বিনিদ্র রজনী পর্ব-১২

0
247

#বিনিদ্র_রজনী
#পর্ব_১২
#মুমতাহিনা_তারিন

যেহেতু শহর থেকে একটু দূরে থাকে তুলি তাইরাস্তায় তেমন জ্যাম দেখা যায় না তবে আজকে কোনো রাজনৈতিক সমাবেশে হবে সেজন্য বড় নেতা আসছে তাই অনেকটা পথ ব্লক হয়ে আছে । রিকশার উপর বসে আছে তুলি আর নিলয় । হাসপাতালে এসে ডাক্তার দেখিয়ে তারপর বাসায় যাচ্ছিল তারা । যদিও তুলি অনেক বারণ করছিল তাও নিলয় কোনো কথায় শুনে নে । অনেক্ষণ যাবত রিকশায় বসে আছে তারা প্রচণ্ড গরম তবে বাতাসের জন্য তেমন ভাবে গরমটা অনুভব হচ্ছে না। নিলয় নিজের মত গল্পঃ করে যাচ্ছে মাঝে মাঝে তুলি নিলয়ের এমন পাগলামো দেখে হাসছে আবার নিজে ও কিছু টুকিটাকি কথা বলছে নিলয়কে ।

” আচ্ছা একটু বস আমি আসছি ”

” কোথায় যাচ্ছো?”

” আসছি একটু অপেক্ষা কর খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবো ”

” আচ্ছা”

বর্ষাকালে খুব বেশি গরম পড়ে কিন্তু আকাশে মেঘ আর বৃষ্টির জন্য এই গরম থেকে বেঁচে যায় জনজীবন । নীল আকাশের দিকে তাকালো তুলি আকাশে উড়ে চলেছে কালো সাদা মিশেল মেঘ । ছোটবেলায় এমন মেঘ দেখে খুব ইচ্ছা হতো এই মেঘ গুলোতে উঠে সারা আকাশ ঘুরে বেড়াবো ,কিন্তু বড়ো হয়ে সব ইচ্ছাগুলো মাটি । ইসস যদি আরেকবার সেই ছোটবেলায় ফিরে যাওয়া যেত । সেই সোনালী দিন গুলো আরো একবার অনুভব করে আবার ফিরে আসত। তার এইসব ভাবনার মাঝেই রিকশা ওয়ালা মামার ফোনে বেজে উঠলো । সামনের গাড়িটা একটু সরে যেতেই সেই স্থান দখল করলো ম্যাম । ব্যাস্ত ভঙ্গিতে ফোন রিসিভ করলো ।

অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসা কথাগুলো তুলির কানে না লাগলেও রিকশা ওয়ালা মামার কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে,,,

” হ্যাঁ আমার মনে আছে ফুলির মা ,,,,সকালে উঠেই অমি আগে তোমাকে জানিয়েছে তুমি চিন্তা করো না আমি ফুলির জন্য সুন্দর খেলনা নিয়ে বাড়ি আসবো ”

……………

” হ্যাঁ তুমি কিন্তু ভালো ভালো রান্না করবে ,,আর একটু সাজবেও কালকে ফুলিকে নিয়ে ঘুরতে যাব আমরা তিনজন ”

……………..

“আচ্ছা তাহলে রাখি তুমি কিন্তু খেয়ে নাও আমি তাড়াতাড়ী আসার চেষ্টা করবো আল্লাহ হাফেজ”

এতক্ষন যাবত মামার কথা শুনে বুঝেছে ফুলি হয়তো মামার মেয়ে । তাদের কাছে এই কথোপকথন কত সাধারণ কিন্তু তুলির কাছে তাদের এই বার্তা বিনিময়টা অনেক বেশি মধুর মনে হলো । সব বাবারা নিজের সন্তানের জন্য কত কিছু করে । নিজের সব পরিশ্রম তাদের জন্য ,,নিজের শেষ সম্বলটুকুতে যদি সন্তানের খুশি লেখা থাকে তাহলে সেটা তাদের দিয়ে দিতেও কুন্ঠা বোধ করে না । অজান্তেই তার হাতটা পেটে চলে গেলো । তুলি যতই চেষ্টা করুক বাবার দেওয়া জায়গাটা কখনোই দিতে পারবে না তার সন্তানকে । একটু বড় হলেই তো তার কাছে তার বাবার সম্পর্কে জানতে চাইবে তখন কি করবে তুলি? কি বলবে নিজের সন্তানকে !

ভাবনার ছেদ ঘটালো নিলয়ের পাশে বসার শব্দে ,,, হাত ভর্তি চকলেট আর আইস ক্রিম নিলয়ের । যদিও খুব বেশি ও না তবে মোটামুটি অনেক ।

” এইযে কোথায় হারিয়ে গিলি?”

শান্ত দৃষ্টি ফেলে নিলয়ের দিকে তাকালো তুলি । উদাস তার চোখ জোড়া ,,,,কিছুক্ষন আগেই তো সব ঠিক ছিল আবার কি হলো বুঝতে পারলো না নিলয় । কিন্তু তুলির কাছে কিছু জিজ্ঞেস করলো না ,,মানুষের কিছু একান্ত কষ্ট থাকে যা কারোর সাথে বলা যাই না । সবুজ পলি থেকে আইস ক্রিম বের করে তুলির সামনে ধরলো ।

” এই নে খা ,,,তোর তো আইস ক্রিম খুব পছন্দের ছিল,,,”

” বাহ সব তো দেখছি মনে আছে তোমার ”

“হ্যাঁ আছে তুই জিজ্ঞেস কর আমি সব বলতে পারবো ,,,দেখিস ”

“আচ্ছা বলো তো আমার কোন ফুল ভালো লাগে?”

” এইটা তো ইজি ,,,,,পদ্ম ফুল”

” হয়েছে এবার পরের টা,,,”

তাদের কথা চলতে থাকলো আর রিকশাও তালে তালে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে । ঠান্ডা বাতাস ঘামে ভেজা শরীরে লেগে এক অদ্ভুত শিহরন তুলছে ।

_____________________

আদনান জ্যামে ছিল এতক্ষন আজকেও অফিস করে এই এলাকায় এসেছে । ওর দৃঢ় বিশ্বাস তুলি আসে পাশে কোথাও থাকে । তাই নদীর পাশে বানানো পার্কটা তে বসে সময় কাটাই ,,কখনো রাস্তার রং দোকানে বসে চা খাই ,,,রাস্তার যাওয়া আসা করা মানুষজন দের ভালোভাবে লক্ষ করে ,,,যদি কোনো ভিড়ের মধ্যে একবার তুলিকে দেখতে পায়।

গাড়ি গ্যারেজে পার্ক করে আজকে আবার তার প্রিয় টং দোকানে বসলো আদনান । মোটামুটি ভাবে এলাকাটা এখন তার পরিচিত হয়ে গেছে । টং দোকানে বসা অল্প বয়স্ক ছেলেটাও চিনে ফেলেছে আদনানকে । তার নাম রুবেল ,,, পারিবারিক টানা পোড়ানে জীবন এসে থেমেছে এই ছোট্ট টং দোকানে ,,, তাতে আবার গুন্ডা পান্ডা দের টাকা দিতে হয় এই স্বল্প আয়ের থেকে ,, বিকেলের এই সময়টা দোকান ফাঁকা থাকে সন্ধ্যা নামতে নামতে মানুষের ঢল নামে দোকানে ।

” ভাই আজকে তো আসতে একটু দেরি হয়ে গেল ”

” হ্যাঁ আজকে জ্যাম ছিল রাস্তায় তাই দেরি হয়ে গেল রুবেল,,,একটা কড়া লিকারের চা দাও তো চিনি একটু কম দিয়ো ”

কাচের কাপ গুলো গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নিল রুবেল তারপর কাপে চা ঢালতে ঢালতে আদনানের উদ্দেশে বলে উঠলো –

” প্রতিদিন এইখানে আসেন কেনো? তাও অত দূর থেকে! কষ্ট হয় না ….আপনাকে দেখে আমার হাই স্কুল এর জীবনের কথা মনে পড়ে ”

” আসি তোমার ভাবির খোঁজে ,,,,”

রুবেল মুচকি হাসলো ,, গরম গরম চায়ের মধ্যে দুই চামচ চিনি ঢেলে নাড়তে নাড়তে বললো ,,,

” ভাবি কি রাগ করে বাপের বাড়ি চলে এসেছে নাকি?

রুবেলের বাড়িয়ে দেওয়া চায়ের কাপ নিয়ে ঠোঁটে ছোঁয়ালো আদনান । না সেই স্বাদ আর কোনো চাতে পায় নি আদনান । তুলির সেই যত্ন মাখা চা,,,,

” অনেক বড় কাহিনী তবে এক কথায় বলতে গেলে আমার দোষ বেশি ,,,তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি এখন ফেরানোর জন্য ঘুরছি কিন্তু তার ঠিকানা নেই ,,,আমি জানি ও না সে ফিরবে কিনা ”

” হ্যাঁ ভাই আমাদের ছেলেদের এই এক সমস্যা আমরা নিজের বউদের বুঝি না ,,,আমার বাবাকে দেখতাম আম্মুকে খুব মারতো কিন্তু আম্মু সারাদিন পরের বাড়ি কাজ করে বাড়ি এসে রান্না করত আব্বুর যাবতীয় সব কাজ করে দিত ,,,তারপর আম্মু অসুস্থ হয়ে পড়লো আর আব্বুর টনক নড়ল ততদিন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে আম্মু কাউকে চিনত না এখন আর বেঁচে নেই আব্বু তো বোবা হয়ে গিয়েছে আম্মু মারা যাবার পর ”

রুবেল নিজের কথা শেষ করে মলিন হাসলো । সেদিকে তাকিয়ে নিজের মনে প্রশ্ন জাগলো আদনানের তুলিকে হয়তো শারীরিক ভাবে আঘাত করেনি কিন্তু মানসিক ভাবে!! মানসিক ভাবে তো প্রতিদিন ওকে কষ্ট দিয়েছে ।এক বুক ভরা আশা নিয়ে প্রতিবার আদনানের সামনে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তুলি আর প্রতিবার আদনান তাকে অপমান অপদস্ত করেছে । আর আজকে তাকেই খুজে চলেছে ,,,,

” আচ্ছা রুবেল তুমি তো এইখানে স্থানীয় তাই না সব চেনো? ”

” হ্যাঁ ,,,”

” একটা কাজে সাহায্য করবে আমাকে?”

” কি কাজ?”

” একটু খোঁজ নিয়ে বলতে পারবে এই খানে তুলি নামে কোনো মেয়ে আছে নাকি? প্রেগনেন্ট বুঝলে চার পাঁচ মাস আগে এইখানে আসছে ”

” ওহ এই কাজ সমস্যা নেই ,,,,আমি খোঁজ নিয়ে দেখবো চায়ের দোকানে মানুষ এসে কত আড্ডা দেয় দেখবেন আমার খোঁজা লাগবে না নিউজ আমার কাছে আরো চলে আসবে ”

চলবে ,,,,,