বাবুই নীড়ে তারা দু’জন-০৯[শেষ পর্ব]
-মেহরিমা আফরিন
এই শহরের নাম ব্রিস্টল।ইমারতের মতো উঁচু দালান,প্রশস্ত রাস্তায় সারি সারি প্রাইভেট কার,রাস্তার পাশে ড্যাফোডিলের ঝাড়,কখনো কখনো হুটহাট এক পশলা বৃষ্টি।
ইংল্যান্ডের আবহাওয়া বরাবরই চমৎকার।এখানে বৃষ্টি আসে বিনা নোটিশে।হুট করে এসে ব্যস্ত জনজীবন সিক্ত করে যায়।সেই বৃষ্টিতে ব্রিস্টলের রাস্তাঘাট ধুয়ে যায়।ধুয়ে যায় ম্যাপল গাছের সব ক’টা পাতা।ড্যাফোডিলের ঝাড় ভিজে ভিজে সতেজ হয়ে উঠে।কি দারুণ! কি দারুণ!
ব্রিস্টলের সেই নিরিবিলি,অভিজাত এলাকায় তাকে দেখা গেল গাড়ি চালানো অবস্থায়।একহাতে দেড় দুই বছর বয়সী একটা বাচ্চা।অন্য পাশের সিটে একটা স্কুল পড়ুয়া মেয়ে।সিটবেল্ট শক্ত করে বেঁধে সে মনোযোগী চোখে রাস্তার দিকে চেয়ে ছিলো।তার নাম ইশতিয়াক।সাথের দু’টো বাচ্চাও তারই।বুকের বাচ্চাটা ছোটো।নাম ইশান।পাশে বসে থাকা মেয়েটার নাম ইশরা।সে এই বছর সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তি হয়েছে।তাকে স্কুল থেকে আনা নেওয়া করে তার বাবা।
তারা থাকে ক্লিফটন নামের একটা এলাকায়।এলাকাটা বেশ সাজানো গোছানো,কোলাহল নেই তেমন,জীবনযাত্রার মান বেশ উন্নত।ইশতিয়াক গাড়ি থামালো লোহার তৈরি একটা গেইটের সামনে।ভেতরে ঢুকলেই প্রথমে একটা ছোটো বাগান।তারপর একটা ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের ইটের নির্মিত দুই তালা একটি দালান।এই ছোটোখাটো বাড়িটা পছন্দ করেছে রিধিমা নামের এক মেয়ে।সে আবার বাড়ির সামনে নতুন কিছু চারাগাছও লাগিয়েছে গত মাসে।মেয়েটা ইশতিয়াকের হৃদয়ের খুব কাছের।
ইশতিয়াক দীর্ঘশ্বাস ফেলল।এলোমেলো চোখে একবার ম্যাপল গাছটার খড়খড়ে শুকনো পাতার দিকে তাকিয়ে চপল পায়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।
ইশরার ব্যাগটা তার হাতে।
ইশরা গাড়ি থেকে নেমেই বাড়িতে ঢুকে গেছে।স্কুল করার পর তার আর হুশ থাকে না।গিয়েই হাত পা ছড়িয়ে ঘুম দেয়।
ইশতিয়াক গাড়ি লক করে তার পিছু পিছু গেল।তার কোলে ইশান,বাবার শার্টের কলার ধরে নিরবে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে।ইশতিয়াক বাসায় ঢুকেই সবার আগে ইশান কে কোল থেকে নামিয়ে দিলো।
ইশরা ততক্ষণে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছে।ইশতিয়াক ঘরে গিয়ে কিছুটা শাসনের সুরে বলল,”ইশু!এখনই ঘুমাবে না।আগে গোসল করবে।তারপর খাবে।এরপর গিয়ে ঘুমাবে।”
ইশরা ক্লান্ত মুখে হাত পা ছুড়ে বলল,”না পাপা।এখন ঘুমাবো।পরে গোসল।”
“ইশু!উঠো।মা নয়তো খুব রাগ হবে।”
ইশতিয়াক গিয়ে ওকে টেনে তুলল।ইশরা দু’হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে বাবার দিকে তাকালো।ইশতিয়াক ওকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল,”তুমি না আমার লক্ষী মা?যাও।গোসল করে আসো।পাপা খাবার দিচ্ছি টেবিলে।”
তোয়ালেটা হাতে নিয়ে ইশরা গেল ওয়াশরুমে।বিদেশের লোকজন কৃপণ ভারি।ওয়াশরুমটা এতো ছোটো করে বানায়! কোনো মতে শরীরটাই আঁটে।ইশরা গিয়ে ঝরনা ছেড়ে দাঁড়ালো।
ইশতিয়াক ততক্ষণে ফ্রিজ থেকে খাবার নিয়ে গরম করেছে।ইশান খেলছিল কার্পেটে বসে খেলনা দিয়ে।তার খাবারও রান্না করতে হবে।ইশানের খাবার তারা দু’জন গরম গরমই রান্না করে।রিধিমা বলেছে,ছেলেকে যেন ফ্রিজের খাবার না খাওয়ানো হয়।ইশতিয়াক বাধ্য স্বামী।ও বউয়ের কথা খুব শোনে।
সব কাজ সামলে ইশতিয়াক ইশানকে কোলে নিয়ে চেয়ারে বসে।ইশরা তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে তার সামনে আসে।এসে তোয়ালেটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,”চুল মুছে দাও পাপা।”
ইশতিয়াক আলতো হাতে যত্ন নিয়ে মেয়ের চুল মুছে দেয়।তারপর তাকে পাশের চেয়ারে বসিয়ে নিজের হাতে ভাত মেখে খাওয়ায়।
এমন সময় কলিংবেল বাজে।ইশরা চেয়ার থেকে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
দরজা খুলতেই একটা মুখ চোখে পড়ে।শাড়ির কুচি সামলে ইশরা কে সাথে নিয়ে একটা বোকাসোকা মেয়ে মানুষ খাবার ঘরে উঁকি দেয়।তাকে দেখে চোখ দু’টো শান্তি পায় ইশতিয়াকের।মেয়েটির নাম রিধিমা।
বরাবরের মতো সেদিনও সে উঁকি দিলো।ইশতিয়াক স্থির চোখে,একদৃষ্টিতে তাকালো তার মুখের দিকে।ব্রিস্টল থেকে পার্ক স্ট্রিটের ব্যস্ত রাস্তা পাড়ি দিয়ে ক্লিফটন পর্যন্ত আসতে আসতে চোখ মুখ ভীষণ ক্লান্ত হয়ে উঠেছে তার।ইশতিয়াকের সাথে চোখাচোখি হতেই একগাল হাসলো সে।শাড়ির আঁচলটা হাতে প্যাচিয়ে মুখজুড়ে ইয়া বড়ো একটা হাসি টেনে ভেতরে এলো রিধিমা।
ইশতিয়াক ওর শাড়ির রংটা দেখে আর পলক ফেলতে পারলো না।আজ সকালে দু’জনের দেখা হয়নি একবারো।ইশতিয়াক কে ঘুমে রেখেই মেয়েটা বেরিয়ে গেল।এরপর দুই বাচ্চা সামলে এতোক্ষণে আবার দেখা হলো দু’জনের।রিধিমা খুব অনুগত ভঙ্গিতে তার সামনে এসে দাঁড়ালো।ইশতিয়াক তার হাত ধরে বলল,”এতো টায়ার্ড দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?অনেক বেশি প্রেশার?”
রিধিমা মাথা নাড়লো।
“আমি কোথায় টায়ার্ড?তোমাকেই উল্টো টায়ার্ড লাগছে।বাচ্চা দু’টো খুব জ্বালায় তোমাকে তাই না?”
ইশতিয়াক হাসলো।ঐ হাসিতে রিধিমা কোনো ত্যক্ততা কিংবা বিরক্তি খুঁজে পেল না।উল্টো মনে হলো,দুই বাচ্চা সামলে,বউকে ইউনিভার্সিটি পাঠিয়ে মহা সুখে দিন কাটাচ্ছে সে।
বাচ্চা দু’টোকে ইশতিয়াকই খাওয়ালো।তারপর আবার নিজে গিয়ে তৈরি হলো অফিস যাওয়ার জন্য।তার ডিউটি ইভিনিং আওয়ারে।
রিধিমাই আলমারি থেকে তার সব জামা কাপড় বের করে দিল।বাচ্চারা এই সময়ে ঘুমায়।ইশতিয়াক শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল,”আজ সব ক্লাস হলো?”
“হু।হলো তো।”
“তোমার পেপার সাবমিট করেছো?”
“উঁহু।আরো একটু কাজ বাকি আছে।কাল করবো।”
“আচ্ছা।”
ইশতিয়াক সবগুলো বোতাম আটকে নিল।রিধিমা এসে টাই হাতে তার সামনে দাঁড়াতেই সে দুই হাতে রিধিমার কোমরের দুই পাশ জড়িয়ে তাকে একেবারে নিজের কাছাকাছি এনে দাঁড় করালো।রিধিমা তার টাই বাঁধতে বাঁধতে বলল,”তুমি ক্লান্ত হও না ইশতিয়াক?”
“কি নিয়ে ক্লান্ত হবো?”
“এই সবকিছু নিয়ে।সারাদিন দৌড়াচ্ছ।আবার ফ্যামিলির জন্য সময় বের করছো।তোমাকে আমার বড্ড ক্লান্ত লাগে আজকাল।”
“আমি ক্লান্ত নই।তোমাদের জন্য কিছু করলে আমি ক্লান্ত হই না।বরং আরাম পাই আমি।”
“ইশশ রে! বাজে লোকের মিষ্টি কথা।”
ইশতিয়াক ওর শাড়ি গলিয়ে হাতটা ওর উদরের সাথে চেপে ধরে বলল,”কি বাজে কাজ করেছি আমি?”
“এখনো করছো।”
ইশতিয়াক ঐ কথা শুনলো না।পাক্কা আড়াই মিনিট সময় নিয়ে সে রিধিমার ঠোঁটে চুমু খেল।তারপর তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল,”আসি।রাতে আবার দেখা হবে।”
রিধিমা যন্ত্রের মতো ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে।ঐরকম আদর ভালোবাসা দিয়ে লোকটা হুট করে গায়েব হয়ে যায়।এরপর সারা সন্ধ্যা রিধিমা কাটায় ভয়ানক রকম বিষাদ নিয়ে।
উফফ!ব্রিস্টলের গল্পই তো বলা হয়নি।
আপনাদের রিধি আবার পড়াশোনা করছে জানেন?ও করতে চায় নি একদমই।ওর বর ওকে জোর করে আবার কাগজ কলমের দুনিয়ায় ছেড়ে দিয়েছে।রিধিমা মানা করার পরেও সে শুনে নি।বলল,এম.ফিল. টা অন্তত রিধিকে শেষ করতেই হবে।
ইশরার জন্মের প্রায় দশ বছর পরে তাদের ঘরে আরেকজন মানুষ এলো।তার নাম ইশান।ওর জন্ম এখানেই,ক্লিফটনের এই পুরাতন দিনের বাড়িতে।রিধিমা আর ইশতিয়াক প্রায় আড়াই বছর ধরে থাকে এখানে।
দু’হাজার পঁচিশের দিকে একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্ট টিচার হিসেবে শিক্ষকতা করেছিল রিধিমা।পরে আর অন্য কোথাও এপ্লাই করে নি।তখন নাকি পড়াশোনা আর টানতো না তাকে।এমনকি টাকা পয়সা আয় রোজগারেও কোনো মাথাব্যথা ছিলো না তার।ইশতিয়াক তাকে জোর করলো বহুবার।সে জানালো,সে সংসার করবে,ভালো মা হবে।এটাই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।ওসব চাকরিতে আর ইচ্ছে নেই তার।
এর মাঝে ইয়াশের বিয়ে হলো তিন্নি নামের একটি মেয়ের সাথে।তনুশ্রীর বিয়ে হলো তুরহান নামের একটি ছেলের সাথে।সে বিস্তর কাহিনি।লিখতে গেলে নতুন গল্প হয়ে যাবে।
রিধিমা আর ইশতিয়াক দু’হাজার আটাশ সালে এই শহরে এসেছে।ইশতিয়াকের জবের লেটার এসেছে।বিরাট বেতনের চাকরি,উন্নত জীবনযাপন।হাতছাড়া করার কোনো মানেই হয় না।
ব্যাস,রিধি আর ইশরাকে নিয়ে একেবারে উড়াল দিয়ে সে চলে এলো ব্রিস্টলে।
এখানেই তার অফিস,বাড়ি থেকে এক ঘন্টার মতো সময় লাগে যেতে।
বাড়ি আরো কাছে কোথায় নেওয়া যেত।কিন্তু রিধিমার ইচ্ছে,সে একটা ছিমছাম বাড়ি নিবে।বাড়ির সামনে বাধ্যতামূলক একটি বাগান থাকতে হবে।সাথে থাকতে হবে কমলা রঙের পাতার একটি দৃষ্টিনন্দন ম্যাপল ট্রি।
সবকিছু মিলিয়ে এই একটা বাড়িই পাওয়া গেল।রেন্ট একটু বেশি।কিন্তু রিধি যা যা চেয়েছে,তার সব এই বাড়িতে আছে।ইশতিয়াক খরচের চিন্তা না করে এই বাড়িটাই ভাড়া নিলো।বেতনের অঙ্ক বেশ বড় বলে পরে গিয়ে আর কোনো সমস্যা হলো না।দেখা গেল চার সদস্য নিয়ে ক্লিফটনের সেই বাড়িতে ইশতিয়াক দিব্যি সুখে দিন কাটাচ্ছিল।পরের বছর ইশান হওয়ার পর একটা গাড়িও কিনলো।সাথে আরেকটা কাজ করলো।
রিধিমাকে এম ফিলের জন্য ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টলে ভর্তি করিয়ে দিলো।
রিধিমা শুরুতে চায় নি।ইশতিয়াক ওকে বলল,তুমি বলেছো আমার সাথে কখনো সৌজন্য দেখাবে না।আমার থেকে কিছু গোপন করবে না।সত্যি করে বলো,তুমি চাও না এম.ফিল করতে?
রিধিমা তখন আর না করতে পারলো না।এই জীবনে মাস্টার্সের পর আরেকবার বই খাতা ছুঁয়ে দেখার খুব সাধ ছিলো।ইশতিয়াক তার ঐ সাধটুকুও পূরণ করলো।
আনুমানিক আঠারো থেকে বিশ মাসের কোর্স।রিধিমা বলল,”বাচ্চা গুলোকে কে দেখবে?”
ইশতিয়াক ওকে অভয় দিয়ে বলল,”আমি দেখবো।চিন্তা করো না।চোখের পলকে সময় কেটে যাবে।”
সময় আসলে চোখের পলকেই কাটলো।একেবারে ফট ফট করে ছয়টা মাস কেটে গেল।অথচ রিধিমার মনে হলো,এই তো সেদিন এম ফিলের কোর্স শুরু করেছিল সে।
জীবন যে কি অদ্ভুত রকম সুন্দর হয়েছে আজকাল! রিধিমা প্রকাশ করতে পারে না ঠিক মতো।তার পড়াশোনার কথা ভেবে ইশতিয়াক নিজে ইভিনিং আওয়ারে অফিস করে।সকালে রিধিমা যায় ক্লাস করতে।রাতে ইশতিয়াক বাড়ি ফিরলে দু’জন মিলে রান্না করে।কখনো রিধিমা একাই সব করে।ওর ভালো লাগে করতে।
বাড়ির সামনের ম্যাপল গাছটা ওর সাংঘাতিক প্রিয়।প্রায় সময় বারান্দায় একটা কাঠের চেয়ার এনে বসে এক কাপ চা হাতে নিয়ে রিধিমা একদৃষ্টিতে ঐ গাছটার দিকে চেয়ে থাকে।শীত আসলে গাছের পাতা শুকিয়ে যায়।সবটা ঝরে যায় তখন।এরপর বসন্তে আবার গাছ ভরে পাতা আসে।মলিন,বিমর্ষ গাছটা আবার কমলা রঙে সেজে যায়।
রিধির মনে হয়,ঐ ম্যাপল গাছটা আসলে সে।এককালে এমন করেই পাতা গুলো সব খসখসে হয়ে ঝরে গিয়েছিলো।তারপর বসন্ত এলো।রিধিমার সর্বাঙ্গ আবার নতুন করে সাজলো।ঐ বসন্তের নাম ইশতিয়াক।যাকে ছাড়া ক্লিফটনের এই ফকফকে পরিষ্কার রাস্তায় এক পা ফেলতেও ভয় হয় রিধিমার।
বিয়ের পর এক রকম সমস্যায় জর্জরিত হতে থাকে স্বামী স্ত্রী।আগের মতো আর চাঞ্চল্য থাকে না সম্পর্কে।আগের সেই উন্মাদনাও যেন ম্লান হয়ে যায়।
রিধি আর ইশতিয়াকের ক্ষেত্রে সব হলো উল্টো।দিন কে দিন ছেলে মানুষ হয়েছে তারা।যত দিন যায়,সম্পর্ক ততো সতেজ হয়,উন্মাদনাও বাড়ে আপনাআপনি।এক যুগের মতো সময় ধরে চলমান দাম্পত্যে তারা চুমু খায় নব দম্পতিদের মতো।কাছে আসে সদ্য বিবাহিতা স্বামী স্ত্রীর মতো।বাচ্চা দু’টো ঘুমিয়ে গেলে লুকিয়ে লুকিয়ে বাগানে যায় দু’জন।একান্তে কিছুটা সময় কাটায়।তখন দেখে মনে হয়,কিছুক্ষণ আগে বিয়ে হয়েছে তাদের।
সেদিন রাতেও বাচ্চা দু’টো ঘুমিয়ে গেল আগে আগে।ইশতিয়াক ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে সোফাতেই গা ছেড়ে দিলো।
রিধিমা গিয়ে বারান্দায় টেবিল সাজালো।
তারপর নতুন একটা শাড়ি পরে ইশতিয়াক কে ডেকে তুলল।
“ইশতিয়াক! এ্যাই ইশতিয়াক!”
ইশতিয়াক অল্প করে চোখ খুলে বলল,”কি হয়েছে?”
“বারান্দায় এসো।কথা আছে।”
ইশতিয়াক বারান্দায় এলো।আসতেই কেমন চমকে গেল।ছোটো সাইজের বর্গাকার টি টেবিলের উপর একটা কেক রাখা।তার উপর বাংলায় লিখা-ভালোবাসার এক যুগ।
মাথাটা হঠাৎ চক্কর দিয়ে উঠল।ইশতিয়াক তৎক্ষনাৎ ক্যালেন্ডার দেখে বলল,”আজ….আজ বিবাহবার্ষিকী আমাদের?”
রিধিমা হাসি মুখে বলল,”হ্যাঁ।”
বড্ড অনুতপ্ত দেখালো ইশতিয়াক কে।
“এবারো ভুলে গেলাম রিধি?কেন এমন হয় আমার সাথে বলো তো?”
রিধিমা ওকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে গুটিশুটি মেরে বলল,”তুমি সবসময় ভুলেই যেও ইশতিয়াক।যেন প্রতিবার এভাবে আমি তোমাকে চমকে দিতে পারি।”
প্রতিবার অবশ্য রিধিই চমকে দিত।একটা কেক,যেটা সে নিজ হাতে বানাতো,একটা চিঠি,যা সে নিজ হাতে লিখতো,আর এক গুচ্ছ ফুল,যা সে নিজ থেকে জোগাড় করতো-একটানা বারো বছর নিয়ম করে সে এভাবেই চমকে দিয়েছে ইশতিয়াক কে।
এইবার সে তাকে দিলো ডেইজি ফুল।তাও একশোটা।ইশতিয়াক ঐ ফুলগুলো দেখে কেমন যে অন্যমনস্ক হয়ে গেল।কি সুন্দর! কি সুন্দর!
এরপর সে বারান্দায় বসে রিধির চিঠিটা পড়লো।রিধি ততক্ষণে শাড়ির কুচি কিঞ্চিৎ উঁচু করে ধরে বাগানের ঘাসে পা রেখেছে।
ইশতিয়াক পড়লো-
“আমার প্রিয়র চেয়েও প্রিয়,
বারোটা বছর এই মেয়েকে সহ্য করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।তোমার মতো নিরেট ভদ্রলোক কেন আমার মতো নিষ্প্রাণ,নির্বিকার একটি মেয়েকে ভালোবাসলো,আমি জানি না।খুব সম্ভবত স্রষ্টা অজ্ঞাত কারণে পুরষ্কৃত করেছে আমায়।
বারো বছর!বিশ্বাস হয় তোমার?দুই বছর পাঁচ মাসেই যেই ঘরটা ভেঙে যেত,ঐ ঘরটা বারো বছর ধরে টিকে আছে।কে টিকিয়ে রাখলো?তুমিই বোধহয়।
তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আমার।ভালোবাসারও কোনো সীমা নেই।তোমাকে এতো বেশি ভালোবেসেছি যে তুমি পাশে থাকলেও তোমার কথা মনে পড়ে।প্রত্যেক সন্ধ্যা আমি তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে অপেক্ষা করি তোমার।ম্যাপল গাছের ফাঁকফোঁকড় দিয়ে মেইন গেইটের দিকে চেয়ে থাকি।তুমি আসবে এই অপেক্ষায় আমার সন্ধ্যা কাটে না জানো?
এক জীবনে তোমার বড়ো আক্ষেপ ছিলো।কেন তুমি প্রথম প্রেম হলে না আমার?সেই আক্ষেপ স্রষ্টা এমন করে পুষিয়ে দিলো যে তুমি আমার ধ্যান জ্ঞান সব হয়ে উঠলে।এক যুগ ধরে তোমার ঘরনি হয়ে এখনো তুমি আসার আগে অস্থিরতায় হাত পা ঠান্ডা হয় আমার।এখনো তুমি কাছে এলে নিঃশ্বাসে ভাটা পড়ে।বড়ো ছেলে মানুষ হয়ে যাই তোমার কাছে এসে।তুমি ভালোবেসে আমাকে একটা বোকা,অবুঝ,আর আবেগী মেয়ে বানিয়ে দিলে ইশরার বাবা।এতোটাই আবেগী যে,সাইত্রিশ বছরের আমি তোমার কাছে এলে ষোলো বছরের সেই বাচ্চা মেয়েটি হয়ে যাই।
মাই বিলাভড হাসবেন্ড!এমন করেই বিবাহবার্ষিকী ভুলে যেও প্রতিবার।যেন হাত ভর্তি ডেইজি আর এলোমেলো শব্দের একখানা চিঠি দিয়ে তোমার রাতটুকু স্মরণীয় করে রাখতে পারি আমি।
এই শহরে খুব বৃষ্টি হয় জানো?অক্টোবর রেইন।এই বৃষ্টিতে জ্বর হয় না।উল্টো প্রেম বাড়ে।চলো ইশরার বাবা।আজ একটু বৃষ্টিতে ভিজি।প্রেম বাড়াই আরেকটু।আরেকবার নিজেদের নবদম্পতির মতো আবিষ্কার করি।চলো চলো।
ইতি,
রিধি ছাড়া আর কে?(হুমায়ুন আহমেদের মতো হয়ে গেল তাই না?হাহাহা)
ইশতিয়াক চিঠিটা ভাঁজ করে একবার বুকের সাথে চেপে ধরলো।
বাগানের ঘাসে তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা জমা হচ্ছে।রিধিমা হালকা রঙের শাড়ি পরে দু’হাত মেলে বৃষ্টিতে ভিজছে।ম্যাপল গাছ আর ড্যাফোডিলের ঝাড় অবাক হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে।ভাবছে,ভিনদেশে এই অদ্ভুত মেয়েটি এমন করে ভিজছে কেন?
চিঠিটা ড্রয়ারে রেখে ইশতিয়াক ছুটে গেল সেখানে।বৃষ্টির তেজ ততক্ষণে বেড়েছে।রিধিমা ভিজে গেছে পুরোটাই।ইশতিয়াক বলল,”জ্বর উঠবে তো সোনা।”
“কিচ্ছু হবে না।তুমি আসো।”
ইশতিয়াক এলো।অক্টোবরের শান্ত,স্নিগ্ধ,ছন্দোময় বৃষ্টি তাকে পর্যন্ত ভিজিয়ে গেল।রিধি বলল,”এটা ভালোবাসার বৃষ্টি।এই বৃষ্টিতে প্রেম ঝরে।অক্টোবর রেইনের কথা শুনো নি বুঝি?”
শুনে ইশতিয়াক হাসে।বৃষ্টিতে ভিজে জামা কাপড় সব গায়ের সাথে আটকে যায়।রিধির মুখে তখন ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির পানি।ইশতিয়াক হাত বাড়িয়ে পানি টা ঝেড়ে দিলো।রিধিমা বলল,”এদিকে আসো।”
ইশতিয়াক এলো।রিধিমা চিবুক নামিয়ে ঠিক মাথার মাঝ বরাবর যাওয়া সিঁথিটা দেখিয়ে বলল,”আদর করো।”
“করেছি।”
রিধিমা আবার ভিজছে।দু’হাত মেলে,প্রচন্ড প্রশান্তিতে।জ্বর বাঁধানো নিয়ে তার চিন্তা নেই।জ্বর হলেও বা কি?ইশতিয়াক সামলে নিবে।যেমন করে সে সামলাচ্ছে,বারো বছর ধরে।
প্রকান্ড ম্যাপল গাছের গাঢ় খয়েরী কান্ডের সাথে হেলান দিয়ে ইশতিয়াক ওর দিকে তাকালো।এই মেয়েকে দেখলে চোখ দু’টো খুব আরাম পায় তার।দেখতে দেখতে চোখ ভরে আসে,ঘোলাটে দেখায় সবকিছু।
ঠিক তখনই বাড়ির নেমপ্লেটের পাশে কাডবোর্ডে লিখা বাক্যটি খুব করে মনোযোগ আকর্ষণ করে তার।
লিখাটা রিধিমার হাতের।বাড়িতে উঠার তৃতীয় দিনে খুব আহ্লাদ করে পেনসিল আর মার্কার এনে লিখেছিল সে।
সেখানে লিখা-Home is not a place,It’s a person.[অনুবাদ:ঘর কোনো জায়গা নয়।ঘর হলো একটা মানুষ।]
________সমাপ্ত________