#বিকেলের_যতো_রঙ
পর্ব সংখ্যা-০৪
#রুবাইদা_হৃদি
গয়না গুলো আলনারিতে না পেয়ে ভাইয়ার চেহারায় মলিনতা বেড়ে গেলো৷ চিন্তিত স্বরে বললো,
‘আম্মা কি অন্য কোথাও গয়না গুলা রেখেছে?’
ভাইয়ার প্রশ্ন শুনে আমি হতাশা নিয়ে তাকালাম৷ ভাইয়া কি বুঝতে পারছে না! ঝুমা আপার গায়েব হবার সাথে গয়নার সম্পর্ক আছে৷ আমি রাগ দমন না করতে পেরে বললাম,
‘গয়না গুলা ঝুমা আপা নিয়ে চলে গেছে৷ তুমি বুঝতে পারছো ভাইয়া?’
‘না জেনে বুঝে কাউকে দোষ দিবি না মিথি৷ মেয়েটা হুট করে কোই গেলো সেটাও তো চিন্তার বিষয়৷’
‘আমার মাইয়ারে খুইজা আনো আশরাফ৷ আমার অবুঝ মাইয়া৷’
ভাইয়ার কথা শুনে মিনু খালা আবারো বিলাপ জুড়ছেন৷ আমি বিরক্ত হয়ে আম্মার বিছানায় বসে পরলাম৷ ভাইয়া খালার কথা অগ্রাহ্য করে বললো,
‘গয়না খুজে না পেলে টাকার ব্যবস্থা কি করে হবে!আজকে প্রায় লাখ টাকার মতো লাগবে৷’
ভাইয়ার কথা শুনে চিন্তায় আমার মাথা ব্যথার উপক্রম হলো৷ কূল কিনারা না পেয়ে আমি আর কুলসুম ঠাঁই বসে আছি৷ ওইদিকে ভাইয়ার ফোনে একের পর এক মামার ফোন আসতে লাগলো৷ হাসপাতালে বিলের জন্য নাকি তাড়া দিচ্ছে৷ ভাইয়া অস্থির হয়ে ঘরের চারদিকে পায়চারি করছে৷
আব্বা নিজের জীবনে একটা টাকা জমা রাখে নি৷ সে সব মানুষের পেছনে খরচ করেছে৷ আব্বা আমাদের সাথে অন্যায় করলেও অনেক ভালো কাজের নজির আমাদের গ্রামে আছে৷ ভাইয়া এর মাঝেই অনেকের কাছে টাকার জন্য ফোন করলেও সবাই নানা ধরণের বাহানা দিতে লাগলো৷
ভাইয়া উপায়ন্তর না পেয়ে আমাকে ডেকে বললো,
‘মিথি জায়গার জমিনের দলিল ব্যাংকে দিয়ে লোন তুলি৷’
‘যা ভালো মনে হয় করো৷ কিন্তু ঝুমা আপা..’
‘ঝুমার কথা বারবার বলিস না৷ মেয়েটা নিখোঁজ সেটাও অনেক ঝামেলার ব্যাপার৷ কোনো বাজে খপ্পরে না পরলেই হয়৷ বিপদের উপর বিপদ৷’
ভাইয়ার কথা শুনে আমি চুপ হয়ে গেলাম৷ ঝুমা আপা কখনো আমাদের বিপদ হবে এমন কাজ করবে না৷ তবে আজকের ব্যাপারটাতে উনাকে আমার সন্দেহ হচ্ছে৷
ভাইয়া নাস্তা না খেয়েই আমাকে বলে দলিল নিয়ে বের হবার পূর্বেই মিনু খালা তড়িঘড়ি করে আসলো৷ তার হাতে কাপড়ে প্যাঁচানো কিছু একটা৷ ভাইয়াকে পিছু ডেকে বললো,
‘এইখানে কিছু টাকা আছে৷ সাথে কইরা নিয়া যাও৷ জমি বন্ধক রাখা লাগবো না৷’
‘আপনি টাকা পেলেন কোথায়?’ আকি সন্দেহ নিয়ে বলতেই মিনু খালা আঁচলে মুখ ঢেকে বললেন,
‘মাইয়াডার বিয়ার জন্য ওর বাপে প্রত্যেক মাসে টাকা জমাইতো৷ নিয়া যাও আশরাফ৷ তাও তোমার আব্বারে সুস্থ কইরা নিয়া আসো৷’
ভাইয়া আমার মুখপানে অনুমতির জন্য তাকিয়ে আছে৷ আমি দ্বিধাদ্বন্দে পরে নরম গলায় বললাম,
‘নাও ভাইয়া৷ এমনিও এই সমস্যাটা ঝুমা আপার জন্যই হয়েছে৷’
‘তুই বারবার আমার মাইয়ারে বদনাম দিবি না মিথি৷ তোগো ভালোর জন্য আমরা মা মাইয়া বিপদে পরছি৷’
খালার কথা শুনে আমি পাল্টা প্রশ্ন করতেই উনি কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বললেন,
‘দলিল রাইখা যাও৷ এই টাকা গুলা নাও৷ ভালোমতো যাইয়ো বাবা৷ পারলে আমার মাইয়ার খোজ টা নিয়ো৷’
ভাইয়া ছোট করে উত্তর দিয়ে দ্রুত বের হয়ে গেলো৷ আমি দেখলাম মিনু খালা বারবার আঁচলে চোখ মুছছেন৷ তার চোখেমুখে এখন মায়ের মমতা আর স্ত্রীর ভালোবাসার রেশ ফুঁটে উঠেছে৷
.
শ্রাবণ মাসের আজ তেরো তারিখ৷ আকাশে দানবের মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে৷ থেকে থেকে বিদ্যুৎ গর্জে উঠছে৷ আমি মন খারাপ নিয়েই উঠানে থাকা কাপড় তুলতে বের হতেই দেখতে পেলাম ঝুমা আপা বাড়িতে ঢুকছে৷ শরীরে কালকে পরে থাকা থ্রিপিস টা৷ আমি আপাকে দেখে তিরিক্ষি কন্ঠে বললাম,
‘গয়না গুলা কোই?’
আপা আমার কথা শুনে ক্লান্ত ভঙ্গিতে তাকালো৷ ভ্রু উঁচু করে বললো,
‘কিসের গয়না?’
‘ভণিতা করবা না আপা৷ তুমি আমার আম্মার সব গয়না নিয়ে গেছো৷ কোই রাখছো?’
‘আবোল তাবোল বকছিস কেন!এতোদূর থেকে ফিরলাম৷ অনেক ক্লান্ত লাগছে৷’
আপা কিছুটা বিরক্ত কন্ঠে কথা গুলা বললো৷ আমার রাগ দ্বিগুণ বেড়ে গেলো৷ আমি চিৎকার করে মিনু খালাকে ডাকলাম৷ মিনু খালা রান্নাঘর থেকে বের হতেই ঝুমা আপাকে দেখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো৷ গালে,কপালে চুমু দিতে দিতে কান্না মাখা গলায় বললো,
‘কোই গেছিলা আম্মা৷ আমি অনেক ডরাইছি৷ বইলা গেলে কি হতো!’
খালার আহ্লাদ দেখে আমার আম্মার কথা মনে পরে গেলো৷ কলেজ থেকে একটু দেরি হলেই আম্মা বাড়ির গেইট ধরে দাঁড়িয়ে থাকতো৷ আমাকে দেখলেই এমন ভাবে আদর করে প্রশ্ন করতো৷ চোখের সামনে সব ভেঁসে উঠতেই আব্বার প্রতি একরাশ ঘৃণার জন্ম নিলো৷ তবে এই মুহুর্তে আমি নিজের অনুভূতি দমিয়ে খালাকে বললাম,
‘খালা আপাকে জিগ্যেস করো আমার আম্মার গয়না কোই৷’
‘ও তখন থেকে কোন গয়নার কথা বলছে মা! আমি সবেমাত্র জুলেখার বাসা থেকে ফিরলাম৷’
‘মিথ্যা বানোয়াট কথা বলবা না আপা৷গয়না কি আলমারি থেকে ভুতে নিয়ে গেলো৷’
আমি শেষের কথাটুকু মজার ছলে বললাম৷ আমার কথার সুরে কুলসুম ও আমার পাশে এসে বললো,
‘ হ ঠিক কথা৷ খালাম্মার গয়না কোউ রাইখা আসছেন৷ তাড়াতাড়ি কন৷ নয়তো পুলিশ ডাকুম৷’
পুলিশের কথা মনে হতেই আমি বললাম,
‘দেখো আপা আমি তোমাকে সমীহ করি অনেক৷ তুমি নিজেও জানো আমাদের অবস্থার কথা৷ গয়না নিয়ে থাকলে প্লিজ ফিরিয়ে দাও৷ আব্বার চিকিৎসার জন্য লাগবে৷’
‘কোন গয়না!কিসের গয়না! আমি সকাল সকাল আমার বান্ধবী জুলেখার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ওর বাসায় গিয়েছিলাম৷ আম্মা নামাজ পড়ছিলো এইজন্য উনাকে জানায় যেতে পারি নাই৷ আর তুইও বাড়ি ছিলি না৷’
আপার কথা আমার পুরোপুরি বিশ্বাস হলো না৷ আমি কিছুটা রেগে বললাম,
‘ফোন দিয়েও তো বলতে পারতে৷ তোমার ফোন ও তো বন্ধ৷’
‘ফোনটা রাস্তায় কোথায় যেন পরে গেছে৷’
ঝুমা আপা কথাটা যেন অনেক কষ্টে বললো৷ এরপর আমার দিকে সরাসরি তাকাতেই দেখতে পেলাম আপার চোখে পানি৷ আপা কান্না গিলে বললো,
‘মিথি তোকে আমি বোনের মতো ভালোবাসি৷ আমাকে এমন বাজেভাবে সন্দেহ না করলে কি এমন ক্ষতি হতো?’
আমি প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে পারলাম না৷ তবে মিনু খালা বললেন,
‘তোমরা না চাইলে আমরা এই বাড়িতে থাকুম না৷ খালি তোমার আব্বা একটু সুস্থ হোক আমি আমার মাইয়া নিয়া চইলা যাবো৷’
তাদের কথা শুনে আমি বেশ অনুতপ্ত বোধ করলাম৷ তবে আমরা বাড়িতে চারজন ছাড়া কেউ নেই৷ গয়না গুলো হাওয়াতে উঁড়ে গেলো!
টানা দুদিনে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে চারদিক স্যাঁতস্যাঁত করছে৷ বাড়ির উঠানো শ্যাঁওলা জমে সবুজ হয়ে উঠেছে৷ চারপাশের সব কিছু থেকে কেমন একটা ভেজা ভেজা গন্ধে ছেয়ে আছে৷ তবে এই স্যাঁতসেঁতে পরিবেশের একটা ভালো সুসংবাদ হলো আব্বার জ্ঞান ফিরেছে৷ সে খবর শুনেই দাদি আর হোসেন চাচা এসেছে৷ দাদি আসতেই আমি দাদির ঘরে গেলাম৷ দাদি তখন পানের বাঁটা নিয়ে বসেছে৷ পানের পাতায় বিভিন্ন মশলা দিয়ে পান সাজাচ্ছে৷ আমাকে দেখেই পা দুটো টানটান করে বসে বললেন,
‘ঠিকমতো খাওন খাও না কেন বু?’
আমি প্রত্যুত্তরে কিছু বললাম না৷ দাদির পাশ ঘেঁষে বসে রইলাম৷ দাদি আমার মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে বললেন,
‘কিছু কইবা?’
‘চাচার বাড়িতে গেলা কেন হঠাৎ৷’
‘তোমার চাচি অসুখে পড়ছে৷ দেখবার গেছিলাম৷’
দাদির কথা শুনে আমি উনার পাশে রাখা বালিশে সটান শুয়ে পরলাম৷ দাদি নিজ মনে গুনগুন করে গান গীত করছে৷ আমি চোখ বুজতেই দাদি বিছানা থেকে নেমে গেলো৷ দাদি বাইরে যাবার জন্য পাঁ বাড়াতেই আমি ক্ষীণ স্বরে ডাক দিলাম,
‘দাদি৷’
‘কও বু৷’
আমি শুয়ে থেকেই কিছুটা গম্ভীর গলায় বললাম,
‘আম্মার গয়না গুলা ভালোয় ভালোয় আজ বের করে দিবা৷’
আমার কথা শুনে দাদি চমকে উঠলো৷ তার বয়সের ভারে কুঁচকে যাওয়া চামড়া কেমন যেন টান টান হয়ে উঠলো উত্তেজনা তে৷ আমার দিকে তাকিয়ে কিছু টা এলোমেলো গলায় বললো,
‘হোসেনের থেইকা শুনছি বউয়ের গয়না হারায় গেছে৷ এতো ঘটনা ঘটলো কে নিছে আল্লাহ তার বিচার করুক৷’
‘নিজের বিচার নিজে চাইতেছো দাদি?’
দাদি আমার কথা শুনে কেঁপে কেঁপে উঠলো যেন৷ আমি এবার শোয়া থেকে বসে পরলাম৷ দাদিকে অভয় দিয়ে বললাম,
‘আমি কাউকে বলবোনা তুমি গয়না সরায় রাখছো৷’
দাদি আমার কথা শুনে দরজা আটকে দিলো৷ এরপর ধীরে ধীরে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
‘তুমি বুঝলা কিভাবে গয়না আমার কাছে!’
আমি মলিন হাসলাম৷ দাদির দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘সন্দেহ ঝুমা আপাকে করলেও তোমার ঘরে এসে খুজে দেখলাম আমার আম্মার একটা শাড়ি তোমার তোষকের নিচে৷ যে শাড়িতে আম্মা গয়না গুলা একসাথে প্যাঁচিয়ে রাখতো৷’
আমার কথা শুনে দাদি চুপ হয়ে গেলো৷ উনি যে ভয় পাচ্ছে আমি উপলব্ধি করে বললাম,
‘গয়না কোই রাখছো?’
‘তোমার হোসেন চাচা নিয়ে গেছে৷’
দাদির কথা শুনে আমার কষ্টের মাত্রা দুইগুণ বেড়ে গেলো৷ আমি রুক্ষ কন্ঠে বললাম,
‘গয়না দিয়ে উনি কি করবেন! ওইগুলা আমার আম্মার গয়না৷’
দাদি আমার কথা শুনে চুপসে গেলো যেন৷ মিনমিন কন্ঠে বললো,
‘আমার পোলা বিপদে পইরাই নিছে৷ আবার ফেরত দিয়া দিবোনে৷’
‘আর আমার আব্বার যে টাকার অভাবে চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যেতো!’
‘হয় তো নাই৷ মিনুর কাছে মেলা টেকা আছে৷ ও সব খরচ দিবো৷’
দাদির কথা শুনে আমার শরীর ঘিনঘিন করে উঠলো৷ আমি রাগে ক্ষোভে বললাম,
‘তোমার পোলারে বলবা দুইদিনের ভেতর গয়না ফিরিয়ে দিতে৷ নয়তো আমি সবাইকে বলে দিবো৷’
আমার কথা শুনে দাদি অনুনয় করলো৷ আমি কিছু না বলেই ঝুমা আপার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম৷
ওইদিন অহেতুক আমি আপাকে সন্দেহ করেছিলাম৷ এই অনুশোচনা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে৷
আপার ঘরে ঢুকে আমি চারদিকে খুজেও ঝুমা আপাকে না দেখে ঘরের জানালার কাছে এলাম৷ জানালার বাইরে তাকাতেই দেখতে পেলাম মিনু খালা কার সাথে যেন একটা কথা বলছে৷ লোকটার চেহারা গাছের পাতার আড়ালে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না৷ মিনু খালা উনার হাত ধরে কি যে একটা বুঝাচ্ছেন৷ তাদের কথা সম্পূর্ণ স্পষ্ট আমার কানে না পৌছালেও একটা কথা শুনে আমি আৎকে উঠলাম৷ খালা লোকটাকে কিছু টাকা দিয়ে শুধু বললেন,
‘খু’ন করলে ভালোভাবে করতে হয়৷ তোমার মতো আনাড়ি আমি জীবনে দেখি নাই৷ আমার বিপদ বাড়ায় দিছো৷’
উনি কাকে খু’ন করার কথা বললেন!আমি অবাক হয়ে উনাদের কথায় মন দিতেই শুনলাম খালা আবারো লোকটাকে শাসিয়ে বলছে,
‘টাকা নিয়ে এই বাড়ির আশেপাশে আর আসবা না৷ আমি চাই না তোমার জন্য চৌদ্দ শিকের ভাত খাওয়া লাগুক৷’
লোকটা খালাকেও কিছুটা ধমক দিয়ে বললো,
‘আপনার উদ্ভট বুদ্ধির কারণেই চান্স মিস হইয়া গেছে৷’
খালা লোকটার কথা শুনে আরো রেগে গেলো যেন৷ লোকটাকে বিশ্রী ভাষায় গালী দিলো৷ এতে লোকটা হেসে বললো,
‘তুমি তো বউ নামের একটা জিনিস৷ নিজের জামাইকে মারার জন্য উঠে পড়ে লাগছো৷’
ওদের কথা শুনে বুঝতে পারলাম আব্বাকে খু’ন করার জন্য মিনু খালাই লোকটাকে টাকা দিয়েছিলো৷
চলবে….