#বিকেলের_যতো_রঙ
পর্ব সংখ্যা-০৬
#রুবাইদা_হৃদি
ঘরময় একটা শান্ত পরিবেশ বিরজ করছে৷ কেমন টান টান উত্তেজনা সবার মাঝে কাজ করছে৷ আমি চিন্তায় হাতের নখ খুঁটছি৷ ভাইয়া অশান্ত চোখে এদিক ওদিক চোখ বুলাচ্ছে৷ মনে হচ্ছে কোনো সুরাহা খুজছে৷ পুলিশের লোকটার নাম মনোহর৷ বোধহয় উনি সনাতন ধর্মালম্বী৷ লোকটা তার সাথে থাকা কনস্টেবল কে চেয়ার এগিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন৷ লোকটা চেয়ারে আঁটসাঁট হয়ে বসে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘আপনার নাম টা কি যেন?’
‘মিথিকা জামান৷’ আমি উনার চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম৷ উনি আবারো হাসলো৷ লোকটার হাসিতে আমার বিরক্ত লাগছে৷ উনি আরো আয়েশ করে বসে বললেন,
‘আপনি কি কি জানেন?’
‘মিথি ছোট মানুষ৷ আম্মার শোকে সবাইকেই সন্দেহ করে বেড়ায়৷’
ভাইয়া হড়বড় করে কথাটা বললো৷ লোকটা দমে না গিয়ে বললো,
‘মিথিকা সব বলেন৷’
‘আমি কিছুদিন পূর্বে মিনু খালাকে একটা লোকের সাথে দেখেছিলাম৷ আমাদের বাড়ির পেছন দিকে৷ উনি লোকটাকে টাকা দিচ্ছিলেন৷’
আমার কথা শুনে মিনু খালা কিছুটা চিৎকার করে উঠলো৷ তার চোখে মুখে ভয়ের রেশ বেড়ে চলেছে৷ লোকটা মিনু খালার দিকে শীতল চাহনিতে তাকালো৷ মিনু খালা মুহূর্তেই চুপ হয়ে গেলো যেন৷ এর মাঝে হোসেন চাচা তাড়া দেখিয়ে বললো,
‘আপনি যা করার দ্রুত করেন৷ আমার কাজ আছে৷’
‘আরে হোসেন সাহেব যে৷ আপনাকে তো এখানে সবথেকে বেশি দরকার৷’
‘কেন আমার পোলায় কি করছে!’ দাদি মনোহর লোকটার কথার পৃষ্ঠে বললো৷ লোকটা সেদিকে মাথা না ঘামিয়ে আবারো বললো,
‘আপনারা নিদিষ্ট একজনকে বাঁচানোর চেষ্টায় আছেন তাই না আশারাফ সাহেব?’
‘আমি কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি না৷ আমি নিজেও সব রহস্যের কূল কিনারা চাই৷’
ভাইয়া এবার গলায় জোর এনে বললো৷ এখন ভাইয়াকে দেখে আমার আর ভয় লাগছে না৷ আমি দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
‘তদন্ত করা তো আপনার কাজ স্যার৷আপনি আমাদের বিভ্রান্ত কেন করছেন!’
‘আহ! মিথি মুখে লাগাম দে৷ স্যারকে বলতে দে৷’
মামা আমাকে ধমকে বললেন কথাটা৷ আমি চুপ না হয়ে বললাম,
‘আপনার কি মনে হয় স্যার? ঘরের ভেতরেই ভুত আছে!’
লোকটা আমার কথা শুনে হা হা করে হেঁসে উঠলো৷ আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘বেশ বলেছো তো৷ তা মিনু বেগম আপনার বক্তব্য কি? আপনার বোনের মেয়ে তো আপনাকে সন্দেহ করছে৷’
খালা কোনো উত্তর দিলো না৷ বেশ কিছুটা সময় চুপ থেকে বললো,
‘ওর বাপে আমারে ঘরে তুলছে পর থাইকা পোলা মাইয়া দুইটা আমারে দেখবার পারে না৷’
লোকটা খালার কথা শুনে কিছু একটা মনোযোগ দিয়ে চিন্তা করলো৷ এরপর আব্বার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,
‘আপনি মিয়া শোক শেষ হবার আগেই আরেক বউ ঘরে তুলছেন৷ ব্যাপার টা কি!’
উনার প্রশ্ন শুনে আমরা উপস্থিত সকলেই হকচকিয়ে গেলাম৷ লোকটা কি কোনোভাবে জানতে পেরেছে আম্মার খু’নের ব্যাপার টা! উত্তেজনায় আমার শরীর কাঁপছে৷ আমি মনে প্রাণে চাইছি আব্বার ব্যাপার টা যেন মাটিচাপা পরে যায়৷ তবে আমার দোয়া বিফলে গিয়ে লোকটা বলে ফেললো,
‘আপনার প্রথম স্ত্রী সালমা বেগম কে আপনি নাকি কোন ওষুধ দিয়েছিলেন৷ এরপর পরেই উনি মারা যান৷’
‘এইগুলক ভুয়া কথা৷ আমার আম্মা স্বাভাবিক ভাবেই মা’রা গেছেন৷’
ভাইয়া কিছুটা রাগ নিয়েই বললো৷ লোকটা ভরাট গলায় বললো,
‘আপনাদের উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা হয়েছিলো আশরাফ সাহেব৷ লুকাবেন না কিছু৷’
মনোহর স্যারের কথা শুনে আব্বা কেঁদে ফেললেন৷ সে কি করুন স্বর৷ আব্বার কান্না দেখে আমাদের ভেতরে অদ্ভুত তোলপাড় হচ্ছে যেন৷ আব্বা কাঁদতে কাঁদতেই বললেন,
‘আমি মে’রে ফেলেছি সালমা কে৷’
‘কি জন্য মারলেন!’ লোকটা কিছুটা কঠোর স্বরে বললো৷ কিন্তু আব্বা কোনো উত্তর দিতে পারলো না৷ লোকটা আব্বাকে বাদ দিয়ে এবার হোসেন চাচাকে বললেন,
‘মরহুমা সালমা বেগমের গয়না কেনো আত্মসাৎ করলেন?’
‘আমার দরকার ছিলো৷ আর গয়না গুলা আমার নিজের টাকায় করা৷’
‘হোসেন মিথ্যা কথা বলবি না৷ ওইগুলা আমার টাকার৷ ‘ আব্বা হোসেন কাকাকে কথার মাঝে থামিয়ে কঠোর কন্ঠে বললো৷ লোকটা উনাদের দুজনেই ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিলেন৷ লোকটা আর ভণিতা না করে মিনু খালাকে সরাসরি প্রশ্ন করলো,
‘বোনকে কেনো মারলেন?’
মিনু খালা নিজেকে বাঁচানোর জন্য অনেক কিছু বললেও লোকটা তার ভরাট কন্ঠে খালাকেও ধমক দিলেন৷ এরপর উনি উনার কনস্টেবল কে বললেন,
‘বাড়িতে যে মেয়েটা কাজ করে ওকে ধরে নিয়ে আসো৷’
লোকটা রোবটের মতো হেঁটে চলে গেলো৷ আমি প্রতিবাদী কন্ঠে বললাম,
‘কুলসুম আমাদের ঘরের মানুষ৷ ও ভীতু প্রকৃতির৷ ও এই ব্যাপারে কিছু জানে না৷’
‘কুলসুম আসলেই বোঝা যাবে৷’
আমি ভাইয়ার দিকে তাকাতে ভাইয়া আমাকে চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বললো৷ কনস্টেবল লোকটা ইতিমধ্যে কুলসুমকে নিয়ে এলো৷ ওর পাশে একজন মহিলা পুলিশ দাঁড়ানো এবং হাতে দড়ি দিয়ে বাঁধা৷ আমি অবাক হয়ে কিছু বলার পূর্বেই লোকটা চেয়ার থেকে উঠে কুলসুমের দিকে এগিয়ে গেলো৷
কুলসুম ভয়ে জবুথবু হয়ে কাঁপছে৷ লোকটা ওকে একদম শীতল কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
‘সালমা বেগমকে কে হ’ত্যা করেছে?’
কুলসুম মুখ দিয়ে একটা শব্দ ও উচ্চারণ করলো না৷ তবে হাতের ইশারায় মিনু খালার দিকে আঙুল উঁচিয়ে দিলো৷ মিনু খালা কুলসুমকে মা’রার উদ্দেশ্য এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
‘হারাম’জাদী আমারে দেখাস কেন৷ মারছোস তো তুই আর হোসেন৷’
‘কিন্তু ওষুধ তো আপনে আইনা দিছেন খালা৷’
আমার মাথায় যেন আঁকাশ ভেঙে পরছে৷ দাদি আহাজারি করে উঠলো৷ হোসেন চাচা আমতা আমতা করে বললো,
‘মিথ্যা কথা আমি কিছু করি নাই৷’
লোকটা কনস্টেবলের হাত থেকে একটা মোটা লাঠি হাতে তুলে নিতেই সবাই চুপ হয়ে গেলো৷ কুলসুমের থুঁতনি তে লাঠি ঠেকিয়ে মুখটা উচু করলো উনি৷ এরপর ভদ্রভাবে বললো,
‘কুলসুম সব শুরশুর করে ঝেড়ে ফেলো তো৷’
‘খালাম্মার দুইদিন ধরে অনেক মাথা ব্যথা ছিলো৷ এইডা শুইনা এই মিনু খালা আমারে একদিন ডাইকা একটা ওষুধ দিয়া কইলো এই ওষুধ খালাম্মারে খাওয়াইলে আমারে কিছু টাকা দিবো৷ তহন খালার লগে ওই হোসেন চাচায় ও ছিলো৷ আমি কিছু জানতাম না সার৷ আমি ভাবছিলাম খালাম্মা খালি অজ্ঞান হইয়া যাইবো৷’
‘আল্লাহ! তুই কিভাবে পারলি কুলসুম৷ আমার আম্মা তো তোকে কলিজা কে’টে দিয়ে দিতো৷’
আমি কান্না করে বললাম৷ ভাইয়া নিস্তব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে৷ আমি আহাজারি করতেই লোকটা মিনু খালাকে ধমকে বললো,
‘আপনার কাহিনি আপনি বলে ফেলুন৷’
মিনু খালা কোনো ভণিতা না করে বললো,
‘আমি একা বিধবা মানুষ৷ আমার খোজ খবর আশরাফের আব্বা নিতো৷ উনার মনে কোনো পাপ ছিলো না৷ কিন্তু চাল চুলা ছাড়া আমিই একটা বটগাছের নীচে ছায়া চাইতাম৷ কিন্তু এই সব কিছু পাবার সব থেকে বড় বাধা সালমা আপা৷ আমি এই বাড়িতে আসলেই দেখতাম হোসেন ভাই আপারে পছন্দ করে না৷ কারণ আপা আশরাফের আব্বারে পরামর্শ দিতো৷ যার ফলে উনার কাছ থেকে একটা টাকা কড়িও হোসেন সরাইতে পারতো না৷ তাই হোসেন আমারে বুদ্ধু দেয় আপারে প্যারালাইজড করে রাখলে আমার রাস্তা ক্লিয়ার থাকবো৷ আমিও জানতাম ওষুধ খাওয়াইলে আপা প্যারালাইজড হইয়া ঘরে পইরা থাকবো৷ তখন হোসেন আমারে এই বাড়ির বউ করার জন্য আশরাফের আব্বারে চাপ দিবো৷ কিন্তু হোসেন বাটপারি করছে৷’
মিনু খালার কথা শুনে আমি হোসেন চাচার দিকে তাকালাম৷ চাচা আমার আম্মাকে কিঞ্চিৎ অপছন্দ করতো জানতাম৷ তবে মেরে ফেলার মতো একটা জঘন্য কাজটা করলো৷ ভাইয়া চাচার গায়ে হাত তোলার জন্য এগিয়ে যেতেই মনোহর স্যার আটকে দিলেন৷ এরপর হোসেন চাচাকে বললেন,
‘কি জন্য এতো ক্ষোভ?’
হোসেন চাচা জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
‘আমার আব্বা উনার বেশিরভাগ সম্পদ ভাইজানরে লেখে দিয়ে গেছেন৷ আমার বড় ভাই মাতবর মানুষ৷ উনি আমারে আমার হক বুঝায় দিতেন কিন্তু সব সময় বাঁধা দিতো সালমা ভাবী৷ আপনিই বলেন আপনার প্রাপ্য আপনি না পেলে কি করবেন?’
‘তাই বলে নিজের ভাইকেও মে’রে ফেলার চেষ্টা করলেন৷’
মনোহর স্যার চেঁচিয়ে কথাটা বললো৷ তবে হোসেন চাচা হড়বড় করে বললেন,
‘এই কাজ আমি জীবনেও করবো না৷ কারণ শত হোক উনি আমার বড় ভাই৷’
চাচার কথা শুনে আমার একদলা থুতু উনার মুখে ছুড়ে দিতে ইচ্ছা করলো৷ আশরাফ ভাই মনোহর স্যারের হাতের নীচ দিয়েই চাচার শার্টের কলার চেঁপে ধরে বললো,
‘আর তুই যাকে মেরেছিস উনি আমার আপন মা ছিলো৷’
ভাইয়ার হাত থেকে বহু কষ্টে চাচাকে ছাড়ালো উনারা৷ আমার এতো কষ্ট হচ্ছে যেটা বলে বুঝানো সম্ভব না৷
আমি আব্বাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
‘আব্বা আপনি ওষুধ টা আম্মাকে দিয়েছিলেন কেন?’
‘খালু জান জানতো না৷ আমিই দিয়ে কইছিলাম ওষুধ আশরাফ ভাই ঢাকা থেইকা পাঠাইছে৷’
আমি অনুতপ্ত হলাম কুলসুমের কথা শুনে৷ আমি মনোহর স্যারকে প্রশ্ন করলাম,
‘আব্বাকে কে খু’ন করার চেষ্টা করলো?’
‘আমিই চাইছি খু’ন করতে৷ আমি করছি খু’ন৷’
মিনু খালা হাত জোড় করে কথাটা জোর গলায় বললো৷ মনোহর স্যার কিছুটা অবাক হলেন৷ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন,
‘এই বললেন আপনার ছায়া দরকার৷ ছায়া দেওয়ার আগেই রোদ উঠাতে চাইলেন কেন!’
‘লোকটা বিয়ে করে ঘরে তোলার আগে কইছিলো,সব সম্পদ পোলা মাইয়ার নামে দিয়া দিবো৷ তাইলে আমি উনারে বিয়া করলাম কেন! আমার তো লাভ নাই এইখানে৷’
মিনু খালার কথা শুনে আমার উনার প্রতি তাকানোর রুচিটাও শেষ হয়ে এলো৷ মনোহর স্যার উনাকে চেপে প্রশ্ন করলেন,
‘কাদের সুপারিশ দিয়েছিলেন?’
‘মাটি কাটতে যে লোকগুলা গ্রামে আসে ওদের দিছিলাম৷ আমি কাউরে চিনি না৷’
‘তবে ওইদিন টাকা দিলেন কাকে খালা? আমি সব দেখেছি৷’
আমি চিৎকার করে বলতেই খালা মিন মিনে কন্ঠে বললো,
‘আমারে মাটি কাটার লোক গুলার সাথে পাশের বাড়ির রফিক ভাই দেখছিলো৷ উনি জানি কথাগুলা কাউরে না কয় এইজন্য টাকা দিছিলাম৷ উনি নির্দোষ৷’
মিনু খালার কথা শুনে আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম৷ এইজন্যই ওইদিন লোকটাকে আমার চেনা চেনা মনে হচ্ছিলো৷ কি বিষাক্ত এরা! আমি সব শুনে আম্মার শোকে হাটু গেড়ে বসে কাঁদছি৷ ওইদিকে মনোহর স্যার মিনু খালা,হোসেন চাচাকে নিয়ে যাচ্ছে৷ রফিক চাচাকেও জবাবদিহির জন্য খোজ লাগাবেন বলে গেলেন৷
হোসেন চাকেক নেওয়ার আগে দাদি ম’রা বাড়ির মতো কান্না জুড়লেন৷ সেই কান্নার সুর এতোটাই বিষাক্ত ছিলো আমার দাদির প্রতি ভালোবাসাটা জানালা দিয়ে মুক্ত হয়ে গেলো যেন৷
তবে এতো সব কিছুর মধ্যে ঝুমা আপা এখনো বাড়িতে পা রাখে নাই৷ সে কথাটা কারো মাথাতেই ধরা দিলো না৷
মিনু খালা যাবা আগে আব্বার কাছে আসার অনুমতি চাইলেন৷ মনোহর স্যার অনুমতি দিতেই উনি আব্বার কাছে আসতেই আব্বা মুখ ঘুরিয়ে নিলেও আব্বার হাত ধরে উনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
‘আমারে মাফ কইরা দিয়েন আশরাফের আব্বা৷ আমি মনে প্রানে দোয়া করি আপনে যেন সুস্থ হয়ে যান৷’
খালার কথা শুনে আমি বেশ অবাক হলাম! যে নিজে মা’রতে চাইলো সেই ক্ষমা চাচ্ছে৷ আজব দুনিয়া৷ মানুষের কতো রঙ৷ ক্ষণে ক্ষণে তাদের রঙ পাল্টায়৷
চলবে…