#বিকেলের_যতো_রঙ
পর্ব সংখ্যা-০৭
#রুবাইদা_হৃদি
মিনু খালাকে এরপর জোর করেই পুলিশ টানতে টানতে নিয়ে গেলো৷ খালা যাবার সময় বারবার চোখ মুছছিলেন৷ আমি সেদিকে তাকাতেই দেখলাম মনোহর স্যার আবারো ঘরে ঢুকলেন৷ ঘরে ঢুকে বললেন,
‘আমজাদ সাহেব,আপনি এবং আপনার মা দুজনেই সমান অপরাধী৷ দুজনেই অপরাধীদের অপকর্ম লুকানোর চেষ্টা করেছেন৷ এজন্য হয়তো আপনাদের দৌড়াদৌড়ি করতে হতে পারে৷’
‘স্যার আব্বা অসুস্থ৷ আর দাদির ব্যাপার টা আপনাদের উপর৷’
ভাইয়া শান্ত কন্ঠে বললো৷ দাদি ভাইয়ার কথা শুনে মনোহর স্যারের পা ধরতে গেলেন৷ স্যার ছিঁটকে সরে গিয়ে বললো,
‘এ-কি করছেন আপনি!’
‘বাপ আমারে ক্ষমা কইরা দাও৷ পোলায় যে এমন কাজ করবো আমি পরে জানবার পারছি৷ পেটের পোলা তো এই জন্যে মুখ খুলবার পারি নাই৷’
দাদি কথাগুলা আহাজারি করে বললো৷ মনোহর স্যার অসন্তুষ্ট গলায় বললেন,
‘খালাম্মা কাজটা ঠিক করেন নাই৷’
বলেই উনি মাথা দুদিকে ঝাঁকিয়ে আফসোস করতে করতে বের হয়ে গেলেন৷ উনার পিছু পিছু ভাইয়া ও গেলো৷ দাদি তখনো মাটিতে বসে কাঁদছে৷ আমি উঠে আব্বার কাছে গিয়ে বললাম,
‘আব্বা মিনু খালাকে বিয়েটা কেন করেছিলেন!’
আব্বা আমার করা প্রশ্নে বিচলিত বোধ করলো৷ দাদি এবার কান্না থামিয়ে কান উঁচিয়ে আমাদের কথা শোনায় মনোযোগ দিলো৷ আব্বা তপ্ত গলায় বললো,
‘সালমার মিলাদের জন্য মিনুর বাড়িতে বলতে গিয়েছিলাম৷ এই গ্রামে তো ওই তোমার আম্মার কাছের আত্মীয়৷ বাকি সবাই তো দূরে দূরে৷ তাই ভাবলাম মিনুকেই আগে জানাই৷ গিয়ে দেখি বাড়ির আশেপাশে কিছু বাজে ছেলে ঘোরাঘুরি করছে৷ আর কেমন কেমন কথা বলছে৷ আমি প্রতিবাদ করতেই সবাই উল্টাপাল্টা কথা বলা শুরু করে৷ যেহেতু আমি একা একজন ছিলাম আমি হোসেনকে ফোন করে লোক সমাজ নিয়ে যেতে বলি৷ হোসেন যেতেই মিনু আমার কাছে হাতজোড় করে বললো,ওদের যেন আশ্রয় দেই৷ তখুনি হোসেন বলে,ভাবী তো দুনিয়াতে নেই৷ ভাইজান আপনার বিয়ে করা ফরজ৷ আর আশরাফ আর মিথিও মায়ের শোক ভুলতে পারবে৷ আমি দশ কথা চিন্তা করেই বিয়েটা করে ফেলি৷’
আব্বার কথা শুনে আমি চটজলদি পাল্টা প্রশ্ন করলাম,
‘ঝুমা আপার কথাটা তো আব্বা আপনার মাথায় থাকার কথা৷’
‘হোসেন বলেছিলো মিনুকে বিয়ে করলে ঝুমার আরো ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে পারবো৷ আর আশরাফের চাকরি নেই৷ এরপর আবার তোমাদের দেখাশোনার জন্যও তো কাউকে লাগতো৷ এইসব ভেবেই সিদ্ধান্ত টা নিয়েছিলাম৷’
‘আপনি আপনার জীবনে সব থেকে বাজে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন আব্বা৷’
আব্বা আমার কথা শুনে অনুতপ্ত হলো৷ আমার কাছে ক্ষমা চাইলো৷ মেয়ে হয়ে পিতাকে কি করে ফিরিয়ে দেই!
.
চারদিকে সন্ধ্যে লেগে গেছে৷ সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে৷ চোখের পলক ফেললেই যেন উধাও হয়ে যাবে৷ আজান কানে আসতেই আমার মনে পরলো ঝুমা আপা এখনো বাসায় আসে নাই৷ আমি তখন ঘরে ঢুকে আব্বাকে একটা ওষুধ খাওয়াচ্ছিলাম৷ মনে হতেই চিন্তায় কপাল কুঁচকে এলো৷ আব্বা আমার মনের ভাব বোধহয় বুঝতে পারলেন৷ আমাকে ধীর কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,
‘আম্মাজান কি কিছু চিন্তা করছেন?’
‘আব্বা ঝুমা আপা সেই সকালে আমাদের সাথে বের হলো আর বাড়ি ফিরে আসে নি৷’
আমার কথা শুনে আব্বাও বোধহয় চিন্তায় পরে গেলেন৷ আমি আব্বাকে আতংকিত না হতে বলতেই আব্বা বললো,
‘আশরাফ রে দিয়ে খোজ করো৷ মেয়েটা অসহায়৷’
আব্বার শেষের কথাটুকু কেমন যেন লাগে আমার৷ আমি আব্বাকে ভালোভাবে শুইয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম৷ ঘর থেকে বের হতেই মাগরিবের আজান পরলো৷ চারদিকের মসজিদ থেকে আজানের সুর ভেসে আসতেই আমার বুকের মাঝে অজানা ভয় বাসা বাঁধলো৷
ঝুমা আপার সাত কূলে কেউ নেই আশ্রয় দেওয়ার৷ আমি দুরুদুরু বুকে ভাইয়াকে খুজলাম৷ আশেপাশে কোথাও খুজে না পেয়ে ভয় টা যেন জাঁকিয়ে বসলো৷ আমি উঠান পেরিয়ে বাড়ির বাইরে পা রাখতেই দেখলাম ভাইয়া কোথা থেকে যেন আসছে৷ কাছাকাছি আসতেই দেখলাম ঘামে ভাইয়ার শার্ট ভিজে জবুথবু৷ আমাকে দেখে তাড়াহুড়ো করে বললো,
‘ঝুমা কোথায়!’
‘ঝুমা আপা তো সেই সকালের পর আর বাড়ি ফিরে নাই৷ আমি তোমাকেই বলতে যাচ্ছিলাম৷’
‘আমি থানা থেকে ফিরে আসার পথে আমার বন্ধু রফিকুল বললো ঝুমাকে না-কি কয়েকটা ছেলে বিরক্ত করছিলো৷ পরে ও প্রতিবাদ করায় ওর সাথে হাতাহাতি হয়৷ এই নিয়ে নাকি সালিশ বসাবে চেয়ারম্যান বাড়িতে৷’
‘বলো কি! কিন্তু আপা তো বাড়িতেও ফিরে নাই৷ চিন্তার ব্যাপার৷’
আমি চিন্তিত সুরে কথাগুলো বলতেই ভাইয়া আমাকে বললো,
‘তুই বাড়িতেই থাক৷ আমি আশেপাশে খুজে দেখি কোথায় গেলো৷ চেয়ারম্যান কাকা ঝুমাকে সাক্ষী হিসেবে ডেকেছে৷’
আমি কথা না বাড়িয়ে সায় দিলাম৷ ভাইয়া যেভাবে ছুটে এসেছিলো৷ সেভাবেই ছুটে বেরিয়ে গেলো৷ কি একটা মুসিবত! বিপদ আসলে চারদিকে থেকেই আসে এই কথাটা এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি যেন৷
.
রাতের আঁধার বাড়ার সাথে সাথে আমি চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলাম৷ এতো বড় বাড়িতে আজ প্রায় জনশূন্য৷ আমি রোয়াকে বসে ভাইয়ার অপেক্ষা করছি৷ আমাকে বসে থাকতে দেখে দাদি এগিয়ে এলো৷ মিটমিটে আলোয় দেখতে পেলাম দাদির হাতে ভারী কিছু একটা৷ আমি উনাকে দেখেও কোনো কথা বলে দরজার দিকে তাকিয়ে আছি৷ দাদি আমাকে মিনমিনে স্বরে ডেকে বললো,
‘তোর চাচায় ভুল করছে৷ জানোস ই তো তোর চাচারে একটা সম্পদ তোর দাদায় দিয়া যাই নাই৷’
‘দাদি এইসব কথা এখন বলো না৷ তোমার ছেলের কেচ্ছা আমি শুনতে চাই না৷’ আমি কিছুটা রুক্ষ গলায় বললাম৷ দাদি আমার কথা শুনে চুপসে গেলো যেন৷ তবে মিনতির সুরে বললো,
‘ওর দুইডা ছোট ছোট পোলা মাইয়া৷ তোর চাচি কেমনে পালবো!’
‘আমরা ও তো ছোটোই দাদি৷ আমার আব্বা এখনো তোমাকে আম্মা বলে ডাকে৷ আমাদের ও তো ইচ্ছা হয় আম্মা বলে ডাকতে৷’
শেষের কথাটুকু বলতে গিয়ে আমার গলা ধরে এলো৷ এইযে আজ দেড়টা মাস ধরে আমার চুলে কেউ তেল দিয়ে দেয় না৷ আমাকে জোর করে খাবার খাইয়ে দেয় না৷ এই শোক গুলা কি ভোলা সহজ!
আমি আর কোনো কথা বললাম না৷ দাদি আঁচলের নীচ থেকে একটা পোটলা বের করে আমার হাতে দিলো৷ আমি ভ্রুকুটি করে তাকাতেই দাদি বললো,
‘সালমার গয়না৷’
‘চাচা গয়না দিয়ে কি করতো?’
‘মিনু না-কি গয়নার অর্ধেক ভাগ চাইছিলো তাই হোসেনে আগেই সরায় নিছিলো৷’
দাদির কথা শুনে আমার এর পৃষ্ঠে বলার মতো কোনো শব্দ খুজে পেলাম না৷ এরা এতোটাই স্বার্থপর!
আমি গয়না গুলো নিয়ে রেখে দিলাম৷ এরপর অনেক ক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও যখন ভাইয়া ফিরলো না তখন আমার অস্থিরতার মাত্রা বাড়তে লাগলো৷ ঝুমা আপার খারাপ কিছু হয়েছে কি-না! যত্রতত্র ভাবতে ভাবতেই আমি আব্বার ঘরেই ঘুমিয়ে পরেছিলাম৷
আমার ঘুম ভাঙলো ভোরের আলো ফুটতেই৷ আলো চোখে পরতেই আমি হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলাম৷ আব্বা তখনো ঘুমে৷ ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হবার জোগাড়৷ আমি আব্বাকে ধীরে ধীরে ডাকলাম,
‘আব্বা ভাইয়াও তো রাত্রে ফিরে নাই৷’
আব্বা ঘুম চোখ তাকালেন৷ কিছুটা সময় আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলো,
‘তুমি কে?’
প্রশ্নটা শুনে আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘আব্বা আমি!আমি মিথি৷ তোমার মেয়ে৷’
আব্বা কিছু বললো না৷ আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবারো চোখ বুজে ফেললো৷ আমি আব্বার নাকের কাছে আঙুল দিয়ে পরখ করলাম নিঃশ্বাস পরছে কিনা৷ যখন বুঝতে পারলাম আব্বা শ্বাস নিচ্ছে তখন আমার বুকের উপর থেকে যেন পাথর সরে গেলো৷
আমার এতোটা অসহায় লাগছিলো সেটা বলে বুঝানো যাবে না৷ আমি আব্বার বিছানেতেই মাথা রেখে কেঁদে উঠলাম৷
আশেপাশে কেউ নেই৷ মামাও কাল চলে গেছে৷ ভাইয়ার খোজ নেই৷ এতো সব কিছু আমার ছোট মস্তিষ্ক নিতে পারছে না৷ দুনিয়াতে সব কষ্ট যেন আল্লাহ আমাদের উপর হঠাৎ করে দিয়ে দিলেন৷
আব্বা ঘুম থেকে উঠলেন আটটার দিকে৷ তবে এখন উঠে আব্বা নিজেই আমাকে নাম ধরে ডাকলেন৷ আব্বার ডাক শুনে আমার মনে শীতলতা বয়ে গেলো যেন৷ আব্বা আমাকে কাছে ডেকে জিগ্যেস করলো,
‘আশরাফ আর ঝুমা ফিরছে?’
‘আব্বা ফিরে নাই৷ আমার চিন্তা লাগতেছে৷’
‘ভয় পাইয়ো না আম্মা৷ আমি তো আছি৷’
আব্বা আমাকে আশ্বাস দিয়ে বললো৷ আমি আর আব্বাকে সকালে ঘটনা খুলে বললাম না৷ একটু পর দাদি নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকলো৷ আমি তখন আব্বাকে মুখ হাত ধুইয়ে সবেমাত্র বসেছি৷ দাদি খাবার গুলা এক পাশে রেখে বললো,
‘চেয়ারম্যান বাড়িতে খোজ নিলে হইতো না?’
‘খোজ কে নিয়ে দিবে! আমি অসুস্থ হবার পর থেকে সবাই এড়িয়ে চলে৷’
আব্বা আফসোস করে বললো৷ আমি না চাইতেও দাদিকে বললাম,
‘আব্বার একটু খেয়াল রেখো৷ আমি আশেপাশে দেখি৷’
আব্বা সায় দিলেন না৷ তবে আমি জোর করেই বাড়ির বাইরে পাঁ রাখলাম৷ গোটা একটা দিন চলে গেছে ঝুমা আপা নাই৷ ওইদিকে ভাইয়ার খোজ ও নেই৷ বিষয় টা তাজ্জব!
আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে সামনের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলাম৷ বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে৷ বাড়িতে মাত্র দুটো ফোন৷ একটা ভাইয়ার আর একটা আব্বার৷ কিন্তু ওই ঘটনার দিন আব্বার ফোনটা কেউ হয়তো নিয়ে গেছে৷ আর ভাইয়ার ফোন ভাইয়ার কাছে৷ আমি দ্রুত পা চালিয়ে চেয়ারম্যানের বাড়ির উদ্দেশ্য যাচ্ছি৷
পাকা রাস্তায় উঠতেই দেখতে পেলাম কয়েকজন লোক জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ সেখানে আমার ক্লাসমেট রাজুকে দেখতে পেলাম৷ আমি জটলার কিছুটা দূর থেকেই রাজুকে ডাকলাম৷ রাজু আমাকে দেখেই এগিয়ে এলো৷ আমাকে কোনো প্রশ্ন করার সময় না দিয়ে রাজু বললো,
‘তোদের বাড়িতে তো হেব্বি কাহিনি চলে মিহি৷ এ যেন সিনেমা৷’
‘ফাজলামো করবি না রাজু৷’
আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম৷ রাজু জোরালো কন্ঠে আবার বললো,
‘কাল রাত থেকে যে তোদের বাড়ির ওই নতুন মেয়েটারে আটকায় রাখছে৷ এই নিয়ে তো গ্রামে তোলপাড়৷’
নতুন মেয়ে কথাটা শুনেই আমার ঝুমা আপার কথা মনে হলো৷ আমি ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলাম,
‘মানে! কে আটকায় রাখছে৷’
‘চেয়ারম্যান কাকায়৷ ওই মেয়ে নাকি কি আকাম করছে৷’
রাজু শেষের কথাটুকু এতোটা বিশ্রী ভাবে বললো আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো৷ আমি ওর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই ও হাসতে হাসতেই এগিয়ে গেলো৷
আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় কেউ কেউ আফসোস করলো৷ তবে আমি সেদিকে মন দিয়ে চেয়ারম্যান চাচার বাড়ির সামনে এসে পৌছালাম৷ চারচালার বাড়িটা বিশাল বড়৷ আমি জীবনে দুবার এসেছি৷ দুবার ই আব্বা নিয়ে এসেছেন৷ আব্বার সাথে উনার খুব ভালো খাতির৷ আমি স্টিলের দেওয়া বড় গেইটের ছোট পকেট গেইট ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো৷ গেইটের ভেতর ঢুকেই একপাশে পুকুর৷ পুকুরের পাশ দিয়েই সরু রাস্তা৷ কাউকে না দেখে আমার কিছুটা ভয় লাগলো৷ তবে কিছু না ভেবে আমি রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতেই দেখলাম উনাদের উঠানে লোকেরা জোট বেধে দাঁড়িয়ে আছে৷ আমি এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে গেলাম৷ ভীড়ের মাঝে ঢুকতেই গুঞ্জন শুনতে পেলাম৷ কেউ কেউ বলছে,
‘মায়ের চরিত্র ঠিক নাই৷ মাইয়ার ও নাই৷’
কথাগুলা শুনতেই কেমন গা গুলিয়ে এলো৷ আমি ঝুমা আপাকে চিনি৷ আপা কতোটা নিষ্পাপ৷ আমি উনাদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতেই ভাইয়াকে দেখে ধরে প্রাণ ফিরে এলো এমন একটা ব্যাপার ঘটলো আমার সাথে৷
ভাইয়া মাথা নীচু করে একটা চেয়ারে বসে বসে আছে৷ ভাইয়ার চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে৷ যেন কতোরাত ঘুমায় না৷ আমি ভাইয়াকে দেখেই কাছে এগিয়ে গেলাম৷ আমার উপস্থিতি হয়তো ভাইয়া বুঝতে পেরেই ঘুরে তাকালো৷ এরপর নির্লিপ্ত গলায় বললো,
‘তুই আসলি কেন? আব্বা তো বাড়িতে একা৷’
‘কি হয়েছে! তোমাদের খোজ নেই৷ আব্বা চিন্তায় আরো অসুস্থ হয়ে গেছে৷’
‘অনেক কাহিনি হয়েছে মিথি৷ ঝুমাকে ওরা আটকে রেখেছে৷ মেয়েটা আমাদের সাথে সাথে কত কিছু সহ্য করছে বলতো!’
ভাইয়া আফসোস করে বললো৷ ভাইয়ার আফসোস শুনে একটা লোক তিরস্কার করে বললো,
‘আশরাফ এমন আফসোস কইরো না৷ ওরা মা মাইয়া দুইটাই কাল সাপ৷ চরিত্রের কারো ঠিক নাই৷ একজন তোমার আম্মারে মাইরা জেলে ঢুকছে৷ আরেকজনের জন্য এক পোলা আধমরা৷’
আশরাফ ভাই মাথাটা আরো নিচু করে ফেললো৷ তবে আমি রেগে বললাম,
‘না জেনে উল্টাপাল্টা বলবেন না চাচা৷ খালার শাস্তি খালা পাবে৷ কিন্তু উনার সাথে ঝুমা আপার তুলনা করবেন না৷’
‘আরে চুপ থাকো৷’
আমি চুপ থাকলাম না৷ এরপর অনেক প্রতিবাদ করলেও ভাইয়া আমাকে নিচুস্বরে বললো,
‘ঝুমা নদীর পাড় থেকে বাড়ি ফেরার সময় কয়েকটা ছেলে নাকি ওকে চারদিক থেকে আটকিয়ে রেখে ছিলো৷ তখন রফিকুল দেখে একটা ছেলেকে নাকি অনেক মে’রেছে৷ ওই ছেলের বাড়ি থেকে সালিশ ডেকেছে৷ মিনু খালাকে পুলিশে নেওয়ার ফলে সবাই ঝুমাকেই দায়ী করছে৷’
আমি কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললাম যেন৷ মনে মনে ভাবলাম,দেখো খালা তোমার পাপের শাস্তি তোমার মেয়েকে পেতে হচ্ছে৷
‘আপা কোথায়?’
‘ভেতর বাড়িতে৷ চেয়ারম্যান কাকা ঢাকা গেছিলো৷ একটু আগেই আসছে৷ উনি এখানে আসলেই ঝুমাকে নিয়ে আসবে৷’
এরপর আমি আর ভাইয়া দুজনেই নিশ্চুপ হয়ে গেলাম৷ পরিস্থিতি আমাদের হাতের বাইরে৷ গ্রামে এইসব ব্যাপার নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়৷ আব্বা সুস্থ থাকলে হয়তো সুরাহা হতো৷ তবে ব্যাপার টা জটিল হয়েছে মিনু খালার জন্যই৷ সবাই আমাদের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে ঝুমা আপাকে কাঠগড়ায় উঠিয়েছে৷ দোষ না থাকলেও আপা দোষী৷ বিষয় টা গ্রামে মহামারির মতো ছড়িয়ে গেছে যেন৷
আমাদের অপেক্ষা করার মাঝেই চেয়ার ম্যান কাকা এলেন৷ উনি এসে ভাইয়ার পাশে রাখা চেয়ারে বসে বললেন,
‘কার কি অভিযোগ খুলে বলেন৷’
কাকার কথা শুনে ভাইয়া কিছু বলার পূর্বেই ইমরানের আব্বা মানে যে ছেলেটাকে রফিকুল ভাইয়া মে’রেছে উনি সামনে এসে বললো,
‘আমার পোলারে ওই মাইয়া নিজে ডাকছে৷ পরে রফিকুল দেইখাই আমার পোলারে কু’ত্তার লাগান পিডাইছে৷’
‘মিথ্যা কথা বলবেন না চাচা৷ ঝুমাকে ইমরান বিরক্ত করছিলো বলেই আমি মে’রেছি৷’
কথাটা বললো রফিকুল ভাই৷ চেয়ারম্যান কাকা বিরক্ত হয়ে বললো,
‘মেয়েটাকে ডাকো৷ ওর মুখেই শুনি৷’
কাকা বলার পর ঝুমা আপাকে নিয়ে আসা হলো৷ আপার চুল এলোমেলো৷ আপা যথেষ্ট সুন্দরী৷ তবে আজ যেন আপার সৌন্দর্যে ভাঁটা পরেছে৷ আপাকে দেখে আমার কান্না পেয়ে গেলো৷ কি অবস্থা হয়েছে! দেখে মনে হচ্ছে কেউ হয়তো গাঁয়ে হাত তুলেছে
চলবে….