বিনিদ্র রজনী পর্ব-১৫

0
290

#বিনিদ্র_রজনী
#পর্ব_১৫
#মুমতাহিনা_তারিন

“আপনি আবার এইখানে কেনো এসেছেন?”

“প্যানিক করো না আমি আবার চলে যাবো এই ফল গুলো খেয়ে নাও”

তুলি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে আদনানকে দেখছে এতো ভালবাসা তার কিসের শুধুমাত্র নিজের সন্তানের জন্য? হ্যাঁ তাই হবে আমি তো বাসা থেকে এসেছি তিন চারমাস হয়ে গেছে এতদিন তো তার কোনো খোঁজ ছিল না যখনই শুনেছে আমার পেটে তার সন্তান বেড়ে উঠছে তখনি চলে এসেছে। নিজের গলাকে আরেকটু পরিষ্কার করে তুলি বললো

” এতো ভালোবাসা কার জন্য? নিজের সন্তানের জন্য?”

তুলির কপাল কুঁচকে বলা কথাটা কানে তুললো কিনা বোঝা গেলো না । প্লেট ভর্তি ফলমূল নিয়ে ধপ করে বিছানার এক পাশে বসে পড়লো আদনান । ঠোঁটের এক কোন প্রসারিত করে হাসলো ,,,তুলির চোখে চোখ রেখে বললো –

” অত ভাবতে হবে না তোমার,,,,এই গুলো খেয়ে নাও”

তুলির নাক মুখ কুচকে গেলো খাওয়ার কথা শুনে । আদনান এর দিকে না তাকিয়ে বিছানায় বসে উকি ঝুঁকি মারতে লাগলো বাইরে । মূলত শাপলা বেগমকে খুঁজছে তুলি,, আদনানকে দেখে ওর শরীর জ্বলে যাচ্ছে কান্না আসতেছে কিন্তু ও আর দুর্বল নয় । আচ্ছা আদনান কি ওর বাচ্চাকে ওর থেকে কেড়ে নেবে? এতো কষ্ট করেছে যাকে পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্য তাকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে কি চাঁদ দেখতে পারবে না! ছোটো ছোটো হাত গুলো ধরে দিগন্তের পানে হেঁটে যেতে পারবে না! ওর তো টাকার জোর নেই যে নিজের সন্তানের জন্য লড়বে ।

” অতিরিক্ত চিন্তা শরীরের জন্য ভালো না তুলি খাবার গুলো খেয়ে নাও এতদিন কি খেয়েছো না খেয়েছো আমার জানা নেই কিন্তু এখন থেকে আমি সব খেয়াল রাখবো”

আদনান এর এমন কথায় তুলি যেনো আকাশ থেকে ধপাস করে নিচে পড়ে গেল । এতদিন কই ছিল সে! এখন অধিকার খাটাতে এসেছে মনে হচ্ছে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে কিন্তু তুলি চুপ থাকলো। কথা বললে কথা বাড়বে কোনো দরকার আছে অত কথা বলার । আরো এখন উত্তেজিত হওয়া উচিত হবে না তার জন্য । হঠাৎ পেটে তীব্র ব্যাথা অনুভব করলো তুলি দাতে দাঁত চেপে সহ্য করতে চাইলেও মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসলো –

” আল্লাহ্ ”

তুলির হঠাৎ এমন পেট ধরে আর্তনাদ করায় ঘাবড়ে গেল আদনান পরক্ষণে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল । তুলির একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে ধীরে রাখলো । তুলি খামচে ধরেছে আদনানের হাত টা সারা শরীর জুড়ে যেনো ব্যাথাটা ছড়িয়ে গেলো তুলির । এতো জোরে কিক মারে বাচ্চাটা তুলির দম বন্ধ হয়ে আসে মনে হয় সে এখন বেরিয়ে আসতে চাইছে । একটু পরে তুলি স্বাভাবিক হয়ে নিজের হাত আদনানের হাতের মধ্যে দেখে ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিল ।

” আপনি এখন চলে যান আমার ভালো লাগছে না ”
আদনান আর উজ্জ্বল মুখটা নিভে গেলো কথাটা শুনেই । তবুও হাসার চেষ্টা করলো আদনান –

” আমি চলে যাবো তুলি এইগুলো খেয়ে নাও খাওয়া শেষ হলেই চলে যাবো”

” আপনি বার বার এইখানে আসছেন কেনো? কালকে আসছিলেন আমাকে দেখার জন্য তাই না,, আমি বাচ্চা নষ্ট করে ফেলেছি কিনা ?”

আদনান কিছু বলার আগেই ঘরে ঢুকলো শাপলা বেগম । তুলির দিকে তাকিয়ে ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বললো । আদনাননের দিকে শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে ফ্যান এর রেগুলেটর ঘুরিয়ে দিলো শাপলা বেগম । এতো গরম আদনান বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল নিশ্চয় অনেক গরম লাগছে তার ,,,

” ওর কথায় কিছু মনে করো না বাবা ,,,, সন্তানটা যেমন তুলির তেমন তোমারও তোমার যখন তাকে দেখতে ইচ্ছা হবে চলে আসবে,,কোনো কিছু ভাবতে হবে না আর একটা ঘর এক্সট্রা আছে তুমি চাইলে সেখানে আরাম করতে পারো ”

আদনান বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো শাপলা বেগমের দিকে । যার মেয়ের সাথে এতো অন্যায় করেছে তার পরিবার ,,,সে ,,তার সাথে এতো ভালো ব্যাবহার কিভাবে করছে বোধগম্য হচ্ছে না আদনান এর । তবু কোনো প্রতিউত্তর করলো না আদনান ।

তুলির দিকে ফল দিয়ে ভরা প্লেট এগিয়ে দিয়ে খেতে বলে আবার বাইরে চলে গেলো শাপলা বেগম । মায়ের অবাধ্য তুলি কখনোই তেমন হয়নি তাই আজকেও হলো না ,,,এক টুকরো আপেল নিয়ে কামড় দিতেই যাবে সেই সময় ঘরের দরজায় নক করলো নিলয় ।

নিলয়কে দেখে অবাক হয়েছে আদনান কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি কারোর কাছেই । নিজের গলাটা পরিষ্কার করে উঠে দাড়ালো আদনান ।

” তোমরা থাকো আমি না হয় যায় ”

নিলয় বারণ করতে গিয়েও করলো না । তুলির দিকে একপলক তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো আদনান ।

” কিছু ভেবেছিস কি করবি? ”

মলিন হাসলো তুলি ,,, দুটো আঙ্গুর গালে পুরে দিয়ে কিছু বলার জন্য উদ্যত হলো তখন আবার ঘরে ঢুকলো শাপলা বেগম । রান্নাঘরের জানালা দিয়ে আদনানকে বাইরে চলে যেতে দেখেছে সে । কিছু না বলেই চলে গেলো কেনো সেইটা শুনতেই তুলির ঘরে পদার্পণ করলো শাপলা বেগম ।

শাপলা বেগম কে দেখে বসা থেকে উঠে দাড়ালো নিলয় । সালাম দিল ,,,,উত্তরে শাপলা বেগম মিষ্টি হাসলো ,,

” কেমন আছে রেশমা? ”

” এখন ভালো আছে ,,,,তবে মাঝে মাঝেই এমন অসুস্থ হয়ে যায় ,,,এত বার বলি আমার সাথে থাকো কিন্তু আম্মু আসতেই চায়না ”

” এমন করলে হবে ,,, এখন তো ভালো আছে এইটাই আলহামদুলিল্লাহ ,,,আজকে কিন্তু দুপুরে না খেয়ে যাবি না ”

শাপলা বেগম আর নিলয়ের কথা বলা অনেক আগ্রহ নিয়ে শুনছিল তুলি । তাদের কথার সমাপ্তি হওয়ায় একটু খারাপ লাগলো ।

” তুলি কিছু ভাবলি?”

তুলি প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে তাকালো নিলয়ের দিকে । তুলির এহেন দৃষ্টির মনে বুঝতে কষ্ট হলো না নিলয়ের তাই আবার বললো –

” আদনান এর ব্যাপারে ”

তুলির কুচকে থাকা ব্রু স্বাভাবিক হয়ে গেলো । শাপলা বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার প্লেট পড়ে থাকা এক টুকরো আপেল নিয়ে কামড় দিয়ে বললো –

” কি ভাববো বলো? কিছু ভাবার নেই”

তুলির এমন ভাবলেশহীন কথায় শাপলা বেগম আর নিলয়ের মনক্ষুন্ন হলো । শাপলা বেগম তুলির পাশে এসে বসলো ,,, স্নেহভরা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিলো এলো চুল গুলো । মুখের উপর পড়ে থাকা চুল গুলো পিছনে সরিয়ে দিয়ে আলতো করে তুলির হাত টা নিজের হাতের উপর রাখলো ।

” জানো মা মানুষের মধ্যে সব থেকে বড় গুণ কি? মানুষকে ক্ষমা করা ,,,আমি তোকে বলব না আদনান অথবা তার পরিবারকে মাফ করে ফিরে যা ,,,তোর সাথে ওরা যা করেছে সে সম্পর্কে খুব সামান্য ধারণা আমার আছে তাই আমি তোকে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে জোর করবো না । যা সিদ্ধান্ত নিবি ভেবে নিবি কেনো না তোর এই সিদ্ধান্তের উপর একটা নিষ্পাপ বাচ্চার ভবিষৎ নির্ভর করছে ”

শাপলা বেগমের কথা শেষ হতেই নিলয় ও তুলির পাশে এসে বসলো ,,,গলার স্বর নরম করে বললো –

” তুই যে সিদ্ধান্ত নিবি আমি তোর সবসময পাশে থাকবো তুই চিন্তা করিস না । তবে তুই যদি ভাবিস একা একা বেবি কে বড়ো করবি সেইক্ষেত্রে আমি বলবো এটা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে ,,,পারবি না সেটা না পারবি কিন্তু অনেক কষ্ট হবে । তুই সারাদিন স্কুল অথবা যে কাজ করবি তাতে ব্যাস্ত থাকলে তোর বাচ্চা মায়ের ভালোবাসা ঠিক ভাবে পাবে না আর বাবার ভালোবাসা তো এমনই পাবে না ।

তার মানসিক অবস্থা কেমন হবে সেটা সন্দেহের বিষয় ,,,তারপর ধর তুই বাড়ি থেকে কোনো কাজ করলি তবুও হাজার চেষ্টা করেও বাবার ভালোবাসা তুই দিতে পারবি না । যদি একজন মা বাবার আর মায়ের ভালোবাসা দিতেই পারতো তাহলে তো বাবাদের প্রয়োজন ছিল না ,,,সবশেষে বলবো সব দিক ভেবেই সিদ্ধান্ত নিবি ”

______________________

আদনান তুলি দের বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে রাস্তার অপর পাশে থাকা টং দোকানে বসেছে । আজ পর্যন্ত কোনো দিন সিগারেট খাওয়া হয়নি আদনান এর কিন্তু আজকে মনে হচ্ছে একটা খেলেই হয়,,,,নিলয়কে নিয়ে উদ্বিগ্ন আদনান ,,,যত যাই হোক একটা ছেলে হয়ে তুলির আসে পাশে ঘুর ঘুর করাটা আদনান এর খুব একটা পছন্দ হচ্ছে না। সামনে থাকলে কি থেকে কি বলে ফেলবে সে জন্যই উঠে বাইরে চলে এসেছে আদনান । দোকানদার কে একটা সিগারেট দিতে বলতে যাবে যখন তখন কর্কশ শব্দ তুলে ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো আদনান এর ,,,এমন সময় কে কল করতে পারে ভেবেই পকেট থেকে ফোন বের করতেই স্ক্রীন ভেসে উঠলো অতি আকাঙ্খিত একজনের নাম যাকে সে ভালোবাসে নাকি ঘৃণা করে আজও বুঝতে পারেনি আদনান ,,,

চলবে,,,