#বিকেলের_যতো_রঙ
পর্ব সংখ্যা-১১
#রুবাইদা_হৃদি
একটা বিক্ষিপ্ত রাতের প্রহর যেন কিছুতেই শেষ টানছে না৷ ভাইয়া টিনের উপর হেলান দিয়ে বসে আছে৷ আমি উপুড় হয়ে বসে আছি৷ পিঠ ব্যথায় টনটন করলেও মনের ব্যথার কাছে ক্রমশ হার মেনে গেলো৷ চারদিকে রাতের অদ্ভুত শব্দ শোনা যাচ্ছে৷ দূরে পাতা পড়ার শব্দটাও যেন ভয়ানয়৷ আমি নির্লিপ্ত গলায় বললাম,
‘কয়েকটা দিন যেন একযুগের সমান৷ আমাদের জীবন টা মসৃণ হলেও পারতো৷’
‘মসৃণ নয় বলেই বাস্তবতা বুঝতে পারছিস৷ কেউ কারো আপন না৷’
‘তাহলে কি তুমিও আমার আপনা না!’
আমার প্রশ্নে ভাইয়া চমকে উঠলো৷ আবছা অন্ধকারে খেয়াল করলাম ভাইয়া কাঁদছে৷ ছেলেদের চোখের অশ্রু পৃথীবির ভয়ংকর রকমের অসুন্দর একটা বস্তু হয়তোবা৷ আমি ভাইয়াকে প্রশ্ন করলাম না আর৷ তবে ভাইয়া কিছুটা সময় পর বললো,
‘যেদিন জানলাম আব্বা সবকিছুতে জড়িত আমার ইচ্ছে হচ্ছিলো নিজেকে শেষ করে দেই৷ কিন্তু তখন আমার তোর কথা মনে হলো৷ আমি ভাবলাম মিথির তো আমি ছাড়া কেউ রইলো না৷ আমি কিভাবে ওকে এই নিষ্ঠুর জায়গায় একা ফেলে চলে যাই!’
ভাইয়ার কথা শুনে আমার অদ্ভুত শান্তি লাগছে৷ এখন মনে হচ্ছে,আমারো বেঁচে থাকতে হবে৷
‘আব্বাকে কি করবে ভাইয়া! আমি কোনোদিন উনাকে ক্ষমা করবো না৷’
‘জানি না৷ আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না৷’
‘আমি উনাকে এখুনি জিগ্যেস করবো কেন আমাদের সাথে এমন করলেন! আম্মাকে ভালো নাই বাসতে পারেন মে’রে ফেললেন কেন!’
আমি কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললাম৷ ভাইয়া নির্লিপ্ত গলায় বললো,
‘ঝুমার বিয়েটা হয়ে যাক৷ এরপর সিদ্ধান্ত নিবো৷’
‘উনিও তো সমান অপরাধী ভাইয়া! উনাকে নিজের শাস্তি পেতে হবে৷’
‘যথেষ্ট পেয়েছে৷’
‘তাহলে আব্বাও তো নিজের শাস্তি পেয়েছে৷’
আমি প্রশ্ন করতেই ভাইয়া চিন্তিত সুরে বললো,
‘মিথি আমার বড্ড অসহায় লাগছে৷’
আমি বলার কিছু খুজে পেলাম না৷ আসলেই তো! আমরা নিষ্ঠুর কিভাবে হবো!
.
ভোরের আলো ফুটতেই অন্ধকার কেটে গেলো৷ অনেকটা রাত জাগার জন্য ঘুম চোখে এসে ভীড় করতেই ভাইয়া ডেকে তুলে বললো,
‘ঘরে গিয়ে ঘুমা৷’
‘একটা বিহিত না হলে ঘুম আসবে না৷’
‘ঝুমার বিয়েটা হয়ে যাক৷’
‘কেন ভাইয়া! সবাই সমান অপরাধের শাস্তি পাবে৷ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আব্বাকে পুলিশের হেফাজতে দেওয়ার ব্যবস্থা করবো৷’
ভাইয়া কোনো প্রত্যুত্তর করলো না৷ আমি অধৈর্য হয়ে বললাম,
‘তুমি কি করতে চাচ্ছো! ভালোমানুষি একদম দেখাবা না৷ আব্বার জন্য বিন্দুমাত্র মায়া কাজ করছে না আমার৷ ঝুমা আপার জন্য যদি ব্যাপার টা ধামাচাপা দিতে চাও তাহলে আমি নিজেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো৷’
ভাইয়া আমার কথা শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না৷ পকেট হাঁতড়ে মোবাইল বের করে কাউকে একটা কল করলো৷ ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই ভাইয়া ভাব বিনিময় না করে বললো,
‘ইমরান তুমি সব সত্যিটা স্বীকার করবে৷ অপরাধীরা কেন ঘুরে বেড়াবে! তুমি আমাকে সাহায্য না করলে আমি তোমার নামে ধর্ষণের চেষ্টা আর খু’নের মামলা করবো৷ আর তুমি জানো ঝুমা নিজেকে বাঁচাতে সাক্ষী দিবেই৷’
ওপাশ থেকে কি বললো শোনা গেলো না৷ তবে ভাইয়ার মুখে কিছুটা গুমোট ভাব বজায় থাকলো৷ কল রেখে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘ধৈর্য ধর মিথি৷ আমাদের প্রচুর শক্ত হতে হবে৷’
.
বাড়ি ভর্তি মানুষের সমাগম ক্রমেই বেড়ে চলছে যেন৷ ভ্যাপসা গরমে আমি বার বার ঘেমে উঠছি৷ আব্বা আমার সামনে কাকুতি মিনতি করছে৷ আমি ওই গরমের মাঝেই আব্বার ঘরে ঠাঁই বসে আছি৷ আমি উনার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি৷ আব্বা আমাকে বারবার বলছে,
‘আমি ভুল করেছি মিথি৷ তোমার আম্মার সাথে আমার মনের মিল কখনো ছিলো না৷ আমি অনেক মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছি৷ কিন্তু পারি নাই৷’
‘আমার এখন আপনাকে পছন্দ হচ্ছে না৷ আমিও আপনাকে খু’ন করি?’
আব্বা কথাটা শুনে কেমন আঁতকে উঠলো৷ আঁতকে উঠার কথাই৷কারণ সবাই ঝুমা আর ইমরানের গল্প শুনছে৷ এই পাশে কেউ নেই৷ বিয়ে বাড়ি যেন হঠাৎ করেই তামাশা বাড়িতে পরিণত হয়েছে৷ চেয়ারম্যান কাকা হম্বিতম্বি করে বলছে,’আশরাফ তুমি ভালো মানুষ বলেই মেয়েটাকে আমি কড়া শাস্তি দেই নাই৷ মেয়ে আর মা তো অনেক ডেঞ্জারাস৷’
সেইসব কথা আমি এই ঘরে থেকেই বেশ শুনতে পাচ্ছি৷ পুলিশের লোক ও এসেছে৷ উনাদের তো মাথা ঘুরে গেছে সবটা শুনে৷ মনোহর স্যার বলছে,
‘আমজাদ সাহেব লোকটাকে আমার শুরুতেই সন্দেহ ছিলো৷ কিন্তু ওমন মার খেয়ে কাঁত হয়ে পরে আছে বলে বাদ দিয়েছিলাম৷ কি খেল টাই খেলেছে৷’
গ্রামের লোকেরা হাসাহাসি করছে৷ আমি সেইগুলা শুনে মুখে কুলুপ এঁটে আব্বার দিকে তাকিয়ে আছি৷ আব্বা কেমন ছটফট করছে৷ আমি উঠে গিয়ে উনার সামনে দাঁড়ালাম৷ শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
‘আব্বা আপনার কি অনেক কষ্ট হচ্ছে!’
আব্বা আমার শান্ত কন্ঠে শুনে কিছুটা ভড়কে গেলো৷ আমতা আমতা করে বললো,
‘মিথি মা বিশ্বাস কর আমি ভুল পথে ছিলাম৷’
‘আব্বা সেসব কথা বাদ দেন৷ আসেন আমরা নিজেদের কথা বলি৷’
আব্বা কোনো উত্তর দিলো না৷ চুপ করে রইলো৷ আমি আব্বার হাত ধরে বললাম,
‘আব্বা আপনার মনে আছে? আমরা চারজন একসাথে কতো সুখে ছিলাম! আপনি আসতেন কাজ থেকে আম্মা আপনার জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করতো৷ মনে আছে আব্বা?’
আব্বা মাথা ঝাকালেন একদম বাচ্চাদের মতো৷ আমার এতো হাসি পেলো৷ আমি হাসতে হাসতেই বললাম,
‘আব্বা আম্মার সেই ভুনা খিচুড়ির কথা মনে আছে? বৃষ্টি নামলেই আপনি হট্টগোল করে বলতেন,সালমা খিচুড়ি করো আজ৷ আব্বা মনে আছে? আম্মা আপনাকে তেল মালিশ করে দিতো!’
‘সব মনে আছে৷ আমার সব মনে আছে৷’
‘তাহলে কিভাবে পারলেন আম্মাকে মে’রে ফেলতে৷ বলুন আব্বা!’
‘আমি সাময়িক মোহে পরেছিলাম৷ তোমার মিনু খালার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছিলাম আর সে দিয়েছিলো৷’
‘আব্বা আপনাকে আমি আজ থেকে মৃত বলে ঘোষণা করলাম৷ আপনি আমার কাছে ম’রে গেছেন আব্বা৷ আপনার মতো এমন কু’লাঙ্গার পিতা যেন কোনো সন্তানের না হয় আব্বা৷’
‘মিথি মা আমার৷ আমাকে ভুল বুঝো না৷ আমি তো তোমার জন্মদাতা৷’
‘জন্ম দিয়েছেন কিন্তু কর্ম করতে পারেন নাই৷’
আমি বলেই মুখ ঘুরিয়ে নিলাম৷ একরাশ কষ্ট এসে দলা পাকালো আমার গলার মাঝে৷ আমি সেগুলোকে গিলে আবারো বললাম,
‘আমি চাই আপনার জীবনের আয়ু যেন অনেকটা লম্বা হয়৷ আব্বা আপনি সুখ করার জন্য আমার আম্মাকে মে’রেছেন৷ আপনি এখন এমন সুখ করবেন যেখানে আপনার পাশে কেউ থাকবে না আব্বা৷ তবে চিন্তা করবেন না আপনি যেখানেই থাকেন আপনার সেবা যত্নের ব্যবস্থা ভাইয়া করে দিবে৷’
‘আমি তোমাদের সাথে নিয়ে সারাজীবন থাকতে চাই৷’
আমি কোনো প্রত্যুত্তর করলাম না৷ আব্বার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম৷ আব্বা পেছন থেকে বারদুয়েক ডাকলো৷ সেদিকে আমি একদম মন দিলাম না৷
উঠানে দাঁড়িয়ে থাকা মনোহর স্যারকে দেখে বললাম,
‘আপনারা উনাকে নিয়ে কোথায় রাখবেন?’
মনোহর স্যার কিছুক্ষণ ভাবলেন৷ এরপর বললেন,
‘আপাতত হসপিটালে৷ এরপর আরো কিছুটা সুস্থ হলে আদালত যা নির্দেশ দিবে৷ অবশ্য উনি তো এমনিতেই অর্ধেক ম’রা৷’
‘আব্বাকে স্পেশাল ভাবে ট্রিটমেন্ট করার ব্যবস্থা করে দিয়েন স্যার৷ আমি অনুরোধ করছি৷’
ভাইয়া অনুনয়ের সুরে বললো৷ মনোহর স্যার মাথা ঝাঁকালেন৷ বললেন,
‘উনি খু’নের আসামি এবং প্রমাণ লোপাট করেছে৷ যদিও উনার ভাগ্য ভালো৷ অসুস্থ বলে কিছুটা ছাড় পাবেন৷’
ভাইয়ার মুখটা কেমন মলিন হয়ে উঠলো৷ আমি নিজেকে যথাসম্ভব বুঝাচ্ছি৷ রফিকুল ভাইয়ারা ও এসেছে৷ রফিকুল ভাই মনোহর স্যারকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে যেন কি কি বললেন৷ সেসব দিকে নজর দেবার সময় আমাদের দু ভাইবোনের হলো না৷
আখি চাচি গলা ছেড়ে বলছে,
‘আমার জামাই তো খু’ন করে নাই৷ আমার জামাইরে ছাইড়া দেন৷’
তার সাথে তাল মিলিয়ে দাদিও সমাল তালে বলে যাচ্ছে৷ উনাদের চিৎকারে মনোহর স্যারের সাথে থাকা এক কনস্টেবল ধমক দিয়ে বললো,
‘বেশি কথা বললে আপনাদের দুজনকেও জেলে ভরে দিবো৷’
পুলিশের ধমকে চাচি আর দাদি থামলেও কোনো লাভ হলো না৷ ঝুমা আপা কোথা থেকে এসে যেন ভাইয়াকে জাপ্টে ধরলো৷
‘আশরাফ ভাই আমাকে ক্ষমা করো৷ তুমি তো জানো আমি কি জন্য অপরাধ করেছি৷’
ভাইয়া ঝুমা আপাকে ছাড়িয়ে বললো,
‘বিয়ে দিয়ে তোর অপরাধ ভুলে যেতে চেয়েছিলাম৷ তুই আমার ভালোবাসাকে অসম্মান করেছিস৷ নিজের ক্ষোভ মিটিয়েছিস৷ তোকে আর কিভাবে ক্ষমা করবো!’
ভাইয়া বলে থামলো৷ তবে ঝুমা আপা ভাইয়াকে ছাড়ছে না যেন৷ আমি জোর করে উনাকে টেনে সরালাম৷ এরপর একজন পুলিশ এসে উনার হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিলো৷
আব্বাকেও স্ট্রেচারে শুইয়ে নিয়ে আসা হলো৷ আব্বা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে৷ এক হতাশা ভরা দৃষ্টি৷ যে দৃষ্টি উপেক্ষা করার শক্তি বিধাতা বোধহয় কোনো সন্তানকে দেয় নি!
চলবে