বাড়ির নাম বৃষ্টিলেখা পর্ব-৩২ এবং শেষ পর্ব

0
1087

#বাড়ির নাম বৃষ্টিলেখা
#পর্ব-৩২ও শেষ পর্ব

পলিন এই প্রথম আতিফের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আতিফও চুপ করে আছে৷ পেছনে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই। যদিও এই রাস্তাটা নিরিবিলি তবুও স্কুলের সময়ে পলিনের এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকাটা ভালো দেখায় না। আতিফ বলল,

“তুমি কী কিছু বলবে নাকি আমি চলে যাব। ”

পলিন জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো। আতিফ বলল,

“কিছু না বলার থাকলে আমি যাই। এখন গেলে বাস ধরা যাবে। ”

“একটু দাঁড়ান। ”

আতিফ রসিকতার সুরে বলল,

“ওহ সরি এতক্ষন যে বসে ছিলাম সেটা খেয়ালই ছিলো না। ”

পলিন মিটিমিটি হাসলো। আতিফ নিজেও হেসে ফেলল।

আতিফ আবারও বলল,

“বুবু এভাবে ডাকাতের মতো ধরে নিয়ে চলে এলো। আর তুমিও কিছু বলছ না!”

পলিন লাজুক মুখে বলল,

“বুবু বিয়ের জন্য রাজী হয়েছে জানেন?”

আতিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“না জানতাম না। এটা জানার জন্যই তো এখানে দাঁড়িয়ে আছি। ”

পলিন আবারও হাসলো। আতিফের অধৈর্য্য হওয়াটা খুব উপভোগ করছে। আতিফ কঠিন গলায় বলল,

“তাহলে কী এখন চলে যাব? আর তুমি এতক্ষন বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে আর ক্লাস করবে না?”

পলিন এবার শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল,

“অন্য আরও একটা কথা আছে কিন্তু আমার খুব লজ্জা লাগছে। ”

আতিফ অবাক গলায় বলল,

“তুমিও লজ্জা পাও?”

পলিন মাথানিচু করে ফেলল। আতিফ মৃদু হেসে বলল,

“আমি কী চোখ বন্ধ করে ফেলব?”

“চোখ কেন বন্ধ করবেন?”

“তাহলে যদি তোমার লজ্জা কমে!”

“আচ্ছা বলছি, আপনি আবার আবির ভাইকে বলবেন না।”

“আচ্ছা বলব না। ”

পলিন আবারও চুপ করে রইলো। বুকের মধ্যে ধুকপুক করছে। একটা সামান্য কথা বলবে অথচ সেটা পারছে না। আতিফ ঠোঁট টিপে হাসছে। আতিফ নিজেই বলল,

“আচ্ছা তুমি কী এটা বলতে চাইছো যে, বুবুর ভাইয়ার সঙ্গে বিয়ে হলে অতিদ্রুত তোমার একটা গতি হওয়া দরকার? ”

পলিন ক্ষেপে গিয়ে বলল,

“মোটেও না। আমার সামনে পরীক্ষা। ”

“তাহলে? ”

“আপনি ভালো করে পড়াশোনা করুন। আমি নিজে ফেল্টু হলে কী হবে! বাবা কিন্তু ফেল্টু ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে দিবে না। ”

আতিফ গম্ভীর গলায় বলল,

“আচ্ছা। এটাই বলার ছিলো! ”

“হু।”

“এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে! এমনিতে তো সব কথা সোজাসাপ্টা বলো। ”

পলিন মাথানিচু করে ফেলল।

আতিফ বলল,

“আমি চলে যাব?”

“হু। ”

“আচ্ছা।”

আচ্ছা বলেও আতিফ দাঁড়িয়ে রইলো। পলিন বলল,

“যাবেন না?”

“তুমি আগে যাও। ”

“আচ্ছা।”

এবার পলিন নিজেও দাঁড়িয়ে রইলো। আতিফ বলল,

“কিছু বলবে?”

“আপনি কবে আসবেন?”

আতিফ জবাব দিলো না। ওর তো এখন আর যেতেই ইচ্ছে করছে না। আতিফ গভীর গলায় বলল,

“আমি কী থেকে যাব?”

“না। এখানে থাকলে আপনার পড়াশোনা হবে না। ”

আতিফ আর কিছু বলল না। পলিন বলল,

“আমি নিয়মিত চিঠি লিখব। ”

“সেই চিঠি কী আমি পড়তে পারব? ”

“হু।”

“আমি তোমাকে ফোন করব। ”

“ফোন করলেও একটা করে চিঠি পাঠাবেন। চিঠিতে যা থাকে তা ফোনে থাকে না। কথা শেষ হলেই তো ফুড়িয়ে যায়।”

আতিফ হাসলো। বলল,

“পড়াশোনা নিয়ে তোমাকে আর জোর করব না। ফেল করেও তুমি যদি খুশি থাকো তাতেই আমি খুশি।”

পলিন মৃদু হাসলো।

আতিফ আবারও বলল,

“পাল্টে যেও না প্লিজ। যেমন আছ তেমনই থাকো।”

“আমি যা যা বলেছি সেগুলো আবির ভাইকে বলবেন না। ওই ব্যটা ক্ষেপিয়ে মারবে। আমাকে তো ক্ষ্যাপাবে সঙ্গে আমার বাচ্চাদেরও সারাজীবন খোঁটা দিবে। ”

আতিফ শব্দ করে হেসে ফেলল। পলিন লজ্জা পেলেও সামলে নিয়ে বলল,

“হাসার কী আছে। আমারও তো একদিন বাচ্চাকাচ্চা হবে। ”

আতিফ হাসি থামিয়ে বলল,

“আচ্ছা। সেই একদিনের অপেক্ষায়।”

আতিফ চলে যাচ্ছে। পলিনের চোখে পানি এসে গেল। থেকে যেতে বললে আতিফ নিশ্চয়ই থেকে যাবে। কিন্তু কী দরকার! দূরত্ব যতই হোক, একজন আরেকজনের মনে তো সারাক্ষণই থাকবে।

****
বৃষ্টি আবির কে বলল,

“তুমিও যাবে না?”

“না।”

“সাহ্নিক যদি তোমাদের কথা জিজ্ঞেস করে?”

“করবে না। ও’কে আমি চিনি।”

বৃষ্টির মন খারাপ লাগছে। পলিন এর আগে দেখা করতে চাইলেও আজ কিছুতেই রাজী হলো না। আবির বলল,

“সাবধানে যাস। ফোন করিস।”

“আচ্ছা।”

আবির চলে যাচ্ছে। গাড়ি ছাড়া অবধি দাঁড়ালোও না। বৃষ্টি পায়ের কাছে রাখা ব্যাগ টা সরিয়ে রাখলো। সাহ্নিক ওর সঙ্গে দেখা করতে চায় নি। ও নিজে থেকেই যাচ্ছে।

***
সাহ্নিক বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলো। হাতে কাগজে মোড়া বাদাম। বৃষ্টিকে দেখে স্বভাবসুলভ হাসলো। তারপর এগিয়ে এসে বলল,

“ব্যাগ টা আমি নেব?”

“না। আমি পারব।”

“তুমি একা এসেছো?”

বৃষ্টি হাসলো ওর দিকে তাকিয়ে। ওর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল,

“হাটতে সমস্যা নেই তো?”

“না না। আমি এমনিতেই প্রচুর হাটি। ”

বাসস্ট্যান্ড থেকে বেরিয়ে দুজন হাটতে লাগলো। বৃষ্টি বলল,

“আমার মায়ের খুব আফসোস যে আপনাকে পিঠে বানিয়ে খাওয়াতে পারে নি। ”

সাহ্নিক হেসে বলল, আশ্বাস দিতে পারলাম না যে আরেকবার পিঠে খেতে আসব।

বৃষ্টি কিছু বলল না। খানিকক্ষণ হাটার পর ওর নিজেরই ক্লান্ত লাগলো। বলল,

“পার্কে কিছুক্ষন বসি?”

“চলো।”

দুজনে পার্কে বসলো। সাহ্নিক খুটে খুটে বাদাম খাচ্ছে। বৃষ্টি তাকিয়ে দেখছে। ওর তাকিয়ে থাকা দেখে সাহ্নিক বলল,

“এখানকার স্ট্রিট ফুডগুলো দারুণ। ”

“আপনি বাংলাদেশে আর কখনো আসবেন না?”

সাহ্নিক মৃদু হেসে বলল,

“জানিনা।”

“এখন কেন এলেন?”

“তোমাদের একবার দেখতে।”

“দেখতে এসে এভাবে মায়া বাড়িয়ে গেলেন। ”

সাহ্নিক হেসে বলল,

“বৃষ্টিলেখা তোমাদের বাড়ির সবাই ই খুব ভালো। আমি তোমার সম্পর্কে যেমন ভেবেছিলাম তুমি তেমন না। তোমরা সবাই ই অন্যরকম। ”

“আপনি আমার সম্পর্কে কী ভেবেছিলেন? ”

“সাধারণ বাঙালি মেয়েরা যেমন হয় তেমন ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি তেমন নয়। তুমি সাধারণই। তবে একটা কিছু বিশেষ আছে, যার কারণে আলাদা।”

বৃষ্টি হাসলো। পাশের ব্যাগ টা সাহ্নিকের দিকে দিয়ে বলল,

“আমাদের বাড়ি থেকে সবাই কিছু না কিছু আপনার জন্য পাঠিয়েছে। পলিনের একটা চিঠি আছে। চিঠি পড়ে ছিড়ে ফেলতে বলেছে।”

সাহ্নিক ব্যাগটা নিলো। খুশিতে চোখ চকচক করে উঠলো।

সাহ্নিক বলল,

“বৃষ্টিলেখা তুমি কী একবারও তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চাও না?”

“উনি দেখা করতে আসলে ফেরাব না। তবে নিজে থেকে চাই না।”

“তোমার বিয়েতে তাকে ডেকো। ”

“সেটা বোধহয় সম্ভব না।”

সাহ্নিক হাসলো। বলল,

“তোমার মায়ের প্রতি যে অভিযোগ, অভিমান এটা একদিন মুছে যাবে। জীবনে র একটা সময়ে মনে হবে যে যা হয়েছে হয়তো ভালোর জন্যই হয়েছে।”

“আমি এখনই বিশ্বাস করি যে যা হয়েছে ভালোর জন্য হয়েছে।”

সাহ্নিক আবারও হাসলো। বৃষ্টি চুপ করে আছে। সাহ্নিক জিজ্ঞেস করলো,

“তুমি কী আজই ফিরে যাবে?”

“হ্যাঁ। সন্ধ্যেবেলা বাস আছে। ”

“আচ্ছা।”

“আপনার কাউকে কিছু বলার নেই?”

“আবির কে বলবে যে ওর বিয়েতে থাকতে পারলে খুব ভালো লাগতো। কিন্তু সেটা সম্ভব না।”

“কেন সম্ভব না?”

সাহ্নিক বৃষ্টির চোখের দিকে তাকালো। বৃষ্টি আবারও জিজ্ঞেস করলো,

“আপনি ফিরে গিয়ে সবাই কে ভুলে যাবেন?”

“না। আমি কারোর সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলেও কাউকে ভুলব না।”

“আপনার দেয়া ফোন টা কিন্তু আমি ব্যবহার করছি।”

“থ্যাংক ইউ।”

“আপনি ফোন করবেন না?”

“না। আমি ফোন করলে তোমরা জিজ্ঞেস করবে আমি কেমন আছি তখন আমাকে মিথ্যে বলতে হবে। রঙহীন জীবনে আমি বোধহয় ভালো থাকব না।”

বৃষ্টি উঠে দাঁড়ালো। বলল,

“আমি উঠি।”

“আমি এগিয়ে দিয়ে আসি?”

বৃষ্টি কঠিন গলায় বলতে চাইলো, না। কিন্তু পারলো না। মাথা নেড়ে বলল,

“চলুন। ”

বাস স্ট্যান্ডে আসার আগে দুজনে চটপটি খেল। গাড়িতে ওঠার আগে সাহ্নিক বলল,

“বৃষ্টিলেখা তুমি কী আরেকবার আমাকে একটা চিঠি লিখবে?”

বৃষ্টি হাসার চেষ্টা করে বলল,

“লিখব। ”

বৃষ্টি গাড়িতে উঠলো শেষ সময়ে। ওঠার মিনিট খানেকের মধ্যে গাড়ি ছেড়ে দিলো। জানালা দিয়ে তাকিয়ে শুধু দেখলো যে সাহ্নিক চশমা টা খুলে শার্টের হাতায় মুছছে। গাড়ি চলতে শুরু করলো। বৃষ্টির চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা পানি পড়লো। মনে মনে বলল,

“সাহ্নিক আপনার পলিনের কথা শোনা উচিত ছিলো। আপনি না এলেই ভালো হতো। ”

***
আজ বৃষ্টিলেখার গায়ে হলুদ। হলুদ বাটা হচ্ছে। সেই সঙ্গে সুর করে সকলে গান গাইছে,

হলুদ বাটো, মেন্দি বাটো
বাটো ফুলের মৌ।
বিয়ের সাজে সাজবে কন্যা নরম নরম বউ।

বাড়িতে খুশির আমেজ। সবাই ই খুশি। এই বাড়ি থেকে ওই বাড়ি যাওয়া হচ্ছে তবুও আমার দাদী কিছুক্ষণ পর পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছেন, একদিন বাদে মাইয়াটা দূরে চইলা যাইবো।

এবারে আমাদের বাড়ির কথা শুনুন। নিলুফারের খুব সুন্দর একটা মেয়ে হয়েছে কিছুদিন আগে৷ যতক্ষন ঘুমিয়ে থাকে ততক্ষণ ভালো। তাছাড়া সারাক্ষণ ই কপাল কুচকে থাকে। নিলুফার আমাকে বলে, বুবু ও আপনার মতো হবে। শান্ত, শিষ্ট বাপ মায়ের মেয়ে যদি আমার মতো হয় তাহলে তো বিপদ।

টুকু ভাই বাজারে খাবার হোটেল খুলেছে সাহস করে। সবেমাত্র শুরু করেছে তবে ভাবগতিক দেখে মনে হলো যে ভালোই করবে। আমরা একদিন খেতে গিয়েছিলাম। খেয়েদেয়ে বিল দিতে গেলে টুকু ভাই খুব লজ্জা পেল। এই লোক সারাজীবন লজ্জাই পেয়ে যাবেন মনে হচ্ছে।

ফুপুর সঙ্গে নিলুফারের সম্পর্ক আগের থেকে ভালো। নাতনি পেয়ে ফুপু যেন আকাশের চাঁদ পেলেন। সারাক্ষণ কোলেই রাখেন। অনেক দিন হলো তল্পিতল্পা গুটিয়ে কোথাও যাচ্ছেন না। মায়ের সঙ্গে ঝগড়াও আজকাল কম হচ্ছে।

আমার বাবাও ভালো আছেন। বাবা খুব সম্ভবত আমার উপর রেগেও আছেন। অনেক দিন আগে আমি বাবাকে বলেছিলাম, তুমি তোমার প্রাক্তন স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে চিঠিপত্র পাঠাতেই পারো। কিন্তু আমার মা’কে শুধু সংসার চালানোর জন্য যদি দরকার মনে করো তাহলে সেটা কিন্তু তার জন্য অপমান। এই অপমান সে ডিজার্ভ করেন না।

মা ভালো আছেন। আমার বিয়েতে সবচেয়ে খুশি বোধহয় তিনিই হয়েছেন। ছোট মা, কাকাসহ বাড়ির অন্যরাও ভালো আছে। ছোট মা আর কাকার বোধহয় কখনো ঝগড়াঝাটি হয় না। আমাদের চোখে পড়েনি। তবে পলিনের ভাষ্যমতে এরা চুপিচুপি ঝগড়া করে ঘরের দরজা আটকে। এই ঝগড়ার নাম শিক্ষিত ঝগড়া। যেখানে চিৎকার, চেঁচামেচি থাকে না। মুখ ফুলিয়ে থাকা, রাগারাগি এসব থাকে না।

পলিনের কথা তো বলাই হয় নি। পলিন কিভাবে কিভাবে যেন ভালোরকম ভাবে ম্যাট্রিক পাশ করে গেল। এখন সে কলেজ ছাত্রী। আগে আবিরের ডাকপিওন হিসেবে কাজ করতো আর এখন আবির ওর ডাকপিওন হয়ে গেছে। আবির কিন্তু এখনো আমাকে চিঠি লিখে। সেগুলো নিজ হাতেই দেয়। পলিন আর আবিরের সম্পর্ক আগের মতোই আছে। কখনো মেঘের মতো আবার কখনো বৃষ্টির মতো।
আতিফ ছেলেটা ভীষণ ভালো তবে অনেক বেহায়া। রাত বিরাতে ফোন করে বলে, বুবু একটু পলিন কে দাও তো। আমি মাঝেমধ্যে ধমকে উঠলেও হেলদোল নেই। এই ছেলেটা কিছুদিন আগে ভয়ংকর এক কান্ড ঘটিয়েছে। পলিন রাগ করে কথা না বলায় পুরো একটা দিন না খেয়ে থেকেছে। ভাবা যায়! এতো প্রেম কোথা থেকে আসে কে জানে!

আগের চিঠিতে আপনাকে আবিরের সম্পর্কে কিছু লেখা হয় নি। এবার লিখছি, আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি আবিরকে কতটা ভালোবাসি। ভালোবাসা ব্যাপার টা পরিমাপ তো করা যায় না তবে একটা ব্যাপার আমি জানি আবিরের ভালোবাসার কাছে আমার ভালোবাসা ছিটেফোঁটা মাত্র।

এই ছিলো আমাদের বাড়ির গল্প। আর কী লিখি বলুন তো! আমার কথা কিছু লিখিনি। আমি এখন সেজেগুজে বসে আছে। হলুদ শাড়ি, ফুলের গয়না, আর পায়ে আলতা পরে বসে আছি। আপনাকে চিঠি লিখছি। আমি ভালো আছি। সবাই যখন ভালো থাকে তখন আর খারাপ থাকা যায় না। একটা নতুন জীবন শুরু হচ্ছে। চেনা মুখ, চেনা বাড়ি হলেও অনুভূতিটা অন্যরকম। এই বাড়ি থেকে ওই বাড়িতে যাচ্ছি। সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি এক আকাশ ভালোবাসা। লেখকরা বলেন জীবন কে দেখতে হলে বাইরে বেরিয়ে মানুষজন কে দেখতে হয়। বিচিত্র মানুষের সঙ্গে মিশে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়। আমার কাছে আমার বাড়িই হলো জগৎ। এখানে থেকেই একটু একটু শিখছি। মায়া, মমতা শিখছি মায়ের কাছ থেকে। ধৈর্য্য ধরে এগিয়ে যাওয়া শিখছি ছোট মায়ের কাছ থেকে। দাদীর কাছে শিখেছি কিভাবে সবাইকে আগলে রাখতে হয়। নিলুফারের কাছ থেকে শিখছি ভান না করেও নিজের মতো করে থাকা যায়। আর সরলতা শিখছি আমার ছোট্ট বোনের থেকে। আমি খুব ভাগ্যবতী যে এদের সবাই কে সারাজীবন কাছে পাব। আমার ছাদ, আমার বারান্দা, আমার বিছানা এগুলো খুব বেশী দূরে না। কাছেই থাকবে। ইচ্ছে হলেই ছুঁয়ে দিতে পারব।

আমি মিরাকেলে বিশ্বাস করি না সাহ্নিক। কিন্তু আল্লাহ কে বিশ্বাস করি। তিনি চাইলে সবকিছু সম্ভব। আমি খুব করে চাই, তিনি যেন আপনার পৃথিবীকে রঙহীন না করে।

আমার খুব ইচ্ছে একদিন আপনার শহরে আসতে। সেদিন হবে বৃষ্টির দিন। আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যখন খুঁজে পাব তখন আপনি স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে আপনার জীবনের বিশেষ মানুষ টা’কে ডেকে বলবেন। এই হলো বৃষ্টিলেখা। একদিন আমি ও’কে চমকে দিয়েছিলাম। আজ ও আমাকে চমকে দিয়েছে। বলেছিলাম না, ও সাধারণই তবে একটু অন্যরকম।

ইতি
আপনার চিঠিবন্ধু বৃষ্টিলেখা।

পরিশিষ্টঃ
অনেক বছর পরের কথা, পলিন এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। বৃষ্টি স্টেশনে এসেছে পলিন কে উঠিয়ে দিতে। হঠাৎ এক ভদ্রমহিলা তার সাত, আট বছরের ছোট বাচ্চাকে নাম ধরে ডাকলো। এই সাহ্নিক! দুজনেই চমকে উঠলো। অবাক করা বিষয় হলো এই বাচ্চাটির চোখেও চশমা। পলিন ফিসফিস করে বলল,

“বুবু বাচ্চাটার একটা চোখ জন্ম থেকেই বোধহয় অস্বাভাবিক। ”

বৃষ্টি কথা বলতে পারলো না। গলায় কিছু একটা আটকে আছে। পলিন কোনো কথা না বলে ট্রেনে উঠলো। বৃষ্টি পলিন কে কিছু বলতেও পারলো না। ইশারায় মাথা নেড়ে বলল, সাবধানে যেতে। পলিনও মাথা নেড়ে আশ্বস্ত করলো। দুই বোনের চোখেই পানি টলমল করছে।

বৃষ্টি মনে মনে বলল, সাহ্নিক আপনি হলেন আমাদের জীবনে হঠাৎ মেঘে এক পশলা বৃষ্টি। আজও তাই একইরকম ভাবে হৃদয়ে আছে।

ট্রেন চলছে ঝিকঝিক শব্দে। পলিন চোখ বন্ধ করে ফেলল। মনে মনে বলল,

আমরা খুব ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন!

★★
সমাপ্ত