#বিনিদ্র_রজনী
#পর্ব_১৬
#মুমতাহিনা_তারিন
সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে ,,,বিকেলে মৃদু তাপের সোনালী আলো গায়ে পড়ছে আদনান এর । মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছে চায়ের কাপে সেদিকে তাকিয়ে আছে তুলি ,,,জানালা দিয়ে সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । তুলির মনে উকি দিচ্ছে হাজার রকমের দ্বিধা কি করবে ! তারপরে চাপিয়ে দেওয়া এই সিদ্ধান্ত অনেক বেশি ভারী মনে হচ্ছে তুলির কাছে,,,নিজের কথা ভাবলেই হবে না সাথে তার সাথে বেড়ে উঠা একটা নিষ্পাপ প্রাণের কথাও ভাবতে হবে কিন্তু ও কি আদনানকে কোনো দিন আগের মত ভালোবাসতে পারবে?সেটা হয়তো সম্ভব না আর না ওই বাড়িতে পা রাখা ওর পক্ষে সম্ভব ।
শাপলা বেগম বেঘোরে ঘুমাচ্ছে রাতের রান্না বান্না শেষ করেই ঘুম দিয়েছে শাপলা বেগম ,,,জানালা থেকে মুখ সরিয়ে মায়ের দিকে তাকালো তুলি,, আজকে তার জন্যই তো আমার এতো কষ্ট হচ্ছে ,,,,ভাইয়ের বাড়ি থাকলে এতো কষ্ট করতে হতো না নিশ্চয়,,,নিজের ভাই যেমন ই হোক আম্মা থাকলে তাকে কোনো ভাবে অবহেলা করতো না । সে নিজেই হয়তো বড় এক সমস্যা! যেখানেই যাই সেইখানেই মানুষের জীবনের শান্তি নামক জিনিসটা কেড়ে নেয় । গুটি গুটি পায়ে আম্মার কাছে এসে বিছানায় বসলো তুলি একটু হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লো ,,,কিছুদিন যাবত গায়ে ব্যাথা হচ্ছে ,,, পা ফুলে যায় একেতো শরীর ভার তারপর পা ফুললে হাঁটতে যে কি কষ্ট হয় সেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না ,,নিশ্চয় আম্মা ও তাকে জন্ম দিতে গিয়ে এতটা কষ্ট ভোগ করছে তাই তো মেয়ের এই কষ্টের সময়ে কেউ পাশে না থাকলেও আম্মা আছে । এইসব কথা ভেবেই মনের মধ্যে এক অপার প্রশান্তি অনুভব করলো তুলি । বালিশের পাশে পড়ে থাকা ছাই রঙ্গা তসবিহ টা হতে নিয়ে আল্লাহকে স্মরনে নিজেকে সপে দিল । এই সময়টা যত বেশি আল্লাহর এবাদত করতে পারবে ততই সন্তানের জন্য ভালো ,,,,
আদনান এর অনুভূতি সব গুলিয়ে গিয়েছে আরহাম রহমান (বাবা) কল দিয়েছিল আদনানকে ,,,বাবার কল পেয়েও ভালোবাসা ছুঁয়ে যায়নি হৃদয় জুড়ে ,,,যে হৃদয়ে বাবা বলতেই বিষাদ সেইখানে ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি হবে কিভাবে!ছোটবেলায় প্রতিদিন বড় প্রাসাদের ন্যায় বাড়ির ব্যালকনি তে দাড়াতো বিকেল হতেই মাঠে দেখা যেত বাবা ছেলে মিলে ক্রিকেট খেলছে ,,,আদনান এর বুকটা জীর্ণ ভালোবাসা গুলো যেনো মিইয়ে যেত । কতবার মন চাইতো একটু বলতে বাবা আমাদের টাকা লাগবে না তুমি চলে এসো কিন্তু বলা হয়ে উঠতো না পাছে যদি আম্মু বকা দেয় । চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে দাড়ালো আদনান এইসব কথা জোট মনে করবে ততই খারাপ লাগবে,,,অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে বাসায় ফিরতে হবে অফিসের প্রজেক্ট এর কাজ অনেক বাকি পড়ে আছে ।
রোহান শান্ত হয়ে বসে আছে বসার ঘরে চিন্তিত মুখে রান্নাঘরে চা চাপিয়ে চোখের জল ফেলছে শিউলী । ওর মনে একটাই কথা বার বার বেজে চলেছে সব অপরাধের ফল হয়তো,,, রোহান হাজার বুঝিয়েও শিউলী কে শান্ত করতে পারেনি । আল্লাহর ইচ্ছা বাচ্চা হাওয়া না হওয়া কিন্তু সেসব কোনো কোথায় কানে দিচ্ছে না শিউলী । বিয়ের ছয়মাসের মাথায় প্রেগনেন্ট হয়েছিল সে কথাটা একমাত্র শিউলী ছাড়া কেউ জানে না । সবে বিয়ে হওয়ায় বাচ্চা নিতে অনেক অনাগ্রহী ছিল শিউলী ,,তাই যখন বাচ্চার বয়স দুইমাস তখন বাবার বাড়ি যাওয়ার নাম করে বাচ্চা নষ্ট করে ফেলেছিল । তখন একবারও তার মধ্যে কোনপ্রকার অপরাধবোধ এর জন্ম নেয়নি । অনিচ্ছা সত্তে বাচ্চা নিলে হয়তো তাকে পর্যাপ্ত ভালোবাসা দিতে পারবে না এই যুক্তি দাঁড় করিয়ে কোনো দ্বিধা দ্বন্দ ছাড়াই এক নিকৃষ্ট কাজ করে ফেলেছিল শিউলী । রোহান যদি এই কথাটা জানে কি করবে!!! ভাবতেই ভয় লাগছে শিউলির। কিন্তু সেই ভয় চাপিয়ে এক পাহাড়সম দুঃখ বুকে পিশে রেখেছে শিউলী ,,কি হতো ওই বাচ্চাকে রাখলে। রোহান রাগ করতো না সে জানে খুশিতে হয়তো পাগল হয়ে যেতো ,,,কিন্তু আফসোস ছাড়া কিছুই আর হাতে নেই । আল্লাহর দেওয়া নিয়ামত নিজে হতে নষ্ট করার যে এত পীড়া দিতে পারে শিউলী সেটা খুব ভালো ভাবেই তের পাচ্ছে ।
অরোরা সিলেটে চলে যাবে ,,সিলেটে নিজের খালা বাড়ি থেকে নয়ন চাকরির জন্য চেষ্টা করবে অরোরা । হতাশা বার বার তাকে টেনে নিচে নামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সে থেমে থাকার নই মানুষের জীবনে সব কিছু পূর্ণতা নিয়ে আসবে সেটা কখনো আশা করা যায় না । জীবনে সুখ দুঃখ পাওয়া না পাওয়ার সব কিছুর সমষ্টি তাই নিজের জীবনকে আবারও নতুন ভাবে শুরু করতে চাচ্ছে অরোরা । হয়তো আর এই চেনা শহরটাই ভালোবাসা দিয়ে ধরা এক হাত পাবে না,, পড়ন্ত বিকেলে ব্রিজের উপর বসা ঝাল ঝাল ফুচকা আদনান এর সাথে খাওয়া হবে না ,,,দেখা হবে না হয়তো প্রিয় সেই বন্ধুমহলের সাথে মেতে উঠা হবে না গিটার এর মৃদু ধ্বনি আর সবার সমস্বরে ,,সময় বহমান তার স্রোতে বয়ে নিয়ে যাবে অতীত পড়ে থাকবে ভেঙে যাওয়া এক হৃদয় যার সম্পূর্ণটা জুড়ে আছে শুধু হা হা কার,,,,,
” ছেলেটা রেগে আছে ”
আরহাম রহমান স্ত্রীর কথা শুনে চোখে বিস্ময় ভাব ফুটিয়ে তুলে কিছুটা চিৎকার করেই বললো –
” এইসব কাদের জন্য করা! ওদের জন্যই তো সব জেনে বুঝে এমন কথা কিভাবে ভাবে আদনান! আসলে তোমার শিক্ষার অভাবে এমন হয়েছে ”
প্রাণপ্রিয় স্বামীর এমন অবিবেচকের মত কথাটা শরীরে শুই ফোটানোর মত অনুভূত হলো লিতুন বেগমের ,,বুকে জমানো ক্ষোভ টা আজকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলো না ,,,নিজের সব সীমা লঙ্ঘন করে অগ্নিমূর্তি ধারণ করলো ,,নিজে থেকেই অনুভব করলো সারা শরীর অসম্ভব রকম গরম হয়ে যাচ্ছে তার চোখে জল জমছে ,,,
” আরহাম আমার শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন করার আগে নিজেরটা দেখে নিতে একটু? অতীতের পাতা উল্টিয়ে একবার দেখে নিতে আমার বাচ্চাদের শৈশবে কতটা তুমি ছিল! আর আমি কতটা ছিলাম ,,একজন বাবার কাজ নয় শুধু টাকা আয় করে পরিবার চালানো তার সন্তানদের ভালোবাসা দেওয়া ও তার দায়িত্ব একটা কর্তব্য! হ্যাঁ তুমি কেমন বাবা? কেমন বাবা তুমি ছেলের একশো তিন ডিগ্রী জ্বর নিয়ে যখন বিছানা ছেড়ে ঊঠতে পারছে না বার বার নিজের আধো আধো বুলিতে আওড়ানো বাবা বাবা ডাকটা শুনেও তুমি কি নিশ্চিন্তে চিটাগং এ বসে বিরিয়ানি খেয়েছিল আমার আজও জানা নেই ,,,তুমি কি আসলেই তাদের সন্তান ভাবতে কিনা আমার সন্দেহ”
শান্ত তরল পানির মত যার চলন তার এমন কথাতে থতমত খেয়ে গিয়েছে আরহাম । যে কখনো তার উপরে কোনো কথা বলার কথা চিন্তা করেনি সেই স্ত্রী তাকে এমন কথা শোনাচ্ছে ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছে না আরহাম রহমানের ।
” কিসব বলছো লিতুন তখন আমি কাজে ব্যস্ত ছিলাম ,,,তোমাকে খুশি রাখতে আমি কি কোনো খামতি রেখেছি বলো? যখন যা চেয়েছ দিয়েছি বাচ্চারা যা চেয়েছে দিয়েছি তাও তোমাদের এতো কিসের কষ্ট!! আমার উপর এতো নারাজ কেনো??”
স্বামীর এমন কথায় বুকটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো লিতুন বেগমের চোখের জলে ফর্সা মুখটা ভিজে গেলো ,,, তাচ্ছিল্য হাসলো লিতুন –
” একজন মেয়ে কি চায় তুমি জানোই না ,,আমি আজীবন তোমার কাছে কি চেয়েছিলাম জানো? আমি শুধু তোমাকে চেয়েছিলাম আমার পাশে ,,এতো টাকা পয়সা আমার দরকার ছিল না তোমার এই বিরহ আমার ক্ষণে ক্ষণে পুড়িয়েছে আজকে এতটাই পুড়ে গিয়েছি নিজেই নিজেকে চিনতে পারি না ,,,,এতো পাষাণ তো আমি ছিলাম না এতো অহংকার এত হিংশা আমার তো ছিল না ,,নিজের একাকিত্ব আর এই টাকা আমাকে এমন করেছে ,,,তুমি টাকা দিয়েই ভাবতে তোমার দায়িত্ব শেষ । আমি টাকাতেই খুশি থাকি তাই আমি এই টাকা পয়সার মধ্যে সুখের খোঁজ করেছি,,,যার পরিণতি আজকে এমন ,,তুমি জানো আরহাম আদনান আদুরী যখন বাবাকই বাবা কই বলে আমাকে জালাতো আমি কিভাবে সব সামলেছি? জানো না মাঝে মাঝে মনে হয় ঐখানে হয়তো আরেকটা সংসার সাজিয়ে বসেছো,,,সত্যি বল তো বিয়ে করেছ নাকি আরেকটা?
” কি বলছো এইসব লিতুন,,,আমার একটা মাত্র স্ত্রী আর সেইটা তুমি আর তুমিই থাকবে ,,,”
” নিজের বান্ধবীদের স্বামী সন্তান নিয়ে ঘুরতে দেখেছি কত ,,ইচ্ছা হতো তোমার হাত ধরে সমুদ্র সৈকতে হাঁটবো আমার এক হাতে থাকবে আদুরী আর তোমার কোলে আদনান কিন্তু ইচ্ছা গুলো ইচ্ছা হয়ে পড়ে আছে অতীতে ,,,সামনের বিল্ডিং এ থাকা মনিরা ভাবি আর রফিক ভাই যখন রূপালী চাঁদের আলো গায়ে মেখে ছাদে ঘুরে বেড়াতো আমি দেখতাম ,,,আর তোমাকে কল্পনা করতাম কিন্তু তুমি ব্যস্ত থাকতে বাসায় আসলে দুই থেকে তিনদিন থেকেই আবার চলে যেতে ,,,জানো রফিক ভাই আর মনিরা ভাবি এতটা বছর পর হবার পর ও বদলায়নি ,,পাকা চুল আজও কাঠগোলাপ গুঁজে দেয় রফিক ভাই ,,,আমার তো খুব বেশি ইচ্ছে ছিল না আরহাম এমন সব মুহূর্ত পার করার ইচ্ছা ছিল ,,আদনানকে জুম্মার দিনে হাত ধরে মসজিদে নিয়ে যাওয়াটা দেখতে ইচ্ছা হতো খুব,, আদরীর সব নালিশ তোমার কাছে দিচ্ছে ,,তুমি আদর করে তাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিচ্ছো এমন দৃশ্য দেখার ইচ্ছা ছিল খুব কিন্তু আমার ভাগ্য এমন …..”
কথা শেষ করে চোখের জল মুছে নিলো লীতুন,,সব মানিয়ে নিয়েছে সে,,আর কোনো কথা বাড়াতে মন চাইলো না তার তাই ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো,,
আরহাম রহমান কিংকর্ত্যবিমূঢ় হয়ে আছে কি বলবে! কি বলা উচিত তার ! সর শরীরটা কেমন ঠান্ডা হয়ে আসছে তার ।
দরজার সামনে গিয়ে লীতুন বেগমের পা থেমে গেলো । পিছে মুড়ে আর হাম কে বিধ্বস্ত অবস্থায় মাথা নামিয়ে বসে থাকতে দেখে একটু করুণা হল কিনা বোঝা গেলো না । ঝাঁঝালো কণ্ঠে আবার বললো –
” জানো আরহাম বাবারা কেমন হয় ? আদনান কে দেখো একবার ,,,তার বাচ্চা পৃথিবীর আলো দেখেনি কিন্তু তাকে নিয়ে কত রকম চিন্তা যদিও এই চিন্তার পিছনে তোমার হাত ও আছে তবুও দেখে শান্তি পাই আমি ,,,,ওকে বাড়ি ফিরে আসতে বলি না কখনো কেনো জানো? আমি চাই না এই পৃথিবীতে আরেকটা লিতুন আর আরেকটা আদনান এর জন্ম হোক,,,,”