#বাড়ির_নাম_বৃষ্টিলেখা
#পর্ব-২৪
বৃষ্টি বাড়ি ফিরলো সন্ধ্যেবেলা। মা দেরি হবার কারন জিজ্ঞেস করলে বৃষ্টি বলল, বন্ধুর সঙ্গে একটু মার্কেটে গিয়েছিলো। এই মিথ্যের কোনো দরকার ছিলো না। আবিরের সঙ্গে ছিলো বললে অসুবিধা কিছু ছিলো না। তবুও কেন মিথ্যে বলল সেটা ও নিজেও জানেনা।
আবিরের চাকরির খবর বাড়ির সবাই শুনলো সন্ধ্যায়। পলিন এসে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,
“বুবু খবর শুনেছো? আবির ভাইয়ের চাকরি হয়েছে।”
“বাহ! ভালো তো। ”
বৃষ্টি পলিন কেও কিছু বলল না। পলিন বলল,
“আবির ভাইয়ের সঙ্গে ভাব থাকলে এক্ষুনি ওই বাড়ি ছুটে যেতাম। ”
“এখন ছুটে গিয়ে ভাব করে আয়। ”
“না। ওনার সঙ্গে আরও কয়েকমাস কথা বলব না। ”
“এতো শাস্তি! একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না! ”
পলিন চোখ কপালে তুলে বলল,
“বাব্বা! তুমি বলছ এই কথা!”
বৃষ্টি থেমে গেল। গলার স্বর খানিকটা পাল্টে বলল,
“তোর ইচ্ছে হলে বলবি নাহলে না।।”
পলিন সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
“বুবু তুমি আজ কোন বন্ধুর সঙ্গে মার্কেটে গিয়েছিলে?”
বৃষ্টি কঠিন গলায় বলল,
“তুই আমাকে জেরা করছিস?”
“আসলে ঠিক জেরা না… তুমি যে সময়ে বাড়ি এলে, আবির ভাইও সেই সময় বাড়ি এলো। তাই জিজ্ঞেস করলাম। ”
“তাতে কী? আর আমি যদি আবিরের সঙ্গে থাকিও তাতে কী?”
পলিন ভনিতা করে বলল, কিচ্ছু না। থাকলে তাতে তো আমরা খুশি।
বৃষ্টি চোখ পাকিয়ে বলল,
“তুই থামবি?”
পলিন হেসে ফেলল। বৃষ্টি জিজ্ঞেস করলো,
“অকারণে হাসছিস কেন?”
“লুকিয়ে প্রেম করার মজাই আলাদা। কেমন একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার। ”
বৃষ্টি চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“আচ্ছা! তা তুই কার সঙ্গে লুকিয়ে প্রেম করছিস? পাশের বাড়ির ছেলেটার সঙ্গে? ”
পলিন আকাশ থেকে পড়লো। বলল,
“ছিঃ ছিঃ! আমি কেন প্রেম করব!”
“তোর ব্যাপার স্যাপার সন্দেহজনক। সারাক্ষণ প্রেম নিয়ে কথা বলিস। নিজেও নিশ্চয়ই ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস। ”
“মোটেও না। আমার নজর কোনোদিন ই পাশের বাড়ি ছিলো না। ”
বৃষ্টি মৃদু হেসে বলল, এক বাড়ির দুই ছেলেকে বিয়ে করার ইচ্ছে যেন কার ছিলো!
পলিন চুপ করে গেল। বৃষ্টি আর কথা বাড়ালো না। আজকের দিন টা একদম অন্যরকম কেটেছে। সকালে বেরিয়েও ভাবে নি যে দিন টা এমন যাবে। পাশাপাশি রিকশায় বসে যাওয়া, সিনেমা হলে সিনেমা দেখা এসব যে কোনোদিন হবে সেটা স্বপ্নেও ভাবে নি।
***
আতিফ আজ সন্ধ্যায় পড়াতে এসেছে। পড়াতে এসে খেয়াল করলো পলিন খুব চুপচাপ। আগের মতো পাঁচ মিনিট অন্তর কথা বলছে না। পড়ছেও মনোযোগ দিয়ে। পড়ার বিষয় ছাড়া কথাও বলছে। ব্যাপার টা আতিফের জন্য অস্বস্তিকর। যারা সবসময় কথা বলে তারা যদি হুট করে কথা বলা কমিয়ে দেয় তাহলে যেন কেমন লাগে। আতিফ গলা খাকারি দিয়ে বলল,
“কী ব্যাপার আজ এতো চুপচাপ? অন্য কোনো ফন্দি আঁটছো না তো!”
পলিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“কী জ্বালা! আমি কথা বললেও দোষ, না বললেও দোষ! কী করব এখন? জিভ কেটে ফেলব?”
“না সেটা করতে হবে না। যারা সবসময় কথা বলে তারা হঠাৎ চুপ করে থাকলে ব্যাপার টা বিপদজনক। কারণ তারা অন্য ফন্দি আঁটতে ব্যস্ত থাকে। ”
পলিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি ভালো হয়ে গেছি। অনেক ভেবে দেখলাম যে ভালো হওয়া দরকার।
“কেন? ভালো হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাবে?”
“আপনি আজ হঠাৎ এতো কথা বলছেন? আপনি তো এমনিতে চুপ থাকেন। ”
“কী জানি! হয়তো তোমার সঙ্গে থেকে কথা বলা শিখেছি। ”
“আমার সঙ্গে থাকা মানে কী? আপনি তো আমাকে চোখ বন্ধ করে পড়ান। ভালো করে তাকিয়েও দেখেন না। ”
আতিফ থতমত খেল। এই মেয়ে কথা কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। তাই বলল,
“আচ্ছা বাদ দাও। পড়ায় মন দাও। যে অংক গুলো দেয়া হয়েছে ওগুলো করো। ‘
“কথা তো আপনি শুরু করেছিলেন। আমি তো চুপচাপ ই ছিলাম। ”
আতিফ অতিসন্তঃর্পনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই মেয়েকে নিজের অবস্থা ও কী করে বুঝাবে। আর বুঝাবেই বা কী! আতিফ তো নিজেই ভালো করে বুঝতে পারছে না যে ওর কী হয়েছে।
***
বৃষ্টি সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির সামনের জায়গাটায় হাটছিলো। নিলুফার উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছে। হঠাৎই উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,
“বুবু এই দেখেন দুই শালিক! আজ বাড়িতে মেহমান আসবে। ”
বৃষ্টি মৃদু হেসে বলল,
“আমাদের তেমন কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। পলিনের মামার বাড়ি যারা আছেন তারা বছরান্তে একবার আসে। মায়ের বাপের বাড়ি থেকে তাও আসে না। তাই মেহমান আসার সম্ভাবনা নেই। ”
নিলুফার বলল,
“ঘরের সামনে দুই শালিক বসলে ঘরে কুটুম আসে। আমার দাদী বলতেন। আর সত্যিই মিলে যাইতো। ”
বৃষ্টি আবারও হাসলো।
***
আবিরের সবসময়ই ঘুম ভালো হয়। অন্য সবার পরীক্ষার আগে টেনশনে ঘুম হয় না। আর আবিরের উল্টো। ওর আরও টেনশনে ঘুম হয়। কাল রাতে ঘুম হলো ছাড়া ছাড়া। কালকের দিন টা মনে পড়লেই বুকের মধ্যে কেমন যেন করে ওঠে। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। ওর জীবনে কোনোদিন এমন দিন আসবে সেটা স্বপ্নে তো দূরের কথা কল্পনায়ও ভাবে নি। এক সঙ্গে রিকশা করে গিয়ে সিনেমা হলে সিনেমা দেখা। ফেরার সময় আইসক্রিম খেয়ে আবারও রিকশায় ফেরা সবটাই স্বপ্নের মতো। দুজনের কথাবার্তা তেমন হয় নি। সিনেমা হলে তো পুরোটা সময় সিনেমায় মনোযোগ ছিলো বৃষ্টির। ফেরার সময়ও তেমন কথা বলে নি। আবির দুই এক কথা যা বলেছে তার জবাব দিয়েছে।
বাড়ি ফেরার পর আবিরের মনে পড়লো যে বৃষ্টিকে একটা কথা বলা হয়নি৷ চটপট সেটা লিখে নিলো কাগজে। পলিন কে দিয়ে পাঠাতে হবে। বিচ্ছু দুটোকে দিয়ে পাঠানো যাবে না। পলিন অবশ্য এখনো মুখ ফুলিয়ে আছে। কোনো ব্যাপার না, আবির ওর স্কুল যাবার পথে দাঁড়িয়ে থেকে কাগজ টা ধরিয়ে দিবে। দরকার হয় ক’টা টাকা বখশিশও দিয়ে দিবে। পলিন নিশ্চয়ই অতোটা ভালো এখনো হয় নি।
***
আবির এক কাপ চা খেয়ে হাটতে শুরু করলো। শরীরটা চনমনে লাগছে। রোদের তেজ কম। আকাশে মেঘ, রোদ্দুরের খেলা চলছে তাই রোদটাও মিষ্টি লাগছে। গায়ে লাগায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আবির কিছুদূর হাটতেই দেখলো এক ভদ্রলোক বাক্স, প্যাটরা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই পাড়ায় আগে দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না। আবির একটু এগিয়ে যেতেই বলল,
“এক্সকিউজ মি! একটু শুনবেন?”
স্পষ্ট শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা দেখে আবির ধরে নিলো উনি এখানকার না। নিশ্চয়ই গুলশান, বনানী টাইপ এলাকার লোক। এদের কথা বলার স্টাইল টাই অন্যরকম। আবির জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায় যাবেন?”
“আপনি এখানে থাকেন?”
“এখানে থাকি না। খানিক দূরেই আমার বাড়ি। ”
“আমি একটা এড্রেস খুঁজে পাচ্ছি না। কাইন্ডলি একটু হেল্প করবেন। ”
“বলুন। ”
“বাড়ির নাম বৃষ্টিলেখা। এটা কোথায়?”
আবির তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। বলল,
“আপনি বৃষ্টিলেখাদের বাড়িতে যাবেন?”
“জি। এখানে নাকি ওই বাড়ির নাম বললেই সবাই চিনবে। ”
আবির ভাবতে লাগলো। বৃষ্টিদের আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে এই লোক কে কখনো দেখে নি। কে হতে পারে! আবির কিছু জিজ্ঞেস করলো না। বলল,
“চলুন। ”
ভদ্রলোক একটা ব্যাগ নিজে নিলো। বড় ট্রলিটা আবির নিলো। ভদ্রলোক বলল,
“বাই দ্য ওয়ে, আমি সাহ্নিক। ”
“আপনি বৃষ্টিলেখা কে চিনেন?”
“হ্যাঁ চিনি। কিন্তু দেখা হয় নি। ”
“ওদের বাড়ির আর কাউকে চিনেন?”
“সবাই কে চিনি। পলিন, টুকু, পিকু, পিয়াস….
আবির স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এবার কনফার্ম হলো যে ওদের পরিচিত কিংবা আত্মীয়। ভদ্রলোক কে জিজ্ঞেস করা যেত যে উনি কে কিন্তু সেটা জিজ্ঞেস করতে ওর একটু খারাপ লাগছিলো।
***
বাড়ির সামনে এসে আবির বলল,
“এই যে বাড়ির নাম বৃষ্টিলেখা। ”
ভদ্রলোক সেই বাড়ির দিকে এক পলক দেখে আবিরদের বাড়ির দিকে তাকালো। কী যেন ভেবে আবারও তাকালো। আবির খুব অবাক হলো। বলল,
“আপনি যে বাড়ি যাবেন সেটা তো ওই বাড়ি। তাহলে এই বাড়ি দেখছেন যে!”
“এটা মনে হচ্ছে আবির দের বাড়ি। ”
আবির বিস্মিত গলায় বলল,
“আবির কে চিনেন আপনি? ”
“হ্যাঁ। বৃষ্টিলেখার আবির বলে কথা। চিনতে তো হবেই।”
আবিরের চোখে আগের মতোই বিস্ময়। তবে ভদ্রলোকের শেষ কথাটা শুনে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। “বৃষ্টিলেখার আবির”!
চলবে…