হলো,তুমি আমার সাথে এডজাস্টমেন্টে থাকো।”
“এডজাস্টমেন্টের সংসারে কেউ কারো জন্য রাতের পর রাত অপেক্ষা করে ইশতিয়াক?”
“তা জানি না।”
রিধিমা হাত দু’টো ওর কাঁধে রেখে বলল,”ইশতিয়াক! আমি এখন থেকে ভেবেছি মনে মনে কোনো কথা রাখবো না।তোমারও রাখা উচিত না।মনে মনে কথা রাখবো না বলেই একটা কথা বলি তোমাকে।তুমি সেদিন বললে আমার মনে যা দুঃখ আছে,তা যেন আমি লিখি।আমি তাই খুঁজে খুঁজে শুধু দুঃখ টুকুই লিখেছি।এর মানে এই না যে আমার সংসার কেবলই অনেকগুলো দুঃখের সমষ্টি।এভাবে সংসার টিকে না।
আমি তোমাকে এখন একটা কথা বলবো।কথাটা বললে তুমি ভীষণ খুশি হবে।খুশিতে তুমি আজ সারাক্ষণ আমার পিছু পিছু ঘুরবে,ইশরার মতো।”
“কি কথা?”
“আমি তোমাকে এক দুইবার ভালোবাসি নি।আমি তোমাকে অসংখ্যবার ভালোবেসেছি।
–তুমি ইশরা পেটে থাকা অবস্থায় খুব রাতে গিয়ে আমার জন্য আইসড টি আর বেকড পাস্তা এনেছিলে।আমি সেদিন তোমায় ভালোবেসেছি।
–তুমি ইশরা পেটে থাকা অবস্থায় প্রতিদিন আমার পায়ে অলিভ ওয়েল মেখে মালিশ করে দিতে।আমি সেদিন তোমায় ভালোবেসেছি।
–তুমি একবার অকারণেই গতবছর অক্টোবর মাসের পাঁচ তারিখে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে একটা শিউলি ফুল আমার কানের পিছে গুজে দিলে।দিয়ে বললে,শিউলি নাকি অক্টোবরের ফুল?অক্টোবর প্রেমের মাস।তাই প্রেমের মাসের ফুলটুকু তুমি দিলে তোমার প্রেমিকাকে।আমি সেদিন তোমায় ভালোবাসলাম।
–ইশরা হওয়ার পর তুমি সব ছেড়ে ছুড়ে আমার কাছে এলে।মেয়েকে একবার কোলেও নিলে না আমার জ্ঞান ফেরার আগে।সেদিন তোমায় এতোবেশি ভালোবাসলাম,যে খুশিতে আমি কান্নাই করে দিলাম।
–আমি ঘুমানোর পরে একদিন তুমি এসে আমার গায়ে কাঁথা তুলে দিলে।এরপর অকারণেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে।আমি সেদিন তোমায় ভালোবাসলাম।
–একবার ঝগড়ার মধ্যে মাথা গরম করে ফেলার ভয়ে তুমি থেমে গেলে।থেমে গিয়ে আমার দুই ঠোঁটে ইচ্ছে মতো চুমু খেলে।সেদিন আমি লজ্জায় পড়ে তোমাকে ভালোবেসে ফেললাম।
–সেদিন ড্রয়িং রুম ভর্তি মানুষের সামনে তুমি বললে,রিধি যদি আমাকে মেরেও ফেলে,তবুও আমি তার সাথেই সংসার করতে চাই।তখন আমি তোমাকে এতো বেশি ভালোবাসলাম,যেই ভালোবাসা আমার এই জীবনে কাউকে আমি দেয় নি।না ইশরা,না আমার বাবা।
তুমি অভিমান করো,যখন তুমি ভাবো,তুমি আমার প্রথম প্রেম না।আমিও অভিমান করি,যখন আমি ভাবি ইশতিয়াক নামের অভিন্ন একজন মানুষ কে আমি রোজ রোজ ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে নতুন করে ভালোবাসছি।”
রাত নেমেছে।ইশরা ঘুমিয়ে আছে খাটের মাঝামাঝি।রিধিমা ওকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেও ঘুমিয়ে গেছে।
ইশতিয়াক কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করলো।তারপর ওঠে ইশরা কে তুলে খাটের একপাশে দেয়ালের দিকে চাপিয়ে দিলো।
রিধিমা হাত বাড়িয়ে জায়গাটা খালি পেতেই ধড়ফড় করে উঠলো।
“ইশু!ইশু!”
ইশতিয়াক ওর মুখ চেপে ধরে কন্ঠস্বর খাঁদে নামিয়ে বলল,”ইশু আছে।আমি সরিয়েছি।চেঁচাবে না।”
রিধিমা পর পর দুইবার পলক ফেলল।ইশতিয়াক ওর মুখ থেকে হাত সরাতেই ফিসফিস করে বলল,”কেন সরালে?”
“সারাক্ষণ ম্যা ম্যা করে।এখন একটু দূরে থাকুক।”
রিধিমা হাসলো।হাত বাড়িয়ে বলল,”তুমি এখন রিধি রিধি করে আমার মাথা খেতে এসেছো?”
“হ্যাঁ।”
ইশতিয়াক ওকে টেনে নিজের কাছে আনলো।রিধিমা বলল,”আমি পাগল হওয়াতে ভালোই হয়েছে।আদর আহ্লাদ বেশি পাই।”
ইশতিয়াক মুখ শক্ত করে বলল,”তুমি পাগল না।”
“ঐ আরকি।শোনো ইশতিয়াক!”
“বলো।”
“মানুষ আমাকে কি ভাবে তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।কিন্তু তুমি সবসময় এমন থাকবে।”
“এমন মানে?”
“মানে তুমি সবসময় গলা উঁচু করে বলবে,রিধি যেমনই হোক,আমি তার সাথেই সংসার করবো।”
“আচ্ছা।এরপর?”
“বলবে রিধি পাগল হলেও আমার সমস্যা নেই।আমি ওর বর।বরের জন্য পাগল হবে না তো কার জন্য হবে?”
ইশতিয়াক মৃদুস্বরে বলল,”এরপর?”
“তুমি সবসময় সবার আগে সরি বলবে।”
“আচ্ছা।”
“আমি যখন বলবো,দূরে যাও চোখের সামনে থেকে,তখন তুমি এতো শক্ত করে আমায় জড়িয়ে ধরবে,যেন নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয় আমার।”
“আর?”
“আর যখন আমি তোমার সব কথায় কেবল মাথা নাড়বো,তখন বুঝবে আমি ভয়ংকর রেগে আছি তোমার সাথে।তখন তুমি চটপট আমাকে চেপে ধরে অনেক গুলো চুমু খাবে।”
ইশতিয়াক ওর কথা শুনলো।সে থামতেই মুখ তুলে রিধিমার কোমল গালে তিন চারটে চুমু খেল।রিধিমা হেসে বলল,”আরে বোকা।এখন বলি নি তো।রাগ হলে বলেছি।”
ইশতিয়াক ওকে আরেকটু কাছে টেনে ওর গালের সাথে গাল ঘঁষে বলল,”আর যখন আমি রাতে এমন টুপুসটাপুস চুমু খাবো,তখন তুমিও বুঝবে আমার তোমাকে চাই।”
রিধিমা হেসে ফেলল শব্দ করে।হাতের বালা জোড়া খুলে সাইডবক্সের উপরে রেখে মুক্ত হাতে ইশতিয়াক কে জড়িয়ে ধরে বলল,”আমারও।আমারও তোমাকে চাই।আদর করো তো একটু আমায়।”
পরের দিন ইশতিয়াক অফিসে যাওয়ার আগে রিধিমার জন্য একটা চিঠি লিখলো।সাথে দিলো কয়েকটা তাজা নয়নতারা ফুল।
চিঠিতে সে লিখলো,
“তুমি ভুল জানো,রিধি।তুমি একাই বার বার প্রেমে পড়ো না আমার।আমিও পড়ি।যতোবার আমি তোমার কাছে যাই,ততবার আমি তোমার প্রেমে পড়ি।গতকাল রাতেও পড়েছি।সামনে আবার পড়বো।
তোমাকে নিয়ে প্রচন্ড জেলাসিতে ভুগি।এতোটাই বাজে ভাবে পজেসিভ হয়েছি তোমার প্রতি,যে ইশরা সারাদিন তোমার গায়ের সাথে মিশে থাকলেও বিরক্তি ধরে আমার।
রিধিমা শোনো!
তোমাকে একটা কথা বলি।তোমাকে সামনে থেকে যতোবার আমি রাগ করে বলবো,আমি তোমার প্রথম প্রেম না,ততবার তুমি আমায় কাছে টেনে বলবে,আমি তোমার একমাত্র প্রেম।আমি আসলে তোমায় রাগানোর জন্যই ঐ কথা বলি।তুমি রাগবে না।তুমি উল্টো বলবে,তুমি প্রমাণ চাও তুমিই যে আমার একমাত্র প্রেম?বলেই আমার গালে,কপালে,ঠোঁটে সুন্দর করে আদর দিবে।যেভাবে আমি তোমাকে আদর করি,সেভাবে।এরপর তোমার নরম নরম হাতে আমার চুল টেনে দিবে।ইশরাকে ঘর থেকে আউট করে আমার স্ট্রেস দূর করে দিবে।এই ছোটো ঘরটায় প্রতিদিন বাসর হবে আমার।প্রতিদিন সংসার হবে।কি?তুমি করবে তো সংসার রিধি?এই আমার সাথে।এই তোমাকে ঠিকঠাক বুঝতে না পারা অপদার্থ লোকটার সাথে?আমি কিন্তু রোজ রোজ ফুল দিবো তোমায়।যেন তুমি বুঝতে পারো,আমি মানুষটা অবুঝ হলেও তোমাকে চাই ভীষণ করে।”
চলবে-