বাড়ির নাম বৃষ্টিলেখা পর্ব-৩১

0
522

#বাড়ির নাম বৃষ্টিলেখা
#পর্ব-৩১
সাহ্নিক আসার কথা বললেও আর আসে নি। ফোন করে জানিয়েছে যে আসতে পারবে না। সপ্তাহ খানেক এর মধ্যেই চলে যাবে। সেটা শুনে পলিনের যে খুব মন খারাপ হয়েছে সেটা বৃষ্টি খেয়াল করলো। রাতে ঘুমাতে যাবার সময় পলিন বলল,

“বুবু আমরা একবার ঢাকায় যেতে পারি না?”

বৃষ্টি বুঝতে পেরেও বলল,

“হঠাৎ ঢাকায় যাবার দরকার টা কিসের রে?”

পলিন খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,

“সাহ্নিক ভাইয়ার সঙ্গে একবার দেখা হতো। ”

বৃষ্টি খানিকটা রুক্ষ গলায় বলল,

“সাহ্নিকের সঙ্গে একবার দেখা করার কী খুব দরকার আছে? তাছাড়া এই সাহ্নিক কে পলিন? কেউ না। ”

পলিন চুপ করে রইলো। বৃষ্টির রাগের সামনে আর মুখ খোলার সাহস পেল না। পলিন কে চুপ করে থাকতে দেখে বৃষ্টি আবারও বলল,

“পলিন তুই আর সাহ্নিকের সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ রাখবি না। ”

পলিন কোনো জবাব দিলো না। বৃষ্টি আবারও বলল,

“তুই কী আমার কথা শুনতে পেয়েছিস?”

পলিন অস্ফুটস্বরে বলল, হু।

বৃষ্টি পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো।

****
আবিরের হাতে আর সময় আছে সপ্তাহ খানেক। এর পর চাকরিতে জয়েন করতে হবে। এই ক’টা দিন চোখের পলকেই হয়তো কেটে যাবে। তবুও আবিরের তর সইছে না। যত তাড়াতাড়ি কাজে ব্যস্ত হওয়া যায় ততোই ভালো। ব্যক্তিগত জীবনের ঝামেলা আর ভালো লাগছে না। অবশ্য আবিরের জীবনে এখন নিজের আর ঝামেলা নেই। বৃষ্টির বাবা বাড়ি এসে ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলে গেছে। বৃষ্টি নিজে থেকেই বিয়েতে মত দিয়েছে। আবিরের এই খুশিতে নাচার কথা কিন্তু নাচতে পারছে না। ওর মন ভার অন্য কারনে।

আতিফের ডাকে আবিরের ধ্যান ভাঙলো। আতিফ জিজ্ঞেস করলো,

“ভাইয়া ঘুমাচ্ছো?”

“না। কিছু বলবি? ”

“কাল তোমার আমার সঙ্গে যেতে হবে না। ”

আবির জবাব দিলো না। আতিফ কাল ঢাকায় চলে যাবে। এই সিদ্ধান্ত ওর নিজেরই নেয়া। আবির কিছু বলে নি। কেন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটাও জিজ্ঞেস করে নি। পলিনের সঙ্গে ওর ভালো একটা বন্ডিং থাকার পরও আতিফের ব্যাপারে একটা কথাও বলে নি। বলা উচিতও না। প্রেম, ভালোবাসা ব্যাপারগুলো আসলে ব্যক্তিগত। এখানে অন্য কারও কথা না বলাই ভালো। আতিফের ব্যাপার যদি আতিফ নিজে সামলাতে না পারে তবুও ওর কিছু করার নেই।

আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“তুই একা সব সামলে নিতে পারবি?”

“পারব। ”

“আচ্ছা। ”

আতিফ চলে গেল। মুখে সব সামলানোর কথা বললেও কতটা নিজেকে আর নিজের মন কে সামলাতে পারবে কে জানে! জীবন জীবনের মতো চলবে, কারো জন্য কিছু আটকে থাকবে না। দিনশেষে তবুও আফসোস থেকে যায়। সব পেয়ে গেলেও মনে হবে প্রিয় মানুষ টা জীবনে থাকলে আর কিছু লাগে না।

***
বৃষ্টি ঘুম থেকে উঠে পলিন কে দেখলো না। পলিন সকালে উঠে টিউশন পড়তে গেছে৷ আতিফ নিজেই আর ও’কে পড়াতে পারবে না বলেছে। বৃষ্টির একটু মন খারাপ হলো। পলিনের সঙ্গে কাল রাতে ওভাবে রাগ করায় বেশী খারাপ লাগছে। পলিন নিজেও হয়তো কষ্ট পেয়েছে।

বিছানা গোছাতে গিয়ে পলিনের বালিশের নিচে বৃষ্টি চিঠি পেল। মন খারাপ ভাবটা এক নিমিষেই দূর হয়ে গেল।

পলিন চিঠিতে লিখেছে,

প্রিয় বুবু,

তোমার চিঠি পাবার পর চিঠিটা যে কতোবার পড়েছি তার হিসেব নেই। কী সুন্দর করে সবকিছু বুঝিয়ে দিলে! একদিন দুলু আপা আমাকে বলেছিল, তুই কী জানিস পলু, বৃষ্টি কতোটা ভাগ্যবতী! কারণ তোর মতো একটা বোন ওর আছে। আর আমি ঠিক উল্টোটা ভাবি। তোমার মতো একটা বুবু আমার আছে। তোমাকেও আমার অনেক কিছু বলার আছে। যেগুলো শুনলে ভীষণ মন খারাপ হবে। তবুও না বললেই নয়।

প্রথমে আবির ভাইকে দিয়ে শুরু করি। এই মানুষ টা’কে আমি ভীষণ পছন্দ করি। তার একটাই কারণ, সে মন থেকে সৎ। এমন মানুষ খুব একটা পাওয়া যায় না। যেমন আমাদের কাকার কথা বলি। কাকা বড় মা’কে কিন্তু কম ভালোবাসে না। তবুও তার প্রথম স্ত্রীর জন্য একটা দূর্বলতা আছেই। মাঝেমধ্যে সে নিজেই তোমার মা’কে চিঠি লিখে। বড় মা নিজেও সেটা জানে। কিন্তু কিছু বলে না। আমি চেয়েছি তোমাদের জীবনে এরকম কিছু না ঘটুক। তোমার যার সঙ্গে বিয়ে হবে তারই কিন্তু সবটা জুড়ে থাকার অধিকার। তার সঙ্গে থেকে অন্য আরেকজনের কথা ভেবে মন খারাপ করা মানে একদিকে যেমন তাকে অপমান করা হয়, অন্যদিকে ছোটও করা হয়।

কাকা তোমার মায়ের কথায় সাহ্নিকের সঙ্গে তোমার বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিল। এখানে একটা ব্যাপার তোমাকে জানিয়ে রাখি, সাহ্নিক কিন্তু আসলে তোমার মায়ের স্বামীর ছেলে না। সাহ্নিক তাদের দত্তক নেয়া ছেলে। উনি যাকে মা বলে ডাকতেন তিনি খুব অসুস্থ ছিলেন। মা হওয়া তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো বলে ওনাকে দত্তক নেয়া। সাহ্নিক অন্য একটা পরিবারে বড় হলেও তার জীবনে কোনো দুঃখ, কষ্ট তেমন ছিলো না। অমন একটা ভালো মানুষ তার জীবনে দুঃখ, কষ্ট আসবেই বা কেন! আমাদের বাড়িতে ক’টা দিন এসে কীভাবে সবাই কে আপন করে নিলো! অথচ এই মানুষ টা’র সামনের দিনগুলো কী যন্ত্রণায় কাটবে। বেঁচে থেকেও মরার মতো দিন কাটাতে হবে।

সাহ্নিকের একটা কঠিন রোগ হয়েছে। প্রথমে রোগ টা’কে গুরুত্ব না দেয়ার কারণে যখন রোগ সম্পর্কে জানতে পারলো তখন আর প্রতিকার করার কোনো চান্সই নেই। চোখের অপটিক নার্ভ শুকিয়ে যাচ্ছে। যত সময় চলে যাচ্ছে ততো দৃষ্টিশক্তি কমে যাচ্ছে। এভাবে হয়তো একদিন পৃথিবীর সব রঙ দেখা থেকে বঞ্চিত হবে।

এই মানুষ টা আমাদের বাড়িতে এসেছে শুধু আমাদের দুই বোনের চিঠি পেয়ে। এক নজর সবাইকে দেখার জন্য। নাহলে তার আফসোস থেকে যাবে।

এবার একটা সত্যি কথা বলি বুবু। আমি সাহ্নিকের প্রেমে পড়িনি। তুমি বিশ্বাস করবে কী না জানিনা, আমি সত্যিই এই মানুষ টার প্রেমে পড়িনি। আবির ভাইকে ভালো লাগার কারণ হিসেবে অনেক কিছু থাকলেও সাহ্নিক কে বিনা কারনেই ভালো লেগে যায়। তবে সেই ভালোলাগায় কোনো প্রত্যাশা আমার তৈরী হয় নি। শুধু সাহ্নিকের অসুখের কথা শুনে একবার মনে হয়েছিল যে আমিও ওঁর সঙ্গে চলে যাব। কোনো সম্পর্কে না জড়িয়েও তো একজনের পাশে থাকা যায়! আমার যা উল্টাপাল্টা ভাবনা। পরে মাথা ঠিক হয়ে গেল।

আমার মন খারাপের কারণ এটাও ছিলো। একই কারনে আবির ভাইয়ের মনও খারাপ। সে অবশ্য এই ঘটনা আমার থেকেই জেনেছে। তবে মন খারাপ এর আরেকটা কারণও আছে। বুবু তোমাকে বলতেও আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে। আতিফ একদিন আমার স্কুলের সামনে এসেছিলো। আমি স্কুল থেকে বেরোতেই বলল,
“আমি তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। তোমার সঙ্গে কথা আছে।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম যে কী কথা! তখন বলল, পলিন আমার ভালো না লাগা রোগের কারণ তুমি। তুমি কী আমার এই রোগ ঠিক করে দিতে পারবে?

আমি কিছু না বলে চলে এসেছি। এরপর আর একটা কথাও বলিনি। তখন নিজের অনুভূতি না বুঝলেও পরে ওর অবস্থা দেখে বুঝতে পেরেছি। কিন্তু না পারছি সেটা বলতে আর না পারছি সইতে। কী করব বলো তো! নিজের জন্যও খারাপ লাগছে আবার ওর জন্যও খারাপ লাগছে। আমি যদি নিজে থেকে কিছু বলিও সেটা নিয়ে সারাজীবন খোঁটা সহ্য করতে হবে। আর কেউ না হলেও আবির ভাই সারাজীবন খোঁটা দিবে। তুমি কী আমার হয়ে ওনাকে একটু বলে দিবে যে আমারও ওনাকে অল্প অল্প ভালো লাগে!

***
বৃষ্টি চিঠি শেষ করে খেয়াল করলো যে ওর গাল ভেজা। চিঠিটা ভাজ করে রেখে ঝটপট তৈরী হয়ে নিলো। নিচে নামতেই নিলুফার বলল,

“বুবু খাবেন না?”

“এখন না। একটু কাজ আছে। ”

বৃষ্টির মা বলল,

“এখন আবার কোথায় কাজে যাচ্ছিস?”

বৃষ্টি জবাব না দিয়ে দ্রুত চলে গেল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেল আবিরদের বাড়িতে। আবির বাড়িতে নেই। বৃষ্টি আতিফের নাম ধরে ডাকলো। আতিফ বেরিয়ে বলল,

“কী ব্যাপার বুবু?”

“তুই এক্ষুনি আমার সঙ্গে চল। ”

“কোথায়।”

“গেলে দেখতে পারবি। ”

“আমি এখন যেতে পারব না। আমার তৈরী হতে হবে। দেরি হলে বাস পাব না। ”

“আমার সঙ্গে চল। তারপর যে জাহান্নামে যাওয়ার যাবি।”

বৃষ্টি আতিফের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল।

***
রিকশা নেয়ার সময় আবিরের সঙ্গে দেখা হলো। আবির অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“এই তোরা যাচ্ছিস কোথায়?”

বৃষ্টি রিকশায় উঠতে উঠতে বলল,

“পলিনের স্কুলের দিকে যাচ্ছি। গেলে আসতে পারো। ”

আবিরও কোনো কিছু না ভেবে রিকশা নিয়ে নিলো।

***
বৃষ্টিকে দেখে ওর বাবা বললেন,

“কীরে তুই এখানে? ”

“পলিনকে একটু দরকার। ও আমার উপর রেগে আছে তো তাই।”

“তা সেটা বাড়িতে মেটানো যেত না। স্কুল শেষ করে ও তো বাড়িই যাবে। ”

বৃষ্টি চুপ করে রইলো।

পলিন অবাক গলায় বলল,

“তুমি এখানে?”

“আমার সঙ্গে আয়। ”

পলিন বৃষ্টির সঙ্গে এসে যখন আতিফ কে দেখলো তখন চুপসে গেল। আতিফ পলিন কে দেখে অন্যদিকে তাকালো। পলিন বৃষ্টির হাত চেপে ধরে বলল,

“আমাকে এখানে কেন এনেছো। ”

“যে কথা বলতে তোর খুব লজ্জা লাগছে সেই কথা আতিফ কে বলবি। ”

“না না পারব না। ”

“কেন! এমনিতে তো অনেক বলতে পারিস। আজ কেন পারবি না?”

পলিন চুপ করে রইলো। বৃষ্টি আতিফকে গিয়ে বলল,

“পলিন তোকে কী যেন বলবে, শুনে আয়। ”
বৃষ্টি আর দাঁড়ালো না। চলে এলো ওখান থেকে।

***
আবির ওদের খুঁজে না পেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বৃষ্টিকে আসতে দেখে বলল,

“কিরে আমার ভাইটাকে কী করলি?”

“এতো টেনশনের কারণ নেই। অক্ষত আছে। ”

আবির সন্দিহান গলায় বলল,

“তোদের বিশ্বাস নেই। ”

বৃষ্টি আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,

“তোমার ভাই আমার না হওয়া দেবর। খুব একটা দূরের কেউ না।”

“না হওয়া দেবর মানে? হবু দেবর বল!”

বৃষ্টি সরু চোখে তাকালো। বলল,

“কেন! তোমাদের বাড়ি থেকে তো এখনো কিছু জানায় নি। ”

আবির হেসে ফেলল। বৃষ্টি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো। পারলে বলে ফেলতো, সবসময় যারা হাসে তাদের মন খারাপ করলে একটুও ভালো লাগে না। আমি মানুষ কে হাসাতে পারি না, শুধু নিজেই রাগতে পারি। তাই দয়া করে বাকী জীবন মন খারাপ না করার বিনীত অনুরোধ।

চলবে…