#বিনিময় (৩)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
ছেলে মেয়েকে বিদায় দিয়ে সাবিনা এসে সেই পার্কে বসে। সকালবেলা এখানে তেমন মানুষের দেখা পাওয়া যায় না। তাই তেমন কেউ নেই। সাবিনা বসে মনেমনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনেমনে জীবনের হিসাবগুলো করে নেয়। সেই মূহুর্তে মেঘা এসে তার পাশে বসে। মেঘাকে এখানে দেখে সাবিনা অবাক হয়। সে বিরক্তি নিয়ে বলে,“তুমি আমাকে অনুসরণ করছো?”
“না তো।
আরে আমি মেয়ে মানুষ। আপনাকে কেন অনুসরণ করবো কাকী মা?”
মেঘার এই প্রশ্নে সাবিনা তার দিকে কঠিন চোখে তাকায়। মেঘা সেটা দেখে শব্দ করে হেসে দেয়। নরম গলায় বলে,“আমি তো এই পার্কেই রাত কাটিয়েছি। আপনাকে এখানে এসে বসতে দেখে আসলাম।”
“কী!”
সাবিনা অবাক হয়ে যায়। সে আবার বলে,“তুমি এখানে রাত কাটিয়েছো?”
“হ্যাঁ। বাসা ভাড়া পাইনি।
তাই এখানেই কাটাতে হলো।”
মেঘার মুখে এই কথা শুনে সাবিনা কৌতুহলী চোখে তাকায়। মেঘা ধীরে ধীরে বলে,“এই শহরে আমি নতুন। একটি কাজে আসা। এসে বিপদে পড়ে গেলাম। বাসা পাচ্ছি না থাকার জন্য।”
“এমন জীবন নিয়ে তুমি আবার সুখ বিনিময় করছো?”
সাবিনা কথাটি উপহাস করেই বলে। এটা শুনে মেঘা মুখে হাসি রেখে বলে,“তো এখানে দুঃখের কী হলো? জীবন মানেই তো এমন কিছু পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। তো এটা দুঃখের কেন হবে? বরং আমার তো এখানে রাতে থাকতে সেই মজা লাগছে।”
মেঘার মুখে এই কথা শুনে সাবিনা একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। পরক্ষণে নিজেকে সামলে সাবিনা বলে,“এতবড় মেয়ে। একা এই পার্কে রাত কাটাতে ভয় হয়নি? যদি কিছু হয়ে যেতো?”
“হলে হতো। যা হওয়ার তা এমনি হবে। অহেতুক সেটার কথা ভেবে আমি আগেই কেন ভয় পেয়ে থাকবো? আর যা হয়ে গেছে সেটা হয়ে গেছে, সেটা তো আর বদলানো যাবে না তাই সেটা ভেবেও কষ্টে থাকা উচিত নয়।”
মেঘা কথাটি বলে মিষ্টি হেসে সাবিনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সাবিনাও তার মুখটা দেখছিলো। অতঃপর বলে,“তুমি চাইলে আমার বাড়িতে থাকতে পারো।”
“হ্যাঁ?”
মেঘা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে। সাবিনা বলে,“ভাড়ায়। ফ্রী থাকতে দিবো না। যদিও আমার বাড়ির সব ফ্লোর ভাড়া দেওয়া। শুধু আমরা যে ফ্লোরে থাকি সেটাই ফাঁকা। আপাতত কয়েকদিন আমার সঙ্গেই থেকো। এর মাঝে এক ফ্যামিলি চলে যাবে, তারা চলে গেলে নাহয় তুমি সেখানে থেকো।”
“আচ্ছা।
তা আমায় নিজের ঘরে তুলবেন? হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত?”
মেঘার এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পায় না সাবিনা। সে মনেমনে বলে,“সত্যি তো। মেয়েটা খুব মিশুক তাই আমি এই সিদ্ধান্ত নিলাম। নাকি এই মেয়েটার মুখটা দেখার পর আমার মনের মধ্যে অদ্ভুত যে অনুভূতিটা হচ্ছে তার জন্য।”
সাবিনা ভেবে পায় না। অন্যদিকে মেঘা খুশি হয়। সে নিজের খুশি সাবিনার কাছে প্রকাশ করে। সাবিনাও তার খুশি মুখ দেখে মুচকি হাসে। অতঃপর সাবিনা মেঘাকে নিয়ে তার বাড়ি চলে আসে। তবে তার মনে কিছু প্রশ্নও ছিলো। তাই না পেরে বলে,“আচ্ছা তুমি কালকে কেন বললে না তোমার কোন থাকার জায়গা নেই?”
“আমি তো জানতাম না আপনি আপনার বাসা ভাড়া দেন। তাছাড়া আপনি তো তখন আমার সঙ্গে সেভাবে কথাই বলেননি।”
মেঘার জবাবটা সাবিনার পছন্দ হয়। সে কিছু না ভেবে মেঘাকে নিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। অতঃপর মেঘার পরিচয় পত্র চায়। যতই মনের মধ্যে কিছুটা টান অনুভব হওয়ায় বাড়ি নিয়ে আসুক। এই যুগে কাউকে এত বিশ্বাস করা যায় না। তাই ভবিষ্যত যদি কিছু করে বসে মেয়েটা। মেঘা সাবিনার কথা শুনে তার পরিচয়পত্র, সে কোন কাজে এসেছে সব দেখায়। সাবিনা সব দেখার পর আর সন্দেহ করে না। সাবিনা এবার জিজ্ঞেস করে,“তোমার পরিবারে কে কে আছে?”
“কেউ না।
আমার বাবা, মা ছোটবেলায় মা রা গিয়েছে। বড় হয়েছি দাদা, দাদীর কাছে। তারাও গত হয়েছেন অনেক বছর হলো। এখন একাই থাকছি।”
মেঘার কথা শুনে সাবিনা অবাক হয়। মেয়েটার বাবা, মা নেই। ছোটবেলায় মা রা গিয়েছে অথচ এই কথাটি বলেও সে মিষ্টি এক হাসি মুখে ধরে রেখেছে। তার দুঃখটা প্রকাশ করছে না। মেঘার এই গুন তার চমৎকার মনে হলো। তবুও সাবিনা থামে না। সে মেঘাকে আরও কিছু প্রশ্ন করে। মেঘা সব প্রশ্নের জবাব দেয়। অতঃপর বলে,“ভয় নেই। এখানে আমি আপনার ক্ষতি করতে আসিনি।”
“তবে কেন এসেছো?”
সাবিনা জানে মেঘার থাকার জায়গা নেই তাই এসেছে। তবুও কেন জানি প্রশ্নটা করলো। মেঘা তার প্রশ্ন শুনে উত্তর দিলো,“বিনিময় করতে।”
কথাটি শুনে সাবিনা হেসে দেয়। নিজের জীবনে দুঃখের শেষ নেই সে এসেছে সুখ বিনিময় করতে। সাবিনার মুখে হাসি দেখে মেঘাও খুশি হয়।
_____
আলতাব প্রিয়াকে চোখের সামনে দেখে খুব খুশি হয়ে যায়। সে তাকে জড়িয়ে ধরতে নিলে প্রিয়া বাঁধা দেয়। নরম গলায় বলে,“সব পরে হবে। এখন চলো।”
“আমরা এখন কোথায় যাবো?”
আলতাবের প্রশ্নে প্রিয়া মুচকি হেসে বলে,“এখন আমরা কাজি অফিস যাবো। বিয়ে করতে।”
এটা শুনে আলতাব খুব খুশি হয়। প্রিয়া একটি কাজে আলতাবের ফোনটা চায়। আলতাব দিয়ে দেয়। অতঃপর আলতাব মনের কথা ধরে না রাখতে পেরে বলে,“আচ্ছা প্রিয়া তুমি তো আমার থেকে অনেক ছোট একটি মেয়ে। তুমি আমাকে কেন ভালোবাসলে?”
“এই প্রশ্নের উত্তর কতবার দিবো?
আমার একজন বিশ্বস্ত জীবনসঙ্গী চাই। তাছাড়া আমি প্রথম নাকি যে বুড়ো কাউকে বিয়ে করছি। এরকম উদাহরণ তো অনেক রয়েছে।”
“হ্যাঁ তা অবশ্য রয়েছে। কিন্তু তারা তো ধনী দেখে বৃদ্ধ লোককে বিয়ে করেছে৷ আমার তো কিছুই নেই। যা ছিলো সবই সাবিনার নামে।”
আলতাবের মুখে এই কথা শুনে প্রিয়া মুচকি হাসি দেয়। অতঃপর বলে,“তোমার মনের সব প্রশ্নের উত্তর তুমি পেয়ে যাবে। এখন চলো। বিয়েটা করে নেই। সেই সঙ্গে তোমার জন্য একটি সারপ্রাইজ রয়েছে।”
“সারপ্রাইজ?”
আলতাবের প্রশ্নে প্রিয়া মাথা নাড়ায়। অতঃপর তারা দু’জন একটি ভিড় বাসে উঠে পড়ে। আলতাব যদিও রিকশায় উঠতে চেয়েছিলো তবে প্রিয়া রাজি হয়নি। সে বাসে যাবে। তাই আলতাবকেও মানতে হয়।বাস ওঠার পর প্রিয়া আলতাবকে দুষ্টু ইশারা দিলে সে লোকজনের দিকে নজর দিয়ে দেখে কেউ দেখছে কি-না। অতঃপর প্রিয়ার গালটা টিপে দেয়। একটুপর প্রিয়ার কোমরে হাত দিতে নিলে সে ধাক্কা দিয়ে তাকে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। রাগান্বিত গলায় বলে,“বুড়ো বয়সে ভিমরতি। কু ত্তার বাচ্চা ম রার বয়স হয়ে গেছে, তুই এখন এই বয়সে বাসে উঠে মেয়ের বয়সী মেয়েকে নোংরা স্পর্শ করিস।”
“কী হয়েছে আপা?”
বাসের অন্যরা জিজ্ঞেস করতে প্রিয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,“এই লোকটা আমাকে নোংরাভাবে স্পর্শ করেছে।”
”কী? এই বুড়ো বাম। তুই নষ্ট তা মানলাম তাই বলে মেয়েটার বয়স দেখবি না।”
এদিকে এসব দেখে আলতাব হতভম্ব হয়ে যায়। সে বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে? এরই মাঝে যারা প্রিয়ার গায়ে লোকটিকে হাত দিতে দেখেছে তারাও সাক্ষী দেয়। লোকজন আলতাবকে মা রতে নেয়। আলতাব বলে,“না। আপনারা ভুল ভাবছেন। ও আমার হবু বউ। আমরা তো বিয়ে করছি।”
“ছিঃ ছিঃ।
শেষমেশ আমার বাবার বয়সী এক লোকের থেকে এমন কথা শুনতে হলো।”
প্রিয়া পুরো অভিনয় করতে শুরু করে। তার এই জীবনের কোন অর্থ রইলো না। তার সঙ্গে তার বাবার মতো একজন খারাপ কিছু করতে চাইছে। লোকজন ইতিমধ্যে ক্ষেপে গিয়েছে। তারা আলতাবের কোন কথা না শুনে তাকে ইচ্ছেমতো মা রতে থাকে। কেউ কেউ ভিডিও করছে। আলতাবের মুখ স্পষ্ট দেখা যায় তেমন ভিডিও করে তার সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়। আলতাব সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করে, তারা ভুল ভাবছে।সে তো প্রিয়ার ভালোবাসায় এতটাই অন্ধ যে এখনো ভাবছে প্রিয়া বোধহয় না বুঝে এসব বলছে। প্রিয়া এমন কান্ড দেখে মনেমনে খুব হাসে। আলতাব এক পর্যায়ে উচ্চশব্দে বলে,“আপনারা ভুল করছেন। ও প্রিয়া। ওর সঙ্গে আমার এত দিনের সম্পর্ক। আজ আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি।”
এত মা র খাওয়ার পরও এই কথা বলা লোকজন এবার প্রিয়ার দিকে তাকায়। কেউ কেউ বলে একত্রে তো উঠতে দেখেছি। প্রিয়া বলে,“একসঙ্গে নয় বরং ওনি আমার পিছু নিয়ে উঠেছে বাসে। এমনটাই হবে। এছাড়া তেমন কিছু নয়। আর শুনুন ঐ লোকটা মিথ্যা কথা বলছে।”
“প্রিয়া তুমি এমন কেন করছো?”
“কে প্রিয়া?
এখন মিথ্যা গল্প বানানো হচ্ছে? এরপর বলবি প্রিয়া নামে একজনকে ভালোবাসতি তার কথা মনে পড়ায় আমাকে বাজেভাবে স্পর্শ করেছিস। মানে পাগল হওয়ার অভিনয় করবি। তোদের আমি ভালোভাবে চিনি। বাসে ট্রেনে মেয়েদের নোংরা স্পর্শ করে যখন ধরা পড়িস তখন এমন গল্প সাজাস।”
এরপর আলতাব প্রিয়াকে প্রিয়া বলায় এবার প্রিয়া বলে উঠে,“আমি প্রিয়া নই। আমি মৌমিতা।”
প্রিয়া অর্থাৎ মৌমিতা নিজের আইডি কার্ড দেখালে সবাই নিশ্চিত হয়ে যায় আলতাব পাগল হওয়ার অভিনয় করতে চাচ্ছে। এবার প্রিয়া তার পায়ের জু তো খুলে আলতাবের গালে মা রে। এই দৃশ্যও ক্যামেরা বন্দি হয়ে যায়। প্রিয়া জু তা মেরে বলে,“এই বয়সে এসে ধর্ম কর্ম বাদ দিয়ে মেয়ের বয়সী মেয়েদেরকে ডিস্টার্ব করার শা স্তি এটা। তোকে আমরা পুলিশে দিলাম না। তবে আশা করি আজকের পর আর তুই এসব করবি না। করার সাহসও দেখাবি না।”
আলতাব প্রিয়ার এই রূপ দেখে পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে যায়। যার জন্য নিজের স্ত্রী, সন্তান সব ছেড়ে চলে আসলো সেই মেয়েটা তাকে এভাবে অপমান, অপদস্ত করছে। কিন্তু কেন? প্রিয়া বোধহয় আলতাবের মনের কথা বুঝতে পারলো। সে শব্দ না করে ঠৌঁট নাড়িয়ে বলে,“সারপ্রাইজ।”
আলতাবকে বাস থেকে কু কুরের মতো নামিয়ে দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে সে ভাইরাল হয়ে গেছে৷ লোকজন তার ছবি পোস্ট দিয়ে ক্যাপশনে লিখছে,“কচি মেয়ে ধরতে গিয়ে চাচা মিয়া কট।”
আলতাব এসবের কিছুই জানে না। সে শুধু জানে সে যাকে ভালোবেসে বাড়ি ছেড়েছে সে তাকে ভরা বাসে সবার সামনে অপমানিত করলো। সবাই তাকে খুব বাজে লোক ভেবেছে। খুব বাজে।
’
’
’
চলবে,
(ভুলক্রটি ক্ষমা করবেন।)