বিচ্ছেদের অন্তরালে প্রেম এলো জীবনে
শেষ পর্ব
মাহবুবা বিথী
অহনাকে বিমর্ষ বদনে বেরিয়ে আসতে দেখে শেজাদ জিজ্ঞাসা করলো,
—–তোমার কি মন খারাপ?
—হওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়?
—-তোমার চেনা নেই জানা নেই তাতেই মন খারাপ হয়ে গেল। আর আমার সাথে পাঁচ বছরের সম্পর্ক তারপর দুবছরের সংসার জীবন তাহলে আমার মন খারাপ হওয়াটা কি দোষের?
—-দোষের হতো না যদি না ডিভোর্স হতো।
—-তোমাকে একটা সত্যি কথা বলি। আমাদের আসলে ডিভোর্স হয়নি। বাসায় আব্বু আম্মু জানে আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। এমনকি নিহারও ডিভোর্স চেয়েছিলো। আমিও দিতে চেয়েছিলাম।
—-দিলেন না কেন?
—-সে অনেক লম্বা কাহিনী।
—-আমাকে কি বলা যায়?
—-কেন যাবে না? তবে তুমি বোর হবে নাতো?
অহনা একটু গম্ভীর হয়ে বলে,
—হবো না।
বহুদিন থেকে অহনার এই বিষয়টা জানার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু সাহস করে বলতে পারেনি। আজ যখন শেজাদ নিজ থেকেই বলতে চাইছে অহনা সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইলো না। শেজাদ ওকে নিয়ে একটা কফিশপে বসলো। কিছু খাবার অর্ডার করে নিজের জন্য কফি আর অহনার জন্য জুস নিয়ে নিলো। শেজাদ নিরবতার চাদরে নিজেকে মুড়িয়ে নিলো। অহনা জুসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে শেজাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-আপনার ইচ্ছা হলে বলবেন। তা,না হলে আমাকে জানানোর দরকার নেই।
শেজাদ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
—-আমার সাথে ওর পরিচয় হয় অনার্স ফাস্ট ইয়ারে। খুব চটপটে উচ্ছল ছিলো। প্রথম দৃষ্টিতেই ওকে আমার ভালো লেগে যায়। প্রথমে বন্ধুত্ব তারপর সম্পর্কে জড়ালাম। গভীর ভালো লাগা আর ভালোবাসায় বুঁদ হয়ে রইলাম। আমি দীঘির স্বচ্ছ জলের মতো ওর কাজল কালো আঁখির দিকে চেয়ে থাকতাম। ঐ চোখে যেন সব প্রেম জমে আছে। মনে হচ্ছিলো আমি সারাজীবন ঐ কাজল কালো চোখের দিকে তাকিয়ে জীবন পার করতে পারবো। সেই থেকে নিহারের সাথে ভালোবাসার নৌকায় পাল উড়িয়ে দিলাম। শিক্ষকদের কড়া নিয়ম কানুন নাই। বাবা মায়ের শাসন থেকেও কিছুটা মুক্ত। তাই বাঁধাহীনভাবে নিহারের সাথে বাঁধভাঙ্গা উচ্ছাসে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। টিএসসি রমনার বটমূল মাওয়া ঘাট আহসানমঞ্জিল আবার কখনও সিনোপ্লেক্সে মুভি দেখে সময় পার করতে লাগলাম। কখনও বৃষ্টিভেজা শীতল দুপুরে ওর সাথে হুটখোলা রিকশায় ঘুরে বেড়াতাম। সবই ঠিকঠাক চলছিলো। অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বাসা থেকে আব্বু আম্মু বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। আমিও নিহারকে ওর প্যারেন্টসদের সাথে কথা বলতে বললাম। ও বলছি বলবো বলে আমাকে ঘুরাতে লাগলো। একদিন রেগে গিয়ে ওকে বললাম,
“তোমার মতলবটা কি? তুমি কি আমাকে আসলেই বিয়ে করতে চাও নাকি চাও না? নাকি আমি তোমার কাছে সময় কাটানোর অনুসঙ্গ ছিলাম।”
ও আমার কথাগুলো শুনে বললো,
—-আমার একটা বিষাদের অতীত আছে। যা জানলে তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাইবে না।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
—এই পাঁচ বছরের সম্পর্কে তুমি তো আমাকে কখনও বলো নাই?
—–তোমাকে হারানোর ভয়ে বলি নাই।
—-তবে আজ কেন সেই বিষাদের অতীতকে টানছো?
—-এখন তো বলতেই হবে। তা,না হলে তোমাকে কিখবা তোমার পরিবারকে ঠকানো হবে।
আমি ওর কথা শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললাম,
—-আমি তোমার সেই অতীত জানতে চাই না। তুমি বরং তোমার প্যারেন্টসদের সাথে বিয়ের বিষয়টা ফয়সালা করো।
—-এতিম খানায় বেড়ে উঠা এই আমি বাবা মা কোথায় পাবো?
আমি প্রথমে খুব অবাক হলাম। তাইতো এই বিষয়টা ও আমাকে আগেই জানাতে পারতো। পরে মনে হলো আমি তো ওকে ভালেবেসেছি। সুতরাং ওর জন্ম নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নাই। তারপরও কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
—-তুমি পড়ালেখা করার খরচ কিভাবে যোগাড় করতে?
—-আমার দত্তক মা বাবা আমাকে পড়িয়েছেন।
—-তাহলে তো কোনো সমস্যাই নাই। মা বাবা মানেই মা বাবা। উনারাই তো তোমার বিয়ের ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে পারেন।
—-কিভাবে মিটাবেন? উনারাও তো না ফেরার দেশে আলে গিয়েছেন। আমার এইচএসসি পরীক্ষার দুমাস আগে দুজনেই চলে যান। বাবা স্ট্রোক করে মারা গিয়েছেন। আর মা হার্ট এট্যাক করে মারা গেছেন। ঢাকায় আমার বাবার নিজের বাড়ী ছিলো। উনারা মারা যাওয়ার সাথে সাথে আত্মীয়স্বজন সেই বাড়ীর উপর হামলে পড়ে। বিশেষ করে মামা খালারা। কেননা বাবা আগে মারা যাওয়াতে চাচারা সম্পত্তি পাবেন না। মা মারা যাবার পী আমি যেহেতু মায়ের গর্ভজাত সন্তান নই তাই আমি নাকি কোনো সম্পত্তি পাবো না। পরে জমিল দলিল ঘেঁটে দেখা গেল ঐ বাড়ির ফিফটি পার্সেন্ট আমার নামে লিখে দেওয়া আছে। এতে মামা খালারা খুবই শকড হলেন। যাই হোক অনেক কাহিনী করে ঐ বাড়ি বিক্রি করা হলো।বিভিন্ন পারপাসে আমার কাছ থেকে টাকা কেটে নিয়ে আমাকে চল্লিশ ভাগ প্রপার্টির টাকা দিলো। আমিও তাই নিয়ে সন্তষ্ট থাকলাম।
ওর এই বিষয়গুলো বাবা মাকে জানানোর পর উনারা বিয়েতে মত দিতে চাইলেন না। তবে আমার পিড়াপীড়ি তে বাধ্য হয়ে রাজী হলেন। ছ,মাস বপশ ভালোই চলছিলো। হঠাৎ নিহারের আচরন পরিবর্তন হতে থাকে। একটুতেই রেগে যেতো। ওর টাকা পয়সা খরচ করতে চাইতো না। আমাকেই ওর সব চাহিদা মেটাতে হতো। নতুন চাকরি বেতন বেশী ছিলো না। হিমশিম খেতাম। তারপরও চালানোর চেষ্টা করতাম। কিন্তু নিহার দিনে দিনে অসহিষ্ণু হতে শুরু করলো। এভাবে দুবছর পার হলো। এদিকে আম্মু বাচ্চা নেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। আম্মুর ধারণা বেবি হলে হয়তো আমাদের সম্পর্কটা ভালো হবে। কিন্তু নিহার রাজী হলো না। শেষেরদিকে আমাদের মারামারিও হতো। এসব দেখে আমরা আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নেই। এরমাঝে ও প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তারের শরনাপন্ন হলে জানতে পারি ওর জরায়ুতে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে। সে কারনেই ও আমার সাথে এরকম আচরণ করেছে যাতে ওকে আমি ডিভোর্স দেই।
—-আপনার সাথে উনার ডিভোর্স হয় নাই?
—–না,
—তাহলে আমাকে বিয়ে করলেন কেন?
—-ওর অনুরোধে তোমাকে বিয়ে করেছি। কারণ ওর কথা হচ্ছে ওর আয়ু তো ফুরিয়ে আসছে। সুতরাং আমার বিয়ে করে নেওয়াই ভালো। আমি রাজী হচ্ছিলাম না। কিন্তু ও আমাকে বলে, আমি বিয়ে না করলে ও আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে।যার ফলে আমাকে বিয়ে করতে রাজী হতে হলো। পাশাপাশি ওকে চিকিৎসা করানোর দায়িত্ব নিলাম। টাকা পয়সা ঐ খরচ করেছে। আমাকে শুধু ওর তদারকি করতে হয়েছে। যেদিন তোমাকে ডাক্তারের কাছে নেওয়ার কথা ছিলো সেদিন ওর অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। ওকে আইসিইউতে নিতে হলো। সেই থেকেই অজ্ঞান হয়ে আইসিইউতে আছে। জানি না কতদিন এভাবে থাকবে।
ছয়মাস পর_________
সব বৃত্তান্ত শোনার পর শেজাদের উপর আর অভিমান করে থাকেনি। নিহার অবশেষে মারা যায়। ওর মৃত্যুর পর ওর সব অর্থ এতিমখানায় দান করা হয়। এদিকে অহনার একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়। নিহার আর শেজাদের নামের সাথে মিল রেখে অহনা ওর নাম রাখে শানু। আসলে নিহারের জীবনের সব ঘটনা শোনার পর অহনার ওর জন্য খুব মায়া হয়। নিহারের মৃত্যুর পর শেজাদ ও অনেক পাল্টে যায়। অহনার প্রতি অনেক দায়িত্বশীল হয়ে উঠে। অনেক ভালোবাসে। অহনা জানে, শেজাদ কখনও ওর প্রথমপ্রেমকে ভুলতে পারবে না। বিশেষ করে যেই প্রেমের শেষ পরিনতি এতো করুণ তাকে তো কখনও ভোলা যায় না। কিন্তু অহনাকে শেজাদ আর কখনও অবহেলা করেনি। শেজাদের বাবা মারা যাওয়ার ফলে ওর দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়। একহাতেই মা, স্ত্রী, কন্যা, শাশুড়ী সবার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। অহনার ঘরটা যেন আজ সব দিক থেকেই ভালোবাসায় পূর্ণ।
সমাপ্ত