বিনিদ্র রজনী পর্ব-১৭

0
346

#বিনিদ্র_রজনী
#পর্ব_১৭
#মুমতাহিনা_তারিন

প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা করছে আদনান এর বিছানা জুড়ে আছে বিভিন্ন ধরনের ফাইল আর শর্ট নোটস কাজের দিকে ঠিক ভেবে মনোযোগ দিতে পারছে না আদনান কিভাবেই বা দেবে? ,,,প্রতিদিন অত দূর ড্রাইভ করে যাওয়া আসা করতে অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছে । কিন্তু তুলি কে না দেখলেও মনে শান্তি লাগে না আদনান এর তাই চিন্তা ভাবনা করছে ঐখানে একটা বাসা ভাড়া নেবে আদনান আর কতদিন বা রোহান দের বাসায় থাকবে! আদরীর সাথে কল এ কথা হয়েছে ,,তুলিকে খুজে পেয়েছে শুনে আদুরী কিছুটা থমকে গিয়েছিলো । নানান ভাবে তুলির খারাপ দিক গুলো বানিয়ে বানিয়ে ভাইয়ের কান ভার করার চেষ্টা করেছে আদরী কিন্তু আদনান তার কোনো কথাই কান দেইনি । ও নিজের ভাবনায় মশগুল ,,,আম্মুকে খুব মনে পড়ে কিন্তু তুলির নামে আজে বাজে বলবে যা আদনান এর একদম ভালো লাগবে বিধায় আদনান আর ওই বাড়ি পা রাখছে না । তবে রাহেলা খালা লিতুন বেগমের শারীরিক মানসিক সকল অবস্থায় আদনানকে জানায় এই কাজটা আদনান তাকে দিয়েছে আর রাহেলা ও কোনো মতবিরোধ করে নি মেনে নিয়েছে আরো আনন্দের সাথেই ,,,তুলির সংসার সুন্দর হোক ভালোবাসা দিয়ে পরিপূর্ণ হোক রাহেলা মনে প্রাণে সেটাই চায় ।

তুলির আপাতত কোনো কাজ নেই আজকে নিলয়ের সাথে ডাক্তার এর কাছে গিয়ে চেক অ্যাপ করিয়ে এসেছে । ডাক্তার সকল ধরনের কথা শুনে বুঝে তুলিকে সাবধান থাকতে বলেছে কোনো ধরনের মানসিক চাপ আর ভারী কাজ করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে । যেহুতু বাচ্চা পুষ্ট আর শারীরিক দিক দিয়ে সুস্থ তাই তুলির বাচ্চা আগে হওয়ার সম্ভবনা আছে বলে জানিয়ে দিয়েছে তাই সতর্ক থাকতে হবে সর্বদা । তুলি কোনো ধরনের কাটা ছেড়া চাই না ছোটো থেকেই তার এইসব অনেক ভয় তাই আল্লাহর কাছে মন দিয়ে চাচ্ছে যাতে কোনো ধরনের সমস্যা যেনো না হয় । রাত প্রায় নয়টা বাজে ক্ষুদা ও লাগছে খুব শাপলা বেগম মালতী বেগমের ঘরে গিয়েছে ,,,আজকে খুলনা থেকে ফিরেছে মালতী আদনান আশা যাওয়া সম্পর্কে কিছুই জানে না । তুলি তখন শুয়ে থাকায় শাপলা বেগম উঠতে বারণ দিয়ে ছিল তুলির জন্য চালতের আচার নিয়ে এসেছে মালতী বেগম । হাতে আচারের বোয়াম নিয়ে ঘরে ঢুকেছে শাপলা বেগম ,,,সোজা রান্নাঘরে গিয়ে তুলির জন্য একটু আচার বেড়ে নিয়ে ঘরে ঢুকলো,,,

” খিদে লাগে নি তোর? সেই কখন খেয়েছিস ”

নিজের চিন্তায় এতটাই মগ্ন ছিল তুলি হঠাৎ শাপলা বেগমের কথা শুনে ভয়ে কেপে উঠছে,,পা দুটো ভালো ভাবে মেলে দিয়ে বলল –

” আমি এখ্নই খেতে যেতাম ভালো হয়েছে তুমি এসে গেলে ”

” তুই কি কোনো কিছু নিয়ে ভয় পাচ্ছিস?মুখটা কেমন পাংশুটে হয়ে আছে কেনো?”

” আম্মা সব কিছু ভালোভাবে হবে তো ? আমার শুধু ভয় লাগছে ডাক্তার বলেছে নয়মাস হয়তোবা লাগবে না তার আগেই হয়ে যাবে হয়তো ”

মেয়ের এমন কথা শুনে শাপলা বেগম আচারের বাটিটা এগিয়ে দিয়ে পাশে বসলেন ,,, এমন চিন্তা তারও হতো ,,,সবাই হয়তো মা হওয়ার জন্য খেয়াল রাখে কিন্তু একজন মায়ের কাছে এই ভয়টা অনেক বেশি লাগে ,,, এমন ভয় করার কথা কারোর সামনে বলা ও যাই না,,, বললেই নাক মুখ কুচকে বলে আমরা যেনো ছেলে পেলে জন্ম দেইনি,এতোই যখন ভয় তাহলে বাচ্চা না নিলেই পারতে,, নিজের মেয়ের এই ভয়টা বুঝতে পেরে কপালে একটা চুমু দিল শাপলা বেগম ,,,তুলিকে আশ্বস্ত করতে বললো –

” যা হবে আল্লাহর ইচ্ছায় হবে অত ভয় পেতে হবে না ,,,আল্লাহর কাছে দোয়া করো যাতে সব ভালোভাবেই হয় ”

” যদি না হয়”

” আল্লাহর উপর বিশ্বাস নেই?”

” আছে তো আম্মা কিন্তু,,,”

” আল্লাহর উপর বিশ্বাস থাকলে কিন্তু আসার কথা না ,,,এই আচার টুকু খেতে ইচ্ছা হলে খা নইলে আমি ভাত বেড়ে দিচ্ছি”

” খাচ্ছি আম্মা তুমি ভাত বাড়ো অনেক ক্ষুদা লেগেছে,,,”

আর কথা না বাড়িয়ে শাপলা বেগম রান্নাঘরে চলে গেলেন । যদিও মেয়েকে আশ্বস্ত করেছেন তিনি কিন্তু নিজের ভিতর ও অনেক দুশ্চিন্তা হচ্ছে আল্লাহর কাছে বার বার মোনাজাতে নিজের মেয়ের মঙ্গল কামনা করছে শাপলা বেগম ,,,আজকে আর দুই প্লেট ভাত বাড়েনি নিজের হাতে মেয়েকে খাইয়ে দিবে শাপলা মেয়ের মনে যে ঝড় বয়ে চলেছে তার আন্দাজ তো একটা মায়ের থাকে,,,

আদনান গাড়ি ড্রাইভ করছে ,,,ভালো লাগছে না তার অনেক তৃষ্ণা পেয়েছে আদনান এর তুলিকে তৃষ্ণা যা শুধু একবার দেখা করলেই শেষ হবে ,,,তাই অনেকটা জোরেই গাড়ি চালাচ্ছে আদনান রাস্তায় নিয়ন আলো তাকে তাকে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে ,,কল্পনায় ভাসছে তুলির সুন্দর মায়াবী একটা মুখ যার কোলে একটা ছোটো বাচ্চা বাচ্চা টা দেখতে একদম তুলির মত হয়েছে ,,,,, ইসস তার একটা সুন্দর পরিবার হয়ে যাবে ,,কিন্তু তুলি রাজি হবে তো আদনান এর জীবনে ফিরে আসতে? আগের মত ভালোবাসবে তাকে!! যদি নাও ও বাঁধে আদনান নিজে ওকে এত ভালোবাসা দেবে যা তুলির সব অভিমান ভেঙে দেবে ,,,

______________

” শিউলি তুমি একবার জানাতে পারতে আমাকে তুমি এতটা নির্দয় কিভাবে হলে!”

শিউলির মুখে কোনো রা নেই কি বলবে! কোন মুখে বলবে ,,,সাধু হাউমাউ করে কান্নাকাটি করছে শিউলী আগেরবার ডাক্তার এর কাছে গিয়ে আরেকটা বেশি টেস্ট করিয়ে ছিল রোহান ,,,যার রিপোর্ট আজকে গিয়ে হাসপাতাল থেকে এনেছে । যাতে স্পষ্ট শিউলির মা হওয়ার সম্ভবনা শূন্যের কোটায় ,,,যার কারণ হচ্ছে মিস্ক্যারেজ করানো ,,শিউলী যে ওষুধ খেয়েছিল সেটা ছিল একটা ভালো মানের এবং হাই পাওয়ার এর যার কারণে বাচ্চা মারা যাওয়ার পর ও এই ওষুধ এর কাজ কিছুদিন চলমান ছিল যার ফল স্বরূপ তুলির এই অবস্থা ,,,

” কি হলো কথা বলছো না কেনো!!! বলো কথা,,,,আমরা তো বাচ্চা নিয়ে ভালোভাবে রাখতেই পারতাম ,,এমন তো ছিল না যে আমার আর্থিক সমস্যা চলছে তাহলে তুমি এমন টা কেনো করলে???আর এত বড় সিদ্ধান্ত একা একা কিভাবে নইলে তুমি? তোমার হাত কাপল না নিজের সন্তানকে মারতে!”

রোহান এর চোখ দুটো লাল হয়ে গিয়েছে রাগে ,,,, শরীর কেমন কাপছে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে বার বার শান্ত করার চেষ্টা করছে রোহান কিন্তু এত বড় একটা কথা সামনে আসলে কি আর সহজে রাগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়!!

” আমার ভুল হয়েছে ,,আমি বুঝতে পারেনি এমন কিছু হবে আমি বুঝতে পড়লে জীবনে ওই কাজটা করতাম না রোহান,,,,আমাকে ক্ষমা করে দাও তুমি প্লিজ”

রোহান রাগে এদিক ওদিক পায়চারি করছে ,,,নিজের রাগ কে অনেক ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে রোহান কিন্তু আজকে যেনো কোনো কাজ হচ্ছে না । মনে হচ্ছে শিউলীকে কয়েকটা চড় মারতে কিন্তু পারছে না ,,,স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা কাপুরুষের পরিচয় তাই বার বার নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে,,,ডাইনিং টেবিল এর উপর পড়ে থাকা পানির বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে সোফায় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে রোহান । আজকে কেনো জানো খুব কান্না পাচ্ছে তার ,,,ছেলেদের কাদতে নেই এই কথাটা কে বলেছিল!! শিউলি কে এতো ভালোবাসা দিয়ে আজকে রাখলো সে কি তাকে বিশ্বাস করতে পারেনি? একবার বলতেই পারতো তার সাথে ,,,এতো কিছু খুব কৌশলে লুকিয়ে গিয়েছে শিউলী! আশ্চর্য হচ্ছে রোহান এখন ওর মনে সন্দেহ হচ্ছে আর কি কি লুকিয়েছে শিউলী তার কাছ থেকে,,,,

” আমার পাশে বসো ,,,যা করার করে ফেলেছ এখন হাজার কেঁদে ও কোনো লাভ নেই ”

শিউলি তার নড়বড়ে পা নিয়ে কোনোমতে হেঁটে রোহানের পাশে বসলো ,,চোখ দুটো কেঁদে কেঁদে ফুলিয়ে ফেলেছে শিউলী ,,,শিউলীর দিকে তাকিয়ে রোহান একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো ,,পানির বোতল শিউলির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে চোখের জল মুছে দিলো রোহান,,,

” দেখ শিউলী আমাদের কারোর অধিকার নেই একটা নিষ্পাপ বাচ্চাকে হত্যা করার ,,আল্লাহর নিয়ামত একটা বেবী তুমি সেই নিয়ামতকে নিজে সরিয়ে দিয়েছো জীবন থেকে এখন শত কাদলেও তুমি তাকে ফেরাতে পারবে না তাই আশা করবো তুমি সাভাবিক থাকার চেষ্টা করবে ”

রোহান এর কথা শুনে শিউলির আরো বেশি কান্না পাচ্ছে ,,,এই ছেলেটা এতো বেশি ভালোবাসে কেনো তাকে !

” তুমি কি আমাকে ক্ষমা করে দিবে?”

” শিউলি এই কথাটার উত্তর আমি দিতে পারবো না ,,,,তবে একটা কথা কি যেনো আমি তোমার কাছ থেকে এটা কখনোই আশা করি নি,,,,মানুষ সময়ের সাথে বদলে যায় আমি হয়তো বদলে গিয়েছি তাই না,,নয়তো তোমার ঠিক ভেবে খেয়াল রাখতে পারছি না তাই হয়তো এমন করতে পেরেছো ,,,”

শিউলির চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে ,,,মন হচ্ছে ঘুরে পড়ে যাবে হয়তো ,,,মনে মনে বার একটা কথা আওড়াচ্ছে তোমার ভালোবাসার কোনো কমতি নেই রোহান আমি ই পারিনি তোমাকে সবটুকু দিয়ে ভালোবাসতে,,,,

____________________

সকাল হয়ে গিয়েছে ,,,সকালের সোনালী আলো মিষ্টি হয় কিন্তু আজকে এই আলোকরশ্মির তাপ ব্যাপক ,,,,,আদনান রাতে নিলয়ের বাসায় থেকেছে,,,রাতে তুলিকে দেখেই চলে এসেছিল আদনান থাকেনি ,,,তুলি তো আদনানকে দেখে হতবাক এতো রাতে আদনান অত দূর থেকে কোনো কারণ ছাড়াই চলে আসলো তাও তুলির জন্য এটা কোনোভাবেই তুলির হজম হচ্ছে না,,,,,

চলবে ,,,,