বাসন্তীগন্ধা পর্ব-২২+২৩

0
338

#বাসন্তীগন্ধা
|২২|
লাবিবা ওয়াহিদ

রোজা চোখ মেলে সাইয়ানের দিকে তাকালো। সাইয়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। তা দেখি মুচকি হাসলো রোজা। আবারও বলতে শুরু করলো,

–“স্পর্শ গুলো বুঝতে না পারলেও কী ধরণের স্পর্শ সেটা বুঝতাম না। কারণ এই ধরণের স্পর্শের মুখে আগে কোনোদিন পরিনি। বড়ো ভাইও ছিলো না যে ভাইদের ভালোবাসা বুঝতে পারবো। তবে এটুকু মনে হচ্ছিলো কোনো ভাই এরকম ভাবে স্পর্শ করে না। বাবা আদর করলেও অস্বস্তি হতো না৷ শুধুমাত্র রুবেলের কাছে থাকলেই অস্বস্তি হতো। সময় বাড়তে লাগলো, রুবেলের উক্ত্যক্তর তীব্রতাও দিনদিন বাড়ছিলো। শেষে একদিন কেঁদে দিয়ে বলেছিলাম আমার থেকে দূরে থাকতে। আমার তাকে একদম পছন্দ না। রুবেল তখন রাগে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে দু’গালে দুই চড় দিয়েছিলো। তারপর কাউকে কিছু না বলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

রুবেলের চড়ের কারণে সেদিন খুব জ্বর আসে আমার। রুবেল বাড়ি ফেরেনি। সেই রাগে সৎ মা সেদিন প্রথমবারের মতো আমায় অনেক বেশি মেরেছিলো। মারতে মারতে আমায় আধমরা করে ফেলেছিলো। বাবা মাঝে না আসলে হয়তো সেদিন মরেই যেতাম। দুইদিন আধমরা হয়ে রান্নাঘরেই পরে রইলাম। কেউ আমায় বিছানায় পর্যন্ত নিয়ে যায়নি। সৎমা নিজের মতো কাজ আর রান্না-বান্না করে চলে যেত। আমার দিকে খেয়ালই করতো না। যেন আমি অদৃশ্য কিছু, আমাকে চোখে দেখা যায় না।

এরপর আসে সেই বীভৎস রাত। সেদিন রান্নাঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ বাজে অনুভূতি হতেই চোখ মেলে তাকালাম। দেখতে পেলাম রুবেল আমার সাথে…”

রোজা থেমে গেলো। হাত দুটো মুঠিবদ্ধ করে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলতে লাগলো,
–“রুবেলের কাছে কত আকুতি মিনুতি করেছি। কিন্তু সে আমার কোনো কথা কানে নেয়নি। ভীষণ হিংস্র হয়ে উঠেছিলো সে। যখন দেখলাম কোনো কথাতে কাজ হচ্ছে না, তখন নিজেকে বাঁচানোর জন্য খুব কষ্টে তাক থেকে ভারী কাঁচের জগটা তুলে নেই। অতঃপর সেটা দিয়ে নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে রুবেলের মাথায় আঘাত করে সরিয়ে দেই। উপরওয়ালার কী রহমত, ওইটুকুনি আমাকে হঠাৎ বড়ো বানিয়ে ফেললো। আমি চটজলদি উঠে দাঁড়ালাম। এমন ঘটনায় নিজের আহত শরীরেও কেমন প্রাণ বাঁচানোর উৎস খুঁজছিলাম। সেই সঙ্গে ভয়ও করছিলো, রুবেলকে এই আঘাত করেছি ভাবতেই ভয়ের আশঙ্কা আরও বেড়ে যাচ্ছিলো। রুবেল জ্ঞান হারিয়েছিলো আর আমি ভেবেছিলাম ম* রে গেছে। আমি দ্রুত দিক-নির্দেশনা না দেখে সদর দরজার দিকে ছুটে যায়। দরজা কোনোরকমে খুলে দারোয়ানের কাছে গিয়ে কিছু বলার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন চোখ খুলি তখন নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করি। পাশে পেয়েছিলাম আমার মাকে। মা চোখে জল নিয়ে আমার দিকেই তাকিয়েছিলো।

পরে জানতে পারি দারোয়ান আঙ্কেল-ই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো আর মাকে সেই খবর দিয়েছিলো। মা-ই নাকি দারোয়ানকে বলে রেখেছিল যাতে কোনো বিপদ হলে দারোয়ান তাদের জানাতে পারে। দারোয়ান আঙ্কেলও ভীষণ ভালো মানুষ ছিলেন, আমাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি নিজের চাকরীর পরোয়া না করে আমাকে বেশি মূল্য দিয়েছেন। জানেন, আল্লাহ’র কাছে অনেক দোয়া করি। ওই মুহূর্তে উনি আমাকে না বাঁচালে আমি হয়তো আর বাঁচতাম না। আমাকে খুবলে খেত ওরা।”

এই মুহূর্তে এসে রোজাকে বুকে টেনে নিলো সাইয়ান। রোজার সঙ্গে সঙ্গে আবেশে চোখ বুজে এলো। কী পরম শান্তি। রোজা অনুভব করছে সাইয়ানের হৃদপিন্ডের ধুকপুকানির শব্দ ক্রমশ বাড়ছে। সেই শব্দ শুনতে শুনতে রোজা সাইয়ানের টিশার্ট খামচে ধরে বলতে লাগলো,

–“সেই ঘটনার পর মা আমাকে নিয়ে খুলনা ছেড়ে চট্টগ্রামে চলে আসে। এখানে আমার মামা ছিলো। অর্থাৎ আমার নানাবাড়ি। মা যেই বাড়ীতে থাকছেন ওটাই আমার নানার ভিটে৷ মামা’রা আলাদা হয়ে গিয়েছে।

আমি শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকলেও মানসিক ভাবে আমি খুব-ই বিপর্যস্ত ছিলাম। আমাদের এত টাকাও ছিলো না যে আমার চিকিৎসা করাবে। মা-ও গার্মেন্টসে চাকরি করে একা হাতে সব সামাল দিয়েছে৷ তাই সবকিছু ভেতরে চাপা দিয়ে আমি পড়াশোনা করতে লাগলাম। মা সবসময় চেষ্টা করতো যেন ওই ভয়ংকর দিনটা আমার জীবন থেকে মুছে যাক। এজন্যে সবসময় স্বাভাবিক আচরণ করতো। কিন্তু শৈশবের ঘা তো এত সহজে মুছতো না। মাঝেমধ্যেই আমি অস্বাভাবিক হয়ে যেতাম। এভাবে চলতে চলতে পড়াশোনা শেষ করলাম, ছয় মাস চাকরি খোঁজার পর আপনাদের অফিসের খোঁজ পেলাম। সেখানে নিয়োগ হলাম। ধীরে ধীরে আপনার প্রেমেও পরে গেলাম।”

বলেই রোজা চুপসে গেলো। সাইয়ান এতক্ষণ শক্ত থাকলেও রোজার শেষ কথা শুনে গলে গেলো। আলতো হেসে ফেললো সে। হঠাৎ রোজাকে অবাক করে দিয়ে রোজার কপালে অধর ছোঁয়ালো। মুহূর্তে-ই রোজার সর্বাঙ্গ জুড়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো। শক্ত করে খামচে ধরলো সাইয়ানের টি-শার্ট। রোজাকে এমন কাঁপতে দেখে সাইয়ান হাসলো। অতঃপর বিনাবাক্যে রোজাকে শুইয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে পরলো। রোজাকে স্বাভাবিক করতে তাকে বুকে টেনে নিয়ে সাইয়ান বললো,
–“অনেক রাত হয়েছে। এবার ঘুমাও দেখি।”

রোজা স্বস্তির সাথে চোখ বুজলো। এই বুকে ঠাই পেলে দুনিয়ার সকল দুঃখ রোজা ভুলে যেতে পারে। কেন তার মানসিক ডাক্তার বুঝলো না সাইয়ান নামক মানুষটাই তার সেরা ওষুধ?

———————
আজ রোজা এবং সাইয়ানের রিসিপশন অনুষ্ঠান। কমিউনিটি সেন্টারে নয় বরং সাইয়ানদের বাগানে-ই অনুষ্ঠানটি করা হচ্ছে। নিজের বাড়িতে নিজস্ব অনুষ্ঠানের আলাদা শান্তি আছে। তাই রোকসানাই বাড়িতে অনুষ্ঠান করতে বলেছে।

আজকাল রোকসানা এবং আইয়ুঁব সাহেবের মধ্যে তর্কা-তর্কি ভাব দেখা যাচ্ছে। মা-ছেলের মধ্যে কী চলছে সেটা শুধু তারাই জানে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেও দুজনের কেউ-ই আসল কথাটা বলে না। মেহের নিজেও বুঝতে পারছে না এদের মধ্যে কী চলছে?

বাড়ীভর্তি মেহমান। অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। মেহমান বেশিরভাগ চলে গিয়েছে। বাকিরা বাড়ীতেই গিজগিজ করছে। অনেকে বউ দেখে ঘুমোতেও চলে গেছে। আর বাগানে থেকে গেছে সাইয়ান, সারিমের কাজিন এবং বন্ধু-বান্ধব। সবগুলো মিলে প্যান্ডেলের এক কোণে ঘাসের উপর বসে আড্ডা দিচ্ছে। সাথে আছে তাদের নিষিদ্ধ পানীয়। যা বড়োদের থেকে লুকানো হয়েছে। এদিকে মাহিমসহ মেহের, সামিরা মিলে বাসর সাজাচ্ছে। রোকসানা-ই তাদের এই কাজ করতে বলেছে। যার ফলস্বরূপ তিন ভাই-বোন ব্যস্ত। রোজা বসেছে সামিরার ঘরে। মাহিম মুখ ভার করে ফুলের প্যাচ ধরতে ধরতে বললো,

–“কী সুন্দর ভাইয়া’রা মিলে ওটা গিলছে আর আমি কী না এখানে বাসর সাজাচ্ছি? আমাকে নিলে কী এমন হতো? বয়স তো আমার বিশ হয়েছেই!”

সামিরা মাহিমের মাথায় চাপড় মেরে বললো,
–“চাচ্চু জানতে পারলে তোকে বাড়ীতে থাকতে দিবে না। সাথে ভাইদের মাইরও ফ্রী। বাই ওয়ান গেট ওয়ান টাইপ!”

মেহের হু হা করে হেসে দিয়ে বললো,
–“আরেকটা ফ্রী জিনিস আছে। সাইয়ান ভাইয়ার রিসিপশনেও মাহিম ফ্লার্টিং করেছে। বাবা দায়িত্ব দিছে মেহমানদের দেখ-ভাল করার, আর ইনি মেয়েদের এক্সট্রা লেসন শিখিয়েছে!”

মেহেরের কথা শুনে মাহিম রেগে মেহেরের চুল টান দিয়ে বললো,
–“তোর কোনো কাজ ছিলো না? আমার পিছে পিছে ঘুরছিস কেন? আমি তোর থেকে দেড় মিনিটের বড়ো। যা ইচ্ছা করতে পারি, তোর কী?”

মেহেরও মাহিমের চুল টেনে দিয়ে বললো,
–“তুই বয়সে আমার থেকে দেড় মিনিটের বড়ো হলেও পড়াশোনার দিক দিয়ে এক বছরের বড়ো। কথা-বার্তা ভালোভাবে বলবি। নয়তো আমি মুখ খুলতে বাবা তোর পা*য় লাথ মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিবে!”

সামিরা বহু কষ্টে তার হাসি থামিয়ে বললো,
–“এসব চুলাচুলি বন্ধ করে দ্রুত ঘর সাজা। নয়তো দেখা যাবে জামাই সাহেব চলে আসছে আর দেখছে বউ বাসর ঘরে নেই, এখনো বাসরও সাজানো হয়নি।”

মাহিম মেহের উভয়েই দুজনকে ভেঙিয়ে আবার কাজে মনোযোগ দিলো। দ্রুত হাতে সব কাজ সেরে মাহিম বেরিয়ে গেলো। আর মেহের এবং সামিরা মিলে রোজাকে সাইয়ানের রুমে নিয়ে এলো। সুন্দর করে বসিয়ে দিয়ে যে যার ঘরে চলে গেলো। মেহের তার ঘরে যেতেই চমকে উঠলো।

~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।

#বাসন্তীগন্ধা
|২৩|
লাবিবা ওয়াহিদ

মেহের নিজের রুমে এসে চমকে গেলো। তার-ই বিছানায় সারিম হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। কখনো নাক না টানা সারিম আজ নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। মেঝেতে জুতো, মোজা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গায়ের কোটটাও মেঝের এক কোণে এলোমেলো করে পরে আছে। বলা বাহুল্য, খুব খারাপ অবস্থা। অন্য সময় হলে সারিমের প্রতি প্রচন্ড বিরক্ত হতো। কারণ, মেহের তার যাবতীয় ব্যবহৃত জিনিসপত্র অন্য কারো ব্যবহার করা একদমই পছন্দ করে না। সেখানে এই বদস্বভাব স্বয়ং সারিমের। তবে আজ মেহেরের মধ্যে কোনো বিরক্তি কাজ করছে না। বরং সারিমকে তার বিছানায় দেখে কোনো রকম অভিযোগ করলো না, চোখ-মুখও কুচকালো না। তবে দুশ্চিন্তায় কপালে কতশত ভাঁজ পরেছে।

বিয়ে বাড়ি, মেহমানভর্তি মানুষ৷ যতোই কাজিন হোক না কেন এক রুমে থাকাটা বড্ড দৃষ্টিকটু। তাই মেহের চিন্তিত হয়ে আর রুমে প্রবেশ করলো না। প্রথমে সারিমের রুমে চলে গেলো। দরজা খুলতে গিয়ে দেখলো দরজা লক। ভ্রু কুচকে গেলো মেহেরের। সারিমের রুমে কে বা কারা দখল করলো? ভেতর থেকে শব্দ হলে হয়তো ধারণা করতে পারতো। সারিমের রুম ছেড়ে মাহিমের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। মাহিমের রুমে এসে দেখলো মাহিম বাদে বয়স্ক দুজন দূর সম্পর্কের ফুপা-ফুপি ঘুমিয়ে। এমন অবস্থা থেকে মেহের চটপট দরজা লাগিয়ে দিলো৷ মাহিমের রুমের এ অবস্থা হলে মাহিম কোথায় শুলো?

মেহের উপর থেকে নিচে তাকালে দেখলো বেশকিছু কাজিনের সাথে ঢালা বিছানা করে মাহিম বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। সাইয়ান তার রুমে। রোজার সাথে। মেহের সবকিছু দেখে বড্ড অসহায় বোধ করলো। পরে হঠাৎ মনে পরলো সামিরার কথা। মেহের যেন আশার আলো খুঁজে পেলো। দ্রুত ছুটলো সামিরার রুমে গেলো। কিন্তু হায় কপাল। কথায় আছে, অভাগী যেদিকেই যায় সেদিকেই পানি ফুরায়।”

মেহেরের সাথেও তাই হলো। মুখটা দেখার মতো হলো। এখন কী করবে? ওদিকে মেহেরের অগোচরে আশিফ এবং সামিরা মিলে প্রেম করতে ব্যস্ত। সারিমের রুমটা আশিফ-ই নিয়েছে। আশিফের দুজন বন্ধু বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। আর আশিফ সারিমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হবু বউয়ের সাথে প্রেমালাপে ব্যস্ত। সামিরা এবং সারিমের বারান্দা পাশাপাশি হওয়ায় আশিফ এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে। সারাদিন কাজের ব্যস্ততায় সামিরার সাথে মন ভরে কথা হয়নি। কথা তো দূর, সারাদিনে দুই, একবার চোখের দেখা দেখেছে।

সামিরার বেলাতেও তাই। থাই গ্লাস টেনে দেওয়ায় ভেতরের কোনো শব্দ বাইরে আসছে না। এদিকে মেহের নিরাশ হয়ে রুমে চলে এলো। রুমে এসে দেখলো সারিমের নাক ডাকা থেমেছে। আগের জায়গায় কোনো নড়াচড়া ছাড়া ঘুমোচ্ছে। মেহের সারিমের কাছে এগিয়ে গেলো। যদি কোনো ভাবে নিচে পাঠিয়ে দেওয়া যায় তাহলেই হবে। তাই সারিমের কাছাকাছি গিয়ে আলতো হাতে সারিমকে ডাকলো। কিন্তু সারিমের কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। মেহের আবার ডাকলো। পরপর কয়েকবার। সারিম নড়াচড়া করে অন্যদিকে ফিরে ঘুমিয়ে যায়। মেহের হতাশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে নিচে চলে গেলো। সিঙ্গেল সোফায় কিছুক্ষণ বসে রইলো। সবাই ঘুমোচ্ছে আর মেহের ঢুলুঢুলু অবস্থায় সকলের ঘুমের দিকে তাকাচ্ছে। তার দৃষ্টি করুণ। এখানে সব ছেলেরা৷ নয়তো মেহের কোনো এক জায়গায় নিজের জায়গা ঠিকই করে নিতো৷ মেহের আবার উপরে চলে গেলো।

রুমে কতক্ষণ পায়চারি করলো। আবার ডাকলো সারিমকে। সারিম ঘুমের মাঝেই চোখ-মুখ কুচকে বিরক্ত হয়ে আওড়ালো,
–“জ্বালাস না তো মেহের। ঘুমোতে দে। আ’ম টায়ার্ড!”

মেহের নরম হয়ে সারিমের দিকে চাইলো। সারাদিন দৌড়া-দৌড়ি করেছে। তার উপর কিসব ছাই-পাশ গিলেছে। মেহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সারিমকে কঠিন ভাবে নিষেধ করবে যেন এসব না গিলে। এগুলো স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর।

এসব আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে মেহের চেয়ারে গিয়ে বসলো। সারিমের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে পুরো মুখশ্রী। তখনই মেহেরের মাথায় এলো ইলিরার কথা। ইলিরার বিয়ে হলো গত এক সপ্তাহ আগে। ইলিরা সারিমকে দাওয়াত দিয়েছিলো। কিন্তু মেহেরের মনে অসম্ভব কু ডাকছিলো। ইলিরার বিয়ের দিন মেহের সারিমের বাহুর শার্টের অংশ খামচে বড়োই ব্যাকুল কন্ঠে বলেছিলো,

–“প্লিজ ইলিরা আপুর বিয়েতে যাবেন না!”

মেহেরের কাকুতি যেন সারিম কোনো কারণ ছাড়াই মেনে নিলো। সত্যি সত্যি-ই ইলিরার বিয়েতে যায়নি। ইলিরাকে কল করে মিথ্যা বলে যে সারিমের হঠাৎ-ই কিছু কাজে চট্টগ্রাম যেতে হয়েছে। মেহের সেদিন অত্যন্ত খুশি হয়েছিলো। যার ফলে মেহের খুশি-মনে সারিমের জন্যে কিছু রান্না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্যে সেদিন প্রথমবারের মতো রান্নাঘরে প্রবেশ করে মেহের। প্রথমদিনেই কাজের নামে নিজের হাত পুরিয়ে বসলো। পাশের চুলোতেই জ্যুতি মাছ ভাঁজতে দিয়েছিলো। জ্যুতি বারবার করে বলেছিলো চুলোর থেকে দূরে সরে আসতে, গরম তেল ছিটে আসতে পারে। কিন্তু মেহের সেই কথায় গুরুত্ব না দিয়ে ভীষণ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছিলো,
–“কিচ্ছু হবে না।”

কিন্তু পরমুহূর্তেই ঘটলো অঘটন। তেল ছিটে আসলো মেহেরের হাতে। যার ফলে কালচে দুটো ছোটো ছোটো দাগ হয়ে গেছে। সঙ্গে অসম্ভব জ্বালা। মেহের সেটা মাকে বুঝতে না দিয়ে চোখ-মুখ শক্ত করে কুচকালো। বড়োদের কথা না শুনলে যা হয় আর কী। অতঃপর মেহের পুরো সময়টা নিজেকে সামলে মায়ের সাহায্যে পায়েশ রাঁধলো। নিজে আগে টেস্ট করলে বুঝলো লবণ বেশি দিয়ে ফেলেছে। প্রথম বারের এমন রান্নায় মেহেরের উত্তেজিত মন মুহূর্তে-ই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সারিমকে খুশি করতে গিয়ে এখন পায়েশ-ই খাওয়ার অযোগ্য। অখাদ্য তো আর সারিমের মুখের সামনে তুলে ধরতে পারে না? এজন্য না চাওয়া সত্ত্বেও সব পায়েশ ফেলে দিতে হয়েছে। ফুরফুরে মেজাজ বিষণ্ণ হয়ে গেলো।

দুপুরবেলায় খেতে গিয়ে সারিম কোনো ভাবে হাতের দাগ দেখে নেয়। অতঃপর মেহেরের এক গাদা বকা শুনতে হয়েছে সারিমের থেকে৷ সারিমের বকা খেয়ে মেহেরের সেদিন অর্ধেক পেট ভরে গিয়েছিলো।

————-
হঠাৎ কিছু শব্দে মেহেরের ঘুম ভেঙে গেলো। আরেকটুর জন্যে টেবিলে থোঁতা গিয়ে লাগেনি। এতক্ষণ গালে হাত ভর দিয়ে ছিলো। যার ফলে বাম হাতটা এখন ঝিমঝিম করছে। নাড়াতেও কষ্ট হচ্ছে। মেহের আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলো ভোর হয়ে গিয়েছে। মেহের নিজেও মনে করতে পারলো না সে কখন ঘুমিয়ে পরেছে। বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলো সারিম ঘুমিয়ে আছে। কোমড়ে অসহনীয় ব্যথা। সারা রাত এক ভাবে থাকার ফল। আবারও দরজায় কড়াঘাত করলো কেউ। বিকট শব্দে সারিমের ঘুমটাও ভেঙে যায়। যার কারণে সে উঠে বসলো। উঠে বসলেও চোখ তখনো বন্ধ। যেন ঘুম তখনো কাটেনি। চুলগুলোও ঠিক নেই, ভীষণ উষ্কখুষ্ক।

মেহের সময় নষ্ট না করে দরজার কাছে গেলেই চমকালো। ব্যাপার কী, দরজা তো লক। মেহেরের স্পষ্ট মনে আছে মেহের দরজা ভিঁজিয়েই চেয়ারে গিয়ে বসেছিলো। চোখ লেগে যাওয়ায় দরজা লাগাতে ভুলে গিয়েছিলো। মেহের আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে দরজা খুললো। দরজা খুলতেই মেহেরের চোখ কপালে। তার সামনে রোকসানা, মেহেরের বাবা এবং আইঁয়ুব সাহেব। সঙ্গে আরও তিন জন আত্নীয়। মেহের বড়োদের দেখে তার কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো। ভেতরে সারিম আছে। এখন কী করবে মেহের? বারংবার শুকনো ঢোঁক গিলছে। মনে মনে দরুদ পড়লো। উপরওয়ালার কাছে প্রাণপণে বললো যাতে এবারের মতো বাঁচিয়ে দেয়। মেহের তাদের ভেতরে ঢুকতে না দিয়ে বললো,
–“কিছু লাগবে?”

রোকসানা মেহেরের কোনো কথা কানে না তুলে মেহেরকে সরিয়ে দিয়ে একপ্রকার জোর করেই ভেতরে প্রবেশ করলো। রোকসানার পিছু পিছু বাকিরাও প্রবেশ করলো। এই পরিস্থিতিতে মেহেরের হাঁটু-জোড়া থরথর করে কাঁপছে। বিপি লো হয়ে আসছে তার। সারিমকে মেহেরের ঘরে দেখে সকলের চোখ কপালে উঠে যায়। রোকসানা আইঁয়ুব সাহেবের দিকে তাকালো। আইঁয়ুব সাহেবের চেহারা দেখার মতো। সারিমকে এই অবস্থায় মেহেরের রুমে একদমই প্রত্যাশা করেনি। আইঁয়ুব সাহেবের ভাব-ভঙ্গি দেখে রোকসানা কৌশলে পৈশাচিক হাসি দিলো। এবার না মেনে যাবে কোথায় বড়ো বাপ?

~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।