বিধুর রজনী পর্ব-২৮ এবং শেষ পর্ব

0
635

#বিধুর_রজনী
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২৮ ‘সমাপ্ত’ ]
___________________
৬৯.
অন্ধকার কক্ষে পা গুটিয়ে নিশ্চুপ বসে আছেন সম্রাজী আরওয়া।খোলা জানলার মাধ্যেমে চাঁদের আলো কক্ষে প্রবেশ করলেও পুরোপুরি কক্ষটায় আলোর প্রভাব ফেলতে পারেনি।অন্ধকার কক্ষে আরাম কেদায়ার গা এলিয়ে বসেছেন তাসবীর।তার মুখোমুখি পালঙ্কে সম্রাজী।অন্ধকারের মাঝেও তিনি নিশ্চুপ চেয়ে আছেন আরওয়ার পানে।সম্রাট তাসবীরের দৃষ্টির আড়ালের ব্যর্থ চেষ্টা নিয়ে আরো জড়সড় হয়ে যান সম্রাজী।অন্ধকারের মাঝেও তাসবীর যেন তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, আরওয়া ভয়ে ঢোক গিলে আকাশের চাঁদের আলো আজ যেন ঠিকরে পড়ছে তার কক্ষে।

” চাঁদের রূপ দেখছেন?ঝলসে পড়ছে।”

আরওয়া প্রত্যুত্তর করলো না।পালিয়ে যাওয়ার ভয়ে আজ নির্ঘাত তাসবীর তাকে শাস্তি প্রদান করবেন অথচ এই ছেলে কী না চাঁদ নিয়ে পড়েছে!

” এমন এক জোছনা রজনীতে আপনাকে খুঁজে পেয়েছিলাম সেদিন আপনার বিধুর মুখখানী দেখে আমার দুনিয়া থমকে যায়।আর আজ আবার একই পরিস্থিতিতে আপনাকে খুঁজে পেয়েছি।হারিয়ে যেতে চান কেন আরওয়া?”

আরওয়া চোখ তুলে তাকায় তাসবীরের পানে।হালকা বাতাসে তার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।তার সাথে তাসবীরের নরম কথার ভাজে ভয়টা তার শতগুনে বেড়ে চলেছে।

” ঘর ছেড়ে নিজের গায়ে কলঙ্কের দাগ কেন লাগাতে চাইছেন বেগমজান?”

” আমি পরপুরুষের হাত ধরে তো যাইনি।”

” সে কথা তো আর লোকে বুঝবে না।এবার অন্তত নিজের বুদ্ধি বিবেক কাজে লাগান।আমাকে হ/ত্যা করার ভয়ে পালিয়ে না গিয়ে বরং যারা ভুল কথা কানে ঢালছে তাদের এড়িয়ে চলুন।”

আরওয়া চমকে তাকায় তাসবীর কি করে জানলেন তাকে হ/ত্যার ভয়ে আরওয়া পালিয়েছে?সেদিন ফুফুমার শর্ত মানতে গেলে তাসবীরকে চিরতরে হারাতে হবে,অন্যদিকে তাসবীর প্রমাণ করতে ব্যর্থ সে নির্দোষ সব মিলিয়ে গোলকধাঁধায় পড়েছিলেন আরওয়া।নিজেকে সবটা থেকে মুক্তি দেওয়ার লোভে রাতের আঁধারে পালিয়ে যান তিনি।

” আমাকে বিশ্বাস করলেন না মেনে নিলাম নিজের ভাইকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়?আপনার ভুলের জন্য আমি কিছুই বলবো না তবে এর শেষ আমি দেখেই ছাড়বো।”

আরওয়া ফুপিয়ে উঠে ক্লান্ত চোখে তাকায় তাসবীরের নিকট ।তাসবীর কেদারা ছেড়ে আরওয়ার নিকট হাজির হয়।আরওয়ার কোলে মাথা রেখে চাপা ক্রোধ নিয়ে চেপে ধরে তার থুতনি।

” আগেই বলেছিলাম আপনাকে ক্ষমা কর‍তে করতে না আবার আমি ক্লান্ত হয়ে যাই।আপনার জীবনে এটাই শেষ সুযোগ দুঃসাহসিক নামক আপনার এসব বেপরোয়া বিষয়গুলো আমি মোটেও আর সহ্য করবো না”

” আপনাকে সহ্য করতে হবে না।আমি বড্ড ক্লান্ত বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ দিন।এই মুহুর্তে মোটেও কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।শুভ রাত্রি।”

তাসবীরকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পালঙ্কে মাথা ঠেকলেন সম্রাজী আরওয়া।গায়ে চাদর টেনে আড় চোখে তাকালেন তাসবীরের পানে।মানুষটাকে কি রেগে গেছে?নাকি হতভম্ব রূপে চেয়ে আছে তার দিকে কে জানে!
৭০.
নিজের মনের বিরুদ্ধে কাজ করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।অন্যের বুদ্ধিতে পিছলে যাওয়ার চেয়ে নিজের বুদ্ধিতে মiরে যাওয়া ঢের ভালো।সম্রাজ্ঞী বিনিতার কক্ষে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে লতাকে নিয়ে উপস্থিত হন রাজসভায়।নিজেকে আড়ালে রেখে সম্রাট তাসবীরকে দেখছিলেন আরওয়া।আজ সম্রাটের মেজাজ বেজায় গরম।সভাসদগন সতর্কতার সহি নিজেদের আলাপ-আলোচনায় মশগুল।

” এখান থেকে চলুন আপা সম্রাট কেমন যেন রেগে আছে।”

” চুপ করো লতা।তিনি কেন রেগে আছেন সেটা তো বুঝতে হবে আমাকে।”

” এখান থেকে কীভাবে বুঝবেন আপনি?সম্রাট তো বলেই দিয়েছে আপনি কখনো সভাসদস্যদের সামনে যাবেন না।চলুন চলুন.. ”

লতা হাত টেনে নিয়ে চলে যায় আরওয়াকে।সারাদিন কাটিয়ে সম্রাট তাসবীর উপস্থিত হন রাতে।আরওয়া তখন আরশির সম্মুখে বসেছিলেন সুগন্ধি গায়ে মাখিয়ে ঘুরে তাকান তাসবীরের নিকট।তাসবীর কাতর চাহনী নিক্ষেপ করে পালঙ্কে ছিটকে পড়েন সহসা।

” সম্রাট মশাইয়ের কি শরীর খারাপ লাগছে?”

” না।”

” তবে আজ রেগে আছেন কেন?কি হয়েছে?”

” আগে এটা বলুন লুকিয়ে লুকিয়ে আমায় দেখে কি পান?”

আরওয়া চমকে তাকায় আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে রয় পালঙ্কের কাছে।তাসবীর তার হাত টেনে বসিয়ে দেন পালঙ্কে।

” আপনি ভেবেছিলেন আমি জানি না?যতদিন যান প্রত্যেকদিন আমি আপনাকে স্পষ্ট দেখতে পাই তবে বুঝতে দি না।এভাবে আর সবার সম্মুখে যাবেন না বেগম।”

” আগে বলুন আপনি রেগে ছিলেন কেন?”

তাসবীর নড়ে চড়ে বসে হতাশার শ্বাস ছেড়ে বলে,

” সেসব আপনার না শুনলেও চলবে শুয়ে পড়ুন।”

” এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন তাসবীর?আপনার চোখে মুখে হতাশার রেশ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।”

” একজন দাসীর নগ্ন দেহ প্রাসাদের পেছনে পাওয়া গেছে।মেয়েটার সাথে কোন নরপশু ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছে।তার করুন পরিস্থিতি দেখে আমার বার বার আলোর কথা মাথায় আসছে আহমেদাবাদ প্রাসাদে কার এমন দুঃসাহস হবে?প্রাণের ভয় থাকলে কেউ নিশ্চয়ই এমন কাজ করতো না।”

” ঘটনা কি প্রাসাদের কেউ করেছে নাকি বাইরের কেউ।”

“তা নিয়ে তদন্ত চলছে।পিতামাতার এই সম্পর্কে কিছু জানে না।আপনি দয়া করে এসব সম্পর্কে কিছু বলবেন না কাউকে।আমার বর্তমানে প্রাসাদে ব্যভিচার ভাবতেই নিজেকে অযোগ্য মনে হচ্ছে।”

আরওয়া হতভম্ব চোখে চেয়ে রয় তাসবীরের পানে।ইবনুল রাশীদের কথা মাথায় আসতে নিজেকে সংযত করে নেয় সে।

” ইবনুল রাশীদের খোঁজ পেয়েছেন?”

” সত্যি বলতে কেউ কেউ ধারণা করছেন ইবনুল রাশীদ বেঁচে নেই।তাকে এখনো খুঁজে চলছে আমার দল আর মেসবাহ’র দল।”

৭১.
মহলের শেষ কোনে কিছু কক্ষ তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে।কক্ষগুলো ব্যবহার না হওয়ায় এদিকটা মানুষজনের আনাগোনা কম বলা চলে।দাস-দাসীরা মাঝে মাঝে এসে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে যান।ইদ্রীস রাশীদ একা অবসন্ন সময় পার করছেন নিজের কক্ষ ছেড়ে সারাটা মহল ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নেন।গতকাল তাসবীরের মুখ থেকে দাসী হত্যার বিষয়টি জানতে পেরে মনটা আরো অবসন্ন হয়ে উঠেছে।কিন্তু বর্তমানে বেঁধেছে দারুন বিপত্তি একটি কক্ষের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পিতলের দ্বার পেরিয়ে ইদ্রীসের কানে উপস্থিত হয়েছে একটি মেয়ের চিৎকার।বদ্ধ কক্ষে কারো চিৎকার পাওয়া যেন বিপদ সংকেতের মতো ঠেকলো ইদ্রীসের কাছে।কক্ষের বাইরে সরু গলিটায় পরখ করে দুইজন দাসকে দেখতে পেয়ে ছুটে যায় ইদ্রীস।

” এই কক্ষ বাইরে থেকে বন্ধ করা কিন্তু ভেতরে কোন মেয়ের চিৎকার পাওয়া যাচ্ছে।”

” ক..কি বলছেন মশাই এখানে মেয়ের চিৎকার আসবে কেন?”

” আরে আমি স্পষ্ট শুনেছি।দ্রুত দ্বার খোলার ব্যবস্থা করুন।”

” দ.দ্বার খুলতে যে চাবির প্রয়োজন।”

” সেটা আমিও জানি চাবি নিয়ে আসুন।”

” ঠিক আছে।”

দুজন দাস উলটো পথে হাটা শুরু করে।তারা ইদ্রীসকে মিথ্যা বলে তাদের জান নিয়ে পালায়।এই মুহুর্তে দ্বার খোলা মানে নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনা।এর পেছনেও রহস্য আছে।

একে একে পেরিয়ে যায় সময় দাসদের আসতে না দেখে ইদ্রীস নিজেই দ্বার খোলার চেষ্টা চালায়।ততক্ষনে কক্ষের ভেতর থেকে দ্বারের করাঘাত শব্দে ইদ্রীস নিশ্চিত হয় ভেতরে কেউ আছে।লোহার দন্ড নিয়ে মরিচা ধরা কুলুপে বেশ কয়েকবার আঘাত করতেই অতিদ্রুত কুলুপটি খুলে যায়।ইদ্রীস রাশীদ অতিদ্রুত পিতলের দ্বার ঠেলে কক্ষের ভেতর প্রবেশ করেন চোখের সামনে সহসা ভেসে উঠে লতার অর্ধ নগ্ন দেহ।চোক্ষু লজ্জায় চোখ সরালেন তিনি, তবে তীব্র ক্রোধে পাশে তাকাতে ন্যাড়া মাথার ব্যক্তিটিকে দেখে প্রথমে না চিনলেও পরবর্তীতে চোখ দেখে সহজে চিনে ফেলেন কক্ষে কাঙ্ক্ষিত সেই ব্যক্তি ইবনুল রাশীদের উপস্থিতি।লতা লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিজের দেহ আবৃত করতে ব্যস্ত ততক্ষনে ইবনুল পেছন থেকে লতার চুল টেনে ধরেন।তীব্র ব্যথায় চেচিয়ে উঠেন লতা।

” ভাইজান আপনি?ল..লতাকে ছেড়ে দিন ভাইজান।”

” ছাড়ার জন্যে তো ধরিনি।কত বছরের তেষ্টা মেটানোর বাকি আমার। একমাত্র আরওয়ার কারণে লতাকে এক রাতের জন্যেও কাছে পাইনি।”

” লতাকে সর্বদা বোনের চোখে দেখেছি নিজের ছোট বোনের মতো আপনি এসব কি বলছেন ভালো ভাবে বলছি লতাকে ছেড়ে দিন।”

ইবনুল ক্রোধ নিয়ে হাতে থাকা পিতলের ফুলদানি ছুড়ে মারলো ইদ্রীসের মাথায়।আকস্মিক আক্রমণে নিজেকে বাঁচাতে ব্যর্থ হলেন তিনি।মাথা ফেটে রক্ত ততক্ষণে গড়িয়ে পড়ছে জুলপি বেয়ে।লতা নিজের শরীর ঢাকতে ব্যস্ত ইবনুলের হাত থেকে রক্ষা পেতে একের পর এক পালটা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে সে কিন্তু বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী ইবনুলের সাথে পেরে উঠা চারটেখানি কথা নয়।ইদ্রীসের হাতে কাছে পড়ে থাকা লোহার দন্ডটি তুলে ইবনুলের মাথায় আঘাত করে যার ফলে ছিটকে সরে যায় সে।লতা সেই সুযোগে গুটিয়ে দাঁড়ায় ইদ্রীসের পাশে,

“আপনার পিতাকে আপনার বড় ভাই হত্যা করেছেন।ফুফুমাকে মেরে ফেলেছেন তিনি পাশের কক্ষেই আছেন।আমি দেখে ফেলায় আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে আ..পানাকেও ছাড়বে না দ্রুত পালিয়ে যান।”

ইদ্রীস হতভম্ব চোখে তাকায় ইবনুলের পানে।মাথা ধরে মেঝেতে গড়াগড়ি করছে সে।লতার দিকে তাকিয়ে তীব্র ক্রোধে বলে,

” খা** মা*** তোরে বাঁচায় কে?”

ইবনুল উঠে দাঁড়ায় লতার গায়ে হাত তুলতে নিলে দুই ভাইয়ের মাঝে হাতাহাতির সৃষ্টি হয়।তাদের রক্তারক্তি পরিস্থিতি বেগতিক দেখে উঠে দাঁড়ায় লতা এ পরিস্থিতি বেশিক্ষণ চলতে দেওয়া যাবে না।

৭২.
লতাকে পাওয়া যাচ্ছে না দীর্ঘক্ষণ বিষয়টা বড্ড ভাবিয়ে তুলেছে আরওয়াকে।গতকাল দাসী মৃত্যুর ঘটনাটি ভাবতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে তার।চারদিকে সবার কাছে লতার খোঁজ জানতে চেয়েও যখন পেলনা তখন সারা মহলে লতাকে খুঁজতে খুঁজতে মহলের শেষ কোণে উপস্থিত হন আরওয়া।ভেজানো দ্বারের ভেতর থেকে শোরগোলের শব্দে দ্রুত সেখানে প্রবেশ করেন তিনি।আরওয়া রক্তাক্ত দুই ভাই এবং অর্ধ নগ্ন লতাকে দেখে স্তম্ভিত।আরওয়াকে দেখতে পেয়ে লতা ছুটে চলে যায় তার কাছে।মেয়েটা দিশাহীন চোখে নিজের গায়ের চাদর ছেড়ে লতার গায়ে জড়িয়ে দেন।
ততক্ষণে ইদ্রীস রাশীদ রক্তাক্ত হয়ে মেঝেতে ছিটকে পড়েন।লতা খুবলে ধরেন আরওয়ার হাত,

” ফুফুমা বেঁচে নেই আপা।ইবনুল ফুফুমাকে মেরে ফেলেছেন।”

” ক..কি!”

” আপনার বাবার হত্যাকারী ইবনুল রাশীদ গতরাতে যে দাসীর লাশ পাওয়া গেছে তাকেও ইবনুল হত্যা করেছে।”

ইবনুল ভেতর থেকে পিতলের দ্বার অতিদ্রুত রুদ্ধ করে।লতার কথায়
আরওয়া শিউরে উঠে লতাকে কিছু বলার আগেই ইবনুল পেছন থেকে আঘাত করেন লতাকে।দুঃসহ ব্যথায় মেঝেতে ছিটকে পড়েন লতা।ইবনুল ততক্ষণে আরওয়ার চুল খামছে ধরে,

” যার কারণে রাজ্য হারালাম তাকে বিয়ে করে রঙ্গ লীলায় মত্ত ছিলি।তোর কারণে আবু তাসবীর বেঁচে ছিল, না হলে সেদিনি দুশমনের শেষ দিন হতো।”

” তিনি দুশমন না ভাইজান দুশমন আপনি।আমার পিতামাতা ঘরে কালসাপ পুষেছেন।”

” তুই তো কালনাগিনী।তোর কারনে তাসবীর এতদূর এসেছে।”

” আপনি তার বোনের সাথে এত জঘন্য কাজ কি করে করলেন?একবারো বিবেকে বাধলো না আপনার?”

আরওয়ার কথায় যেন বেশ মজা পেয়েছে ইবনুল।দূর্বল শরীর নিয়ে গা দুলিয়ে হেসে বলেন,

” বিবেক?সেটা আবার কি।হা হা হা!”

” পিতাকে কেন মেরেছেন?পাতালে প্রবেশ কি করে করেছেন তাসবীর যদি ঘুনাক্ষরে টের পেতো তবে সেদিন আপনার শেষ দিন হতো।”

” খাবারে বিষ মিশিয়ে মেরেছি এই দুনিয়াতে তার থাকার প্রয়োজন নেই।তিনিও সর্বশেষ তাসবীরের দাসত্ব স্বীকার করেছেন।আমার প্রতি নাকি তার ঘৃণা জন্মে গেছে এবার দিলাম পরকালে পাঠিয়ে।”

” ফুফুমার অন্যয় কি ছিল?তা…”

” কাউকে বাঁচতে দেব না কাউকে না।একে একে সবাইকে মেরে তোর আর তাসবীরের সম্পর্ক ছিন্ন করার চেষ্টা করেছি এই রাজ্য জয়ের লোভ আমার আজীবন ছিল আর এখনো আছে এই রাজ্য আমার হবেই।”

” আমি বেঁচে থাকতে হবে না ভাইজান।”

” তোকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন নেই।”

নিষ্ঠুর ইবনুল আরওয়ার চুল ধরে মাথা ঠুকে দেয়ালের সঙ্গে একের পর এক প্রহার করে চলছে।রক্তাক্ত ইদ্রীস এবং লতা পিট পিট চোখে চেয়ে আছে আরওয়ার পানে।কিছু করতে চেয়েও তারা ব্যর্থ।আরওয়া নিজের জান বাঁচাতে কৌশল খাটানোর চেষ্টা চালায় ঝাপসা চোখের আড়ালে বার বার ধরা দিতে থাকে তাসবীরের মুখচ্ছবি।দেয়ালে রক্ত ছিটকে বীভৎস পরিস্থিতি।নিজের প্রাণ বাঁচাতে আরওয়া দেয়ালে সজ্জিত থাকা শানিত তরবারি হাতে তুলে নেয়।ইবনুলের ডান বাহুতে আঘাত করতে ছিটকে দূরে পড়ে যায় সে।

পরিস্থিতি এতটাই ঘোলাটে হয়েছে যে ইবনুলের প্রতি জমানো মায়া দরদ অনেক আগে কেটে গেছে।তবে আজ যা হলো বাদ বাকি সকলের জান বাঁচাতে ইবনুল রাশীদের শাস্তির প্রয়োজন।ইবনুল যখন মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল তখন শানিত তরবারি হাতে অল্প অল্প পায়ে এগিয়ে আসেন আরওয়া।ইবনুল মাথা ঘুরে তাকাতে রক্তাক্ত আরওয়ার মুখে হাসি দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন।

” আমার হাতে সর্ব প্রথম তরবারি আপনি তুলে দিয়েছিলেন ভাইজান।সেই ছোটকাল থেকে শিখিয়েছেন রাগ, জেদ,মানুষের রক্ত ঝরিয়ে কি করে আনন্দ লুটতে হয় কখনো কাউকে ভালোবাসতে শিখিয়ে দেননি।আজ শেষ বারের মতো আপনার রক্ত ঝরিয়ে আনন্দ লুটবো।”

” আরওয়া……”

চোখের পলকে থেমে গেল ইবনুলের কণ্ঠ ইদ্রীস এবং লতা হতভম্ব চোখে তাকিয়ে দেখছে সবটা।কি হলো?কি।হয়ে গেল?শানিত তরবারির সাহায্যে আরওয়া যখন ইবনুলের শিরশ্ছেদ করলো তখন লাগামহীন রক্ত ছিটকে ছড়িয়ে পড়লো আরওয়ার মুখে
সারাটা দেহ তখন রক্তে রঞ্জিত।দুই হাত দূরে ছিটকে পড়লো ইবনুলের কা~টা মাথা।রক্তাক্ত মুখে যখন খিটখিটে হাসছিল আরওয়া তখন তার মুখের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলো ইদ্রীস নিজের পাশে তাকিয়ে লতার অচেতন মুখখানী দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি।

৭৩.
প্রতিদিনের ন্যায় আজকেও রাজসভা বসেছে।আজকের সভায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে উজির মশাইয়ের সঙ্গে আলোচনায় বসেন সম্রাট তাসবীর।সকল প্রহরী সহ দাস-দাসীদের এক এক করে প্রাসাদের মাঠে জড়ো করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এর পেছনে অবশ্য কারণ আছে দাসী হত্যার আসল হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ সেনাপ্রধান।তাই তো পরবর্তীতে এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা যেন না ঘটে তার জন্য আগাম সর্তক হচ্ছেন সকলে।রাজসভায় যখন সবাই সম্রাট তাসবীরের বক্তব্য শুনতে ব্যস্ত ঠিক সেই সময় ঘটলো এক অবিশ্বাস্য ঘটনা।রক্তাক্ত মুখ,দূর্বল শরীর টেনে এগিয়ে আসলেন সম্রাজী আরওয়া।সম্রাট তাসবীরের সহিত বিবাহের পর থেকে কখনো মহলে সভাসদস্যগন সম্রাজীর মুখ দর্শনের সুযোগ পাননি।আজ সকলে অদ্ভুত বেশে সম্রাজীকে দেখে পিলে চমকে উঠলেন।এলোমেলো চুলে রক্তাক্ত মুখ নিয়ে তাসবীরের নিকট ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সম্রাজী আরওয়া।তাসবীরের নিকট সেই মুহুর্তেরা কেমন যেন ছিল তার পা মাটির সঙ্গে কেউ যেন বেঁধে দিয়েছে।বসা থেকে সম্রাট উঠে দাঁড়াতে তার সাথে বাকি সদস্যগন দাঁড়িয়ে পড়লেন।সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলেন সম্রাজীর নিকট।সম্রাজী আরওয়ার হাতে থাকা উত্তরীয়’র সাহায্যে বাঁধাই করা পুটলি থেকে চুইয়ে চুইয়ে সারাটা মেঝেতে রক্ত পড়ছিল।তার পেছন পেছন কয়েকজন দাসী এগিয়ে আসছিল কিন্তু তারা সভাসদস্যদের সামনে না গিয়ে অর্ধ পথে থেমে যায়।আরওয়া হাটু ভেঙ্গে বসে পড়ে তাসবীরের পায়ের কাছে।

” আমায় শেষ বারের মতো ক্ষমা করুন সম্রাট মশাই।”

জড় বস্তুর ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলেন তাসবীর।সভাসদস্যগন যেন থমকে গেছে আজ।

” আপনাকে অবিশ্বাস করার জন্য আপনার সর্বোচ্চ ভালোবাসা মর্যাদা পেয়েও আপনাকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য।আমাকে শেষ বারের মতো ক্ষমা করুন সম্রাট।”

” আরওয়া উঠে দাঁড়ান কি হয়েছে আপনার?”

তাসবীর ব্যস্ত পায়ে আগলে ধরতে চাইলেন আরওয়াকে কিন্তু আরওয়া তাসবীরকে হাত ইশারায় থামিয়ে দিলেন।

” আমার কথা শেষ হয়নি সম্রাট।আমি আমার পিতার হত্যাকারীকে পেয়েছি, আলোর হত্যাকারীকে পেয়েছি আমি ভুল ছিলাম সম্রাট।”

” পেয়েছেন মানে?ইবনুল রাশীদ কোথায় আমি তাকে আমার সামনে চাই।”

তাসবীর জোরালো সুরের কথায় ঠোঁট বাকিয়ে হাসলেন সম্রাজী।

বাঁধানো পুটলিটা খুঁলে কাঁপা কাঁপা হাতে ইবনুলের কাটা মস্তক উপস্থাপন করলেন তাসবীরের পায়ের নিকট।রক্তাক্ত ন্যাড়া মস্তক দেখে ছিটকে সরে গেলেন তাসবীর।রক্তে তার পা ভেসে যাচ্ছে।

” আপনার পায়ের নিকট জা/নো/য়ার ইবনুল রাশীদের কাটা মাথা।”

সভাসদস্যদের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি হলো।সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে একবার একবার দেখে নিলেন ইবনুলের কাটা মাথা।এরি মাঝে উপস্থিত সম্রাট সিদ্দীক এবং সম্রাজ্ঞী বিনিতা।আরওয়ার শোচনীয় অবস্থা দেখে তারা বিচলিত চোখে তাকিয়ে আছে।
তাসবীর তার দু’চোখ বন্ধ করলেন আরওয়ার দুঃসাহসিক কাজ আঁচ করতে পেরে ভয়ে অন্তরটা কেঁপে উঠলো।

” সবার সমস্ত ক্ষোভ আমি মিটিয়ে দিয়েছি আর কখনো দুঃখেরা এই রাজ্য ছুঁয়ে দেবে না।কোন নারী ব্যভিচারে মৃত্যু বরণ করবে না।কোন পুত্র পিতার গায়ে আঘাত দেওয়ার আগে এ দিনের কথা ভাববে।ইবনুল রাশীদের সমাপ্তি এখানেই।”

” আপনি তার শিরশ্ছেদ করেছেন?”

” আমি করেছি।ফুফু মা বেঁচে নেই সম্রাট আমার ফুফু মা মারা গেছেন।ফুফু মায়ের প্রিয় ভাইপো ছিল ইবনুল রাশীদ অথচ প্রিয় ভাইপোর হাতেই তার প্রাণ গেল!আমার পিতার সবচেয়ে কাছের সন্তান ছিল তার বড় পুত্র আর সেই বড় পুত্র দিনের পর দিন তাকে আড়ালে ঠকিয়ে গেছে তিনি তা বুঝতেই পারেনি।লতাকে আমি বোনের নজরে দেখেছি আজ লতার ইজ্জতে আঘাত হেনেছেন ইবনুল রাশীদ।ছোট ভাইজানকে মারাত্মক প্রহার করেছেন অল্পের জন্য আমিও বেঁচে ফিরেছি বাকি সিদ্ধান্ত আপনার আপনি নিজেই জানেন কি করতে হবে।আমি ক্লান্ত মানসিক শারিরীক উভয় দিকে আমি ক্লান্ত আমার আর কেউ নেই আমার এবার বিশ্রামের প্রয়োজন।”

রক্তাক্ত শরীর টেনে সিংহাসন ছেড়ে নেমে গেলেন আরওয়া।তাসবীর স্তব্ধ চোখে সবটা দেখছে শরীর তার বড্ড কাঁপছে।

৭৪.
শরাব পানের নেশায় নিজেকে মত্ত না রাখলেও যার নেশায় সারাটা দিন পেরিয়ে রাত গড়ায় সম্রাটের তিনি হলেন তার প্রিয়তমা স্ত্রী আরওয়া নূর।মানসিক শারীরিক উভয় শান্তির স্থল তার নিকট আরওয়া।যুদ্ধ,রাজ্য জয়,একের পর এক হত্যাকান্ডে যেখানে রাজপুত্রেরা মত্ত সেখানে আবু তাসবীর সম্পূর্ণ ভিন্ন।একটা সময় সিংহাসনে গেড়ে বসেছিলেন পিতার অসুস্থতায় এবং এরপর ইবনুলের শাস্তির অপেক্ষায়। সময়ের তালে তিনি দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে আসেন।তার নেশা কবিতার ছন্দে তার নেশা ক্যানভাসের সাদা মনে রঙের মেলা সাজাতে।তার প্রিয় ঘোড়া তারিমকে সাথে নিয়ে একেরপর এক গোপন পরিচয়ে রাজ্য ঘুরে যাযাবর বেশে দিন কাটাতে।তবে সবচেয়ে বড় নেশা যে নেশা তাকে বার বার কতল করে আর তা হলো প্রিয়তমার নেশা।মেয়েটা তাকে প্রতিনিয়ত কতল করে যায় তবে তরবারিতে নয় তার মায়াবী চোখের ইশারায়, অদেখা ভালোবাসার ভুবনে তাকে নিয়ে প্রতিনিয়ত হারিয়ে যায়।

ইবনুলের মৃত্যুর পরবর্তীতে আবু সিদ্দীক পুণরায় সিংহাসন আরোহণ করেন।আগের ন্যায় আহমেদাবাদ রাজ্যে সুখ শান্তির যেন ঢ্ল নেমেছে।

অলকপুরী রাজ্যের সম্রাট ঘোষণা করা হয় ইদ্রীস রাশীদকে।পিতা আব্বাস রাশীদের পুত্র ইদ্রীস রাশীদ একথা ভাবতেও যেন সকলে অবাক হন।কেননা পিতা যতটা বর্বর,অত্যাচারকারী সম্রাট ছিলেন পুত্র ততটাই উদার।আরওয়ার সহচর লতাকে দেওয়া হয়েছে উত্তম স্থান।ইদ্রীস তাকে ছোট বোনের ন্যায় আগলে রাখেন,আরওয়াকে নিয়ে ঠিক যত টা আদর যত্নের আয়োজন ছিল লতাকে নিয়েও ঠিক তেমনটাই চলছে। একজন রাজকন্যার ন্যায় জীবন পাওয়ার পরেও নিজেকে সাধারণ ভাবে উপস্থাপণ কর‍তে পছন্দ করেন লতা।সবচেয়ে বড় কথা তার জন্য রাজ্যের নানান প্রান্ত থেকে শাহজাদাদের বিবাহের প্রস্তাব আসছে লতার জন্য উত্তম পাত্র খুঁজতে ব্যস্ত সম্রাট ইদ্রীস রাশীদ।

বলিষ্ঠ দেহের মাঝে চাপা পড়ে থাকা আরওয়ার নিত্যদিনের ঘটনা বলা চলে।আজকেও তার পরিবর্তন হয়নি।বেলা হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ তাসবীরের কাছ থেকে তার নিস্তার নেই।মুক্তির লোভে তাসবীরের গায়ে আঁচড় কাটেন আরওয়া কিন্তু তাতে কি লাভ?তাসবীর তো নড়ে চড়ে ঠিকি তাকে জড়িয়ে শুয়ে আছে।ঘুম ছাড়া বাকি দুনিয়ার কোন কর্মকান্ডে যেন তার মন নেই।

” আমার কথা শুনবেন না তাই না?কতবার যে ডেকেছি আপনাকে।”

” কি বলবে?সেই তো একই কথা এবার ছাড়ো তাই তো?”

” আপনি বলেছিলেন আমায় নিয়ে চলে যাবেন?কিন্তু কবে যাবেন তাসবীর?চলুননা তারিমকে নিয়ে আমরা হারিয়ে যাই ঘুরে ফিরে জীবনটা ঝামেলা মুক্ত করি।”

” আমাদের জীবনে তো ঝামেলা নেই।আমরা ঝামেলাহীন দুই প্রাণি।ইদ্রীসকে বলা আছে তারা আজকে আসবে।”

” ভাইজান আসবে কেন?”

” আগামী প্রত্যুষে আমরা বেরিয়ে পড়বো অজানায়।”

” তার মানে সত্যি আমরা মুক্ত পাখির ন্যায় উড়বো আপনি দেখবেন আমাদের জীবনটা রূপকথার গল্পের মতো সুন্দর হবে।”

” সুন্দর হতেই হবে আমার পাশে তুমি আছো যে।”

সময়টা পেরিয়ে গেল।অবশেষে কাঙ্ক্ষিত সময় ধরা দিল অরওয়ার নিকট।কিছুক্ষণ বাদে সে বেরিয়ে পড়বে তাসবীরের সঙ্গে।আহমেদাবাদ কিংবা অলকপুরীতে তারা কবে ফিরবে নিজেরাও জানে না।হয়তো অনেক বছর পর আবার হয়তো মনের টানে ফিরেও আসতে পারে।লতা আরওয়ার বুকে মাথা রেখে বুক ভাসাচ্ছে।তার কান্নারা আজ বেসামাল তালে চলছে, আরওয়ার দূরত্ব সে মানতে নারাজ আরওয়ার সান্নিধ্য তাকে আনন্দ দেয় অথচ সেই আরওয়া চলে যাবে।ইদ্রীস বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বিদায় জানায়।সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘোড়া তারিমের পিঠে উঠে বসেন আরওয়া।তাসবীর মুচকি হেসে ঘোড়াম লাগাম ছাড়ে।দূর থেকে মনে হয় এক জোড়া সুখি কপোত-কপোতী যেন উড়ে চলছে লাগামহীন আনন্দচিত্তে।অপরদিকে মুক্ত পাখির ন্যায় দুই হাত চারিদিকে ছড়িয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠেন আরওয়া নূর।তাসবীর তার হাসি দেখছে,দীঘল কেশের সুঘ্রাণে উত্তাল হয়ে উঠেছে তার মন প্রাণ।

” আমার নূর, তুমি আমার সেই রজনীর একচিলতে আলো ছিলে এই আলো আমি অর্জন করেছি।তোমার বিধুর মুখখানী আমার প্রণয়ের ঢেউয়ে ভাসিয়েছে বারংবার।বর্বর অত্যাচারী শেহজাদী আরওয়া নূরের জীবনে ঢেলে দিয়েছি ভালোবাসার ফোয়ারা আমি তাকে অর্জন করেছি। এখন আমি একজন দিগ্‌বিজয়ী যোদ্ধা।”

আরওয়া মিহি হাসে।ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে চলা ঘোড়ার পিঠে বসে এতক্ষণ প্রকৃতিতে মত্ত থাকলেও তাসবীরের স্বগতোক্তি কথার সুরে ঘুরে তাকান আরওয়া।তাসবীরের শুষ্ক ঠোঁটের ফালিতে হাসির রেখা টেনে নিজের চিত্তচাঞ্চল্য ঠোঁট মিলিয়ে দিলেন চোখের পলকে।প্রথম ধাপে বেগতিক অবস্থায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেন তাসবীর তবে ফিরিয়ে দেননি আরওয়াকে সে সাধ্য তার নেই।প্রিয়তমার ঠোঁটের ভাজে ভাজে নিজেকে মত্ত রাখায় ক্রমশ উদ্দীপিত হয়ে উঠলেন তিনি।সময় পেরিয়ে গেল বেশ কিছুক্ষণ আহমেদাবাদের শেষ প্রান্তে এসে ঘটে যায় বিপত্তি মেসবাহ তার দলবল সহ দাঁড়িয়ে আছেন।ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেলেন আরওয়া।

” জনাব মেসবাহ এখানে কেন?”

” তা তো আমি জানি না।ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়ান আরওয়া।”

আরওয়া নেমে দাঁড়ালেন।ভয়ে তার বুক কাঁপছে আরওয়ার প্রতি সেদিনের অপমানের প্রতিশোধের জেদ মেসবাহ’র ছিল হয়তো এখনো জমা আছে।তবে কি তিনি প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বেন!

তাসবীর ঘোড়া থেকে নেমে এগিয়ে গেলেন মেসবাহ’র নিকট।মেসবাহ নিজেও ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন।

” কেমন আছেন জনাব তাসবীর?”

” আলহামদুলিল্লাহ। আপনি এখানে?”

” শুনলাম আগের মতো হারিয়ে যাচ্ছেন।কোথায় যাচ্ছেন ফিরবেন কবে তা তো জানি না তাই ভাবলাম দেখা করি।”

” ওহ শুনে খুশি হলাম।”

মেসবাহ এগিয়ে গেলেন আরওয়ার নিকট আরওয়া ভয়ে পিছিয়ে গেল।মেসবাহ তাতে মিহি হাসলেন।আরওয়া ভয় পাচ্ছে? এ যেন অদ্ভুত দৃশ্য তার কাছে।

” আপনি কেমন আছেন আরওয়া?”

” আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি।তবে আপনাকে দেখে ভালো থাকতে পারছি না।”

” পুরানো হিসেব মিটাতে এসেছি যে।”

” হিসেব!”

” আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন।তার ফলাফল আমি পেয়েছি।বর্তমানে আমি আমার পরিবার নিয়ে সুখী।আপনি সুখী তাসবীরকে নিয়ে আসলে আপনার আর আমার সম্পর্ক কখনোই এক হওয়ার না।প্রতিটি সম্পর্কে আগুন পানির যোজন বিয়েজন থাকে।সেদিক থেকে আপনিও আগুন আমিও আগুন অথচ তাসবীরকে দেখুন আপনার জন্য উত্তম জীবন সঙ্গী।”

” আমি আমার বর্তমান নিয়ে সুখে আছি সে কথায় দ্বিধা নেই।”

” জি আমিও মানি।ভালো থাকবেন আরওয়া।আপনার সাক্ষাৎ পাওয়ার ইচ্ছে আমার অনেক ছিল আজ পেয়ে আমি ধন্য।”

মেসবাহ এগিয়ে গেলেন তাসবীরের নিকট তার কাঁধে হাত রেখে অনুরোধ সুরে বলেন,

” আপনি আমার অনেক উপকার করেছেন তাসবীর।তার ঋণ কখনো শোধ কর‍তে হয়তো পারবো না।তবে আমার একটাই চাও অন্তত এক রাতের জন্যে হলেও আমার প্রাসাদে আপনাদের থাকতে হবে।”

” অবশ্যই একদিন হঠাৎ গিয়ে চমকে দেব এখন আসি?”

” আল্লাহ হাফেজ আবার দেখা হবে।”

তাসবীর আরওয়া পুণরায় ঘোড়া পিঠে ছুটে চলেন ক্ষিপ্রগতিতে।মেসবাহ দূর থেকে দেখছিলেন তাদের এ যেন রাজযোটক।
আরওয়া তাসবীর পথ পেরিয়ে গহিন জঙ্গলে ছুটে চলেন। সবুজ গাঢ় গাছগাছালির ফাঁকে যেন এক চিলতে সূর্যের আলো তাদেরকে চোখ রাঙিয়ে দেখছে এরা কে বা কারা?

তাসবীর তার ঘোড়া তারিমের লাগাম টেনে নেমে দাঁড়ান।জঙ্গলে ফুটে থাকা বুনোফুল নিয়ে আরওয়ার জন্য ফুলের মুকুট তৈরি করেন।আরওয়া তার কাজ সন্দিহান চোখে দেখে যায় শেষ পর্যায়ে তাসবীর যখন তার মাথায় ফুলের মুকুট পড়িয়ে দেয় তখন অবাক চোখে তাকিয়ে হেসে ফেলেন আরওয়া।তাসবীর কাতর স্বরে বলেন,

” আমার সম্রাজী আমার বেগমজান।”

” তবে আমাদের রাজ্য কোথায় সম্রাট মশাই?”

” এই যে এই জঙ্গল ধরে নাও আমাদের রাজ্য।”

” রাজ্য আছে,সম্রাট আছে, সম্রাজী আছে, কিন্তু শাহজাদা, শেহজাদী যে নেই!”

আরওহার লজ্জা মিশ্রিত কথার ভাজে আড় চোখে তাকালেন তাসবীর।কিঞ্চিৎ হেসে বলেন,

” একটু সময় একটু সুযোগ একটু অপেক্ষা হোক তবে শাহজাদা কিংবা শেহজাদী খুব শীঘ্রই তাদের পিতামাতার ভালোবাসার রাজত্ব দখলে আসবে।”

তাসবীর পুণরায় লাগামহীন ছুটে চললেন।আরওয়ার দিঘল চুল উড়ছে বাতাসের গতিতে।আরওয়ার প্রতিটি মুহুর্তে কানের কাছে কেউ যেন বলছে জীবন সুন্দর!যদি দুজনের চাওয়া পাওয়া এক হয় তবে এ জীবন সপ্নের মতো সুন্দর!”
_________সমাপ্ত________