বিকেলের যতো রঙ পর্ব-০৯

0
32

#বিকেলের_যতো_রঙ
পর্ব সংখ্যা-০৯
#রুবাইদা_হৃদি

বাড়িতে আজ উৎসবের আমেজ৷ এইসব দেখে আমার অস্বস্তিতে বুক ভার হয়ে আসছে৷ আব্বার ঘরে যেতেই দেখলাম হোসেন চাচার বউ মানে চাচি বসে আছে৷ আমাকে দেখেই উনি আহাজারি করে বললেন,

‘মিথি তোমার চাচারে মাফ করা যায় না? আমার পোলাপান দুইটার ভবিষ্যৎ অন্ধকার৷’

‘এইটা তো আদালত বলতে পারবে,চাচি৷’

‘তোমরা মামলা উঠায় নাও মা আমার৷ তোমার পায়ে ধরি৷’

উনি বলেই আমার পায়ে ধরতে এলেন৷ আমি সরে যাবার সময় পেলাম না৷ বিষয় টা এতোটাই দৃষ্টিকটু ছিলো আমি কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললাম যেন৷ আব্বা তখন বললেন,

‘আখি তুমি শান্ত হোও৷ মিথির পা ছাডো৷ মানুষ দেখলে বলবে কি!’

‘ভাইজান আমার আর আমার ছেলেমেয়ের কি হবে! আপনি তো জানেন আপনার ভাইয়ের কোনো নগদ অর্থকড়ি নেই৷ আমার তো বি’ষ খেয়ে ম’রা ছাড়া উপায় নেই৷’

‘কাউকে খু’ন করার অপরাধ তো মাফ করা যায় না চাচি৷’

‘তোমার ভাইবোন গুলার কথা একটু ভাবো৷ ওরা তো বাপ থাকতেও এতিম হইয়া যাইবো৷’

আমি চাচির কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বললাম না৷ একপ্রকার জোর করেই পা ছাড়িয়ে নিলাম৷ তবে এর মাঝে কোথা থেকে ভাইয়া এসেছে খেয়াল করিনি৷ ভাইয়া এসে চাচিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘আপনার আর ওদের দায়িত্ব আমার৷ মিথি যেমন আমার বোন ওরাও আমার ভাইবোন৷ কিন্তু চাচাকে আমি কখনো বের হতে দিবো না৷ যদি আমার জা’ন শেষ হয়ে যায় তবুও৷’

ভাইয়ার কথা শুনে চাচি থমকে গেলো৷ সে গুনগুনিয়ে কাঁদছে৷ ভাইয়া কিছুটা নম্র সুরে বললো,

‘রাফি আর রুহিকে নিয়ে আপনি এই বাড়িতে চলে আসেন৷ ওদের পড়ালেখা থেকে শুরু করে যাবতীয় সব দায়িত্ব আমার৷’

‘তুমি আর কত দায়িত্ব নিবা! আরেক মাইয়ারে বিয়া দেওয়ার দায়িত্ব নিছো৷ তোমার বোন আছে৷ আমার ছেলে মেয়ে অবহেলায় বড় হবে না এর গ্যারান্টি কি!’

‘চাচি দেখুন আমি আলহামদুলিল্লাহ ব্যাংকে জয়েন দিবো এক তারিখ থেকে৷ আমার স্যালারি এভারেজ পঞ্চাশ হাজার৷ এরপর আব্বার সহায় সম্পদ আছে৷ আপনাকে যেদিন তিনবেলা খাবারের একবেলা কম পরবে সেদিন আপনি এই প্রশ্ন টা আবার করবেন৷’

চাচি ভাইয়ার কথা শুনে নিমরাজি হয়ে বললো,

‘ঠিক আছে৷ কিন্তু ভাইজান আর মিথি!’

‘মিথি ছোট ওর সিদ্ধান্ত নেওয়ার বয়স হয় নি৷ আর আব্বা আপত্তি করবে না৷’

‘আখি তুমি নিশ্চিন্তে থাকো৷’

আব্বার থেকে অনুমতি পেতেই চাচি উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো৷ আমি ভাইয়াকে দেখে প্রচন্ড পরিমাণে অবাক হচ্ছি৷ আমার ভাইয়া যে নাকি ভাতটা পর্যন্ত আম্মা হাতে তুলে খাইয়ে দিতো৷ আজকে সে সবার ভাতের দায়িত্ব নিচ্ছে৷ আম্মা বেঁচে থাকলে ভাইয়াকে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেতো৷ আম্মা বরাবর চাইতো ভাইয়া যেন একটু দায়িত্বশীল হয়৷ তবে ভাইয়া তখন ভবঘুরে ছিলো৷
আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ভাইয়ার গালের দাঁড়ি বেড়েছে৷ চুল গুলোও বড় হয়ে গেছে৷ চেহারায় কেমন গাম্ভীর্য ভাব৷ গত কয় মাসে ভাইয়া যেন হুট করেই বড় হয়ে গেছে৷ এইতো কয়েক দিন পূর্বেও আমার সাথে ভাইয়ার ঝগড়া লেগে হাতাহাতি হতো৷ আমি ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম৷ মানুষের জীবন ক্ষণে ক্ষণে বিভিন্ন রুপ নেয়৷

.

সকাল থেকে বাড়িতে নানা ধরণের মানুষের আনাগোনা লেগেই আছে৷ আমি নিজের জন্য কোথাও একটু সময় পাচ্ছি না৷ এর মাঝেই রফিকুল ভাইয়ার পরিবার এসে পরেছে৷ আজকে উনারা ঝুমা আপাকে দেখে যাবে৷ কোনো আনুষ্ঠানিকতা না থাকলেও তার মায়ের আবদারে এই দেখাদেখির পর্বটা৷ রফিকুল ভাই বাড়িতে পা রেখেই বললো,

‘তুমি নাকি ইদানীং পড়াশোনা তেমন করছো না! কারণ কি মিথি?’

আমি উনার প্রশ্নে তাজ্জব বনে গেলাম৷ আশেপাশে অনেক চেনা অচেনা মানুষের ভীড়ে কি বলবো খুজে পেলাম না৷ তবে ভদ্রতার খাতিরে বললাম,

‘আপনারা ঘরে আসুন৷ ভাইয়া একটু বাদেই চলে আসবে৷’

রফিকুল ভাইয়ার মা আমাকে দেখে বললেন,

‘সালমা আপা থাকতে মিথির চেহারা জ্বল জ্বল করতো৷ আহারে মেয়েটা কেমন হয়ে গেছে৷’

আমি কাকির কথা শুনে কিছুটা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ তবে উনি রফিকুল ভাইয়াকে ফিঁসফিস করে বললেন,

‘খু’নির মেয়েটা বিয়ে না করলে হয় না রফিকুল! আমার আর এইসব ভালো লাগছে না৷’

‘তোমার ছেলেকে বুঝায় লাভ নাই৷ চেয়ারম্যানকে সে কথা দিয়ে আসছে৷ আমার মান সম্মান সব শেষ৷’

কাকির কথার পৃষ্ঠে কথাটা কাকা বললেন৷ রফিকুল ভাই যে বিরক্ত হলেন তা মুখভঙ্গি দেখেই বুঝা গেলো৷ উনার র’ক্তবর্ণ চেহারা দেখে কাকা-কাকি চুপ হয়ে গেলো৷ আমি উনাদের নিয়ে বসার ঘরে এলাম৷ এরপর ঝুমা আপার কাছে গেলাম৷
দেখলাম আপা দরজা আটকে রেখেছে৷ বাইরে আখি চাচি দাঁড়িয়ে আছে৷ আমাকে দেখে বললো,

‘ঝুমা তো দরজা খোলে না৷’

চাচির কথা শুনে আমার ভ্রু কুচকে এলো৷ আমি দরজায় কড়া নেড়ে ধীরে ধীরে ডাকলাম,

‘আপা দরজা খুলো৷ উনারা বসে আছে৷’

আপা উত্তর দিলো না৷ কি মুশকিল! কাল রাত থেকে আপা খেতে বসেও খাবার খায় নি৷ আবার এই দরজা আটকে বসে আছে৷ আমি বার দুয়েক ধাক্কাধাক্কি করতেই দাদি ছুটে এলো৷ এসেই হট্টগোল করে বললো,

‘জ্বালায় পোড়ায় দিলো৷ আরে ছেড়ি দরজা খোল৷ কেলেংকারীর আর শেষ নাই এই বাড়িতে৷’

আমি দাদিকে কিছুটা ধমকের সুরে বললাম,

‘সারা গ্রাম এক করো৷ অন্যায় দেখলে তখন মুখে কুলুপ থাকে কেন!’

‘তোর অনেক চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বাইর হইছে৷ এই হাতে তোরে মানুষ করছি৷ আল্লাহ জানি বিচার করে৷’

‘বিষ দাঁত ভাঙলেও সাঁপের ছোবল মারার স্বভাব যায় না৷’

আমি দাদিকে কিছুটা কটাক্ষ করে বললাম৷ দাদি বিড়বিড় করতে করতে জায়গা ছাড়লো৷ চাচি কিছুটা বিরক্তির সুরে বললো,

‘আল্লাহ যন্ত্রণা থেকে উদ্ধার করো৷’

‘আপনিও আপনার শাশুড়ীর সাথে যান চাচি৷ আমাদের ব্যাপার আমরা মিটায় নিবো৷’

‘দোষ তো তোমার ঝুমা আপার মা ও করছে৷ আর চোখ রাঙানি শুধু আমাদের দিকে৷’

‘ঝুমা আপার মা সাহস করছে ঘরের মানুষের উষ্কানিতে৷’

চাচি আমার কথা শুনে মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো৷ ভাইয়া যেন কিজন্য এদের বাড়িতে থাকার জন্য বললো৷ সব ধর্মশালা খুলে বসেছে যেন৷
আমি ঝুমা আপাকে নীচুস্বরে ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি তবুও আপা দরজা খুলছে না৷ কিছুটা ভয় কাজ করছে৷ আমি উপায়ন্তর না পেয়ে বসার ঘরে ছুটলাম৷ ঢুকতেই দেখি ভাইয়া উবাদের আপ্যায়ন করছে৷ আমাকে দেখে কিছুটা অন্যরকম গলায় বললো,

‘ঝুমা কোথায়!’

‘আপা আসতেছে ভাইয়া৷ তুমি একটু আসো আব্বা ডাকে৷’

‘কোনো সমস্যা হয়েছে?’

রফিকুল ভাই প্রশ্ন করতেই আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম,

‘না ভাইয়া৷ আব্বা তো এখানে আসতে পারতেছে না৷ ভাইয়াকে কিছু বলবে বোধহয়৷’

‘আচ্ছা… আচ্ছা৷ এই আশরাফ তুই যা৷’

ভাইয়া আমার দিকে ভ্রু উঁচু করে ইশারায় জিগ্যেস করলো, ‘কি হয়েছে৷’

আমি ভাইয়াকে তাড়া দিয়ে বললাম,’দ্রুত আসো তো৷’

ভাইয়া কথা বাড়ালো না৷ আমার সাথে বাইরে বেরিয়ে এলো৷ আসতেই জিগ্যেস করলো,’এমন করছিস কেন!’

‘ঝুমা আপা দরজা খুলছে না৷ কি মুসিবত৷’

‘এই মেয়েটা আমাকে শান্তি দিবে না৷’

ভাইয়া বলেই ছুটে আপার দরজার সামনে এগিয়ে গেলো৷ আমিও যেতেই দেখলাম ভাইয়া দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলছে,

‘ঝুমা দরজা খোলো৷ বেশি নাটক করবা না৷’

‘ভাইয়া আস্তে বলো৷ উনারা কি ভাববে!’

‘উনাদের আর কি ভাবার আছে৷ সব সময় সব বিষয়ে ছেলেমানুষী৷’

ভাইয়া দরজায় অনেক জোরে একটা ঘু’ষি মেরে বললো৷ তবে এবারে কাজ হলো৷ ঝুমা আপা দরজা খুলে দিলো৷ তার গাল, চোখ, মুখ লাল হয়ে ফুলে আছে৷ আপাকে দেখে ভাইয়া বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,

‘আমাকে আর কতো জ্বালাবে ঝুমা?’

আপা উত্তর দিলো না৷ দরজা ছেড়ে দাড়াতেই ভাইয়া ভেতরে ঢুকলো৷ আমাকে ডেকে বললো,

‘ঝুমাকে একটু গুছিয়ে দে৷’

‘আশরাফ ভাই৷’

আমি কিছু বলার পূর্বেই ঝুমা আপা ভাইয়াকে ডাকলো৷ ভাইয়া অন্যমনস্ক হয়ে ধীর কন্ঠে জবাব দিলো,

‘যা বলার দ্রুত বলো৷ আমার অনেক কাজ আছে৷’

আপা আমার দিকে একাবার তাকিয়ে দরজা টা ভালোভাবে আঁকড়ে ধরলো৷ জিহবা দিয়ে বারবার ঠোঁট ভেজাচ্ছে৷ ভাইয়া বিরক্তিতে ‘দ’ উচ্চারণ করে থেমে গেলো৷ আমি ওই জায়গা থেকে চলে আসতে চাচ্ছিলাম তখুনি ঝুমা আপা বললো,

‘তুমি কি চাও সত্যি সত্যি আমার বিয়েটা হয়ে যাক!’

‘মানুষ কি মিথ্যা মিথ্যা বিয়ে করে ঝুমা?’

ভাইয়ার কথা শুনে আপা আর রা কাটলো না৷ আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘মিথি আমাকে একটু সাজিয়ে দে তো৷ তুমি বাইরে যাও আশরাফ৷ আমি আসছি৷’

আপা কথাটা এমন ভাবে বললো শুনতে কেমন অদ্ভুত লাগলো৷ আপা কখনো ভাইয়াকে নাম ধরে ডাকে না৷ ভাইয়া কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরের দিকে ছুটলো৷ যেন তার কতো তাড়া৷ ভাইয়ার যাবার দিকে তাকিয়ে ঝুমা আপা বললো,

‘তোর ভাই আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে মিথি?’

‘জানি না আপা৷ তবে ইদানীং ভাইয়া সব পারে৷’

‘হ্যাঁ আমার সেই ভোলা সাধাসিধে আশরাফ ভাই কেমন বড় হয়ে গেছে৷ এইতো কয়েক দিন আগেও আমাকে এক বিকেলে বললো,ঝুমা চাকরি টা হয়ে গেলেই আমার জীবনে বসন্ত হবে৷’

আপা কথাটা বলেই মেঁকি হাসলো৷ হাঁসতে হাঁসতেই বললো,

‘তোদের আব্বা আমার জীবনটাকে রঙহীন বিবর্ণ বানিয়ে ফেলেছে মিথি৷ আমি এই জীবনে উনাকে ক্ষমা করবো না৷’

‘আপা মুখে লাগাম দাও৷ শত হোক উনি আমার আব্বা৷ এইখানে দোষ সবার ছিলো৷’

ঝুমা আপা আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

‘আয় আমাকে সাজিয়ে দে৷’

আমি কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হয়েই আপাকে সাজতে সাহায্য করলাম৷ তবে আপা কেমন অদ্ভুত ভাবে সব লাগাচ্ছে৷ আমার হাত থেকে পাউডার টা নিয়ে বললো,

‘ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা তোর হৃদয় কি করে বুঝবে! হৃদয় ভাঙার কষ্ট সেই বুঝে যার হৃদয়ে এই যাতনার বীজ বপন করা৷’

আমি আপার কথা শুনে কিছুটা মিঁইয়ে যাওয়া কন্ঠে বললাম,

‘আপা যা হচ্ছে মেনে নাও৷ আমাদের নিয়তিতে হয়তো এমনটাই ছিলো৷’

আপা আমার কথা শুনে আবারো মলিন হাসলো৷ আমি আপাকে পরিপাটি করে থ্রি পিচের ওড়না টা মাথায় টেনে দিলাম৷ আপা যেন জীবন্ত পুতুলের মতো হেঁটে যাচ্ছে৷
কি যে হবে! এইসব ভেবে আমার চিন্তায় গলা শুকিয়ে আসছে৷

আপাকে বসার ঘরে নিয়ে যেতেই ভাইয়া বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে৷ সেই তাকানোটা ছিলো বেদনার৷ তবে রফিকুল ভাই খুশিতে ঝুমঝুম করছে৷ আপাকে দেখার পর উনার আব্বা আম্মাও কিছুটা মলিন হলেন যেন৷ তবে কাকি আপাকে বললো,

‘বিয়ের পর তোমার মায়ের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবা না৷’

আপা প্রশ্ন শুনে ছল ছল চোখে আশরাফ ভাইয়ের দিকে তাকালো৷ তবে ভাইয়া দৃষ্টি সরিয়ে বললো,

‘কাকি মা যতোই খারাপ হোক সন্তানের কাছে মা পবিত্র সত্তা৷’

‘কিন্তু আশরাফ মহিলার তো মতলব ভালো না৷ মেয়েকে উস্কাবে না এইটা কিভাবে নিশ্চিন্ত থাকবো আমরা?’

কাকা প্রশ্ন টা করতেই ভাইয়া হাসিমুখে জবাব দিলো,

‘আমাদের ঝুমা খুবই ভালো একটা মেয়ে৷ ও যা করে নিজ বুদ্ধিতে করে৷’

ভাইয়ার কথা শুনে আপা কিছুটা চমকে উঠলো যেন৷ আমি বুঝতে পেরে বললাম,

‘কি হয়েছে আপা!’

আপা ‘কিছু না’ বলে চুপ হয়ে রইলো৷ রফিকুল ভাই বললো,

‘আশরাফ আমরা দশ বারোজন কাল জোহরের পর এসে বিয়ে পরাবো৷’

ভাইয়া সম্মতি দিলো৷ ঝুমা আপা কন্ঠে খাদে নামিয়ে বললো,

‘আপনারা কি কাল ই আমাকে নিয়ে যাবেন?’

আপার প্রশ্ন শুনে কাকি কিছুটা রাগ হলো বোধহয়৷ উনার অভিব্যক্তি তে বোঝা গেলো৷ তবে ভাইয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য বললো,

‘হ্যাঁ যাওয়া আসা তো চলবেই৷ ঝুমা তুমি চিন্তা করো না৷’
রফিকুল ভাই সম্মতি দিয়ে বললো,

‘তোমার যখন ইচ্ছে হবে এ বাড়িতে আসবে৷’

এরপর বাকিটা বিয়ের আলাপ সেরে উনারা বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হলেন৷ ভাইয়া উনাদের বাইরে পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলো৷ আর আমি আপাকে রেখেই আব্বার রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম৷

.

আমাদের আশেপাশে পাড়া প্রতেবেশী অনেককেই ভাইয়া দাওয়াত করেছে৷ ঝুমা আপার বিয়েটা হঠকারিতার মধ্যে হলেও ভাইয়া যথাসম্ভব আয়োজনের চেষ্টা করছে৷ টাকা পয়সার জোগাড় আব্বা নিজের ব্যাংক একাউন্ট থেকে করে দিয়েছে৷ তবে ভাইয়ার চেহারায় হঠাৎ করেই কেমন মলিনতা বজায় চলছে৷ অনেকে বারবার জিগ্যেস করছে,

‘আশরাফের মুখটা এমন লাগছে কেন!’

ভাইয়া খুব সুন্দর করে উত্তর দিচ্ছে,’এইতো চারদিক চিন্তা করে আয়না দেখার সময় হচ্ছে না৷’

আমি অবাক দৃষ্টিতে ভাইয়াকে দেখি৷ ভাইয়ার সব কাজ গোছাতে গোছাতে বেশ রাত হয়ে গেলো৷ আমি ভাইয়াকে টুকটাক সাহায্য করছি৷ রাত বাড়ার সাথে সাথেই ভাইয়া আমাকে বললো,

‘তুই গিয়ে শুয়ে পড়৷’

‘তুমি কি করবে?’

‘আমার হাতে বেশ কিছু কাজ আছে৷ কাল ভোর ভোর উঠতে হবে৷ তদারকি করার তো কেউ নেই৷’

‘ভাইয়া তোমার কষ্ট হচ্ছে না?’

‘কিছু কষ্ট চাপা দিতে হয়৷’

‘আমার প্রচন্ডরকম কষ্ট হচ্ছে৷ আমার মনে হচ্ছে তুমি ভেতরে ভেতরে ভালো নেই ভাইয়া৷’

‘আমাদের জীবন টা বিকেলের রঙের মতো৷ কখনো ধূসর আকাশ৷ কখনো রক্তিম সূর্য৷ কখনো কাঁচা হলদে রঙে ছেয়ে থাকে আবার কখনো কমলা রঙে ঢেকে থাকে৷ কিন্তু আমরা তো এই রঙিন আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবি আকাশের রঙ এমন কেনো হলো! মন মস্তিষ্কে কত উত্তত ঘুরেফিরে কিন্তু উত্তর না পেয়ে সন্ধ্যা এসে চারদিকে ছেয়ে যায়৷ ধর আমার জীবন টা বিকেলের পর সেই কালো সন্ধ্যা৷ এরপর রাত এরপর ঘুম এরপর দিন৷ এভাবেই কেটে যাবে৷’

ভাইয়ার কথা শুনে আমি কিছু বলতে পারলাম না৷ মন খারাপ নিয়েই ঝুমা আপার কাছে এসে শুয়ে পরলাম৷ আপা কাঁত হয়ে শুয়ে আছে৷ ঘুমায় নি আমি বেশ বুঝতে পারছি৷ তবে আমি তাকে না ঘেটে ঘুমের জন্য অপেক্ষা করছি৷ জীবনের হিসাব মেলাচ্ছি চোখ বুজে৷
বেশ কিছুটা সময় পর আমার চোখে ঘুমে বুজে আসতই বুঝতে পারলাম ঝুমা আপা ফুঁপিয়ে কাঁদছে৷ আমার ঘুম ছুটে যেতেই চোখ খুলে পাশে তাকাতে দেখলাম আপা নেই৷ উঠে বসার পূর্বে বুঝতে পারলাম ঘরে আরো কেউ আছে৷ আমি তখন চুপ করে শুয়ে পরলাম৷ ঝুমা আপা কেঁদে কেঁদে বলছে,

‘আশরাফ ভালোবাসা তো সবার সাথে হয় না৷ আর ভালোবাসা নেই সেখানে সংসার করবো কিভাবে!’

‘ঘুমাও ঝুমা৷ এইসব বলে লাভ নেই৷ সংসার করতে করতে ভালোবাসা এসে যাবে৷’

আপা কিছুটা শব্দ করে কেঁদে উঠলো৷ কাঁদতে কাঁদতেই বললো,

‘আমাকে কি ভালোবাসো না আশরাফ! সত্যি করে বলবে৷’

‘ভালোবাসি৷ আর ভালোবাসবো৷ তবে এই ঝুমাকে না৷ আমি সেই নিষ্পাপ ঝুমাকে ভালোবাসি যার মনে কোনো পাপ ছিলো না৷ তোমার মন কলুষিত ঝুমা৷ তোমাকে আমি ঘৃণা করি৷’

চলবে….