বিচ্ছেদের অন্তরালে প্রেম এলো জীবনে পর্ব-০৭

0
1625

#বিচ্ছেদের অন্তরালে প্রেম এলো জীবনে
পর্ব-সাত
মাহবুবা বিথী

অহনা এক কাপড়ে চলে আসাতে সাথী একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
—-কিরে,জামাই আসলো না?
—-আমি আসাতে তুমি খুশী হওনি আম্মু?
—-খুশী হবো না কেন? শেজাদের সাথে অনেকদিন দেখা হয় না। তাছাড়া প্রতি মাসের এক তারিখে আমার ওষুধ থেকে শুরু করে বাজার খরচ সব দিয়ে পাঠায়। আমার তো ইচ্ছে করে ওকে একটু ভালো মন্দ রেঁধে খাওয়াই। তোরা একসাথে আসলে আমারও ভালো মন্দ রাঁধার সুযোগ হতো। অহনা মা আমার, শেজাদকে কখনও অসম্মান করিস না। অনেক ভাগ্যক্রমে এমন শ্বশুরবাড়ী কপালে জোটে।
অহনা অবাক হয়ে ওর মায়ের কথা শুনছিলো। কারণ ও জানতো শেজাদ শুধু ওর মায়ের চিকিৎসা খরচ বহন করে। ওযে সংসারের সব খরচ বহন করে এটা ওর জানা ছিল না। আজ মায়ের কাছে সবটা শুনে ওর মনে হলো, গরীবের মেয়েকে বিয়ে করার এই একটা সুবিধা। দুটো অর্থ ব্যয় করতে পারলে এদের সাথে যা ইচ্ছা তাই করা যায়। কারো কোনো কিছু বলার থাকে না। গরীবের মন পাওয়া মনে হয় বড় সহজ। এরা অল্পতেই খুশী হয়ে যায়। যদিও অহনা ওর মাকে শেজাদের বিষয়টা জানাতে চেয়েছিলো কিন্তু মায়ের এতো প্রশংসা বাক্য শুনে আর বলতে পারলো না। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলা হলো না। এছাড়া মায়ের জন্য প্রতিমাসে এতো টাকার ওষুধ ও কোথা থেকে ম্যানেজ করবে? নিজের উপর বড় অভিমান হলো। নিজেকে আজ অপদার্থ মনে হলো। অহনা নিজের মোবাইলটা বন্ধ করে রাখলো। কারণ ও চায় না শেজাদ ওর সাথে যোগাযোগ করুক। তবে প্রেগনেন্সির এই মুহুর্তে ও কি পারবে শেজাদকে ছেড়ে আসতে? নাকি শেজাদের সব অপকর্ম মুখ বুজে সহ্য করে সারাজীবন আদর্শ স্ত্রীর ভুমিকায় অভিনয় করে যাবে? ও আর কিছু ভাবতে পারছে না।
ওদিকে শায়লা চৌধুরী শেজাদের উপর ক্ষেপে গিয়ে বললেন,
—-শেজাদ তুমি কি শুরু করেছো?
—-কেন কি করেছি আমি?
—ঘরে বউ রেখে পরনারীর সাথে সারারাত কাটিয়ে এসে বলছো কি করেছো তুমি?
—-কাকে পরনারী বলছো?
—-জেনে বুঝে এতো ন্যাঁকামি করছো কেন?
—আম্মু,আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না তুমি কাকে পরনারী বলছো?
—ডিভোর্সের পর প্রাক্তন স্ত্রী পরনারী হয়ে যায়।
শায়লা চৌধুরীর কথা শুনে শেজাদ পাগলের মতো হাসতে হাসতে বললো,
—-যে দেহে কোনো স্পন্দন থাকে না তার সাথে কি লাশের কোনো পার্থক্য থাকে? রাত কাটানো বা না কাটানো তাতে কিছু আসে যায় না।
একথা বলেই শায়লা চৌধুরীকে আর কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শেজাদ নিজের রুমে এসে সজোরে দরজাটা লাগিয়ে দিলো। শায়লা চৌধুরী শেজাদের কথার কোনো অর্থ বুঝতে পারলো না।

এরমাঝে সাতদিন সময় পার হয়ে গেল। এর মাঝে শেজাদ ফোন দিয়েছিলো কিনা ও জানে না। কারণ এখানে আসার পর থেকেই মোবাইলটা বন্ধ করে রেখেছে। আর খোলার ইচ্ছে হয়নি। মাঝখানে একদিন শায়লা চৌধুরী ফোন দিয়ে ওর শরীরের খোঁজ নিয়েছে। সকাল থেকে আজ মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। অহনার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। হাসি কান্না আনন্দ বেদনার স্মৃতির চোরাস্রোতে মনটা আজ ভেসে বেড়াচ্ছে। এই ছয়মাস ওর সাথে শেজাদ যা করেছে তাকি শুধু অভিনয় ছিলো? নিজেকে বড্ড বোকা মনে হলো। কিন্তু ওতো অভিনয় করেনি। ওর পুরোটা দিয়ে শেজাদকে ভালেবেসে গিয়েছে। অথচ শেজাদ কিভাবে ওর সাথে ছলনা করলো। ওর কি অপরাধ ছিলো যার জন্য ওকে এভাবে শাস্তি পেতে হলো? আর শেজাদের কাছে সন্তানের গুরুত্ব আছে বলে ওর মনে হয় না। গুরুত্ব থাকলে ওকে ডাক্তারের কাছে নেওয়ার দিনে শেজাদ কেন নিহারের কাছে যাবে?
অহনা নিজের ঘরে শুয়ে আছে। মনটা তো ভালো না পাশাপাশি শরীরটাও বেকায়দায় আছে। শরীরটা ফুলে গেছে। ওর মা বলেছে শরীরে নাকি পানি আসছে। ডোরবেলটা বেজে উঠলো। এই অসময়ে আবার কে আসলো? অহনার মা সাথী দরজা খুলে দিলেন। সাথী দেখেই শেজাদ বললো,
—–আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া রহমাতুল্লাহি। কেমন আছেন মা?
—-আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি বাবা। তোমাকে দেখার পর আরো বেশী ভালোলাগা অনুভব করছি। মায়ের কথা এতোদিনে মনে পড়লো তোমার?
—-অফিসের ব্যস্ততা থাকায় সামাজিক কাজগুলো ঠিকমতো করতে পারছি না। ইনশাআল্লাহ সময়ের সাথে মানিয়ে নিতে পারবো। মা, অহনা কোথায়?
—-ওর রুমেই আছে। ঘুমিয়ে গেছে মনে হয়। তুমি ও ঘরে গিয়ে দেখতে পারো।
অহনা নিজের রুম থেকে শেজাদের কথা শুনে মনে মনে বললো,
—-হিপোক্রেট,আবার এখন ভালো মানুষ সাজার অভিনয় করছে। এই ব্যাপারে শেজাদ সাহেব ভীষণ পারদর্শী।
অহনা নিজের রুমে শুয়ে শেজাদের পায়ের আওয়াজ শুনতে পারছে। ও বিছানাতে শক্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলো। শেজাদ অহনার রুমেই ঢুকে ওকে ডেকে বললো,
—-আজকে বিকাল পাঁচটায় ডাক্তারের কাছে তোমার অ্যাপয়েটমেন্ট করেছি। তাড়াতাড়ি রেডী হয়ে নাও।
অহনা শোয়া থেকে উঠে বিছানার উপর বসে শেজাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-আমি ডাক্তারের কাছে যাবো না। আপনি চলে যান।
শেজাদ রেগে গিয়ে বললো,
—-অশান্তি করো না,তোমাকে যেটা করতে বলেছি সেটা করো। তাড়াতাড়ি রেডী হয়ে নাও। আমি বলেছি যেতে হবে।ব্যস তোমাকে যেতে হবে। এর বাইরে আর কোনো কথা থাকতে পারে না।
অহনা রেগে গিয়ে চিৎকার করে বললো,
—-কেন যাবো? আমাকে এতো অপমান করে আপনার সাধ মেটেনি তাই না? এক শর্তে যেতে পারি।
—-কি শর্ত
—-আপনি নিহারের সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখতে পারবেন না।
—-সেটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে তুমি নিহারের সাথে দেখা করে ওকে যদি বলতে পারো আমাকে আর কোনোদিন ওর কাছে যেতে দিবে না। আর ও যদি মেনে নেয় তাহলে আমি ওর সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখবো না।
ওদের চিৎকার চেঁচামেঁচি শুনে সাথী এসে মেয়েকে বুঝিয়ে বললো,
—-কিরে অহনা,জামাইয়ের সাথে এভাবে চিৎকার করে কেন কথা বলছিস? দুটো হাড়ি একসাথে রাখলে ঠোকাঠুকি লাগবে। এটাই স্বাভাবিক। বরং ঠোকাঠুকি না লাগলে সম্পর্কের ভীত মজবুত হয় না। তুই রেডী হয়ে নে।
এরপর শেজাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-বাবা, আজকে রাতে এ বাড়িতে থেকে যাও। আমাকেও তোমার আদর যত্ন করার একটু সুযোগ দেওয়া উচিত।
—-মা আজকে না। আজ একটু তাড়া আছে।
—-তাই বলে খালি মুখে যাবে। আমি একটু শরবত বানিয়ে আনছি।
সাথী চলে যেতেই শেজাদ অহনাকে বললো,
—-বসে আছো কেন? তাড়াতাড়ি রেডী হয়ে নাও।
অহনা মনে মনে ভাবলো,শেজাদ কথাটা খারাপ বলেনি। একবার ঐ ডাইনীর মুখোমুখি হতে পারলে ওকে এমন কথা শুনিয়ে দিবে যাতে কোনোদিন শেজাদের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারবে না। কি নির্লজ্জ মহিলা! ডিভোর্সের পর প্রেম যেন উথলে উঠছে। এতো সহজে ও নিহারকে ছেড়ে দিবে না।
অতঃপর রেডী হয়ে ও শেজাদের সাথে ডাক্তারের কাছে চলে গেল। ডাক্তার ওকে দেখে বললেন,সব ঠিকঠাক আছে। আর ভাত জাতীয় খাবার খেতে নিষেধ করলেন। কারণ শরীরে পানি আসছে। এতে মা এবং শিশু দুজনের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। অহনার প্রেগনেন্সির এই সময়ে ভাত খেতেই যেন বেশী ভালো লাগে। একথা তো ডাক্তারকে বলা যাবে না। এরপর ও ডাক্তারের কাছ থেকে বের হয়ে আসলো। তারপর অহনাকে নিয়ে বারডেম হাসপাতালের দিকে রওয়ানা হলো। অহনা বুঝে পেলো না শেজাদ ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। একবার মনে হলো শেজাদ ওকে জিজ্ঞাসা করবে, কাকে দেখার জন্য হাসপাতালে যাচ্ছে। পরক্ষণেই মনে হলো ও নিজ থেকে না বললে জিজ্ঞাসা করবে না। ওর এতো তাগিদ নাই। অবশেষে হাসপাতালে পৌঁছে শেজাদ ওকে নিয়ে আইসিইউ কেবিনের দিকে গেল। সেখানে পৌঁছে কেবিনের গার্ডকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-২২ নম্বর রোগী এখন কেমন আছে?
—-স্যার অবস্থা বেশী ভালো না।
—হুম।
অহনা শেজাদের কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না। এরপর শেজাদ অহনার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-তোমাকে নিহারের সাথে কথা বলতে বলেছিলাম। যাও ভিতরে গিয়ে বলে আসো। আর বলে এসো আমাকে আর কোনোদিন ওর কাছে আসতে দিবে না।
অহনার কাছে সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ও গার্ডের সাথে গুটি গুটি পায়ে ২২নম্বর কেবিনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। বিছানায় যিনি শুয়ে আছেন তাকে অহনার কাছে ঝড়া শিউলি ফুলের মতো লাগলো। শিউলি ফুল যখন ফুটে তখনও সুন্দর। যখন ঝড়ে পড়ে তখনও সুন্দর। নাকে মুখে নল লাগানো। নিস্তেজ অবস্থায় বিছানার সাথে লেপ্টে আছে। ওর একবার ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু হাসপাতাল কতৃপক্ষের নিষেধ আছে। অহনা দাঁড়িয়ে দোয়া পড়লো। এরপর ধীর পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসলো।

চলবে