#বিকেলের_যতো_রঙ
পর্ব সংখ্যা-০৮
#রুবাইদা_হৃদি
আমি ঝুমা আপাকে দেখেই আপার কাছে যেতে চাইলাম৷ তবে এতো মানুষের ভীড় ঠেলে যাওয়া সম্ভব হলো না৷ আমি ভাইয়ার দিকে মাথাটা কিছুটা ঝুঁকিয়ে ধীর কন্ঠে বললাম,
‘তুমি উনাদের বলো এইসব নাটক বাদ দিতে৷’
‘আমি চেয়ারম্যান কাকাকে বলেছিলাম৷ তবে উনি বলেছে যেহেতু এইটা সবার মুখে মুখে উঠে গেছে৷ তাই সঠিক বিচার সবার সামনেই করতে হবে৷’
ভাইয়ার কথা শুনে আমার রাগ হলো৷ কি অদ্ভুত! এলাকার মানুষ জন একটা ঘটনা পেলে এইটা নিতে এতোটা মাতামাতি করে৷ তবে রফিকুল ভাইয়া মানুষ টা অন্যরকম৷ সে সবার সামনে উচ্চ বাচ্য করে বললো,
‘মে’রেছি তো আমি৷ তাহলে দোষ ও আমার৷ ওই মেয়েটাকে অহেতুক টানাহেঁচড়া করা বন্ধ করেন৷’
‘তুমি তো এই মাইয়ার উষ্কানিতেই আমার পোলারে মারছো৷ আমার পোলা বারবার বলছে এই মাইয়াই আমার পোলারে ডাকছিলো৷ এর আগে নাকি প্রেমের প্রস্তাব ও দিছে৷’
ইমরানের বাবা কথাটা বলতেই রফিকুল ভাই রেগে উঠলেন৷ সে কড়া ভাবে বললো,
‘শুনেন চাচা আমি সব নিজ চোখে দেখেছি৷ ইমরান ঝুমাকে টেনে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলো৷ সাথে ওর আরো দুইটা বন্ধু ছিলো৷’
রফিকুল ভাইয়ের ধমকানিতে ইমরানের আব্বা কিছুটা চুপসে গেলো যেনো৷ চেয়ারম্যান কাকা ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘তোমাদের বাড়ির মেয়ের ব্যাপারে তোমাদের মন্তব্য কি আশরাফ?’
‘ওরা আর কি বলবো৷ আপনি তো কেচ্ছা জানেন৷ সালমা ভাবীরে এই মাইয়ার মা কিভাবে মারছে৷’
ভীড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে উঠলো৷ চেয়ারম্যান কাকা বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো,
‘এক কথা বারবার টানেন কেন! আশরাফ তুমি বলো৷’
‘ঝুমা অত্যন্ত ভদ্র একটা মেয়ে চেয়ারম্যান কাকা৷ সে কখনো এমন কাজ করবে না যাতে তার বিরুদ্ধে কোনো কথা উঠুক৷’
ভাইয়া কথাগুলা ঝুমা আপার দিকে তাকিয়ে বললো৷ তার কথাগুলার মমার্থ এতোটাই গাঢ়ো ছিলো ঝুমা আপা কেঁদে ফেললো৷ চেয়ারম্যান কাকা ঝুমা আপার দিকে এক পলক তাকিয়ে ইমরানের আব্বার উদ্দেশ্য বললো,
‘তুমি কি বিচার চাচ্ছো?’
‘রফিকুল আমার পোলার সব চিকিৎসার খরচ দিবো৷ আর এই মাইয়ারে গ্রাম থেকে বের করে দিতে হইবো৷’
‘ইমরানের বাপ সব বিবেচনায় তোমার পোলার দোষ ও কম না৷’
ইমরানের আব্বা কোনো প্রত্যুত্তর করতে পারলো না৷ চেয়ারম্যান কাকা এবার ঝুমা আপাকে প্রশ্ন করলো,
‘দুপুর বেলা গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছিলে কেন! তোমারো তো মতিগতি ঠিক নাই মাইয়া৷’
‘কাকা আমি নদীর পাড়ে কিছু ক্ষণ বসে ছিলাম৷ জানেন ই তো বাড়ির কি অবস্থা৷ বাড়ি ফেরার পথেই ইমরান উত্যক্ত করে৷ এর আগেও বহুবার করেছে৷’
ঝুমা আপা কিছুটা জোর গলায় বললো৷ ইমরানের আব্বা ঝুমা আপার দিকে ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে৷ চেয়ারম্যান কাকা অসন্তুষ্ট হলো আপার কথাতে৷ এরপর রফিকুল ভাইয়াকে জরিমানা ধরা হলো ইমরানের সব চিকিৎসা খরচের৷ আশরাফ ভাই তখন অর্ধের খরচ নিজে নিবে বলে জানায়৷ চেয়ারম্যান কাকা দ্বিমত করলেন না৷ তবে বিচারকার্য শেষ মুহূর্তে চেয়ারম্যান কাকা বললেন,
‘তবে ঝুমাকে গ্রামে রাখবার পারবা না৷ আমি গ্রামে আর অশান্তি চাই না৷ ওর মায়ের জন্য দশ গ্রামে রা পড়ে গেছে৷’
‘ঝুমাকে কোথায় পাঠাবো কাকা! আপনার তো সব জানা৷’
ভাইয়া কিছুটা জোর গলায় বললো৷তবে এতেও কোনো কাজ হলো না৷ উনি উনার কথায় অটল৷ ঝুমা আপাকে কড়া ভাবে বললেন,
‘তোমারে সাতদিনের সময় দিলাম৷ আর এই সাত দিনের ভেতর আশেপাশে টো টো করে ঘুরে বেড়াবা না৷’
কাকার কথা শুনে ঝুমা আপা অসহায় চোখে ভাইয়ার দিকে তাকালো৷ ভাইয়া নিজেই দোটানায় পরে গেলো৷ চেয়ারম্যান কাকাকে এরপর ও বোঝানোর চেষ্টা করলো৷ তবে কাকা সাফ সাফ জানালো,
‘উনি আর কোনো অশান্তি চায় না৷’
উপায়ন্তর না পেয়ে ভাইয়া নিরাশ হয়েই আমাদের দুজনকে সাথে নিয়ে চেয়ারম্যান বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলো৷ ঝুমা আপা অনবরত কাঁপছে৷ ভাইয়া আপাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘তোমরা আমাকে কেনো এতো পীড়া দিচ্ছো! আমি কতো দিক সামলাবো বলো?’
‘মা কে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে?’
আপা ভাইয়ার কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে প্রশ্নটা করলো৷ ভাইয়া মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলো৷ আমি আপাকে দুই হাতে ধরে হাঁটতে হাঁটরে বললাম,
‘চিন্তা করো না আপা৷ সব ঠিক হয়ে যাবে৷’
আপা আমার কথা শুনে মলিন হাসলো৷ ক্লান্ত চোখে মুখে সেই হাসি বিষাদের সুর গাইলো যেন৷ আমি কোনো কথা না বাড়িয়ে আপাকে ধরে নিয়েই বাড়ির পথে পা বাড়ালাম৷
.
বাইরে টুপটুপ করে বৃষ্টি পরছে৷ টিনের চালে ঝমঝম শব্দে মুখরিত৷ সকাল থেকে অঝোর ধারার বৃষ্টিতে বুঝার উপায় নেই বেলা যে বিকেল গড়িয়ে কখন সন্ধ্যা ছুঁয়েছে৷ ঝড় বৃষ্টির মাঝেই ভাইয়া বাড়ি ঢুকলো৷ ভাইয়াকে বাড়িতে ঢুকতে দেখেই ঝুমা আপা একটা গামছা নিয়ে ভাইয়ার দিকে এগিয়ে গেলো৷ ভাইয়া স্বভাব বশত বলে ফেললো,
‘আগে থেকেই সব শিখে রাখছো নাকি!’
কথাটা বলে ভাইয়া নিজেই চমকে উঠলো৷ সেই সাথে চমকালাম আমি আর ঝুমা আপা৷ আপা কথা ঘুরানোর জন্য বললো,
‘আদালতের শুনানি তে কি রায় হলো?’
‘তদন্ত হচ্ছে৷ লম্বা প্রসেস৷ তবে মিনু খালার চেহারা ভেঙে গেছে৷’
কথাটা শুনে ঝুমা আপার কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না৷ আমি ভাইয়াকে বললাম,
‘আজকেও চেয়ারম্যান কাকা এসেছিলো ভাইয়া৷’
‘কোনো কিছু ভেবে পাচ্ছি না৷’
ভাইয়া ভেজা চুল গুকো ঝাড়তে ঝাড়তে বললো৷ দাদি তখন রান্না ঘরে তরকারি কাটছিলো৷ আমাদের কথার মাঝে উনি বললো,
‘আশরাফ ভাই তোরে একটা ভালা বুদ্ধি দেই৷ মাইয়াডারে দেইখা শুইনা বিয়া দিয়া দে৷ নয়তো চেয়ারম্যান এক ঘরে করবো৷’
কথাটা শুনে ভাইয়া আর ঝুমা আপা দুজনের মুখের বর্ণ পাল্টে গেলো৷ ঝুমা আপা তড়িঘড়ি করে বললো,
‘আমাকে কোনো গার্মেন্টসে চাকরি খুজে দাও আশরাফ ভাই৷ আমি নিজের টা নিজে চালাতে পারবো৷’
‘এভাবে বললে হয় না ঝুমা৷ গ্রামের মানুষদের তো দেখলে দোষ না করেও তুমি দোষী৷ শহরে গিয়ে টিকতে পারবা না৷’
ভাইয়া যে নিজের কষ্ট লুকিয়ে কথাগুলা বললো৷ ঝুমা আপা প্রতিবাদ করে বললো,
‘পরিস্থিতি আপনি জানেন৷ আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব না৷’
‘ভর দুপুর বেলা ঘুইরা বেড়ানোর সময় মনে আছিলো না ছেড়ি৷ এখন আমার নাতির মাথা খাও৷
দাদি কুৎসিত ভাবেই কথাটা বললো৷ আমি দাদিকে কিছুটা রুক্ষ কন্ঠে বললাম,
‘দোষ সবাই করে কিন্তু তোমার মতো বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় কয়জন?’
আমার কথা শুনে দাদি চুপসে গেলো৷ নিজ মনে বিড়বিড় করতে করতেই জায়গা ছাড়লো৷ তবে ভাইয়া চিন্তিত কন্ঠে বললো,
‘হাতে আছে আর মাত্র তিনদিন৷ চেয়ারম্যান কাকা এক কথার মানুষ৷’
‘তাই বলে আমরা জলজ্যান্ত মানুষকে নদীতে ভাসিয়ে দিবো!’
আমি অসন্তোষ গলায় বললাম৷ ভাইয়া প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে খাবার চাইলো৷ খাবার খেতে খেতে কোর্টের কথা বললো৷ সেখানে নাকি আজকে রফিক চাচাকে সাক্ষী হিসেবে ডাকা হয়েছিলো৷ রফিক চাচার কথা অনুযায়ী আব্বাকে খু’নের সুপারিশ নাকি মিনু খালাই দিয়েছিলো৷ কথাটা বলার সময় ঝুমা আপা কিছুটা অন্যমনস্ক ভাবে বললো,
‘কাউকে কি ধরতে পেরেছে?’
‘না৷ উনারা নাকি এলাকার বাইরের লোক৷’
ভাইয়া উত্তর দিতেই ঝুমা আপা চুপ হয়ে গেলো৷ আমি ভাইয়াকে আরো নানা বিষয়ে প্রশ্ন করলাম৷ তবে ঝুমা আপা উঠে চলে গেলো৷ আপা বের হয়ে যেতেই ভাইয়া আমাকে বললো,
‘মিথি আব্বার সাথে একটা বিষয় আলোচনা করা লাগবে৷’
‘কি নিয়ে ভাইয়া? খারাপ কিছু! ‘
আমি কিছুটা বিচলিত কন্ঠে বললাম৷ ভাইয়া খেতে খেতে বললো,
‘আব্বার সিদ্ধান্ত জেনে নেই৷ এরপর তোকে জানাবো৷’
আমি আর পাল্টা প্রশ্ন করলাম না৷ ভাইয়াকে সব এগিয়ে দিয়ে আব্বার ঘরে এগিয়ে গেলাম৷
.
আব্বা আম্মার ঘরে আমরা আজ অনেক দিন পর কোনো বিষয়ে আলোচনার জন্য বসলাম৷ আম্মা থাকতে যে কোনো ছোট হোক বা বড় সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে আমরা চারজন মিলে আলোচনা করতাম৷ সেই সব কথা ভেবে আমার মন কিছুটা খারাপ হয়ে গেলো৷ তবে ভাইয়া একদম সটান হয়ে বসে আছে৷ আব্বার মাথার নীভে দুটো বালিশ দিয়ে উঁচু করে দিলাম৷ আব্বা উদগ্রীব নিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘কি হয়েছে!’
‘আব্বা আমি একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷’
আব্বা আর আমি চুপ করে ভাইয়ার দিকে মনোযোগী হলাম৷ ভাইয়া অনেকটা সময় চুপ থেকে বললো,
‘ঝুমাকে বিয়ে দিয়ে দাও আব্বা৷ তোমার জানামতে কেউ থাকলে তাদের খোজ খবর দাও আমি তাদের জানাবো৷’
ভাইয়ার কথা শুনে আমি অবাক হলাম৷ আব্বাও বোধহয় হলো৷ তবে উনি বুঝতে না দিয়ে বললো,
‘শরীয়ত সম্মত তোমার আর ঝুমার বিয়ে জায়েজ৷ তুমি চাইলে আমি আপত্তি করবো না৷’
‘না আব্বা৷ সমাজের একটা ব্যাপার আছে৷ আর আমার উপর অনেক দায়িত্ব৷ আমার ছোট একটা বোন আছে৷ ওকেও ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে হবে৷’
‘ভাইয়া আমাদের কথা চিন্তা করো না৷ তোমার মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ো না৷’
আমার কথা শুনে ভাইয়া হাত বাড়িয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো৷ এরপর বললো,
‘সমাজের বেড়া টা অনেক শক্ত মিথি,তুই বুঝবি না৷ শত হোক ঝুমা সমাজের চোখে আমার বোন৷ এরপর তোকে যখন বিয়ে দেওয়ার সময় হবে মানুষ কটু কথা বলবে৷’
ভাইয়ার কথা শুনে আব্বা নিজেও সায় দিলো৷ তবে অনুতপ্ত গলায় বললো,
‘আমি তোমাদের জীবন টাকে কঠিন করে ফেলেছি৷’
‘আব্বা আপনি তখন আপনার জায়গা থেকে ঠিক ছিলেন৷ এইসব বলার সময় এখন না৷’
‘এই অল্প সময় পাত্র পাবো কোথায়!’
আব্বা বিচলিত কন্ঠে বললো৷ তবে ভাইয়ার যেন উত্তর টা সাজানো ছিলো,
‘রফিকুল আজ নিজেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে আব্বা৷ ও ব্যাংকে চাকরি করছে৷ ভালো একটা স্যালারি পায়৷ বর্তমানে গাজীপুরে আছে৷’
কথা গুলা বলার সময় ভাইয়ার চোখে কেমন পানি এসে ভীড়লো৷ পুরো চোখ জুড়ে পানি জমা হবার পূর্বেই ভাইয়া মাথা নীচু করে বললো,
‘আব্বা দ্বিমত করবেন না৷ আমি চাচ্ছি পরশুদিন বিয়ের দিন দিতে৷’
এরপর কেউ আর একটা কথাও বললো না৷ ভাইয়া মাথা নিচু করেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো৷
চলবে…