বিচ্ছেদের অন্তরালে প্রেম এলো জীবনে পর্ব-০৩

0
697

#বিচ্ছেদের অন্তরালে প্রেম এলো জীবনে
পর্ব- তিন
মাহবুবা বিথী

ক্লান্ত শ্রান্ত অহনা উবার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ডোরবেলটা বাজায়। সাথী দৌড়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিয়ে বলে,
—-আয় মা ঘরে আয়। সেই কোন ভোরে গিয়েছিস আর বাড়ী ফিরতে সন্ধা হয়ে গেল। আয় শায়লা আপার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।
শায়লা চৌধুরী অধীর আগ্রহে অহনাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। এবার নিজে মেয়ে দেখে ছেলেকে বিয়ে দিবেন। নায়লা ওকে অহনার কথা বলেছে। শ্বশুরবাড়িতে মেয়েটা অনেক টর্চারের স্বীকার হয়েছে। তারপরও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সংসারটা করতে চেয়েছিলো। কিন্তু পরকীয়ার বেনোজলে শেষ রক্ষা আর হলো না। সংসার ফেলে বাবার বাড়ি চলে আসতে বাধ্য হলো। সাথী অহনাকে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে ড্রইং রুমে চলে আসতে বলেন। কিন্তু অহনার ইচ্ছে হলো না। আজ সারাদিন ওর উপর দিয়ে কি গিয়েছে তা শুধু আল্লাহপাক জানেন। আল্লাহপাকের অসীম রহমতে নারীত্বের চরম অপমান থেকে ও আজ রক্ষা পেয়েছে। এখন এসব সামাজিকতা ওর ভালো লাগছে না। ও তাড়াতাড়ি সামাজিকতা রক্ষা করে নিজেকে একটু একা করতে চাইছে।
ক্লান্ত শ্রান্ত অহনাকে দেখে শায়লা চৌধুরীর ভিতরে এক অদ্ভূত মায়ার সৃষ্টি হলো। উনার কেন যেন মনে হলো এই মেয়েটাই পারবে তার ছেলের অগোছালো জীবনটাকে গুছিয়ে দিতে। অহনাকে নিজের পাশে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
—-কেমন আছো মা?
শায়লার ডাকে অহনার ভিতরটা যেন কেমন করে উঠলো। বাবা মারা যাবার পর এভাবে আদর করে আর কেউ তাকে ডাকেনি। সবাই শুধু করুণার চোখ দিয়ে দেখেছে। শুধু ওর বড় খালার কথা আলাদা। খালাকে দেখলে ওর মনে হয় মাতৃত্বের স্নেহে ভরা এক অতলান্তিক সাগর। অহনা মাথা নাড়িয়ে বললো,
—-ভালো আছি।
—-মুখটা শুকিয়ে গেছে। সারাদিন মনে হয় তেমন কিছু খাওয়া হয়নি?
—-না,মানে আমার বাইরে খেতে ভালো লাগে না। বাসায় এসে আম্মুর সাথে বসে খেতে আমার ভালো লাগে।
—-তাতো অবশ্যই। যাও তুমি ঘরে গিয়ে ফ্রেস হয়ে নাও।
অহনা চলে যেতেই শায়লা সাথীকে বলে,
—-তোমার মেয়েটাকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। ওর একটা ছবি আমাকে দাও। শেজাদ আর ওর বাবাকে দেখাবো। আমার পছন্দেই শেজাদের পছন্দ। আর শেজাদের পছন্দ হলে ওর বাবার অমত করার কিছু নাই।

অহনার কোনো রিসেন্ট তোলা ছবি সাথীর কাছে ছিলো না। কলেজের নবীনবরণের তোলা একটা ছবি শায়লার হাতে দিয়ে দিলো। শায়লাও সাথীর কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ীর পথে রওয়ানা দিলো।
সাথী যেন আজ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। আল্লাহপাকের কাছে অনেক প্রার্থনা করেছে মেয়েটার যেন একটা ভালো ঘরে বিয়ে হয়। ও ছাড়া তো মেয়েটার আপন কেউ নেই। অন্তত নিজে দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার আগে মেয়েটাকে যেন বিয়ে দিতে পারে। কেননা ওর অবর্তমানে হয়তো মানুষরুপী অনেক শিয়াল কুকুর ওকে ছিড়ে খেতে চাইবে। ইদানিং ওর শরীরটা তেমন একটা ভালো যায় না। তলপেটটা ভীষণ ভারী। মনে হয় পেটের ভিতর একটা ভারী বস্তু রাখা আছে। মাঝে মাঝে অসহ্য ব্যথা হয়। অহনাকে অবশ্য সাথী এসবের কিছুই বলেনি। এমনিতেই বিয়েতে মেয়েটার তেমন মত নেই। তারউপর ওর শরীরের এমন অবস্থার কথা শুনলে হয়তো বিয়েই করতে চাইবে না।

ওদিকে অহনা নিজের রুমে এসে লাইট অফ করে শুয়ে শুয়ে রিসোর্টের ঘটনাটা ভাবছে আর মনে মনে শিঁউড়ে উঠছে। আল্লাহপাকের কাছে অকাতরে শোকরিয়া আদায় করছে আর চোখের কোলে জমানো নোনা পানিগুলো মুছে যাচ্ছে। শয়তানটা যদি জোর করে ওর সম্মানহানি করতো ওর তো কিছু করার ছিলো না। ওতো লোক জানাজানি হওয়ার ভয়ে চিৎকার চেঁচামেঁচি করতে পারতো না। তারসাথে আছে মিডিয়ার দৌরাত্মো। সব মিলিয়ে মুখ বুঝে এতো বড় অসম্মানকে হজম করতে হতো। হঠাৎ রুমের লাইট জ্বলে উঠাতে অহনার ভাবনায় ছেদ পড়ে। ওড়নার আঁচল দিয়ে চোখটা মুছে বিছানায় উঠে বসে। সাথী এসে মেয়ের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
—-এভাবে রুম অন্ধকার করে শুয়ে আছিস কেন? শরীর ঠিক আছে তো?
—-হুম,আম্মু আমি ভাবছি কাল থেকে এই চাকরিটা আর করবো না।
—-আমিও তাই বলি তোর আর চাকরি করা লাগবে না। আমি খুব চিন্তায় থাকি। এই সমাজে মানুষরুপী শিয়াল শকুনের ছড়াছড়ি। যারা মেয়ে মানুষের শরীর দেখলেই খুবলে খেতে চায়। আজকে সারাদিন আমি খুব টেনশনে ছিলাম। বসের সাথে ভিজিটে গিয়েছিস দেখে সারাদিন বুকের ভিতরটা অজানা ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলো। যাক ভালোয় ভালোয় আমার ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে এসেছে।
সাথীর কথা শুনে অহনা চমকে উঠলো। মনে মনে ভাবলো,আম্মু কি কিছু বুঝতে পেরেছে। অহনার মুখের দিকে তাকিয়ে সাথী বলে,
—-তোর কি শরীর খারাপ? মুখটা অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন?
অহনা পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
—না,শরীর ঠিক আছে। আসলে মুখে সারাদিনের ক্লান্তির ছাপ পড়েছে।
—-নিজের উপর তো বহু অযত্ন করেছিস,এবার একটু যত্ন নে। দু’দিন পর বিয়ে হবে। এখন নিজেকে একটু ফিটফাট রাখবি।
অহনা রেগে গিয়ে বললো,
—-তোমাকে বলেছি না আমি আর বিয়ে করবো না?
—-তাই বললে কি হয় মা? এই সমাজে একটা মেয়ের একলা চলা খুব মুশকিল।
—-একলা কোথায়, তুমি আছো না?
—-আমি আর ক’দিন। আমার চোখ দুটো বুঁজলেই সমাজের মানুষরুপী হায়নাগুলো তোকে ছিঁড়ে কুঁড়ে খাবে।
অহনা তারপরও একরকম আর্তনাদ করে বলে,
—-মা,তারপরও আমি বিয়ে করতে চাই না। ইনশাআল্লাহ আল্লাহপাক সবসময় আমার সাথে আছেন। তোমার শরীরটা নিয়ে ইদানিং আমার খুব টেনশন হয়।
—-সেই কারনে আমি তোকে বিয়ে দিতে চাচ্ছি। যদি দুম করে আজরাইল আমার ঘরের দ্বারে চলে আসে আমি যেন শান্তিতে মরতে পারি। এটুকু শান্তি আমায় দে মা। সবসময় এমন প্রস্তাব আসে না। শায়লা আপা তার ছেলের জন্য তোকে পছন্দ করেছেন। আমার মন বলছে তুই অনেক সুখী হবি।

সাথীর এই আকুতিকে অহনা আর অগ্রাহ্য করতে পারলো না। অনিচ্ছা সত্বেও মায়ের সুখের তরে নিজেকে একরকম বিয়ে নামক বন্ধনে আবারো বন্দী করলো। তবে আজকে অফিসের বসের কাছে যে রকম পরিস্থিতির স্বীকার ওকে হতে হয়েছিলো সে কারনে বিয়ে করতে বাধ্য হলো। অহনার হঠাৎ বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠলো। মাকে ও কার কাছে রেখে যাবে? তাই অশ্রু টলমল চোখে মাকে বলে,
—-আমি চলে গেলে তোমাকে কে দেখে রাখবে? তাছাড়া আমি তোমাকে না দেখে কিভাবে থাকবো।
—-কেউ কাউকে দেখে না মা। আল্লাহপাক উনার প্রতিটি বান্দার খেয়াল রাখেন। তাছাড়া তোর এমন জায়গায় বিয়ে হচ্ছে যখন খুশী আমার কাছে আসতে পারবি।

অহনার কোনো আপত্তি আর ধোপে টিকলো না। অবশেষে ওকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো। যার সাথে ওর বিয়ে হচ্ছে তাকে ওর দেখা হয়নি। কিংবা দেখার ইচ্ছা জাগেনি। মায়ের ইচ্ছার মর্যাদা রাখতে গিয়ে নিজেকে যেন এক অনিশ্চিত গন্তব্যের মাঝে সঁপে দিলো।

আজ অহনার গায়ে হলুদ। শায়লা চৌধুরী হলুদের সরঞ্জাম নিয়ে ওদের বাড়িতে চলে এসেছে। যার ঘটকালীতে অহনার বিয়ে হচ্ছে উনি হচ্ছেন নায়লা আন্টি। ওর মায়ের বান্ধবী আর এখন হবেন খালা শাশুড়ী। দেশের বাইরে থাকায় এতো অল্প সময়ে ভিসা ম্যানেজ করে আসতে পারলেন না। আর ওর মামাদের সাথে ওর মায়ের সম্পর্ক খুব একটা ভালো না। উনাদেরকে ওর মা অহনার বিয়ের কথা জানাননি। বড় খালাও এই মুহুর্তে ছেলের কাছে আমেরিকায় আছেন। চাচা ফুফুদের উপর অহনার অভিমান আছে। কেননা ওর বাবার অসুখে কিংবা বাবা মারা যাবার পর কেউ ওর আর ওর মায়ের খোঁজ রাখার প্রয়োজন মনে করেনি। তাছাড়া সাথী নিজেও আত্মীয় স্বজনদের খুব একটা জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি।
সাথীর চোখ দুটো আনন্দ অশ্রুতে ভরে আছে। শায়লা চৌধুরী সাথীকে কোনো খরচ করতে দেয়নি। কারণ সাথী তার সবচেয়ে দামী সম্পদটাই তো শায়লার হাতে তুলে দিয়েছে। শায়লা অহনার গায়ে হলুদ ছুঁয়ে দিয়ে বলে,
—-পারবে না আমার ছেলেটার ভাঙ্গা মনটার জোড়া লাগাতে?
অহনা মাথা নাড়িয়ে বলে,
—-পারবো,আপনি দোয়া করবেন।
শায়লা চৌধুরী অহনার কপালে চুমু দিয়ে বলে,
—-তোমাদের জন্য আমার দোয়া সবসময় থাকবে।

বিয়ের দিন সকালে অহনার মনটা বড্ড বিষন্ন থাকে। এরকম অনুভূতী থাকার কারণটা কি অহনা বুঝতে পারছে না। নিজের বিয়েটাকে পুতুলের বিয়ের মতো মনে হচ্ছে। এই বিয়ে নিয়ে ওর কোনো আগ্রহ নেই। মাকে খুশী করার জন্য ওর এই বিয়ে। ও বাড়ি থেকে বিয়ের পোশাক আর গয়না নিয়ে ওর হবু শাশুড়ী মা চলে এসেছেন। তবে এই মানুষটকে ওর ভীষণ ভালো লেগেছে। মাথা থেকে পা অবদি এ যেন মায়ের অবয়ব। সন্তান জন্ম দিলেই শুধু মা হওয়া যায় না। মা হতে গেলে মাতৃত্বকে লালন পালন করতে হয়। ওকে লাল বেনারশী পরানো হয়েছে। ভারী গয়নার সেট পরানো হয়েছে। মুখে মেকাপের প্রলেপ। আজ যেন জগতের সব রুপ এসে অহনার অঙ্গে ধরা দিয়েছে। দূর থেকে সাথী মেয়েকে দেখছে আর চোখের পানি মুছে ফেলছে। কাজী সাহেব এসে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করলেন। কবুল বলার সাথে সাথে অহনার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠলো। এ কেমন ছেলেখেলা হলো ওর সাথে ও জানে না। এখন পর্যন্ত নিজের বরকে দেখা হলো না। মানুষটা সুস্থ না অসুস্থ দেখতে কেমন কিছুই জানলো না অথচ কবুল বলে ফেললো। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে শায়লা চৌধুরী ওকে গাড়িতে নিয়ে বসালো। তখনি এক ঝলক নিজের বরকে যেন একটু দেখলো। কিন্তু তখন নিজের মাকে ছেড়প যাওয়ার কষ্টে বুকের ভিতরটা ভারী হয়ে আছে। গাড়ী ছাড়ার সাথে সাথে অহনার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হলো। কিন্তু পারলো না। কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে গলার কাছে যেন জমাট বদ্ধ হয়ে থাকলো।

উত্তরা থেকে শ্যামলি রিং রোডে আসতে খুব বেশী সময় লাগলো না। বিশাল পাঁচতলা বাড়ির সামনে এসে গাড়ীটা থামলো। অহনা বেশ অবাক হলো। ওর স্বামী ব্যাক্তিটি গাড়ীর দরজা খুলে একলাই গটগট করে বাড়ীর ভিতরে ঢুকে গেল। তবে শায়লা চৌধুরী এসে অহনাকে খুব যত্ন করে গাড়ি থেকে নামালো। লিফটে উঠিয়ে থার্ড ফ্লোরে এসে থামলো। নতুন বউকে নিয়ে শায়লা চৌধুরী ঘরে ঢুকলেন। এরপর সফেদ পাঞ্জাবী পরা এক লম্বা চওড়া বয়স্ক মানুষের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন,
—ইনি তোমার শ্বশুর ছালাম দাও।
অহনা পায়ে সালাম করতে যাচ্ছিলো। শায়লা চৌধুরী ওকে খপ করে ধরে বলে,
—তোমাকে পায়ে সালাম করতে বলিনি। তুমি উনাকে মুখে সালাম দাও।
অহনা মুখে আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি বারকাতুহু বললো। এরপর শায়লা চৌধুরী ওকে একটা ঘরে নিয়ে বসালো। শীতের বেলা। ঝুপ করে সন্ধা নেমে এলো। শায়লা চৌধুরী ওকে বসিয়ে রেখে চলে গেলেন। অহনা কতক্ষণ বসেছিলো বুঝতে পারলো না তবে দরজা খোলার শব্দে সম্বিত ফিরে পেলো। দরজার দিকে তাকাতেই এক সুদর্শন পুরুষের সাথে ওর দৃষ্টি বিনিময় হয়। একরাশ লজ্জা এসে যেন ওকে ঘিরে ফেলে। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে মানুষটা এসে ওর পাশে বসে। তারপর ভরাট গলায় বলে,
—-পাশেই ওয়াশরুম আছে। একটু ফ্রেস হয়ে আসলে ভালো লাগতো।
অহনা মিনমিন করে বলে,
—-হুম।
তবে বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে নার্ভাসনেসের কারনে শাড়িটা পায়ে জড়িয়ে হোঁচট খেয়ে পড়তেই পাশে থাকা সুদর্শন পুরুষটি ওকে খপ করে ধরে ফেলে। মানুষটার স্পর্শে অহনার পুরো শরীর কেঁপে উঠে।

চলবে