#বিকেলের_যতো_রঙ
পর্ব সংখ্যা-১৩
#রুবাইদা_হৃদি
আজকে ছয় দিন পর গ্রামে এসে কিছুটা স্বস্তি মিললো৷ বাড়িতে ঢোকার আগেই আমি আর ভাইয়া আম্মার কবর দেখতে এলাম৷ কবরের উপর সবুজ ঘাসের দেখা দিয়েছে৷ একটা বুনোফুল একদম আম্মার মাথার সামনে গজিয়েছে৷ ভাইয়া জুতা খুলে কবরস্থানের ভেতর ঢুকলো৷ আর আমি প্রাচীরের বাইরে দাঁড়িয়ে দোয়া করলাম৷ ভাইয়া দোয়া শেষে আম্মার কবরে পরে থাকা শুকনো পাতা গুলা সরিয়ে দিতে দিতে বললো,
‘তুমি কতোটা অভাগী আম্মা৷ আজকে আমি অফিসের সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়ি এসেছি৷ তুমি থাকলে নিশ্চয়ই কতো আয়োজন করতে৷’
ভাইয়ার কথা গুলো শুনে আমারো কিছুটা মন বি’ষিয়ে গেলো৷ অবশ্য গত কয়েকদিন আমাদের দিন গুলা খুব একটা ভালো যায় নি৷ আব্বাকে গত পরশু দেখেছি৷ উনার অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে গেছে৷ আদালত উনার ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না যতোদিন না উনি কিছুটা সুস্থ স্বাভাবিক হয়৷ যদিও উনার প্রতি কিছুটা সসহানুভূতি জন্মেছিলো কিন্তু সেটা ফিঁকে হয়েছে৷ যখন জানলাম উনি নাকি মিনু খালার সাথে দেখা করার জন্য বেশ উতলা ছিলেন৷ কথাটা আমাদের উকিল সাহেব বলেছেন৷ এবং বেশ কটাক্ষ করেই বলেছে৷ সেই থেকেই আমার আর ভাইয়ার সহানুভূতি গুলা ধূসর হওয়া শুরু করেছে৷
বাড়িতে ফিরতেই দেখতে পেলাম দাদি বেজার মুখে বসে আছে৷ আমাদের দেখে বললো,
‘ভিটেমাটি না বেঁচলে হইতো না?’
‘তোমাদের হক তো বুঝিয়ে দিবো বলেছি৷’
ভাইয়া ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললো৷ দাদি কান্নার সুর তুলে বললো,
‘তোরা কোই যাবি?’
‘আমাদের নিয়ে চিন্তা করো না৷’
‘এইটা কইলেই হইবো! তোরাও থাক৷ সবাই মিলামিশা থাকি৷ আমি আর বাঁচুম ই আর কয়দিন৷’
দাদির কথা শুনে আমি শুষ্ক গলায় জবাব দিলাম,
‘এতো ভেবো না দাদি৷ তোমার সাথে চাচি আছে৷ আবার তোমার পোলা জেল থেকে জামিন পাবে শুনলাম৷ তোমার ই তো সুখের দিন এখন৷’
‘সত্য কইবার লাগছোস? হোসেনের জামিন হইবো৷’
দাদি উত্তেজিত কন্ঠে বললো৷ আমি আর ভাইয়া তপ্ত শ্বাস ছাড়লাম৷ সবাই নিজেদের স্বার্থ বুঝে৷ ভাইয়া আর কথা বা বাড়িয়ে ঘরে ঢুকে গেলো৷
.
বিকেল গড়াতেই কয়েক জন মানুষ বাড়িতে আসলো৷ আমি তখন আছরের নামাজ পড়ে বের হয়েছি৷ আমাকে দেখেই তাদের মধ্যে বয়স্ক এক লোক বললো,
‘আশরাফ কোই৷’
‘ভাইয়া একটু বাজারের দিকে গেছে৷’
লোকটা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘আমরা বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করি৷ যেহেতু একা মাইয়া মানুষ বাড়িতে৷’
‘দাদি আর চাচি আছে৷ কি দরকারে এসেছেন আপনারা?’
‘তোমার ভাইয়ের সাথেই আলোচনা করবো৷’
লোকগুলা বাইরে বেরিয়ে গেলো৷ আমার বুক ধুকপুক করছে৷ আবার কোনো বিপদ আসবে না তো! যত্রতত্র ভেবে আমি ঘরে গিয়েই ভাইয়াকে কল করলাম৷ ভাইয়া কল ধরতেই আমি বিস্তারিত খুলে বললাম৷ ভাইয়া দ্রুত আসবে বলে কল কেটে দিলো৷
চিন্তায় আমার ঘাম ছুটে যাচ্ছে৷ আর কোনো ঝড় হয়তো আমরা সামলে উঠতে পারবো না৷
‘লোক গুলা কি তোমার পরিচিত?’
চাচি ঘরের বাইরে থেকেই প্রশ্ন টা করলেন৷ আমি মাথা ঝাকিয়ে না বুঝালাম৷ চাচিও আমার মতো কিছুটা চিন্তিত হয়ে পরলেন৷ এরপর প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,
‘তোমার চাচাকে কবে ছাড়বে জানো কিছু!’
‘এই ধরণের প্রশ্ন করতে আপনাদের শরম করে না চাচি? উনি তো আমার আম্মাকে মে’রে ফেলার জন্যই জেলে গিয়েছে৷ আমরা কি বলেছিলাম আম্মাকে মে’রে ফেলো! এখন আপনারা বারবার এক প্রশ্ন করে আমাদের বিব্রত করছেন৷’
‘তোমার আম্মাকে তোমার আব্বা চালাকি করে মে’রেছে৷ কথাটা ভুলে যেও না! মাঝে থেকে আমার জামাই ফাসছে৷’
মহিলা কিছুটা উচ্চাবাচ্য করে বললো৷ আমি প্রত্যুত্তরে আর কিছু বললাম না৷
কিছুক্ষণ পরেই বাইরে ভাইয়ার আওয়াজ শুনতেই আমি ঘর ছেড়ে বের হলাম৷ লোক গুলাকে ভাইয়া চেয়ার এনে দিলো বসার জন্য৷ আমি, দাদি,চাচি উঠানের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছি৷ ভাইয়া আমাকে ইশারা করে ভেতরে যেতে বললো৷ তবে আমি যাবার পূর্বেই মুরব্বি গোছের লোকটা বলে উঠলো,
‘তোমরা নাকি জমি জমা সব বেঁচে ফেলতেছো!’
‘হ্যাঁ,আমি কাজের সূত্রে ঢাকা চলে যাবো৷’
‘কোন গুলা বেঁচবা?’
‘বাড়ি সহ বাজারের কিছু জায়গা৷’
‘তোমার বাপে তোমাগো কয় নাই! যে সব জমি সব আগেই উনি বায়না নিয়ে ফেলছে৷ তোমার আব্বাকে আমি প্রায় ত্রিশ লাখ টাকা দিয়েছি৷ কিন্তু তোমার বাপে কোনো জমির দলিলে সাইন করে নাই৷’
লোকটার কথা শুনে আমরা আঁতকে উঠলাম৷ ভাইয়া উত্তেজিত হয়ে বললো,
‘ফাজলামো করেন! আবদার নিয়ে আসলেই হবে৷’
‘রাগ করে লাভ নাই আশরাফ৷ আমাদের কাছে প্রামাণ আছে৷’
পাশে থেকে আরেক ভদ্র লোক বলে উঠলো৷ উনাদের কথাবার্তা শুনে দাদি ইতিমধ্যে কান্নাকাটি শুরু করে দিলো৷ ভাইয়া প্রমাণ চাইতেই উনারা একটা একশো টাকার স্ট্যাম্প বের করে দেখালেন৷ যেখানে জমি বিক্রি এবং টাকা নেওয়ার চুক্তির স্বাক্ষর করা৷
এখানে মিথ্যার কোনো অবকাশ নেই ভেবে ভাইয়া হতভম্ব হয়ে গেলো৷ পরিস্থিতি সামলানোর জন্য ভাইয়া বললো,
‘আমি আব্বার সাথে আলোচনা করে আপনাদের জানাবো৷’
‘আমরা আর সময় দিতে পারবো না৷ তোমার আব্বা জালিয়াতি করছে৷ বাড়ি থেকে আজকেই বের হয়ে যাবা তোমরা সবাই৷’
‘চাচা এভাবে তো বললে হয় না৷ আপনারা আগে কিছু জানান নাই৷ আমাকে তো আব্বার সাথে আলোচনা করতে হবে৷’
‘দেখো কি আলোচনা করবা৷ কিন্তু হয় আমাদের জমি রেজেস্ট্রি করে দিবা৷ নয়তো বাড়ি থেকে বের হতে হবে৷’
ভাইয়া সম্মতি দিলো৷ উনারা এক সপ্তাহের সময় দিয়ে চলে গেলেন৷ দাসি হাই হুতাশ করে আব্বাকে গালিগালাজ করছে৷ ভাইয়া আমার সামনে এসে নিরুপায় হয়ে বললো,
‘আব্বা এতো গুলা টাকা দিয়ে কি করতো মিথি! আমরা তো এখনো আব্বার চালাকি ধরতে পারি নাই৷ উনি কিভাবে পারলেন আমাদের সাথে অবিচার করতে৷’
‘অবিবেচক তো অবিবেচক ই হয় ভাই৷’
আমি বলেই তপ্ত শ্বাস ফেললাম৷
.
ঝড় বাদল ঠেলে আমরা দু ভাইবোন আজকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে এসেছি৷ মূল ফটক দিয়ে ঢুকতেই মনোহর স্যার আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন৷ উনি তাড়া দিয়ে বললেন,
‘এতো দেরি করলে হয়! তোমাদের জন্য আমি আরো এক ঘন্টা আগে এসেছি৷’
‘স্যার জ্যামে পরেছিলাম৷’
স্যার বিরক্ত হলেন৷ এরপর যেতে যেতে বললেন,
‘হঠাৎ আমজাদ সাহেবের সাথে দেখা করার দরকার পরলো যে!’
‘উনি নাকি সব জায়গা বিক্রি করে টাকা নিয়েছেন৷ কিন্তু রেজস্ট্রি করে দেন নি৷ কি মুশকিলে পরেছি৷ বলে বুঝাতে পারবো না৷’
‘আমজাদ সাহেব খুবই ধূর্ত মানুষ৷’
মনোহর স্যার মাথা ঝাঁকিয়ে বললো৷ মনোহর স্যারের পিছু পিছু আমরাও জেলের ভেতরে ঢুকলাম ৷ কি নোংরা পরিবেশ আশেপাশের৷ আমি কিছুটা ভয়ে ভাইয়ার হাত খিঁচে ধরলাম৷ ভাইয়া আমাকে অভয় দিয়ে বললো,’ভয় পাস না৷’
আমরা হেটে কিছুটা ভেতরের দিকে আসতেই দেখলাম আব্বা একটা হুইলচেয়ারে বসে আছেন৷ আমাদের দেখে উনি মাথা তুলে তাকালেন৷ মৃদু স্বরে বললেন,
‘ভালো আছো৷’
আমি উত্তর দিলাম না৷ আব্বার জরাজীর্ণ চেহারা দেখে মনেদ ভেতর হুহু করে উঠলো৷ মনোহর স্যার আমাদের একা কথা বলতে দিয়ে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালেন৷ ভাইয়া আব্বার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘আব্বা একটা কথা জানার জন্য এসেছি৷’
‘জায়গা জমি নিয়ে?’
আব্বা বলতেই আমরা দুজনেই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরলাম৷ আমাদের চুপ থাকতে দেখে আব্বা নিজ থেকেই বললো,
‘আক্কাস এসেছিলো তোদের কাছে৷’
‘হ্যাঁ সাথে আরো কিছু লোক এসেছে৷ আপনি কেন জায়গা জমি বিক্রি করলেন!’
ভাইয়া প্রশ্ন করতেই আব্বা মাথা নীচু করে ফেললেন৷ এরপর বললেন,
‘টাকা দরকার ছিলো৷ আর মিনু ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনতে চেয়েছিলো৷’
‘তাই বলে আমাদের ভিটেমাটি হারা করবেন আব্বা! আপনি এতোটা স্বার্থপর কিভাবে হলেন?’
আব্বা আর প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না৷ ভাইয়া পাশে থাকা একটা চেয়ারে ঘুষি মেরে বললো,
‘আপনার জন্য আমার কাল পর্যন্ত কষ্ট হচ্ছিলো আব্বা৷ কিন্তু আজ বুঝলাম আপনি আমাদের জন্ম দিয়েছেন ঠিকি৷ কিন্তু নিজের স্বার্থের জন্য সব ত্যাগ করতেও পিছপা হন নাই৷ আমি ভেবেছিলাম ওরা হয়তো মিথ্যা বলছে৷’
‘টাকা গুলা কোথায় আব্বা?’
ভাইয়ার কথার মাঝেই আমি প্রশ্ন টা করলাম৷ আব্বা নিরুত্তাপ ভাবে জবাব দিলেন,
‘টাকা পাবার সাথে সাথেই মিনু ঢাকায় একটা জমি নিজের নামে কিনেছে৷’
আব্বার কথা শুনে আমাদের আর কিছু বলার রইলো না৷ ভাইয়া রুষ্টভাবে বললো,
‘আক্কাস চাচা আর বাকি দুইজনকে উনাদের জমি বুঝিয়ে দিয়েন৷ উনারা হয়তো কাল বা পরশু আসতে পারে৷’
‘তোদের কি হবে!’
‘আমাদের যা হবার সেই ব্যবস্থা আপনি আগেই করে ফেলেছেন আব্বা৷ দোয়া করি অনেকটা বছর বেঁচে থাকুন৷ ভালো থাকবেন৷’
ভাইয়া বলেই উঠে চলে আসলো৷ আমাকে কড়াভাবে বললো চলে আসতে৷ তবে আব্বা আমার দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে বললো,
‘মিথি মা আমাকে মাফ করে দিস৷’
আমি উত্তর দিতে পারলাম না৷ একরাশ দীর্ঘশ্বাস বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো৷ এই আমাদের আব্বা! যে পর নারীতে আসক্ত হয়ে সব শেষ করে ফেলেছে৷
.
সময়ের স্রোত হয়তো বহমান৷ কিন্তু মনের স্রোত! এইটা হয়তো থেমে থাকে৷ খারাপ সময় গুলো মনের ভেতরে একদম গেঁথে থাকে যেন৷ তবুও মানুষের চলতে হয়৷ বাঁচতে শিখতে হয়৷ আমাকে উদাস বসে থাকতে দেখে ভাইয়া ঘরে ঢুকেই বললো,
‘আমি যে ফিরেছি সে খেয়াল কি তোর আছে৷’
আমি চমকে উঠলাম৷ পুরান ঢাকার কাঠপট্টির এই দোতলার বাসার ভেতরে আমাদের দুই ভাইবোনের ছোট সংসার৷ যেখানে গত সাত মাস যাবৎ আমরা দুজনে বেশ ভালো আছি বলবো না৷ তবে খুব একটা খারাপ নেই৷
ভাইয়া আর আমি নিজেদের কাপড় আর আম্মার জিনিসপত্র নিয়ে সেই যে গ্রাম ছেড়েছি৷ আর ফিরে যাই নি আমরা৷ কেসের ব্যাপার টা চলছে ৷ তবে আমরা আর আব্বার সাথে দেখা করি নি৷ তবে মাঝ খানে ঝুমা আপা নাকি জামিন পেয়েছে৷ ঝুমা আপা বিয়েটা নাকি ইমরানকেই করেছে৷ অবশ্য সে খবর শুনে ভাইয়া অনেকটা মর্মাহত হয়েছে৷ যেটা ভাইয়ার হাবভাবে স্পষ্ট৷ ভাইয়া আমাকে উদাস দেখে আবারো উক্ত প্রশ্ন টা করলো৷ এরপর বললো,
‘তোর ভার্সিটির খবর কি!’
‘সামনে হয়তো মিড হবে৷ বাদ দাও৷ ফ্রেশ হয়ে নাও৷ আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি৷’
‘তুই অন্যমনস্ক কেন!’
‘না এমনি৷ একা একা বাসায় ভালো লাগে না৷ দম বন্ধ লাগে৷’
আমার কথা শুনে ভাইয়া কিছুটা মর্মাহত হলো৷ এরপর ধীর কন্ঠে বললো,
‘কি করবো বল! কেউ তো নেই৷’
‘ভাইয়া তুমি বিয়ে করে ফেলো৷’
‘বিয়েটা আর করবো না৷ সব বিয়ের সাধ মিটে গেছে৷ এরপর তোকে বিয়ে দিয়ে আমি নিশ্চিন্তে দিন কাটাবো৷’
ভাইয়ার কথা শুনে আমার বেশ খারাপ লাগছে৷ আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হচ্ছে,’ঝুমার জন্য কেন তোমার জীবন বিসর্জন দিবে? ‘
সেই কথা আমি আর মুখ ফুটে বলতে পারলাম না৷
চলবে