বিকেলের যতো রঙ পর্ব-০১

0
47

#বিকেলের_যতো_রঙ
পর্ব সংখ্যা-০১
#রুবাইদা_হৃদি

আম্মা মারা যাবার তিনদিনের মাথায় আব্বা মিনু খালাকে বিয়ে করে আনলেন৷ যে খালার মেয়ে ঝুমা আপার সাথে আমার বড় ভাইয়ের বিয়ের কথা আম্মা নিজে ঠিক করে রেখে গিয়েছেন৷ আমি তখনো আম্মার শোকে বিছানায় কাতরাচ্ছি ৷ আব্বার বিয়ের কথাটা বুয়ার মুখে শুনেই ছুটে উঠানে এসেই দেখি আব্বার পাশে মিনু খালা সুতির একটা লাল শাড়ি পরে ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন৷ তার পাশেই ঝুমা আপা শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে৷ আব্বা আমাকে দেখেই চওড়া গলায় বললেন,

‘আম্মাজান তোমার নতুন আম্মুকে সালাম দাও৷’

আমি আব্বার দিকে টলমলে চোখে তাকালাম৷ কান্না আঁটকে বললাম,

‘আম্মা গত পরশু মারা গেছে আব্বা৷ আগর বাতির সুবাস এখনো ঘর থেকে যায় নাই৷’

‘জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে আল্লাহর হাতে আম্মা৷ আমি তো তার হুকুমের গোলাম মাত্র৷’

আব্বা আমার কাছে এসে মাথায় হাত রেখে বললেন৷ আমি আব্বাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম৷ দাদি এসেই আব্বাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘নতুন বউ বাইরে খাঁড়ায় আছে৷ মাইয়া ছাড়৷ দেখতে দেখতে একাই ঠিক হইয়া যাইবো৷’

‘মিনু ঘরে আসো৷ এইটা তো তোমার’ই সংসার৷’

আব্বা আমাকে ছেড়ে দিয়ে মিনু খালাকে উদ্দেশ্য করে বললেন৷ মিনু খালার চোখ চকচক করেছে৷ উনি আমার মায়ের চাচাতো বোন৷ গত চার বছর আগে খালু রোড এক্সিডেন্টে গত হয়েছে৷ আমি খালার দিকে ঘৃণ্য দৃষ্টিতে তাকাতেই উনি আহ্লাদী সুরে বললেন,

‘মিথি আসো আম্মা আমার বুকে আসো৷’

আমি দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঝুমা আপার দিকে তাকালাম৷ সে মুখ কাঁচুমাচু করে দাড়িয়ে আছে৷ খালার কাছে আমি এগিয়ে গিয়ে উনার হাতদুটো ধরে বললাম,

‘অন্য মানুষ যদি কাজটা করতো আমার এতো দুঃখ লাগতো না৷ আপনি আমার মায়ের বোন হয়ে কাজটা করতে পারলেন!’

‘কি কথা কও তুমি! বিয়ে করলাম তোমাদের জন্য৷ তুমি আমায় দোষী বানাও৷’

‘ওরা তো তোমার পা ধরে বিয়ে করতে বলে নাই মা৷ তুমি নিজ ইচ্ছাতে বিয়ে করে এসেছো৷’

ঝুমা আপা শান্তস্বরে কথা গুলা বললো৷ মিনু খালা মেয়ের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকাতেই আপা অগ্রাহ্য করে বললো,

‘তোর রুমে চল মিথি৷’

আমি ঝুমা আপার কথা শুনে এলোমেলো পায়ে ঘরে এলাম৷ পিছুপিছু আপাও এলো৷ ঘরে আসতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বললো,

‘মিথিরে আমার আর আশরাফ ভাইয়ের বউ হওয়া হলো না৷’

আপার কন্ঠে কি যেন একটা ছিলো৷ আম্মার শোক যতোটা না পীড়া দিচ্ছে তার থেকে বেশি বড় ভাইয়ের কথা ভেবে কষ্ট হচ্ছে৷ আমার আঠারো বছর বয়সে জ্ঞান হবার পর থেকে দেখেছি ভাইয়া ঝুমা আপাকে উন্মাদের মতো ভালোবাসেন৷ যদি-ও ব্যাপার টা আমি,আম্মা,আব্বার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো৷ ঝুমা আপাও ভাইয়াকে কিঞ্চিৎ পছন্দ করতেন৷ আব্বা জেনেও কি ভাবে পারলেন এমন একটা কাজ করতে! ভাইয়া যে কষ্টে শেষ হয়ে যাবে৷

.

বিকেলের রোদ পরতেই ভাই বাসায় আসলেন৷ উঠানে থেকেই আমাকে হাঁক ছেড়ে ডাকছেন৷ আমি বিছানা থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম৷ দেখলাম ঝুমা আপা আমার ঘরে রাখা কাঠের চেয়ারে ঘাপটি মেরে বসে আছে৷ চোখের কোণে জমে থাকা পানি ওড়না দিয়ে মুছে আমি ঘর ছেড়ে উঠানে নেমে দাঁড়ালাম৷ আমাকে দেখেই ভাইয়া তপ্ত খড়ার এক বিন্দু বৃষ্টির মতো হাসলো৷ তার হাতে আমার প্রিয় রসমালাই৷ আমাকে কাছে ডেকে বললো,

‘এইগুলা ধর মিথি৷ আম্মা নাই বলে কি আমাকে পানি এনেও দিবি না?’

ভাইয়ার কন্ঠে অভিমান৷ ভাইয়া বাসায় ঢোকার আগেই আম্মা এক জগ ভর্তি পানি নিয়ে আসতেন৷ ভাইয়া হাত মুখ ধুঁয়ে এরপরই ঘরে পা রাখতো৷ আমি কল পাড় থেকে পানি নিয়ে এলাম৷ ভাইয়া আমার হাতে রসমালাইয়ের পলিব্যাগ টা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বললো,

‘দুপুরে খেয়েছিস?’

আমি ঠোঁট চেপে মাথা দুলিয়ে ‘না’ বুঝাতেই ভাইয়া বুয়াকে ডাকলো৷ কুলসুম এসেই ভাইয়াকে দেখে আঁচলে মুখ ডাকলো৷ গুন গুন সুর তুলে কান্না করে উঠলো৷ ভাইয়া চোখমুখ কুঁচকে বললেন,

‘তোর আবার কি হলো!’

‘ভাইজান গো কত বড় একটা দুর্ঘটনা যে ঘটছে৷ আপনারে আমি কেমনে কই৷ হায় হায় রে৷’

কুলসুম হাইহুঁই করে বলছে৷ ভাইয়া আমার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই আমি কুলসুমের দিকে রাগান্বিত চোখে তাকালাম৷ ও প্রায় আমার সম বয়সী কিন্তু মাথায় স্ক্রু কিছুটা ঢিলে৷ আমার তাকানো দেখে মুখ ঢেকেই গুন গুন করতে করতে রান্নাঘরে ঢুকলো৷ ভাইয়া সরু চোখে তাকিয়ে বললো,

‘বাড়িতে কিছু হয়েছে?’

‘মিনু খালা আর ঝুমা আপা এসেছে৷’

‘এইটা তো ভালো কথা৷ কিন্তু দুর্ঘটনাটা?’

আমি কী উত্তর দিবো খুজে পেলাম না৷ চুপচাপ থাকাটাই শ্রেয় মনে হচ্ছে৷ কারণ ভাইয়া ঝুমা আপাকে নিয় ঘর বাঁধার স্বপ্ন সাজিয়েছিলো৷ আমি কিভাবে বলবো ভাইয়া আম্মার সাথে সাথে তোমার স্বপ্ন আব্বা মাটিচাপা দিয়ে ফেলেছেন৷
আমাকে দাঁড়িয়ে নখ খুঁটতে দেখে ভাইয়া ঘাটলেন না৷ আমার হাত ধরে রান্না ঘরে এগিয়ে গেলেন৷ যেতে যেতে বললো,

‘জানিস মিথি এবারের চাকরিটা মনে হয় হয়ে যাবে৷ আম্মা থাকলে কতো খুশি হতো৷ আমার বুকের একটা অংশ খসে পরে গেছে রে৷’

শেষের কথাটুকু ভাইয়া ধরা গলায় বললো৷ আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘আল্লাহ আম্মাকে এতো দ্রুত না নিলেও পারতো ভাইয়া৷’

ভাইয়া নির্লিপ্ত হেসে বললো,’সব’ই আল্লাহর হুকুম৷’

রান্নাঘরে পাঁ রাখতেই মিনু খালা কোথা থেকে যেন ছুটে এলেন৷ ভাইয়াকে দেখেই আহ্লাদ করে বললেন,

‘আসছো আশরাফ বাবা৷ আসো খাইতে দেই৷’

‘আপনারা আসছেন শুনে আমার অনেকটা হালকা লাগছে খালাম্মা৷ মিথিটা একদম ঘরে থাকে৷ আব্বাকে কাল দেখলাম খেতে বসে কাঁদছেন৷’

ভাইয়ার কথা শুনে আমি তার মুখের দিকে তাকালাম৷ আমার বড্ড ভয় হচ্ছে৷ ওইদিকে মিনু খালা খাবার বেড়ে দেওয়ার জন্য কুলসুম কে তাড়া দিচ্ছেন৷ ভাইয়া উনাকে উদ্দেশ্য করে আবারো বললেন,

‘খালাম্মা কয়দিন বেশি থেকে যাবেন৷’

‘ভাইয়া এতো কথা বলো কেন৷ আমার ভালো লাগছে না৷’

আমি ভাইয়ার কথার মাঝে বাঁধা দিয়ে বললাম৷ ভাইয়া আমাকে টেনে চেয়ারে বসিয়ে বললেন,

‘আচ্ছা আর বলবোনা৷ আব্বা কোথায়!’

‘জানি না৷’ আমি অসন্তোষ গলায় বলতেই মিনু খালা লাজুক ভঙ্গিতে বললেন,

‘তোমার আব্বা মসজিদে গেছেন৷ বড় আপার মিলাদের জন্য এতিমখানায় দাওয়াত দিতে৷’

আমি মহিলার কথা শুনে অবাক হচ্ছি৷ এইতো গত পরশুদিনও মহিলা আব্বাকে আমজাদ ভাই বলে ডেকেছেন৷ আমার আম্মার জন্য গড়াগড়ি করে কান্না করছেন৷ আর আজ তার কথার ভঙ্গি সব পাল্টে গেলো৷

.

সন্ধ্যের আবছা আলোয় চারদিক আলো আঁধারের খেলা খেলছে৷ আমি নামাজ পড়ে রোয়াকে বসে তসবি পড়ছি৷ ভাইয়ার অপেক্ষায় বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটা শব্দ হচ্ছে৷ মাগরিবের নামাজ পড়তে ভাইয়া মসজিদে গেছে৷ আব্বার বিয়ের খবর টা ঘরের কেউ না দিলে বাইরের সবাই অবশ্যই কানাঘুষা করছে৷ আমার আব্বা মাতবর গোছের লোক বলেই কেউ বাড়ি বয়ে এসে কথা শোনাচ্ছে না৷ তবে বাইরে কম সমালোচনাও হচ্ছে না৷ আমাকে উদাস হয়ে বসে থাকতে দেখে ঝুমা আপা এসে পাশে বসলো৷ ঝুমা আপা কাঁদছে৷ আমি তসবিহ টা পড়া বন্ধ করে ঝুমা আপাকে বললাম,

‘ভাইয়ার জন্য কষ্ট হচ্ছে আপা৷’

‘আমার জীবন অর্থহীন মনে হচ্ছে মিথি৷ মা বিয়েটা করে এসে আমাকে বলেছে৷ আমি একবিন্দু বুঝতে পারলে কিছু একটা করতাম৷’

‘আর কিছুই করার নেই আপা৷ সব শেষ৷’

আমি উদাস ভঙ্গিতে বললাম৷ আব্বা যে বিয়ে করবে আমরা কেউ বুঝি নাই ৷ আমাদের কথার মাঝেই দেখলাম একটা অবয়ব হেঁটে আসছে৷ আলোর কাছাকাছি আসতে বুঝলাম ভাইয়া এসেছে৷ এসেই আমাদের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

‘আব্বা কোথায়?’

আমি ভয়ে, দুঃখে চুপসে গেলাম৷ ঝুমা আপা উঠে ঘরের ভেতর চলে গেলো৷ ভাইয়ার চোখে বেদনা স্পষ্ট৷ আমি আমতা আমতা করে বললাম,

‘দুপুরের পর আর বাড়ি ফিরে আসে নাই৷’

‘ আব্বা বিয়ে করেছেন?’

আমি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আঁটকে গেলাম৷ ভাইয়া আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই পা টেনে টেনে আমার দিকে এগিয়ে এলো৷ আমি উঠে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরতেই ভাইয়া বসে পরলো৷ আমরা দু’ভাইবোন সেখানে কতোক্ষণ নিশ্চুপ বসে ছিলাম বলতে পারবো না৷ আমি ভাইয়াকে ধরে নিশ্চুপ কাঁদছি৷ তবে ভাইয়া একরাশ দুঃখের মাঝেও বসে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে৷ আমাদের বসে থাকার অবসান ঘটলো পাশের বাড়ির রফিক চাচার আগমনে৷ উনি আসতেই ভাইয়া নড়েচড়ে বসলো৷ রফিক চাচা গলার স্বর নামিয়ে বললেন,

‘তোমরা খবর পাইছো?’

‘ কিসের খবর চাচা!’ ভাইয়া মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে প্রশ্ন করলো৷ রফিক চাচা ভাইয়ার একদম কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে বললো,

‘তোমার আব্বারে কে জানি মাইরা নদীর পাড়ে ফেলে রাখছে৷’

খবর টা এতোটাই বিষাক্ত ছিলো আব্বার প্রতি জমে থাকা অভিমান হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো গলে গেলো যেন৷
চলবে।