বাড়ির নাম বৃষ্টিলেখা পর্ব-২৯

0
492

#বাড়ির নাম বৃষ্টিলেখা
#পর্ব-২৯
আতিফের হঠাৎ সবকিছু অসহ্য লাগার কারণ যে পলিন সেটা আবির আর দুলু টের পেয়ে গেল। দুলু আতিফ কে বলেছিলো,

“তোর যেহেতু কোনো কিছু ভালো লাগছে না তাহলে ক’টা দিন আমার ওখানে গিয়ে থাক। ”

আতিফ রাজি হলো না। বলল,

“না। আমি গেলে পলিনের পড়ার ক্ষতি হবে। ”

কথাগুলো হচ্ছিলো খাবার টেবিলে। আবির আচমকা প্রশ্ন করলো,

“তোর এই কোনো কিছু ভালো না লাগার কারণ আবার পলিন নয় তো?”

আতিফ হঠাৎই চমকে গেল। কোনো জবাব দিলো না। একটা শব্দও উচ্চারণ করলো না। এমনকি আবির আর দুলুর দিকে তাকালো না পর্যন্ত। চুপচাপ আধখাওয়া খাবার টা টেবিলে ফেলে উঠে চলে গেল। আবির একবার দুলুর দিকে তাকালো। দুলুও আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনেই বুঝে গেল কাহিনী। এই ব্যাপারে কেউই আর কোনো কথা বলল না। পরে দুলু আবির কে ডেকে বলল,

“আমরা যে ব্যাপার টা নিছক মজা ভেবে উড়িয়ে দিচ্ছিলাম সেটা সত্যি? ”

আবির হতাশ গলায় বলল,

“জানিনা। ”

“আতিফের পরিবর্তন টের পেয়েছিস! ওর মনে হয় রাতে ভালো ঘুমও হয় না। ”

আবির কিছু বলল না। আতিফের সঙ্গে ওর সম্পর্ক অন্যসব বড় ভাইদের মতো গম্ভীর নয়। খানিকটা বন্ধুর মতোই। আতিফের ম্যুড ভালো থাকলে প্রায়ই বৃষ্টিকে নিয়ে রসিকতাও করে। কিন্তু তাই বলে কখনো নিজের মনের কথা আবির কে জানায় না। আবিরও কখনো জানতে চায় নি। এখন মনে হচ্ছে বিষয় টা ভালো করে জানা দরকার। সমস্যাটা ঠিক কোন জায়গায়।

***
পলিনের পরিবর্তনটুকু ওর মায়ের চোখেও পড়লো। রেনু মেয়ের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার চেষ্টা করলো। জিজ্ঞেস করলো,

“পলিন তোমার কী কোনো সমস্যা? ”

পলিন হতাশ গলায় জবাব দিলো,

“না মা। তোমরা সবাই মিলে এই প্রশ্ন টা কেন করছো?”

রেনু মেয়ের দিকে তাকালো। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়ের মনে উথাল-পাথাল ভাবনা। সারাক্ষন কী এতো ভাবে! এই বয়স টা অবশ্য সেনসিটিভ। পলিন মায়ের সঙ্গে সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনাও হয়তো করবে না। মা মেয়ের সম্পর্ক যত ভালোই হোক কিছু কথা তবুও মেয়ে মা’কে মন খুলে বলতে পারেনা। রেনু পলিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

“পড়াশোনা করতে সত্যিই ভালো লাগছে না? ভয় লাগছে? তাহলে নাহয় একটা বছর সময় নাও। ”

পলিন আঁতকে উঠে বলল,

“না মা। আমি এই বছরই পরীক্ষা দেব। আমাকে একটু সময় দাও। আমি ঠিক সামলে নেব। ”

এরপর আর রেনুর কিছু বলারও থাকে না। তাই কথাবার্তা এখানেই শেষ হয়। রেনুর মন খারাপ হয়, পলিনেরও মন খারাপ হয়। হঠাৎ এভাবে নিজের পরিবর্তন ওরও ভালো লাগছে না। পলিন মনে মনে বলে,

“হে আল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাক। সব….

***
আবিরের সঙ্গে বৃষ্টির সম্পর্ক টা হঠাৎই কেমন দূরের হয়ে গেল। দেখা হলেও তেমন কথা হয় না। আবির প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলে না। বৃষ্টি নিজেও বুঝতে পারে না যে ওর আসলে কী হয়েছে। বিকেলে মার্কেট থেকে ফিরছিলো। রিকশা করে আসার সময় আবির কে দেখলো একটা চায়ের দোকানে বসে আছে। বৃষ্টি একবার ভাবলো নাম ধরে ডাকবে। তারপর সেই চিন্তা বাদ দিয়ে রিকশা থেকে নেমে গেল। আবির খবরের কাগজ পড়ছিল। বৃষ্টি কাছাকাছি এসে ডাকতেই চমকে উঠলো। আবির অবাক গলায় বলল,

“ও তুই!”

“তোমার কাজ আছে কোনো? ”

“না। কিছু বলবি?”

“হু। ”

আবির পেপার টা রেখে উঠলো। সোজা রাস্তায় না হেটে খেলার মাঠের দিকে দুজনে হাটতে শুরু করলো। আবির বলল,

“কী বলবি?”

বৃষ্টি জিজ্ঞেস করলো,

“তুমি কী আমার উপর রেগে আছ?”

আবির বৃষ্টির দিকে তাকালো। খানিকটা রুক্ষ গলায় বলল,

“রাগ করার মতো কিছু করেছিস কী?”

“আমার সেরকম কিছু মনে পড়ছে না। ”

“তাহলে তো হয়েই গেল। ”

“তোমার হাবভাব দেখে তো অন্যকিছু মনে হয়। ”

আবির তীর্যক হেসে বলল, বাবা! তুই আমার হাবভাব বোঝারও চেষ্টা করিস!

আবিরের হেয়ালিটুকু বৃষ্টি গায়ে মাখলো না। বলল,

“তোমার ঠিক কী হয়েছে?”

“বয়স হয়েছে। ”

বৃষ্টি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো। আবির মৃদু হেসে বলল,

“মাঝেমধ্যে ভাবি যে আর কতো! আমার নাহয় অনেক ধৈর্য্য তাই তোর পিছনে বেহায়ার মতো পড়ে আছি। তুই তো মনে হয় সত্যিই বিরক্ত। তাই না?”

বৃষ্টি জবাব দিলো না। আজ আবিরের গলার স্বর অন্যরকম। আবির বলল,

“বাদ দে। আর কিছু বলবি?”

বৃষ্টি জবাব দিলো না। ধীর গতিতে হাটছিলো দুজন। আবির কিছুক্ষন অপেক্ষা করে বলল,

“তাহলে যাই। ”

আবির চলে গেল। বৃষ্টি খানিকক্ষণ হাটলো। একসময় খেয়াল হলো যে আজও ওর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।

***
পলিন,

তুই কেমন আছিস রে? আজ তোকে খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলো। আমরা একসঙ্গে থাকি। হাত বাড়ালেই একজন আরেকজন কে ছুঁয়ে দিতে পারি। তবুও জানতে চাই না কেমন আছি! পলিন তোকে কিছু কথা বলব। কিছু কথা থাকে যেগুলো সামনাসামনি বলা যায় না। সেজন্য চিঠি লেখা। আমরা দুজন এতো এতো চিঠি লিখি অথচ আজ অবধি নিজেদের কোনো চিঠি লিখি নি। শুরু টা আমিই করলাম।

মাঝে মাঝে আমি ভাবি আমার তেমন কোনো বন্ধু নেই কেন! উত্তরও খুঁজে পাই। তার কারণ হলো আমার অন্তঃর্মুখী স্বভাব। কাউকে মনের কথা জানাতে পারি না। কিন্তু তোর ক্ষেত্রে ব্যাপার টা ভিন্ন। তোকে জানাতে পারি। জানাতে ইচ্ছেও হয়। তবুও জানানো হয় না। পলিন তুই কী জানিস মানুষ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায়। একেক বয়সে মানসিক বিকাশ একেকরকম থাকে। একটা সময় ছিলো যখন আমার ইচ্ছে করতো সারাদিন আবির ভাইয়ের আশেপাশে থাকি। সেই বয়স পেরিয়ে যাবার পর মনে হলো ইশ আমি কী বোকা! আবার একটা বয়সে মনে হলো আবির কে আমার লাগবে না। আমি নিজেতেই মত্তো থাকব। সেই বয়স টা পেরিয়েও আবার সেই আফসোস।

তোর আর আমার মধ্যে পার্থক্য কী জানিস! তোর মুখেও যা, মনেও তাই। আর আমার মুখে এক আর মনে আরেক। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আবির যখন আমাদের বারান্দায় তাকিয়ে থাকে তখন আমার মনে হয় কোনো এক কারনে বারান্দায় যেতে পারতাম। আবার আবিরের বাড়ি আসতে দেরি হলে মনে মনে চাইতাম তাড়াতাড়ি আসুক। আচ্ছা আমি এমন কেন! আমি তোর মতো নই কেন! কেনই বা তোর মতো হতে পারি না! তুই কী জানিস আমি নিজেও নিজের খুব অপছন্দের। আমার তো সবসময় ইচ্ছে করতো পলিন হতে। তাহলে তুই কেন আমার মতো হয়ে যাচ্ছিস? কেন তোর মনের খবর আমাকে বলছিস না।

পলিন সোনা একটা কথা শোন, তোর যে বয়স সেই বয়স টা হলো একদম অন্যরকম। এই বয়সে ছাদে উঠে মেঘ ছুয়ে দিতে ইচ্ছে করবে, জ্বর হবে জেনেও বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করবে। এটাই হয়। আমি আজ অবধি কখনো তোকে কোনো কিছুতে বারন করিনি৷ তোর যা করতে মনে চেয়েছে করেছিস। কখনো কোনো বাঁধা দেই নি। ভেবেছি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ও নিজেকে উপলব্ধি করতে পারবে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তুই ভুল করছিস। প্রেমে পড়াটা ভুল নয়। জানিনা তুই সাহ্নিকের প্রেমে পড়েছিস কী না! তবে একটা ব্যাপার বুঝতে হবে যে দুটো বিষয় আলাদা। প্রেম আর মুগ্ধতা দুটো আলাদা ব্যাপার। যখন কোনো সুন্দর হিরোর সিনেমা দেখিস তখন যে ভালো লাগাটা সৃষ্টি হয় সেটাই মুগ্ধতা। সেই মুগ্ধতার রেশ অনেকক্ষন, অনেক দিন থেকে যায়৷ তারপর একসময় কেটেও যায়। সাহ্নিকের প্রতি মুগ্ধতাও একসময় কেটে যাবে। সময় আর পরিস্থিতি তোকে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিবে। কোনো শিল্পির গান ভালো লাগলে আমরা গান টা বারবার শুনতে চাই। ভালো সিনেমা বার বার দেখলে আবারও দেখতে চাই ঠিকই কিন্তু তাই বলে সিনেমার নায়ক কিংবা শিল্পিকে জীবনের অংশ করার কথা ভাবি না। ঠিক তেমনই মুগ্ধতা তার জায়গায়ই থাকা উচিত। ভালো লাগা নিশ্চয়ই দোষের না। কিন্তু কখনো কখনো ভালোলাগাকে প্রশ্রয়ও দিতে নেই।

বুবুকে ভুল বুঝিস না। আমার মনে হলো তোকে কথাগুলো বলা দরকার। এবার নিজের একটা কথা বলি। তোকে খুব বলতে ইচ্ছে করছে। আবির যেদিন চাকরি পেল সেদিন প্রথম আমাকে খবর জানাতে এসেছিল। ওঁর চাকরির খবর শুনে আমার মনে হয়েছিলো ওঁ চাকরি না, আমার জন্য আকাশের চাঁদ নিয়ে এসেছে। সেদিন ওঁর সঙ্গে সিনেমাও দেখতে গিয়েছিলাম। সিনেমা দেখে ফিরে এসে বারান্দায় দাঁড়াতেই হঠাৎ মনে হলো, পৃথিবীর যে প্রান্তেই যে অট্টালিকায় থাকি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট বাড়িটার এই বারান্দাটা আমার ভীষণ মনে পড়বে। বুকের ভেতর টা তখন তোলপাড় হয়ে যাবে।

আজ একটা ভয়ংকর কাজ করেছি। বাড়ি ফিরে দেখলাম বাবা চা খাচ্ছে। মা’ও পাশে বসে আছে। হঠাৎ কী হলো জানিনা, আমি বাবাকে বললাম,

“বাবা তোমরা আমাকে আবির ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দাও। বড় ঘর, অট্টালিকা কিচ্ছু চাই না আমি। বারো হাজার টাকায় আমি সংসার চালিয়ে নেব। আবিরের আমার যতটা দরকার, তারচেয়ে বেশী ও’কে আমার দরকার। নাহলে সারাজীবনই আমার পাথুরে চোখ ঝাপসা হতে থাকবে। ”

বাবা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। মা’ও অবাক হলেন। একবার আমার দিকে একবার বাবার দিকে তাকালেন।

চলবে….