#বিকেলের_যতো_রঙ
পর্ব সংখ্যা-১৪
#রুবাইদা_হৃদি
প্রত্যুষের নম্র আলোক ছটা জানালা ভেদ করে দোতলার ঘর গুলোতে আল আঁধার খেলায় মত্ত্ব হলো৷ আমি আড়মোড়া ভেঙে উঠে বাইরে বের হতেই দেখলাম ভাইয়া জুতা পরছে৷ আমাকে দেখে তাড়াহুড়ো করে বললো,
‘আজকে কেস টা হাইকোর্টে উঠবে৷’
‘তুমি অফিস যাবা না!’
‘ছুটি নিলাম৷ দেখি কি হয়৷ তুই সাবধানে থাকিস৷’
‘উনাদের সর্বোচ্চ শাস্তি কি হতে পারে? উকিল কিছু জানিয়েছে?’
‘না৷ তবে উনাদের পক্ষের উকিল খুবই ধূর্ত৷ মিনু খালার কোন চাচা যেন৷ মোটা অঙ্কের টাকা নাকি সম্মানি দিচ্ছে৷’
‘হ্যাঁ অন্যের টাকা তো তা তো দিবেই৷ চালাকি তো আর কম করে নাই৷ সব টাকা পয়সা নিয়ে এরপর ছেড়েছে আমাদেরকে৷’
‘বাদ দে৷ কারো দিন বসে থাকে না৷’
আমি তপ্ত শ্বাস ফেললাম৷ এরপর বললাম,
‘আম্মার সম্পদের মালিকানা আব্বা কবে নিজের নামে হস্তান্তর করেছে?’
‘আম্মা নাকি নিজ থেকেই উইল করে দিয়েছিলেন৷’
‘এই ব্যাপার টা কবে ঘটলো৷ আমরা কিছু জানতেই পারলাম না৷’
‘আম্মা তো সহজ সরল ছিলেন৷ হয়তো না বুঝেই দিয়ে দিয়েছিলেন৷’
ভাইয়া কথাটা নিরুত্তাপ ভাবে বললো৷ আমি আর পাল্টা প্রশ্ন করার সুযোগ পেলাম না৷ তার পূর্বেই ভাইয়া তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে গেলো৷ আমি ভাইয়ার যাবার দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে আছি৷ ভাইয়ার ভাজ ভেঙে যাওয়া শার্ট৷ ধুলো মাখা জুতো৷ এইগুলা আম্মা জীবিত থাকতে এমন ছিলো না৷ ভাইয়া চলে যেতেই আমি গুটিগুটি পায়ে রান্নাঘরে এগিয়ে গেলাম৷ গ্যাসের চুলা দেখেই আমার কান্না পেয়ে গেলো৷ আম্মা কখনো রান্না করতে দিতো না৷ এইযে আমি গত ছয় মাস ধরে হাবিজাবি রান্না করার চেষ্টা করেছি৷ ভাইয়া মুখ বুজে সবটা মেনে নিয়েছে৷
নাস্তা না বানিয়েই আমি রেডি হলাম৷ ঘরে তালা ঝুলিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্য রওনা হলাম৷ এই অচেনা শহরে আমার ইদানীং বড্ড একা একা লাগে৷ ইচ্ছে হয় কোনো অজানা গলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভীনদেশে চলে যাই৷ যেখানে গিয়ে দেখবো আমার আম্মা,আমি,ভাইয়া আর আব্বা খুব সুন্দর ভাবে মিলেমিশে আছি৷ কিন্তু সেই স্বপ্নটা ধূলিসাৎ হয়ে আছে যেন৷
.
ভার্সিটি থেকে ফিরে আসতেই দেখলাম ভাইয়া চলে এসেছে৷ আমাকে দেখেই শুষ্ক গলায় বললো,
‘রান্না করেছিস?’
‘না৷ আমি তো এতো রান্না করতে পারবো না৷’
‘ফাজলামো করিস না মিথি৷ এমনিতেই অনেক প্যারায় আছি৷’
‘তোমরা সবাই প্যারায় থাকো৷ একটা বার আমার কথা চিন্তা করে দেখেছো! আমি একা একটা বাসাতে থাকি৷ মাঝেমধ্যে অদ্ভুত চিন্তা আসে৷’
আমার কথায় ভাইয়া মর্মাহত হলো৷ শান্ত কন্ঠে বললো,
‘বিয়ের প্রতি মন উঠে গেছে৷ কে না কে আসবে! এরপর তোকে যদি সহ্য করতে না পারে৷ তার উপর আমাদের কিছু নেই৷’
‘তুমি হাইকোর্টে আপিল করো৷ যেন মিনু খালার সম্পত্তি আমাদের বাজেয়াপ্ত করে৷’
‘এইটা হবার সম্ভাবনা শূন্য পার্সেন্ট৷ উনি খুবই ধূর্ত মহিলা৷ জমি কিনেছে নাকি টাকা জমিয়ে রেখেছে এইটা উনার মুখ থেকে বের করা যায় নি৷ আর আব্বা অসুস্থ হবার পর পরেই উনি টাকা গুলা গোপন করে ফেলেছে৷’
‘জানো ভাইয়া আমার মাঝেমধ্যে আব্বার উপর করুণা হয়৷ উনি আমাদের ঠকিয়ে নিজেই সবথেকে বাজে ভাবে ঠকে গেছেন৷’
আমি মলিন গলায় বললাম৷ ভাইয়া প্রতুত্তরে কিছু বললো না৷ জুতোজোড়া পরে আবারো বাইরে যাবার উদ্দেশ্য বের হতে হতে বললো,
‘তোকে রান্না করতে হবে না৷ আজ আমরা কাচ্চি খাবো৷’
.
এক মধ্য দুপুরে খবর এলো মিনু খালাকে জেলের কিছু মহিলা কয়েদি কোনো এক ঝামেলার রেষ ধরে খুব মে’রেছে৷ মা’রের ফলে উনার প্রাণ ওষ্ঠাগত৷ সেই খবর আমাদের দিয়েছে মনোহর স্যার৷ আপাতত মিনু খালাকে হসপিটালে এডমিট করা হয়েছে৷ খবর টা যখন ভাইয়া আমাকে দিলো আমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালাম না৷ তবে সব থেকে দুঃখের বিষয় হচ্ছে হোসেন চাচা জামিন পাবার সাথে সাথেই চাচি আর দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে পলাতক৷ এরমাঝে দুই হাজিরাতেও নাকি উনার দেখা মিলে নি৷ ওইদিকে গ্রামে আমার দাদি একা নিজের বোনের বাসায় ছটফট করছে৷ ভাইয়া আমাকে উদ্দেশ্য করে কাচুমাচু গলায় বললো,
‘দাদিকে আমাদের সাথে রাখি৷’
‘তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার৷ কিন্তু আমি বারতি একজনের জন্য কোনো রান্না বা কাজ করতে পারবো না৷ আর দাদির জন্য তো না৷’
‘উনি মুরব্বি মানুষ৷ শুনলাম অনেক কষ্টে আছে৷’
‘থাকুক এইটা উনাদের প্রাপ্য৷’
আমার কড়া জবাবে ভাইয়া আর জোরাজোরি করলো না৷ ভাইয়া সব সময় সবার কথা ভাবে৷ এই স্বভাব টা একদম বিরক্তিকর৷
আমাকে রাগ করতে দেখে ভাইয়া নির্মল গলায় বললো,
‘সময় সবাইকে জবাব দেয়৷’
‘আমি তোমার মতো ভালো মানুষ না৷ সব থেকে বঞ্চিত আমরা৷ কারণ তোমার জানা৷’
‘দাদির ব্যাপার বুঝ মিথি৷ উনি বুড়া মানুষ৷’
‘এরপর এসে আবার কূটকাচালি করবে৷ এইসব আমি মেনে নিতে পারবো না৷’
আমি রুক্ষ ভাবে বললাম৷ ভাইয়া আমাকে একপ্রকার ধমক দিয়ে বললো,
‘তুই সব সময় বেশি বুঝিস৷ সব সময় হিংসা বিদ্বেষ নিয়ে চললে হয় না৷ পরিস্থিতি বুঝতে হয়৷’
‘হ্যাঁ যারা আমাদের এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে৷ তুমি তাদের নিয়েই মাতামাতি করো৷ ঝুমার জন্য এখনো তুমি মন খারাপ করে থাকো৷ তুমি আমাকে বুঝাও!আজকে এই ভাড়া বাসায় টেনে টুনে তোমার আর আমার সংসার চালাতে হচ্ছে৷ কেন! আমরা কি এতোটাই অসহায় ছিলাম? আমাদের অসহায় করেছে কে! আমার আব্বা থেকে শুরু করে সবাই৷’
আমি বলেই হনহন করে চলে এলাম৷ ভাইয়া পেছন থেকে বার দুয়েক ডাকলো৷ আমি শুনলাম না৷ মানুষের জীবন টা এতোটা অসহায় না হলেও তো পারতো তাই না!
কিন্তু আমাদের এই ছোট জীবনে কতোকিছু ঘটে গেলো৷
.
আজকে দুটো দিন আমি নিজেকে ঘর বন্ধী করে রেখেছি৷ পেটে পানি ছাড়া কিছু ঢুকে নি৷ অবশ্য ভাইয়া অনেকবার ডেকেছে৷ ক্ষমা চেয়েছে কিন্তু আমার জমে থাকা ক্ষোভ গুলা পেটে ঘুরপাক খাচ্ছে৷ রাগ টা অবশ্য ভাইয়ার উপর না উনার চিন্তা ভাবনার উপর৷ গত সাত আট মাসের ঘটনা গুলা ভাবলে নিজেকে কবরস্থানের বাসিন্দা মনে হচ্ছে৷ যেন আশেপাশে কেউ নেই! আমাদের একটু আলোক ছটা দেখাবে৷
আমি যত্রতত্র ভেবেই আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলাম৷ খুদায় পেটের ভেতরে চোঁ-চাঁ শব্দ হচ্ছে৷ উঠে দাঁড়াইতেই মাথা ঘুরে উঠলো৷ চোখ ঝাপসা লাগছে৷ আমি এলোমেলো পা ফেলে দরজা খুলে বের হতেই দেখি ভাইয়া কাঠের চেয়ারে বসে আছে৷ চোখ মুখ শুকনা৷ আমাকে দেখে তপ্ত গলায় বললো,
‘তুই আমাকে একা রেখে থাকতে পারলি মিথি৷ আমি যে দুইদিন না খেয়ে আছি সে খেয়াল কি তোর আছে! কোই আম্মা তো আমাকে না খাইয়ে রাখতো না৷’
ভাইয়ার কথা শুনে আমি হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলাম৷ ভাইয়াও কাঁদছে৷ আমি গিয়ে ভাইয়ার দু হাত আঁকড়ে ধরে বললাম,
‘সত্যি বলছি ভাইয়া৷ আমার আর কিছু চাই না৷ আমি একটু শান্তি চাই৷ দাদির যা খরচ লাগে তুমি দিয়ে দিয়ো৷ কিন্তু ওই মহিলাকে এনো না৷ আমাদের আবার সব ধ্বংস করে ফেলবে৷’
‘আনবো না৷’
ভাইয়া নির্লিপ্ত গলায় বললো৷ আমার চোখ মুছে দিয়ে বললো,
‘কি খাবি বল!’
‘কিছু না৷ আমি চাই তুমি একটা বিয়ে করে ফেলো৷’
ভাইয়া আমার কথা শুনে চুপ হয়ে গেলো৷ অনেকক্ষণ কিছু একটা ভেবে জবাব দিলো,
‘বিয়ে করবো৷ কিন্তু আমাকে মেয়ে দিবে কে!’
ভাইয়ার কথা শুনে আমি সত্যি সত্যিই চিন্তায় পরে গেলাম৷ তবে ভাইয়া আমাকে চিন্তা করতে না দিয়ে উঠে গেলো৷ রান্নাঘরে গিয়ে গরম ধোঁয়া উঠা ভাত আর আলুভর্তা নিয়ে এসে বললো,
‘আজ কি জন্য যেন অফিস থেকে ফিরেই মনে হলো তোর খুদা লেগেছে৷ এইজন্য রান্না করেছি৷ যদিও ভাত নরম হয়ে গেছে৷’
ভাইয়া আফসোসের সুর তুলে বললো৷ আমি হেসে ফেললাম৷ আমার হাসি দেখে যেন কিছুটা স্বস্তির শ্বাস ফেললো৷
এইযে আমরা দুজন মিলে একসাথে আলুভর্তা দিয়ে ভাত খাচ্ছি৷ এতোটা শান্তি সত্যিই আমরা এই কয়মাসে পাই নি৷
চলবে….