#বিকেলের_যতো_রঙ
#রুবাইদা_হৃদি
সমাপ্ত পর্ব
ভাইয়া গম্ভীর হয়ে বসে আছে৷ এইদিকে আমার মন মস্তিষ্কে বেশ টান টান উত্তেজনা কাজ করছে৷ যদিও আমি চাচ্ছি না ভাইয়ার অমতে কোনো কিছু হোক৷ বা এমন কোনো কিছু হোক যার ফলে আমাদের সদ্য কিছুটা জোড়া লাগা মন টা আবারো ভেঙে যাক৷ তবে মোকশেদ আংকেল বেশ জাদরেল মানুষ৷ বাড়িওয়ালা বলেই কি-না!
লোকটা ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আবারো গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
‘জোয়ান কালে আমার বেশ নাম ডাক ছিলো৷ আমার সব জায়গাতেই পরিচিত লোকজন আছে৷ তোমার আন্টি আমাকে তোমাদের সব কিছু বহু আগে থেকেই জানিয়েছে৷ ব্যবসার জন্য মন দিতে পারি না-ই৷’
‘সমস্যা নেই আংকেল৷ আমরা সামলায় নিয়েছি প্রায়৷’
‘আরে বেটা! সামলায় তো নিবাই৷ কিন্তু মানুষের পরামর্শ ও তো দরকার আছে৷’
লোকটা একপ্রকার ধমকে কথাটা বললো৷ উনার হম্বিতম্বিতে আমি বেশ বিরক্ত হচ্ছি৷ ভাইয়া আমাকে ইশারায় চুপ থাকতে বললো৷
‘আপনি হয়তো জানেন আমার আম্মাকে সবাই ষড়যন্ত্র করে মে’রে ফেলেছে৷ সেই কেসটা অলরেডি আদালতে চলমান৷ এর উপর আবার আমাদের আব্বা সব সম্পদ বিক্রি করার উদ্দেশ্য প্রায় ত্রিশ লাখ টাকা নিয়েছে৷ এইটার জন্য একটু দৌড়াদোড়ির উপরে আছি৷’
‘চিন্তা করো না৷ আমার ভাইপো এইসব ব্যাপারে খুব পটু৷ আমি আশা করি ওর থেকে পরামর্শ নিলে তোমরা উপকার পাবে৷’
ভাইয়া চিন্তিত হয়ে মাথা ঝাঁকালো৷ মোকশেদ আংকেল খানিকক্ষণ বাদে উঠে চলে যেতেই ভাইয়া আমাকে বললো,
‘উনাদের মতলব বুঝতে পারছি না৷’
‘আমিও না৷ কিন্তু সাহায্য করতে চাইলে নেওয়া উচিৎ বলেই আমার মনে হচ্ছে ভাইয়া৷’
‘কিন্তু আন্টির ভাইঝিকে আমি বিয়ে করতে পারবো না৷’
ভাইয়া বেশ গম্ভীর কন্ঠে বললো৷ আমি শুনেই হেঁসে ফেললাম৷ বেঁচারা বেশ যাতাকলে পরেছে৷
‘আব্বার অবস্থা বেশি ভালো না৷’
‘এতে আমাদের কিছু করার নেই ভাইয়া৷’
‘হ্যাঁ! মিনু খালার ওই আত্মীয় যিনি উনাদের হয়ে কেস লড়ছিলো৷ লোকটা না-কি বলেছে কেসটা উনি চাইলেও জিততে পারবে না৷ কারণ সব প্রমাণ উনাদের বিপক্ষে কাজ করছে৷ এমনকি ইমরানের আব্বা নিজে এসে ছেলের বিপক্ষে সাক্ষী দিয়েছে গত কালের শুনানি তে৷’
‘বলো কি!’ আমি অবাক হয়ে বলতেই ভাইয়া মাথা ঝাকিয়ে বললো,
‘ইমরান উনার ব্যাংক একাউন্ট থেকে নকল সাইন দিয়ে টাকা তুলতে গিয়ে ধরা খেয়েছে৷ উনি তো এমনিই রগচটা মানুষ৷ এরপর ঝুমাকে বিয়ে করার ফলে ছেলেকে ত্যাজ্য করেছে৷’
‘ওদের কৃতকর্মের ফল দুনিয়াতেই ভোগ করছে৷ এতো কাহিনি করে লাভ হলো কি!’
‘আমরা এতিম হয়েছি৷’
ভাইয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো৷ আমি প্রত্যুত্তরে কিছু বললাম না৷ দুজনেই বেশ খানিকটা সময় নিজেদের ভাবনায় ছিলাম৷ আমাদের ছোট দুনিয়াটা অদ্ভুত ভাবে আলো আঁধারে ছেয়ে থাকলে আমরা বেশ ভালো আছি৷ আমাদের যারা খারাপ রাখতে চেয়েছিলো তাদের প্রাণ ই এখন ওষ্ঠাগত৷ এইজন্য হয়তো অনেকে বলে, আল্লাহর হাতে সবটা ছেড়ে দিলে বসে বসে দেখে যায়৷
.
আদালত চত্ত্বরে ঢুকতেই মিনু খালাকে চোখে পরলো৷ দুজন পুলিশ উনার পাশে দাঁড়িয়ে আছে৷ মহিলার চেহারা কেমন বিবর্ণ হয়ে গেছে৷ আজকে আম্মার মৃত্যু কেসের শুনানি ছিলো৷ আব্বাকে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে৷ আর মিনু খালা আর হোসেন চাচার শুনানির তারিখ আরো পিছিয়েছে৷ কারণ উনারা সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলো না৷ তবে কুলসুমের বয়স এখনো আঠারো হতে দুমাস বাকি বলে জুডিশিয়াল কারাগারে পাঠানো হয়েছে৷
ভাইয়াকে উকিল একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে গেছে৷ আমি মিনু খালার সামনে এগিয়ে যেতেই উনি আমার দিকে কিছুটা অসন্তুষ্ট দৃষ্টিতে তাকালেন৷ আমি সেই দৃষ্টির প্রতুত্তরে মৃদু হাসলাম৷ নম্র কন্ঠে বললাম,
‘টাকা হজম হয়েছে খালা?’
‘এখানে কথা বলার অনুমতি নেই৷’ পাশে থাকা পুলিশ টা রুক্ষ কন্ঠে বললো৷ তবে আমি বেশ সাহস নিয়েই বললাম,
‘আল্লাহর লানত আপনার উপর পরুক খালা৷ ক্ষমা মহৎ গুণ হলেও আমি আপনাকে কোনোদিন ক্ষমা করবো না৷ একমাত্র আপনার খারাপ চরিত্রের জন্য একটা পরিবারে ভয়াবহ ধ্বস নেমেছে৷ সেই ধ্ব্স আপনার উপর ও নামুক৷’
‘এই আপনি যান তো এখান থেকে৷ নয়তো পুলিশ ভ্যানে উঠাবো৷’
লোকটা আবারো ধমকে বললো৷ তবে মিনু খালা ধীর কন্ঠে বললো,
‘পাঁপ তো তোমার বাপে করছে৷ যার শাস্তি আমাকে ভুগতে হচ্ছে৷’
‘হায়রে! এতো তাড়াতাড়ি ভালোবাসাও শেষ? আফসোস৷’
আমি কিছুটা কটাক্ষ করেই বললাম৷ মিনু খালার চোখ মুখের ভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে উঠলো৷ উনি কিছু বলার পূর্বেই পুলিশের লোক দুটো আমাকে আরো কয়েকটা ধমক দিয়ে উনাকে নিয়ে ভ্যানে উঠালেন৷ তবে সেই ধমকে আমার কোনো হেলদোল হলো না৷ বেশ অন্য রকম শান্তি অনুভব হচ্ছে যেন৷
আমাকে হাসিখুশি দেখে ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে ফেললো৷
‘হাসছিস কেন!’
আমি সংকীর্ণ ভাবে জবাব দিলাম,’পাপীরা পাপ করে ভালো নেই ভাইয়া৷’
‘স্বাভাবিক৷ মিনু খালা টাকা থাকলে জোর থাকতো৷ আক্কাস কাকা উনার লোক দিয়ে খোজ লাগিয়ে টাকা উদ্ধার করেছে মিনু খালার বোনের থেকে৷’
‘কোন বোন এইটা? মিনু খালার বড় বোনের সাথে তো তার সম্পর্ক আগে থেকেই ভালো না৷’
‘টাকার লোভে আবার ভালো হয়ে গেছে৷ মজার কথা কি জানিস! মহিলা নিজেও পাঁচ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে৷ শুধুমাত্র ১৭ লাখ টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে৷ আবার শুনলাম আক্কাস চাচা নাকি প্রতারণার মামলা দিয়েছে অনেকের নামে৷’
‘মিনু খালার তো বেঁচে ফেরার উপায় নেই৷’
‘ঝুমা আর ইমরানের ও নেই৷’
ভাইয়া মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বললো৷ আমি সেদিকে গুরুত্ব দিলাম না৷
‘তাহলে আমরা জমি গুলা পাবো?’
‘শুধুমাত্র আম্মার টুকু৷ আব্বার গুলা উনি বিক্রি করে দিয়েছে৷ অবশিষ্ট কিছু নেই৷’
‘থাক৷ ওইগুলা আমাদের দরকার নেই৷’
ভাইয়া আমার কথা শুনে মৃদু হাসলো৷ আজকে আমরা কোর্ট থেকে অনেকটা প্রশান্তি নিয়ে বের হচ্ছি৷ এই প্রশান্তি টা গত কয়েক মাসে পাই নি৷
.
জানুয়ারির প্রচন্ড শীতে হাঁড় পর্যন্ত কেঁপে উঠছে যেন৷ চারদিকে ঘন কুয়াশার চাঁদর লেপ্টে আছে৷রাস্তার দুপাশে ক্ষেত জুড়ে হলুদ শর্ষে ফুলে ছেলে আছে৷ ফুল গুলা কুয়াশার বিন্দু বিন্দু জলে একদম নুইয়ে পরেছে ৷ এমন শীতল পরিবেশ দেখে মনের ভেতর কেমন আঁকুপাঁকু করে উঠছে৷ আজ বহুদিন পর গ্রামকে সামনে থেকে উপভোগ করছি৷ আমি কুয়াশা জমে থাকা ভেজা ঘাস মারিয়ে আম্মার কবরের সামনে এসে দাঁড়ালাম৷ জরাজীর্ণ একটা কবর৷ তবুও! দেখে মনে হচ্ছে কেউ সুন্দর করে যত্ন করে রেখেছে৷ জানি না আম্মা আপনি কেমন আছেন!
তবুও আপনার কবর দেখলে আলাদা এক শান্তি লাগে৷ মনে হয় এইতো আমার আম্মা ঘুমিয়ে আছে৷ দোয়াদরুদ পড়তে পড়তে আমার চোখ দিকে অনর্গল পানি বের হচ্ছে৷ এইযে আমরা হুট করে বড় হয়ে গেলাম৷ এইটা কি আম্মা আপনি দেখতে পাচ্ছেন!
আপনার আশরাফ সত্যি সত্যি বিয়ে করবে না বলে করে ফেলেছে৷ যদিও সে একটা নাটকীয় অধ্যায়৷
বাড়িওয়ালা আন্টির ভাতিঝি সোনালি ভাবীর সাথেই বিয়েটা হয়েছে৷ আন্টি এক প্রকার জোর করেই বিয়েটা দিয়ে ফেলেছেন৷ অবশ্য বিয়েটা দিয়ে ভালোই হয়েছে৷ নয়তো ভাবীর মতো ভালো মানুষ পেতাম না৷ আজ প্রায় দু বছর হতে চললো ভাবী আমাদের সাথে৷ সময় কতো দ্রুত বয়ে যায়৷ এইযে কবরস্থানে আব্বার কবরটা একপাশে পরে আছে৷ আজ আমি তার জন্যও মন খুলে দোয়া করলাম৷ আব্বা জেলেই মারা গেছেন একদিন ভোর সকালে৷ তার মৃত্যুটা স্বাভাবিক না হলেও বেশ অস্বাভাবিক ছিলো৷ বাথরুমে উল্টো হয়ে পরে ছিলেন৷ সে খবর শুনে আমি না গেলেও ভাইয়া ঠিকি ছুটে গিয়েছিলো৷ নিজ উদ্যোগে এনে কবরস্থ করেছে৷
আমি সেসব ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে চলেছি৷ কুলসুম আর মিনু খালাকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে৷ ঝুমা আপা,ইমরান আর হোসেন চাচাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে৷ যদিও ব্যাপার গুলা এতোটা সহজ ছিলো না! তবুও পাপের শাস্তি তো দুনিয়াতেই ভুগছে৷
.
আমাদের সেই চিরজেনা বাড়িতে ঢুকতেই ভাবি হইহই করে বললো,
‘তোমরা কোথায় থাকো বলো তো! সকাল থেকে খোজ নেই৷’
‘আমি তো কবরস্থানে গিয়েছিলাম৷’
‘তোমার ভাই কোথায়? ওই লোক কোই৷ নাকি এখনো ঝুমার প্রেমে মশগুল৷’
ভাবির কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম৷ আমাদের হট্টোগোলের মধ্যেই ভাইয়া এক হাত ভর্তি বাজার নিয়ে ঢুকলো৷ সাথে বেশ কিছু ছেলেমেয়েও পিছু পিছু ঢুকলো৷ আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘ওরা কে?’
‘গ্রামের মাদ্রাসা থেকে এসেছে৷ আজ তো আম্মার মৃত্যু বার্ষিকী৷ তাই ভাবলাম ওদের নিয়ে আসি৷’
‘ভালো করেছো৷ তুমি আগে বলবা না!’
ভাবি কিছুটা রেগে বললো৷ ভাইয়া বাজার গুলা নামিয়ে বললো,
‘রান্না করে ফেলো তো সোনালি৷’
‘আর কাউকে বলবে না!’
আমি জিগ্যেস করতেই ভাইয়া বললো,
‘আমরা আমরাই তো৷ আর কাকে বলবো! আমাদের তো কেউ নেই৷’
ভাইয়া অনেক হতাশা নিয়ে বললো৷ তবে ভাইয়া বলতে দেরি ভাবি কেঁদে ফেললো৷ ভাইয়া কিছুটা ধমকে বললো,
‘আবার কাঁদো কেন!’
‘তুমি কষ্ট পাচ্ছো৷’
ভাবীর এমন বাচ্চামো কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম৷ ভাইয়া মুখ বাঁকিয়ে ঘরে চলে গেলো৷ আমরা দুজনে ছেলে মেয়ে গুলাকে নিয়ে ঘরে গেলাম৷ এইযে আমাদের ফাঁকা ঘর টা পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো৷ এর থেকে আর বড় শান্তি কোথায়?
মানুষের জীবনের রঙ ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়৷ আমাদের যারা সব থেকে বঞ্চিত করতে চেয়েছিলো৷ তাদের অস্তিত্ব আজ কোথায়! বুকের ভেতরে উথলে পরা ঢেউ টা কিছুটা প্রমশিত আজ হয়েছে৷ তবুও মাঝেমধ্যে আব্বাকে জিগ্যেস করি,’আব্বা আমাদের কেন এতিম করলেন!’
সেই উত্তর টা কোথাও পাই নি৷ তবে এই শূন্য জীবনে একটা কথা বুঝেছি বিশ্বাস টা নিজের ছায়াকেও মাঝেমধ্যে করা যায় না৷
সমাপ্ত